পাঠক আমার না কিশোরী না তরুনী কালের একাত্তরের স্মৃতি বলার জন্য আজ কি বোর্ডে বসলাম।
যে বয়সে আনা ফ্রাঙ্ক দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ঘটনা ডাইরীতে লিখেছিলেন!
আমার পরিণতি ও স্মৃতি আনার মত এত করুণ নয়!
হয়ত এতে অনেক উচ্ছাস থাকবে, পুরো বাস্তবতা ফুটে না ও উঠতে পারে।
কিন্তু আমার বয়সের একজনের চোখে যা ধরা দিয়েছিল তাই বলব।।
একাত্তরের প্রথম দিকের ঘটনা। তারিখ মনে নেই।

ইয়াহিয়া ক্ষমতা বঙ্গবন্ধুকে অর্পণ করছেনা, তাই নিয়ে দেশ তোলপাড়।
আমি স্কুলে পড়ি মার্চ শুরু হওয়ার আগে থেকেই আমাদের শহরটা উত্তাল হয়ে উঠেছিল মিছিলে, শ্লোগানে। ছাত্ররাই (রংপুরের বিভিন্ন স্কুল, কারমাইকেল ও রংপুর কলেজ) প্রধানতঃমিছিল করত।
মাঝে মাঝে আমাদের স্কুলের সামনে এসে জোর জোরে শ্লোগান দিয়ে আমাদের মিছিলে
যোগদান করতে বলত। ছেলেরা স্কুলের ছোট গেট দিয়ে ঢুকে দারোয়ানকে বাধ্য করত বড় গেট খুলে দিতে।
৯৫% মেয়েরাই ভয়ে দৌড়ে স্কুলের পেছনের দিকের সারি সারি বাথরুমে গিয়ে লুকিয়ে থাকত।

কিছু সাহসী মেয়ে মিছিলে যোগ দিত। এমনি একদিন মিছিল এসেছে।
আমিও যথারীতি বান্ধবীদের সাথে মিছিল এড়াতে দৌড় লাগাতে যাচ্ছি। এসময় কামরুন্নাহার ডানা(পরবর্তীতে ব্যাডমিন্টনে সারা দেশে চ্যাম্পিয়ন)বলতে শুরু করল….
“লজ্জা করেনা আপনাদের দেশের এই অবস্থা আর আপনারা মিছিলে যাচ্ছেন না”!
ডানা আমার জুনিয়র ছিল ওর ভাই আওয়ামি লীগের পক্ষে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল।
সুতরাং কি আর করা! মিছিলে যোগ দিয়ে ইয়াহিয়ার মুন্ডুপাত করে আমরা ক’জন বান্ধবী বাসায়
ফিরে গেলাম।তখন প্রতিদিনই প্রায় একই অবস্থা।২/১ টা ক্লাশ করার পরই মিছিল এসে পরত।

এরপর এল রক্তাক্ত মার্চ!
মনে পরে ৩রা মার্চ – মিছিলে গুলি চালিয়েছে অবাঙ্গালিরা!
সকালে বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছি, এ সময় পাশের পাড়ার একটা ছেলে রাস্তা দিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে, আমাদের প্রতিবেশী এক ছেলেকে বলল…”এই খোকা তোর বাবাকে গুলি করেছে”!
ওর বাবা বাজার করতে গিয়েছিল। অবাঙ্গালি আনসারী ডাক্তারের বাড়ীর ছাদ থেকে গুলি করা হয় তাঁকে!
সঙ্গে সঙ্গে ওদের বাড়ী থেকে ভেসে এল উচ্চস্বরে কান্নার রোল, আর্তচিৎকার আর হাহাকার!
আমরা বাড়ীর সবাই ওদের সান্তনা দিতে গেলাম।

চারদিকে একটা ঘন আধাঁর নেমে আসছে এরকম একটা অনুভূতি হত তখন।
পড়দিন সকালে আব্বা বসে পেপার পড়ছে, কাছে গিয়ে বললাম “আব্বা আজ স্কুলে যাবনা”?
উত্তর- জানে বাঁচ আগে তারপর স্কুল!
শুনে মনমরা হয়ে সারাবাড়ি ঘুরলাম। বান্ধবীদের সাথে গল্প খেলাধূলা বির্সজন দিতে মোটেও
মন চাইছিল না।

তারপর কালরাত্রি ২৬শে মার্চের পর আমরা কেউই শহরে থাকা নিরাপদ মনে করলাম না।
খালা খালাতো বোনরা মিলে গ্রামে চাচার বাড়ি গেলাম। শহর থেকে ৪/৫ কিলোমিটার দূরে।
খালাদের শশুরবাড়ি অনেক দূরে তাই খালারাও সাথে এল। গ্রামে সব খালাতো ভাইবোনরা মিলে
খুব আনন্দে কেটেছে আমাদের। প্রায় ৪০/৫০ জন একসাথে খাওয়া, ঘুমানো, বেড়ানো।
খেতে বসলে উঠানে বসতে হত, এত মানুষের ঘরে বসে খাওয়ার জায়গা ছিলনা।
আর ছিল আত্মীয়স্বজনদের বাড়ী ঘুরে ঘুরে দাওয়াত!

তাই প্রদীপদেবদের জীবনে এতকিছু ঘটে গেছে ঐ সময়ে ভাবলে মনে অপরাধবোধ জাগে!
শুধু একটা ছোট্ট কারণ কবে কখন আমার পূর্বপুরুষরা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন!
আর তাদের পূর্বপুরুষরা তা করেননি।

একদিন ফুফুর বাড়িতে গিয়ে দেখি ঘরে প্রতিমার মত সুন্দরী এক মহিলা!
শুনলাম ওনারা মাড়োয়ারী ফুফার সঙ্গে ব্যবসা করেন।
ফুফা বড় একটা ঘর ছেড়ে দিয়েছেন। ওনারা নিজেরাই রান্নাবান্না করে খান।
সঙ্গে বড় বড় সিন্ধি গাইও এনেছেন তারা।
তখন রংপুর শহরের অদূরে মাহিগঞ্জে মাড়োয়ারীরা পাটের ব্যবসা করত।
স্বাধীনতার পর ওদের আর দেখা যায়না বললেই চলে।

আমার চাচা,খালু আওয়ামী লীগের ঘোর সমর্থক। মাঝে মাঝে দেশের পরিস্থিতি নিয়ে বড়দের মধ্যেতর্কবিতর্ক শুরু হত।
আমরা চুপচাপ তা শুনতাম।
আব্বা সরকারী চাকরী করতেন।সরকার থেকে নির্দেশ এসেছিল নিয়মিত অফিসে হাজিরা দিতে।
আব্বা মাঝে মাঝে অফিসে যেতেন।একদিন পাকি সৈন্যদের মুখোমুখি হওয়ার পর উপস্থিত বুদ্ধিবলে তাদের সঙ্গে উর্দূতে বাৎচিত করে রেহাই পান।
তবুও ঐ সময় সব বাঙ্গালিকেই সতর্ক হয়ে চলতে হয়েছে।

মাঝখানে রমজান মাসে আমরা আবার শহরে গেলাম। আমাদের প্রতিবেশীরা হিন্দু। ওনারা মার্চেই ভারতে চলে যান। তাদের বাড়ির মেয়ে ছিল আমার খেলার সাথী।।
গ্রাম থেকে এসে দেখলাম সেই বাড়ি দখল করেছে পাড়ারই এক বিহারী পরিবার।

রমজান মাস।আমার কলেজে পড়ুয়া বোন কোরান শরীফ পড়ছে –
জানালার পাশ দিয়ে হয়ত শুনেছে বিহারীনি……
ওনার বিহারী টোনে উচ্চস্বরে সংলাপ ….
বাঙ্গালি কাফেরের জাত!
নেংটি পরার জাত!
আবার কোরান পড়ে!
মড়ার ওপর খাড়ার ঘা! সেই বাড়িতে ক্যান্টনমেন্ট থেকে নিয়মিত পাঞ্জাবী সেনারা আসত।
আর ঐ বিহারীনি তাদের সম্বোধন করতঃ
আইয়ে ভাইয়া, বারান্দায় বসতে দিত, বলত..
আইয়ে চা পিলিয়ে।

এরই মধ্যে দু’একদিন স্কুলেও গেছি খালাতো বোনের সঙ্গে।
মাঝে মাঝে দেখতাম বিরাট বড় বড় জলপাই রংয়ের ট্রাক ভর্তি সৈন্য।
যাচ্ছে ক্যান্টনমেন্ট থেকে শহরের দিকে।
মাঝে মাঝে রিক্সার পেছনের জানালা দিয়ে দেখতাম ওদের।
রক্তচক্ষু সৈন্যদের দাঁত কেলানো হাসি দেখে শিউরে উঠতাম আমরা দু’জন।
রিক্সাওয়ালাকে বলতাম তাড়াতাড়ি চালাতে।

আর ঐ বিহারীদের ছেলেটা কোথা থেকে যেন একটা রাইফেল পেয়েছিল।
আকাশে প্লেন দেখলেই বাড়ির পেছনে খোলা জায়গায় গিয়ে গুলি ছুড়ত প্লেন লক্ষ্য করে তা মাটিতে নামাতে।
ওযে বৃথাই চেষ্টা করছে সেটা বুঝে মনে কৌতুক জাগত!
আমাদের বাসার উঠানে তখন ট্রেঞ্চ খোঁড়া হয়েছে।

একদিন ঐ বিহারীনি বলছে আমার ছোট ভাইকে মর্ডানে নিয়ে গিয়ে চামড়া ছিলে
ইন্দারায় ফেলে দেবে।(তখন শহরের যারা আওয়ামী লীগ করত বা রাজনীতি করত তাদের মেরে মর্ডান হলের ইন্দারায় ফেলে দেয়া হত)। ঐ জায়গাটা এখন শহীদদের বধ্যভূমি।
এসব দেখে শুনে আমরা আবার গ্রামে চলে যাই।

চাচার বাড়ীতে মাঝে মাঝে শুনতাম মিলিটারী আসছে। চাচী আমাদের কাপড় জামা সব বড় বড় ধানের ডুলিতে লুকিয়ে রাখতেন। বাচ্চাসহ মুরগী গুলোকে বাড়ীর সামনে রেখে আসতেন।
যেন ও গুলো নিয়ে ওরা চলে যায়।মাঝে মাঝে শুনতাম গৃহস্থদের ছাগল ধরে নিয়ে যেয়ে খেত ওরা।
একদিন সকালে শুনলাম মিলিটারী আসছে।
সাথে সাথে আমরা দৌড় বাড়ীর পেছনের বাঁশ ঝাড়ে।
দৌড় দিতে গিয়ে চাচী বাচ্চাসহ পিছলে পড়লেন টিউবওয়েলের পাশে।
ওসব মনে পরলে হাসি আসে এখনো।

ডিসেম্বার মাসটা ছিল উত্তেজনাকর। আকাশে প্রায়ই ভারতীয় বিমান দেখা যেত।
আমার বোন বুকে রেডিওটা নিয়েই ঘুমাত।

ষোলই ডিসেম্বারের সকাল।
ও আমাকে আর আমার খালাত বোনকে বলছে….
দেশ স্বাধীন হয়েছে!
বিশ্বাস করতে পারছিলাম না!সে এক অন্য অনুভূতি! মনে হচ্ছিল আমরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা!
যেন রুপকথার সোনার কাঠির পরশে পাষাণপুরী জেগেছে!
চারদিকে ফুলে ফুলে ভরে গেছে!
শহরে বাসায় ফেরবার সময় দেখলাম……
রণাঙ্গন বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধারা ফুলে ফুলে ভরা ট্রাক নিয়ে শহরে প্রবেশ করছে!
পেছনে জনতার আনন্দ মিছিল!