গতকাল মধ্যরাতে ঘুম ভেঙ্গে গেল হঠাতই। দেখি, মাথার কাছে রহমান বসে। প্রথমটাই চিনতে পারি নি। পরে ও বৃত্তান্ত বলাই চিনতে অসুবিধে হল না। আমার কলেজ জীবনে শুরু করা একটা গল্পের নায়ক ছিল রহমান। গল্পটি মাঝ অব্দি লিখে ফেলে রেখেছিলাম। ঐ সময় কবি হওয়ার ঝোঁক মগজে এতটাই ঝেঁকে বসেছিল যে রহমানের ভবিষ্যৎ চাপা পড়ে রইল পুরানো নথি-পত্রের ভেতরে। আমি তখন কবি হওয়ার নেশায় নেশা ধরিয়েছি গাঁজায়। এ পাড়া সে পাড়া চষে জিরিয়ে নিয়েছি বেশ্যা পাড়ায়। পাগলামো বেড়েছে সংসারে, আঁতলামো বেড়েছে স্বভাবে। লোকে আমাকে খোর বলেছে, চোর বলেছে অনেকেই, কিন্তু কবি বলেনি কেউ। রহমানের অভিশাপে কি না জানি না, আমার আর কবি হওয়া হয়নি। গল্পে আবার ফিররো ফিরবো করে ফেরা হয়ে ওঠেনি। সংসারের চাপে বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম রহমানকে।

গতকাল সন্ধ্যায় পুরনো কাগজ-পত্রগুলো বিক্রি করে দেবো ভেবে বারান্দায় ফেলে রেখেছিলাম, ওখান থেকেই সুযোগ বুঝে সটকে এসেছে রহমান।

এতদিন পরে এভাবে আবার রহমানের সাথে দেখা হয়ে যাবে ভাবিনি। ওকে দেখে ভালোলাগার সাথে সাথে একধরনের শঙ্কাও কাজ করছিল ভেতরে ভেতরে। এতদিন পর ও কি চাই আমার কাছে ?

‘মুক্তি’,- রহমান দৃঢ় কণ্ঠে বলল। ‘আমি মুক্তি চাই এ-বন্দি জীবন থেকে।’

কিন্তু আমি তো কবেই গল্প লেখা ছেড়ে দিয়েছি। ইনফ্যাক্ট, কিছুই লিখি না আর।

‘তুমিই না একদিন বিপ্লবের বীজ বপন করেছিলে আমার অন্তরে। একজন বিপ্লবী আর কতদিন ঘুমবে, আর কতদিন ঘুম পাড়িয়ে রাখবে তাকে?’

কিন্তু সময় এখন পাল্টেছে। বদলেছে জীবন। তুমি বরং ফিরে যাও তোমার গোপন জায়গাটিতে। সেই ভালো তোমার জন্য, আমার জন্যেও।

‘সে বড় একঘেয়ে। তুমি বরং এই সময়ের মাঝেই ছেড়ে দাও আমাকে- আমার মত করে।’

রহমান এতটাই জেদ করে বসলো যে আমি আর না করতে পারলাম না।

পরদিন মধ্যরাতে পুরানো সেই চেয়ারটাতে পুনরায় বসলাম। পাশের চেয়ারটা আরও পাশে টেনে বসলো রহমান। গল্পটা আবার লিখতে বসলাম। রহমান তার ইচ্ছে মত লিখিয়ে নিলো সব। আমার সেই তেজ আর স্বপ্ন দেখার সামর্থ্য গত হয়েছে কবেই তাই নীরবে মেনে নিতে হল ওর নির্দেশ। একসময়ের ফাস্ট ক্লাস পেয়ে সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া রহমান এখন এ প্লাস পেয়ে নর্থ সাউথে ভর্তি হয়েছে। পাল্টে গেছে পোশাক আশাকেও- ঢিলে ঢোলা শার্ট-প্যান্টের বদলে এখন সে জিনস আর টি-শার্ট পরে। যে কিনা একদিন রাজনীতিবিদ হয়ে দেশের সেবা করতে চেয়েছিল এখন সে উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশ গমনের ধান্দা করছে। পারলে থেকে যাবে ওখানেই। আমি লিখতে লিখতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সকালে উঠে দেখি রহমান উধাও। রাস্তা ঘাট তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম, এ-গলি সে-গলি কোথাও বাদ রাখলাম না- রহমানের কোন হদিশ পেলাম না।

বহু বছর পর ঢাকার নাম করা এক রেস্তোরায় রহমানের সাথে দেখা। প্রথমটাই ও আমাকে চিনতে পারেনি, বিস্তারিত বলায় আমাকে চিনতে তার অসুবিধে হল না। এ-কথায় সে-কথায় জানতে পারলাম, এখন সে আমেরিকা প্রবাসী। তার জীবনের বাকিটা কিছুটা পাঠক কিছুটা সে নিজেই গড়ে নিয়েছে। আমাকে বলল, পরের বছর সময় করে এসে নামটা বদলে যাবে, রহমান নামটা নাকি বড্ড বেমানান ওখানে!