এই লেখাটা ডারউইন দিবস উপলক্ষে প্রস্তুত করেছিলাম, পরে আল্লাহর অশেষ কুদরতে ঠিক তিনদিন আগেই মনিটর নষ্ট হয়ে গেল! লেখাটা ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক পত্রিকায় প্রকাশিত কার্ল ঝিমারের “Evolution of feathers” প্রবন্ধের ভাবানুবাদ, সাথে কিছু তথ্যসূত্র জুড়ে দিয়েছি।
:line:
বেশিরভাগ মানুষের পক্ষেই প্রকৃতির সবচেয়ে বড় বড় বিস্ময়গুলো দেখে যাওয়া সম্ভব না। আমরা কখনই কলোসাল স্কুইড মাছের বাস্কেটবল আকৃতির চোখ দেখতে পারব না। নারহাল তিমির পঙ্খীরাজ ঘোড়ার মত শৃঙ্কও আমরা হয়ত শুধু ছবিতেই দেখব।
তবে উড়ন্ত ডায়নোসর দেখার জন্য আমাদের ইতিহাস বই ঘাটা লাগবে না, ঘর থেকে বের হলেই আপনি ডায়নোসরদের উড়াউড়ি করতে দেখবেন। নগরায়নের আগে তো বাংলাদেশের গ্রামগুলোর শীতের সকালে ডায়নোসরদের গান শুনেই বাঙ্গালীর ঘুম ভাঙত 😛
আসলে আধুনিক পাখি যে উড়তে অক্ষম ক্ষুদ্রাকৃতির coelurosaurian theropod থেকে বিবর্তিত হয়েছে, এটা অনেকেই জানেন না।১ তবে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আমরা এত পাখি দেখতে পাই যে তাদের ডাইনসোরীয় ঐতিহ্য আর তাদের পুচ্ছকে পাশাপাশি দেখতে আমাদের কোন সমস্যা হয় না। আসন্ন বাতাসের মুখে টিকে থাকার জন্য উড়ার কাজে ব্যবহৃত পালকগুলো অপ্রতিসম হয়ে থাকে- পালকের সম্মুখ প্রান্তটা চিকন ও শক্ত হয় এবং পশ্চাৎভাগটা লম্বা ও নমনীয় হয়। পাখি তার পাখাকে একটু কাত করলেই ভাসমান অবস্থায় উড্ডয়নের জন্য বায়ু প্রবাহটা যেভাবে উপযোজিত করা দরকার ঠিক সেভাবেই করে।
উড়োজাহাজের পাখা একইভাবে বায়ুপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করলেও পাখির পাখা ওই ধাতব বস্তুর চেয়ে অনেক অনেক বেশি জটিল। পালকের একটা কেন্দ্রীয় দন্ড থেকে অনেকগুলো চিকন কাঁটা বিস্তৃত হয়, প্রত্যেকটি কাঁটার মধ্যে থাকে আরও ছোট ছোট কাঁটা, অনেকটা গাছের ডালের শাখা-প্রশাখার মত। প্রত্যেকটা কাঁটার সাথে থাকে একটা করে আঁকড়ি বা hook। এই আঁকড়িগুলো যখন আশেপাশের কাঁটাগুলোর আঁকড়িগুলোকে আঁকড়ে ধরে, তখন তারা খুবই হালকা কিন্তু শক্ত একটা জাল সৃষ্টি করে। পাখি যখন ঠোঁট দিয়ে তার পালক পরিস্কার করে, তখন কাঁটাগুলো আলাদা হয়ে আবার ঠিকই আগের অবস্থানে ফিরে আসে।
এই বিষ্ময়কর প্রক্রিয়াটি বিবর্তনের অন্যতম প্রগাঢ় রহস্য। ডারউইনের অরিজিন অব স্পিসিজ প্রকাশের মাত্র দু’ বছর পর জার্মানীর এক পাথর খনির শ্রমিক এক কোটি পঞ্চাশ লাখ বছরের পুরনো কাকের আকৃতির একটি জীবাশ্ম আবিস্কার করেন। এটির পাখির মত পালকযুক্ত পাখা থাকলেও ডাইনোসরের মত দাঁত ছিল, তিনটি নখযুক্ত আঙ্গুল, একটা অস্থিযুক্ত লেজ সহ ডাইনোসরদের সাথে অনেক শরীরতাত্ত্বিক সাদৃশ্য ছিল। এর নাম Archaeopteryx। জার্মানীতে পাওয়া এই “পাখি” এর জীবাশ্ম এই লাইনে একদম প্রথম, এর পরে একই প্রজাতির আরও অনেক জীবাশ্ম পাওয়া গিয়েছে।২ আরকিওপটেরিক্সের জীবাশ্মটি উড্ডয়নক্ষমতার বিবর্তনের ক্রান্তিলগ্নের চিত্রধারণ করেছে। বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত্য এর চেয়েও কোন প্রাচীন “পাখি” খুজে পাননি। বিজ্ঞানীরা আগে পালকের উৎপত্তি সম্পর্কে জানার জন্য সরীসৃপদের আঁশ নিয়ে গবেষণা করতেন, সরীসৃপরা পাখিদের নিকটতম আত্মীয় কিনা! পালকের মত শল্কও মসৃণ, তাই বিজ্ঞানীরা ধারণা করে নিয়েছিলেন যে পাখির পূর্বপুরুষের শল্ক হয়ত প্রজন্মান্তরে বিস্তৃত হয়েছিল। পরে হয়ত এই শ্লকগুলোর প্রান্তগুলো তন্তুসার হয়ে বিভক্ত হয়ে পৃথিবীর প্রথম পালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। একে উড্ডয়নের জন্য অভিযোজন হিসেবে দেখার পেছনে যুক্তিও আছে। মনে করুন পাখির পূর্বপুরুষরা শল্কযুক্ত, ক্ষুদ্রাকৃতির চতুষ্পদী সরীসৃপ যারা গাছ থেকে গাছে লাফিয়ে দিন কাটাতো। তাদের শল্কগুলো যদি ধীরে ধীরে বিস্তৃত হত, তবে তারা ধুম করে নিচে না পড়ে একটু একটু করে ভেসে ভেসে তাদের পূর্বের অবস্থানের থেকে একটু দূরে গিয়ে অবতরণ করত। বলাই বাহুল্য, এই সুবিধা যাদের ছিল না তাদের লাফালাফি করার সময় নিচে পড়ে গিয়ে মৃত্যবরণ করার সম্ভাবনা অনেক বেশি ছিল। একই সাথে যদি তাদের হাতগুলো বিবর্তিত হয়ে পাখার জন্ম দিত, তাহলে তো সোনায় সোহাগা! উড্ডয়নক্ষমতার বিবর্তন হয়ত পাখার বিবর্তনের সমকালীন ছিল।
উড্ডয়নক্ষমতার বিবর্তনের এই অনুকল্প সত্তুরের দশকে প্রথম প্রস্তাব করা হয়েছিল যখন ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবাশ্মবিদ জন অস্ট্রম পাখিদের অস্থি কাঠামোর সাথে Tyrannosaurus rex এবং Velociraptor ডায়নোসরের জীবাশ্মের অদ্ভুত মিল লক্ষ করেছিলেন। তবে তাদের অনেক বড় পা, ছোট হাত এবং লম্বা ও মজবুত লেজ ছিল, যা গাছে লাফালাফি করার প্রাণীদের শরীর কাঠামোয় একদম বেমানান। অন্য জীবাশ্মবিদরা দাবি করেছিলেন যে পক্ষীকূল ডায়নোসর থেকে বিবর্তিত হয়নি, বরং এই দু’টো দলের একটা সাধারণ পূর্বপুরুষ ছিল। ১৯৯৬ সালে চীনা জীবাশ্মবিদরা অস্ট্রমের অনুকল্পের সমর্থনে বিষ্ময়কর প্রমাণ পেলেন। জীবাশ্মটি ছিল এক কোটি পচিশ লাখ বছরের পুরনো Sinosauropteryx। এই জীবাশ্মটির একটি অবাক করা বৈশিষ্ট্য হল যে অসংখ্য লম্বা ও ফাঁপা সূত্র বা filament এর পৃষ্ঠদেশ এবং লেজকে আবৃত করে রেখেছিল। একটি স্থলচর থেরোপডের গায়ে আসলেই প্রাচীন পালকের অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছিল, একারণে ধারণা করা হয়েছিল যে পালকের উদ্ভবের সাথে হয়ত উড্ডয়নের বিবর্তনের কোন সম্পর্ক ছিল না। এর পরই জীবাশ্মবিদরা একটার পর একটা পালকযুক্ত থেরোপড আবিস্কার করতে লাগলেন। এতগুলো জীবাশ্ম পেয়ে তাঁরা পালকের একটি দীর্ঘ ইতিহাস তৈরী করতে নেমে পড়লেন। একদম প্রথমেই এসেছিল ফিলামেন্ট। এরপর এসেছিল বিভিন্ন প্রকার পালক- কারও কারও পালক ছিল আজকের পাখিদের মত তুলতুলে, কারও কারওরটা ছিল প্রতিসমভাবে সাজানো কাঁটাসমষ্টি। অন্য কিছু থেরোপডের ছিল ফিতার মত ফিলামেন্ট, যা আর বর্তমানে দেখা জায় না।
এই লম্বা, ফাঁপা ফিলামেন্টগুলো একটা নতুন প্রশ্ন উত্থাপন করল- যদি এরা আসলেই পালক হয়ে থাকে, তবে এরা শল্ক থেকে বিবর্তিত হল কেমনে? বর্তমান যুগে এখনও সুতোর মত ফিলামেন্টওয়ালা থেরোপড পাওয়া যায়- তারা হল পাখিদের বাচ্চা। পক্ষীছানাদের শরীরে পালকগুলো প্রথমে ছোট ছোট লোম হিসেবে বেড়ে ওঠে, পরে এগুলো জটিলতর আকৃতি ধারণ করে। পাখিদের ভ্রুণে এই লোমগুলো “প্ল্যাকোড” নামক এক প্রকার চর্মকোষ থেকে উদ্ভূত হয়। এই প্ল্যাকোডের উপর দ্রুত বর্ধনশীল একটি কোষচক্র একটি সিলিন্ডার আকৃতির প্রাচীর গড়ে তুলে,এগুলোই পরে লোম হয়। সরীসৃপেরও প্ল্যাকোড রয়েছে, তবে ভ্রুণ অবস্থায় প্রত্যেকটি প্ল্যাকোড এমন কিছু জিন সক্রিয় করে যার ফলে প্ল্যাকোডের পিছনের দিকের চর্মকোষগুলো বড় হয়ে শল্ক সৃষ্টি করে। ’৯০ এর দশকে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের রিচার্ড প্রুম এবং কানেকটিকাট বিশ্ববিদ্যালয়ের এলান ব্রাশ প্রস্তাব করেন যে জেনেটিক কোডের একটা সামান্য পরিবর্তনের ফলে হয়ত চর্মকোষগুলো অনুভূমিক রেখায় বৃদ্ধি না পেয়ে উল্লম্ব রেখায় বেড়ে উঠতে শুরু করে, যার ফলে শল্করা পরে পালকে বিবর্তিত হয়েছিল। অর্থাৎ, পালক আসলে একই বাদ্যযন্ত্রে ভিন্নভাবে বাজানো একটি সঙ্গীত। একবার ফিলামেন্ট তৈরী হলে সামান্য কিছি পরিবর্তনের মাধ্যমে জটিল জটিল সব পালকের উদ্ভব ঘটা অস্বাভাবিক কিছু না।
কয়েকদিন আগেও বিশ্বাস করা হত যে থেরোপড বংশের প্রাচীন কোন সদস্যে হয়ত প্রথমবারের মত পালকের আবির্ভাব ঘটেছিল। ২০০৯ সালে চীনা বিজ্ঞানীরা ডাইনোসর বংশের ornithischian শাখার Tianyulong প্রজাতির একটি জীবাশ্ম আবিস্কার করলেন। ডাইনোসর বংশের এই শাখাটি থেরোপড বংশের অত্যন্ত দূর সম্পর্কের আত্মীয়। এর ফলে একটা নতুন সম্ভাবনা দেখা গিয়েছিল যে সব ডাইনোসরের পূর্বপুরুষেরই হয়ত পালক ছিল, পরে কিছু কিছু প্রজাতির ক্ষেত্রে হয়ত এটি বিলুপ্ত হয়েছিল। টেরোসর(উড্ডয়নের ক্ষমতাযুক্ত সরীসৃপ) আর ডাইনোসরদের সাধারণ পূর্বপুরুষ আরও অনেক বেশি প্রাচীন, সেই টেরোসরদের গায়ে কিছু ছোট ছোট চুল পাওয়া গিয়েছিল। যদি সুনিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয় যে এগুলো পালক, তাহলে পালকের উৎপত্তি বিবর্তনের সময়রেখায় আরও বহুদূর পিছিয়ে যাবে।
আরেকটা চমকপ্রদ সম্ভাবনাও আছে। পাখি, ডাইনোসর আর টেরোসরদের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠতম জীবিত আত্মীয় হল কুমিররা। এই শল্কযুক্ত প্রাণীগুলোর গায়ে পালক না থাকলেও দেখা গিয়েছে যে শল্ক ও পালকের জিনের মাঝে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে৫, ৬, তাই ২ কোটি ৫০ বছর আগে কুমিরের পূর্বপুরুষের দেহে পালক পাওয়া গেলেও আমরা আশ্চর্য হব না। কিছু কিছু বিজ্ঞানী মনে করেন কুমিররা কিভাবে তাদের পালক হারালো এটাই বড় প্রশ্ন, শুধু পাখিদের পালক নিয়ে পড়ে থাকলে হবে না। পালক যদি প্রথমে উড়াউড়ির জন্য বিবর্তিত না হয়ে থাকে, তাহলে তাদের আর কি কি উপযোগীতা থাকতে পারে? কিছু জীবাশ্মবিদ অন্তরণের(insulation) প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। দেহের অগ্রভাগের অঙ্গগুলো নীড়ের উপর ছড়িয়ে রাখা অবস্থায় অনেক থেরোপড আবিস্কৃত হয়েছে, খুব সম্ভবত তারা তাদের পালক ব্যবহার করে সন্তানদের ছায়া দিচ্ছিল।
সাম্প্রতিককালে জনপ্রিয়তা পাওয়া আরেকটা অনুকল্প হল যে পালকের উদ্ভবের পেছনে নিজেকে প্রদর্শন করার প্রবনতার ভূমিকা থাকতে পারে। বর্তমান যুগের পাখিদের পালকের রঙের বাহার দেখে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। ময়ূরের মত পাখি তাদের বাহারি পালক উন্মোচন করে বিপরীত লিঙ্গকে আকর্ষণ করে। এই অনুকল্পের গ্রহনযোগ্যতা অনেকাংশে বৃদ্ধি পেল যখন ২০০৯ সালে বিজ্ঞানীরা ময়ূরের পালকগুলোকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা শুরু করলেন। তাঁরা পালকগুলোর মধ্যে মেলানোজম নামক কিছু অনুবীক্ষণিক স্থলী(sac) দেখতে পেলেন যার সাথে অন্য সব পাখির রঙিন পালকের জন্য দায়ী অরগানেলের(কোষের ভেতরের কিছু ছোট্ট জিনিস যা একটি সুনির্দিষ্ট কাজ সম্পাদন করে) সম্পর্ক রয়েছে। এই মেলানোজমগুলো এত ভালভাবে সংরক্ষিত যে বিজ্ঞানীরা খুব সহজেই বিলুপ্ত ডায়নোসরদের পালকের রঙ খুজে বের করতে পারেন।৩, ৪ Sinosauropteryx এর লেজের লাল ও সাদা রঙের ডোরাকাটা ছিল। এই প্রজাতির পুরুষরা হয়ত তাদের লেজ নাচিয়ে নারীদের আকর্ষণ করার চেষ্টা করত, অথবা জেব্রাদের মত তাদের ডোরাকাটা ব্যবহার করে শত্রু আর মিত্রের মধ্যে পার্থক্য করত।
পালকের কাজ যাই হোক, একটি বিশেষ গোত্রের ডাইনোসর তাদেরকে উড্ডয়নের কাজে ব্যবহার করার কয়েক লক্ষ বছর আগে থেকেই তারা অস্তিমান ছিল। জীবাশ্মবিদরা বর্তমানে পালকের এই পরিবর্তন নিয়ে গবেষণা করছেন। সাম্প্রতিককালে ১ কোটি ৫০ বছরের পুরনো একটি জীবাশ্ম পাওয়া গিয়েছে, নাম তার Anchiornis।
পাখিটি আকারে মুরগির মত, তার হাতের পালকে ছিল সাদা-কাল অংশ আর মাথায় ছিল একটি লালচে পালকের মুকুট। উড্ডয়ন কাজে ব্যবহৃত পালকের সাথে Anchiornis এর পালকের বেশ সাদৃশ্য ছিল, কিন্তু সেগুলো বর্তমান যুগের পাখিদের পালকের মত প্রতিসম ছিল না। বলাই বাহুল্য, তার উড্ডয়ন ক্ষমতা বেশ কম ছিল। তার পুচ্ছ এদিক দিয়ে দুর্বল হলেও সংখ্যার দিক দিয়ে ছিল সবল। হাত, পা থেকে শুরু করে পদাঙ্গুলিতেও তার পালক ছিল। ময়ূরের মত যৌন নির্বাচনের ফলেই হয়ত তাদের এই দশা হয়েছিল। এরকম নজরকাড়া পুচ্ছরাজি বিপরীত লিঙ্গের পাশাপাশি শিকারীদেরকেও মুগ্ধ করত(!), যেমনটা ময়ূরের ক্ষেত্রে দেখা যায়। তবে বেইজিংয়ের Institute of Vertebrate Paleontology and Paleoanthropology এর কলিন সালিভান ও তাঁর সহকর্মীরা দেখিয়েছেন যে Anchiornis এই বিপত্তি মোকাবেলা করতে পেরেছিল। আধুনিক পাখিদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত থেরোপডদের কব্জিতে একটা কীলকের মত হাড় ছিল যার ফলে তারা তাদের হাত শরীরের পাশে ভাঁজ করে রাখতে পারত, এর ফলে তাদের হাতের পালকগুলো মাটির সংস্পর্শে আসত না। আধুনিক পাখিরা উপরের দিকে পাখা সঞ্চালন করার সময় একই রকম একটি হাড় ব্যবহার করে। সুলিভানের গবেষণা সঠিক হলে প্রমাণিত হবে যে উড্ডয়নের জন্য এই গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যটি পাখার উদ্ভবের আগেই বিবর্তিত হয়েছিল। বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানীরা একে বলেন এগজাপটেশন(exaptation)- অর্থাৎ, পুরনো কোন অঙ্গকে নতুন কাজে ব্যবহার করা। এখন মনে হচ্ছে উড্ডয়নের লক্ষ লক্ষ বছর আগেই একের পর এক এগজাপটেশনের মাধ্যমে উড্ডয়নের সম্ভাবনা আলোর মুখ দেখেছিল।
এই পরিবর্তনটা কিভাবে ঘটেছিল, সেটা নিয়ে এখনও অনেক বিতর্ক রয়েছে। কিছু কিছু বিজ্ঞানী মনে করেন যে পালকযুক্ত ডাইনোসররা স্থলে থেকে পাখা ঝাপটিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে একসময় উড়ার ক্ষমতা অর্জন করেছিল, কিন্তু অনেকে এই অনুকল্পের বিরুদ্ধে যুক্তি দেখান যে Anchiornis এর পায়ের “পাখাগুলো” উড়ার জন্য তো দূরের কথা, স্রেফ দৌড়ের জন্যই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করত। এই গবেষকরা প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন যে প্রাচীন পক্ষীকূল গাছ থেকে গাছে লাফিয়ে বেড়াত, তাদের পালক ব্যবহার করে তারা বাতাসে কিছুক্ষণের জন্য হলেও ভাসতে পারত। এভাবেই তারা কোটি কোটি বছর ধরে আধুনিক পক্ষীকূলে বিবর্তিত হয়েছিল।
University of Montana-Missoula এর কেন ডায়াল মনে করেন, এই দু’টো অনুকল্পেরই সঠিক হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু হবে না। ডায়াল দেখিয়েছেন যে অনেক পাখির শাবকরা শিকারীর হাত থেকে বাঁচার জন্য গাছের গুড়ির মত উচু জায়গায় দৌড়ে ওঠার সময় তাদের অতি ক্ষুদ্র পাখাগুলো ঝাপটিয়ে উত্তোলন শক্তি(traction) সঞ্চয় করার চেষ্টা করে। তারা যদি গুড়ি বেয়ে উঠতে নাও পারে, পাখা ঝাপটানোর কারণে তারা অন্তত নিরাপদে ভূমিতে অবতরন করতে পারে। শাবকটি যখন প্রাপ্তবয়স্ক হয়, এই নিয়ন্ত্রিত অবতরনই তখন পরিপূর্ণ উড্ডয়ন ক্ষমতায় রুপ নেয়। ডায়াল মনে করেন, পাখি শাবকের এই বড় হওয়ার মধ্যেই উড্ডয়ন ক্ষমতার বিবর্তনের রহস্য লুকিয়ে আছে।
বিজ্ঞানের বাইরের অনেকেই মনে করেন উড্ডয়ন ক্ষমতার বুঝি কোন ব্যাখ্যা নেই। বস্তুত, অনেকেই মনে করেন যে বিবর্তনমূলক জীববিজ্ঞান বুঝি অজানা প্রশ্নের ভারে ভারাক্রান্ত, যেন বিজ্ঞানের এই শাখার কাছে কোন প্রশ্নেরই কোন উত্তর নেই। আসলে বিজ্ঞানের এই শৃঙ্খলে প্রশ্নের চেয়ে সম্ভাব্য উত্তরের সংখ্যাটাই বেশি, কোনটা সঠিক উত্তর সেটা প্রমাণ করাই আসল চ্যালেঞ্জ। বিবর্তনমূলক জীববিজ্ঞানের অন্যসব ক্ষেত্রের মত এক্ষেত্রেও সমস্যাটা আসলে ঠিক উলটো- আলোচ্য রহস্যের পেছনে এত বেশি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা রয়েছে যে কোনটা সঠিক সেটাই হল প্রশ্ন। সময়ই এর উত্তর দিবে।
তথ্যসূত্র:-
১) http://www.ucmp.berkeley.edu/diapsids/avians.html
২) http://www.talkorigins.org/faqs/archaeopteryx/info.html
৩) Andrea Thompson (2008-07-08). “Feather Fossils Could Yield Dinosaur Colors“. LiveScience. Retrieved 2009-08-29
৪) Li, Q., Gao, K.-Q., Vinther, J., Shawkey, M.D., Clarke, J.A., D’Alba, L., Meng, Q., Briggs, D.E.G. and Prum, R.O. “Plumage color patterns of an extinct dinosaur.” Science, 327(5971): 1369 – 1372. doi:10.1126/science.1186290 PMID 20133521
৫) Matthew J Greenwold and Roger H Sawyer, Genomic organization and molecular phylogenies of the beta (β) keratin multigene family in the chicken (Gallus gallus) and zebra finch (Taeniopygia guttata): implications for feather evolution, BMC Evol Biol. 2010; 10: 148. Published online 2010 May 18. doi: 10.1186/1471-2148-10-148.
৬) http://faculty.weber.edu/rmeyers/feather%20devel%202.pdf
(Y)
পৃথিবী, অনুবাদটা খুব চমৎকার হয়েছে। এর আগের বেশ কিছু অনুবাদ খুব খটমটে হয়েছিল, এই লেখাটি সে সব ভার থেকে মুক্ত। তবে সংশপ্তকের বক্তব্যটিও খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে হবে। পাখিরা যে থেরাপড ডায়নোসর থেকে বিবর্তিত হয়েছে সেটা নিয়ে বোধ হয় খুব বেশি বিতর্ক নেই, কিন্তু সেই আদি উৎসটা Coelurosaurian Theropod ই ছিলো কিনা সেটা বোধ হয় নিশ্চিত নয়। যদিও coelurosaurian dinosaurs দের সবারই পালক ছিলো বলে মনে করা হয়।
লেখাটির জন্য অনেক ধন্যবাদ।
এটা একটা এমনই পপুলার সাইন্স ‘অনুকল্প’ যে যেটা আজ পর্যন্ত জীব বিজ্ঞানের সন্তোষজনক পিয়ার রিভিউয়ের ছাকুনী পার হতে পারে নি বরং বিবর্তনবাদকে আইডিদের কাছে হাসির খোরাকে পরিনত করেছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে, Coelurosaurian Theropod -এর কি জিনোম সিকোয়েন্স আজ পর্যন্ত কি করা গেছে যাতে সেটা কোন আধুনিক পাখির সাথে মিলিয়ে দেখা যায় ? এর উত্তর – একটা বড় না। অন্যদিকে নিয়ান্দারথালদের জীনোম প্রজেক্ট পর্যন্ত আছে। জীনোম সিকোয়েন্স ছাড়া এ ধরনের মিলানোর চেষ্টা ১০০ বছর আগে জীবাশ্মবিদদের যুগে হয়তো গ্রহন করা হত, কিন্তু এখন আর নয়।
সমস্যা হচ্ছে যে পপুলার সাংবাদিকেরা শিব গড়তে গিয়ে বানর বানানোর মত করে বিবর্তনকে হাসির খোরাক বানাবে যেটার তাপ কিনা আবার জীব বিজ্ঞানীদের সামলাতে হয়।
পৃথিবী, ছবিগুলোকে imageshack ছাড়া অন্য কোথাও বা মুক্ত-মনায় আপ্লোড করে দেও । রীতিমত ব্যাঙ হয়ে গেছে। 🙂
ঘটনা বলি, এই সাইটে লগ ইন না করা থাকলে ছবি দেখা যায় না, অন্য জায়গার কথা জানি না তবে বাংলাদেশে এটাই ঘটছে।
@সৈকত চৌধুরী, ছবিগুলো প্রথমে মুক্তমনাতেই আপলোড করার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু পোষ্টে ছবি যোগ করার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারলাম না(আগে তো ভালমতই ছবি এড করতে পারতাম)। নেটের খারাপ অবস্থার কারণে কোনমতে ইমেজশ্যাকে আপলোড করে দিয়েছি, পরে সময় পেলে ফটোবাকেটে আপলোড করব।
লেখাটি প্রাঞ্জল, প্রবাহমান ও সুপাঠ্য। আমার মত বিবর্তনে আনাড়ির এই লেখা বুঝতে তেমন অসুবিধা হয় নি। কাজেই অন্যদের এই লেখা পড়তে অসুবিধা হবার কথা।
এই লেখা পরে অনেক নতুন বিষয় জানলাম।
কিন্তু যখন পড়লাম:
তখন কেমন যেন সংশয় সৃষ্টি হল–এই কারনে যে সৃষ্টিবাদীরা অথবা ধর্মবাদীরা হাততালি দিতে থাকবে সমস্বরে–যেন তাদেরই জয়।
@আবুল কাশেম,
ভুল করেছিঃ
বাক্যটা হবে:
কাজেই অন্যদের এই লেখা পড়তে অসুবিধা হবে না।
দুঃখিত–আল্লা পাক ভুল করিয়েছেন।
@আবুল কাশেম,
বিজ্ঞান কারো হাততালিকে পরোয়া করে না। কোনো কিছু অজানা থাকলেই বা সম্পূর্ণ নিশ্চিত সমাধানে না পৌছতে পারলেই যদি সৃষ্টিবাদীরা তাদের জয় হয়ে গেছে বলে মনে করে তবে সেটা তাদেরই মানসিক দৈন্যতা।
@আবুল কাশেম,
সৈকত ভাই যেমন বলেছেন, ধর্মবাদীদের চিন্তাভাবনা বিজ্ঞানের কাছে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক। বিজ্ঞান কোন বিশেষ আদর্শের ভিত্তিকে শক্ত করার জন্য কাজ করে না, কিন্তু বৈজ্ঞানিক গবেষণার অগ্রগতির ফলে যদি কোন বিশেষ আদর্শ লাভবান হয়, তবে আমাদের আদর্শিক স্ট্যানপয়েন্টটাকেই পুনঃবিবেচনা করতে হবে।
তাছাড়া বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানের যে বৈশিষ্ট্যের কথাটা বললাম, সেটার কারণে সৃষ্টিবাদীদের নাখোশ হওয়ারই কথা। সৃষ্টিবাদীরা দাবি করে জীবজগত এত বেশি জটিল যে এটিকে সম্পূর্ণভাবে বুঝতে পারা বিজ্ঞানীদের পক্ষে সম্ভব না, অর্থাৎ, বিজ্ঞানীরা কিছুই বুঝতে না পেরে নির্বাক হয়ে আছেন। বাস্তবতা কিন্তু ঠিক উলটো- একটা প্রশ্নের জন্য এখন এত বেশি ব্যাখ্যা পাওয়া যায় যে এই সমস্যাগুলোকে ব্যাখ্যাহীন মিরাকল ভাবাটাই নির্বুদ্ধিতা।
সুন্দর অনুবাদ!
পড়ে ভাল লাগল!