লিখেছেনঃ স্বকৃত নোমান

ঈশ্বর। এ সত্তাটির প্রতি মানুষের কৌতূহল চিরায়ত। পৃথিবীর বৃহৎ ধর্মগুলো ঈশ্বরকে কেন্দ্রে রেখেই গঠিত। মানুষের বিবেক-বুদ্ধি বিকশিত হবার অব্যবহিত পরই হয়ত এ সত্তার ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকবে। সে কতকাল আগের কথা, এখনো সেভাবেই চলছে। কত উত্থান-পতন হলো মানুষের, কত প্রাণী এল গেল, প্রকৃতি কত বার ভাঙা-গড়ার খেলা খেলল, কিন্তু বিশ্বাসীদের কাছে ঈশ্বর আজও অস্তিমান। কখনোই ঘটেনি তার অস্তিত্বের সংকট। পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষই এখন একেশ্বরে বিশ্বাসী। তারা উপাসনা করেন তার; যদিও-বা উপাসনার ধরণ ভিন্ন। আবার ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করেন এমন মানুষের সংখ্যাও কম নয়। স্বীকার ও অস্বীকারের মাঝামাঝিও আছেন অনেকে। ঈশ্বরের নামে মানুষ যেমন শৃঙ্খলিত হয়েছে, তেমনি চালিয়েছে নৃশংসতাও। ঈশ্বরের নামে পৈশাচিকতা এখনো বন্ধ হয়ে যায়নি।

কিন্তু কে এই ঈশ্বর? কী পরিচয় এই চিরায়ত সত্তার? অধিকাংশ ধর্মশাস্ত্রে ঈশ্বর বিষয়ে একটা ধারণা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে তা ভীষণ রহস্যে আচ্ছাদিত। শাস্ত্রপ্রোক্ত সেই সব ব্যাখ্যা ঘুরানো-পেঁচানো এবং ধোঁয়াশা বলে মনে হয়। তা পাঠান্তে প্রেমের পরিবর্তে তার প্রতি ভয়ের সৃষ্টি হয়। কোনো ধর্মশাস্ত্রই ঠিক এভাবে বলতে পারেনি : এই, ইনিই হচ্ছেন ঈশ্বর। বিভিন্ন দার্শনিক যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন করে ঈশ্বরকে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালানো হয়েছে, কিন্তু শেষাব্দি ঈশ্বর প্রতিষ্ঠিত হতে হতে আর হয়ে ওঠে না।

আস্তিক-নাস্তিক কিংবা সংশয়বাদী প্রত্যেকেই জীবনের কোনো না কোনো সময়ে বহুবিশ্র“ত ঈশ্বর নামক সত্তাটির সন্ধান করে থাকেন। তাড়িত হন এক কঠিন ভাবনায়। অবিশ্বাসী হতে পারি, কিন্তু আমিও যে ঈশ্বরের সন্ধান করিনি এরকম বলাটা বোধহয় উচিত হবে না। মাঝে মধ্যে শেষ রাতে জানালা খুলে আকাশের দিকে তাকিয়েছি। নক্ষত্রের ফাঁকে দৃষ্টি দিয়েছি কথিত ঈশ্বরকে দেখবো বলে। কৈশোরে পিতার মুখে শুনেছি, শেষ রাতে ঈশ্বর নাকি প্রথম আসমানে নেমে আসেন। শৈশবে শোনা সেই কথাটি এখনো মাঝে মধ্যে রিচুয়্যাল হয়ে ওঠে। কাঁচা মনে যে তা গেঁথে গিয়েছিল! কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হলে হঠাৎ ঈশ্বরের কথা স্মরণ হতো। হতে পারে তা ঐতিহ্যগত স্বভাব। আমার পূর্বজ মানুষগণ লক্ষ-কোটি বার ঈশ্বরের নাম জপেছেন। তাদের কাছে শুনতে শুনতে আমারও মনের ভিতর ঈশ্বর নামক একটি সত্তার বিমূর্ত অবয়ব স্থায়ী আসন গড়ে নিয়েছিল। তাই বলে অন্ধ-বিশ্বাসী নই আমি। ঈশ্বরকে দেখার জন্য, পাওয়ার জন্য যত রকমের মানবীয় চেষ্টা আছে, সব চেষ্টাই করেছি। কিন্তু তাকে দেখিনি, পাইনি। অবশেষে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছাই—না, ঈশ্বর নামক কোনো সত্তা নেই। সব ভূয়া, কাল্পনিক, ছলনা। কিন্তু এ সিদ্ধান্তেও বেশিক্ষণ স্থির থাকা গেল না। ভিতরে প্রশ্নের সৃষ্টি হয় যে, আমি নিশ্চয়ই আদম, ইব্রাহিম, মুসা, ঈসা, মুহাম্মদ, রুমী, শ্রীচৈতন্যের চেয়ে বেশি জ্ঞানী নই! তারা সবাই ঈশ্বর-বিশ্বাসী। এদের মধ্যে তো তিনজন রয়েছেন যারা প্রত্যেকেই এক একটি শক্তিশালী ধর্মের প্রণেতা। হাজার হাজার মানুষ তাদের অনুসারী। অসংখ্য মানুষ শ্রদ্ধাভরে তাদের নাম উচ্চারণ করেন।

তাহলে আমার সিদ্ধান্ত ঠিক, নাকি তাদেরটা ঠিক। লক্ষ-কোটি মানুষ যেখানে বলছেন ঈশ্বর আছে, সেখানে ‘ঈশ্বর নেই’ বলে নিজেকে জ্ঞানী হিসেবে জাহির করাটা হাস্যকর নয়? তাই দোদুল্যমানতায় ভুগতে থাকি। ঝুলতে থাকি বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের মাঝামাঝি কোনো একটা স্থানে।

দুই.
অতঃপর এ সিদ্ধান্তে স্থিত হতে পারি যে— না, ঈশ্বর বলে আসলেই কেউ নেই, কিছু নেই। তাহলে বিশ্বাসীরা কোথায় পেল এ ঈশ্বর? তার কাজই-বা কী? কী-ই বা প্রয়োজন এ সত্তাটির? অবশেষে বিশ্বাসীদের ঈশ্বর বিষয়ে আমার ভিতর কতগুলো ধারণার সৃষ্টি হলো। আসুন, এবার সেগুলো নিয়ে আলোচনা করা যাক।

প্রথমতঃ
ঈশ্বর মূলত মানব-সৃষ্ট একটি সত্তা। ঈশ্বর মানুষকে সৃষ্টি করেনি, মানুষই নিজ প্রয়োজনে ঈশ্বরকে সৃষ্টি করেছে। এরকম একটি উক্তিতে বিশ্বাসীরা ক্ষেপে যেতে পারেন। আশা করছি তারা ক্ষেপবেন না। কারণ, এ একটি ধারণা মাত্র। ধারণাকে সত্য বলে ধরে নিয়ে কেউ ভুল করবেন না নিশ্চয়ই!

‘মানুষই ঈশ্বরের স্রষ্টা’ এ ধারণাটিকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যার জন্য একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। একজন মানুষের কথা ধরা যাক। মনে করুন তার নাম আমজাদ। প্রতিটি মানুষের মতোই আমজাদ বয়সপ্রাপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজের ভিতর কিছু স্বপ্নের সৃষ্টি করেছে। জীবনের একটা লক্ষ্য নির্দিষ্ট করে নিয়েছে সে। মনে করা যাক, তার জীবনের লক্ষ্য হচ্ছে, সে ঢাকা শহরে একটি বাড়ি ও একটি গাড়ির মালিক হবে কিংবা পৃথিবীর উল্লেখযোগ্য জ্ঞান সে অর্জন করবে।

তো আমজাদ মাঝ-বয়সে এসে ঢাকা শহরে একটি বাড়ি ও একটি গাড়ির মালিক হয়ে গেল কিংবা সে পৃথিবীর উল্লেখযোগ্য জ্ঞান-শাস্ত্রগুলো পাঠ করে ফেলল। এখন তার সামনে বাস্তবায়ন করার মতো কোনো স্বপ্ন নেই। তার জানা মতে আর কোনো জ্ঞান নেই যা সে অর্জন করেনি। ঠিক এমন একটা সময়ে আমজাদের করণীয় কী? সে কি হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবে? না, তা থাকবে না। তাহলে সে কী করবে? তার সামনে তো অর্জন করার মতো কিছুই থাকল না।

ঠিক এমন একটা মুহূর্তে আমজাদ নিশ্চিত আত্মহত্যার কথা ভাববে। কারণ, স্বপ্ন ছাড়া আমজাদ কেন, কোনো মানুষই বেঁচে থাকতে পারে না। প্রতিটি মানুষের বেঁচে থাকার জন্য কিছু স্বপ্ন, কিছু আশার প্রয়োজন হয়। মানুষ সেই স্বপ্ন কিংবা আশাগুলোর পেছনে ছুটতে ছুটতে মৃত্যুর কথা ভুলে থাকে। যেমন বয়স্ক মানুষের সামনে কোনো স্বপ্ন থাকে না। তাই সে মৃত্যুর জন্য আটঘাট বেঁধে, মালকোচা মেরে প্রস্তুত হয়। আজরাইল তার জান কবয করার জন্য প্রস্তুত হয় না, সে নিজেই আজরাইলের হাতে তার জানটি তুলে দেবার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে। কারণ, সে জানে যে সে মারা যাবে। তাকে জানানো হয়েছে একদিন যে তার মৃত্যু হবে। সে জানে যে, একদিন এই পৃথিবীর আলো-ছায়া থেকে অপসৃত হয়ে লম্বা সময়ের যে সময়ের কোনো ইতি নেই দ্বারপ্রান্তে উপনীত হবে তাকে। মানুষ যদি না জানত যে একদিন তার মৃত্যু হবে, তবে এ কথা নিশ্চিত, ষাট-সত্তর কিংবা আশি নয়, মানুষ আরো অনেক দিন বেঁচে থাকত। কেননা সে যখন জানত যে আমাকে হাজার বছর বেঁচে থাকতে হবে, তখন তার চোখে স্বপ্ন থাকত, জীবনের একটা স্থির লক্ষ্য থাকত। কিন্তু ব্যক্তি যখন জেনে যায় সে মরে যাবে, তখনই জীবনের একটা পর্যায়ে এসে তার সমূহ স্বপ্ন ভঙ্গ হয়। আশা থেকে, লক্ষ্য থেকে নিজেকে সে দূরে সরিয়ে নেয়। মানসিকভাবে সে দুর্বল হয়ে পড়ে। আগের মতো মনোবলটা আর থাকে না তার। অতঃপর ক্রমান্বয়ে সে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হয়।
তো আমজাদের তো সব চাওয়া-পাওয়া পূরণ হয়ে গেল। তাহলে সে বাঁচবে কী জন্য? তার বেঁচে থাকার অর্থই-বা কী? ঠিক এমন একটা সময়ে আমজাদের পূর্ববর্তী মানুষদের রেখে যাওয়া একটা সত্তা এসে তার সামনে দাঁড়ায়। সে বলে : ‘আমাকে জানো, আমাকে খোঁজো।’ অতঃপর আমজাদ নুতন আশায় বুক বেঁধে সেই সত্তাটিকে খোঁজায় নিরত হয়। খুঁজতে থাকে, কিন্তু পায় না। পেয়ে গেলেই কিন্তু ঝামেলাটা বাঁধে। অর্থাৎ সেই সত্তাটিকে পেয়ে গেলে আমজাদ আবারও স্বপ্নহীনতায় পতিত হবে। তার সামনে আর কোনো স্বপ্ন থাকবে না। তাই সে আবার আত্মহত্যার কথা ভাববে। সুতরাং অনিবার্য কারণে আমজাদ এমন একটি সত্তার অনুসন্ধানে ব্যাপৃত হয়, যাকে কোনোদিন পাওয়া যাবে না, দেখা বা স্পর্শ করা যাবে না। এভাবে খুঁজতে খুঁজতে একদিন আমজাদের সামনে মৃত্যু এসে দাঁড়ায়। আমজাদ স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে বরণ করে নেয়। কারণ সে ভাবে, মৃত্যুর ওপারেই বুঝি সেই অদৃশ্য সত্তাটাকে পাওয়া যাবে!
আমজাদের পূর্ববর্তী মানুষেরা যদি সেই অদৃশ্য সত্তার ধারণা নাও রেখে যেত, তবুও আমজাদ সেই সত্তার খোঁজ করত। কারণ, প্রাকৃতিক বিবর্তন তার ভিতরে নানা প্রশ্নের জন্ম দিত। মানুষের স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সে ভাবুক, সে ভাবতে ভালবাসে, অজানাকে জানার আকুতি তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তাই মনের ভিতর সৃষ্টি হওয়া ভাবনাগুলোর মিমাংসায় সে কোনো এক সত্তার অস্তিত্ব আবিষ্কারে ব্যাপৃত হতো। নবী ইব্রাহিমের কথাই ধরুন। ঈশ্বর কে এ নিয়ে তিনিও কম গবেষণা করেননি। চন্দ্রের আলো, সূর্যের প্রখরতা, নক্ষত্রের উজ্জ্বলতা দেখে ইব্রাহিম ওগুলোকেই ঈশ্বর বলে ভাবলেন। যুক্তি দ্বারা প্রমাণের চেষ্টা করতে চাইলেন তার বিশ্বাসকে। কিন্তু যখনই অনুধাবন করলেন যে, এগুলো তো নশ্বর। তখন তার ভিতর সংশয়ের সৃষ্টি হলো। ভাবলেন, তাহলে ঈশ্বর কে? ঈশ্বর নামক কেউ আদৌ আছে কিনা? শেষমেষ তিনি স্বীয় প্রজ্ঞা ও যুক্তির অতীত এক মহা অবিনশ্বরকে ঈশ্বর হিসেবে সাব্যস্ত করে তার কাছে নিজেকে সমর্পণ করলেন। এছাড়া তার কিছুই করার ছিল না। তিনি তো প্রাকৃতিক যাবতীয় কার্যের কারণ খুঁজেছেন, কিন্তু কারণের শেষ হয় না। স্বাভাবিকভাবেই একটা চূড়ান্ত কারণ তার সামনে এসে দাঁড়াল। সেই চূড়ান্ত কারণকে তিনি দেখতে পান না। অবশেষে নিজের ভিতরের হতাশাবোধটাকে দূর করার জন্যই তিনি অদৃশ্য এক ঈশ্বরের কল্পনা করলেন। এরকম একটি ঈশ্বরের কথা তাকে কিন্তু আগে কেউ বলে দেয়নি, নিজের প্রয়োজনেই তিনি সৃষ্টি করেছেন এই সত্তাটিকে।

এখানে এসে ঈশ্বরের একটা প্রয়োজন অনুধাবন করা যায়। ঈশ্বর স্বপ্নহীন আমজাদকে স্বপ্ন দেখায়, আশাহীন মানুষকে আশার বাণী শোনায়। আর এ কারণেই প্রজ্ঞাবানরা এই অদেখা-অচেনা সত্তাটিকে সৃষ্টি করলেন; যাতে মানুষ স্বপ্নহীনতার মহামারিতে না ভোগে।
অতএব, ঈশ্বর মানুষেরই সৃষ্টি।

দ্বিতীয়তঃ

কিছু কিছু মানুষ আছেন, যারা অন্তর্মুখী থেকে স্বস্তি পান না। তারা দলবদ্ধ হয়ে থাকতে ভালবাসেন। তাই তিনি নিজের একটি দল তৈরি করেন। দলের জন্য অর্থাৎ মানুষের জন্য নিজের সময়কে ব্যয় করেই তার স্বস্তি। সমাজ-সংস্কারক মোহাম্মদ তেমনই একজন মানুষ। শুধু তিনি নন, ইব্রাহিম, দাউদ, মুসা, ঈসা, বুদ্ধসহ সব সমাজ-সংস্কারকই এমন। কেবল নিজেদের কল্যাণ নয়, সামগ্রিক কল্যাণে জীবনের সময়টুকু ব্যয়ে আগ্রহী ছিলেন তারা।
মোহাম্মদের কথাই ধরা যাক। বিপথগামী একটা জাতিকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার জন্য হেরার গুহায় মোহাম্মদ ধ্যানস্থ হলেন। অনুধ্যানে নিরত হলেন কীভাবে মানুষগুলোকে একটি উন্নত জীবনের দিকে আনা যায়। ধ্যানে পড়ে থাকলেন দিনের পর দিন। কিন্তু কোনো উপায় বের করতে পারলেন না। তিনি যদি তার জাতিকে বলেন—তোমরা অন্যায় করো না, শান্তি প্রতিষ্ঠা করো। তাহলে তো কেউ তার কথা শুনবে না। কারণ তিনি যে একদার রাখাল! তাই নিজ মাতৃভূমিতে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি পূর্ববর্তী সংস্কারকগণের মতো একটা ঐশী সত্তার ধারণা পুনরুজ্জীবনের প্রয়োজন অনুভব করলেন। একজন মধ্যস্থতাকারী দাঁড় করালেন। সেই মধ্যস্থতাকারী সত্তাটির নামকরণ করলেন ‘ইলাহ’ বা ‘আল্লাহ’। হেরার গুহা থেকে নিস্ক্রান্ত হয়ে তিনি স্বজাতির উদ্দেশে বললেন—তোমরা গোত্রে গোত্রে যুদ্ধে লিপ্ত থেকো না, এসো আমরা শান্তি প্রতিষ্ঠা করি। তোমরা কন্যা সন্তানকে জীবন্ত পুঁতে ফেল না, তারাও তোমাদের মতো মানুষ।

কিন্তু মানুষ তার কথা পাত্তা দিল না। তখনই তিনি হাজির করলেন সেই মধ্যস্থতাকারী ঐশী সত্তাটিকে। বললেন—এসব কথা কিন্তু আমার নয়। প্রশ্ন এলো—কার? বললেন—এসব কথা আল্লাহর। কিন্তু আল্লাহ কে? বললেন—আল্লাহ হচ্ছেন অদৃশ্য। তাকে দেখা যায় না, বিশ্বাস করে নিতে হয়। তোমরা যে-সব গর্হিত কাজ, করছো তা অব্যাহত রাখলে আল্লাহ তোমাদেরকে কঠিন শাস্তিতে নিপতিত করবেন।
আল্লাহ নামক অদৃশ্য শক্তিবান সত্তার কথা শুনে উচ্ছৃংখল একটি জাতির মনে ভয় জন্মাল। তারা সেই শক্তিকে দেখে না। যা দেখা যায় না তা তো ভয়ানক! না জানি কোনদিক থেকে আবার আক্রমণ করে বসে! তাই তারা অদৃশ্য ভীতিতে আক্রান্ত হয়ে বাধ্য হয় অন্যায় কাজ থেকে নিজেদের বিরত রাখতে।

শিশু যখন ঘুমাতে চায় না, কেবলই দুষ্টুমি করে, তখন মা শিশু সন্তানটিকে এই বলে ভয় দেখান যে—বাবা ঘুমাও, নইলে কিন্তু ভূত আসবে। শিশুটি যদি না ঘুমায়, তাহলে সত্যি সত্যি কি ভূত আসবে? আসবে না। মা-ও কখনো ভূতকে দেখেনি। শিশুকে ঘুম পাড়ানোর জন্যই ভূত নামক একটি সত্তার ধারণা শিশুর সামনে উপস্থাপন করে। আর তাতে শিশুটি ভয় পেয়ে ঘুমায়। বস্তুতঃ ধর্মপ্রণেতারাও ঠিক এই কাজটিই করেছেন।
এখন পর্যন্ত পৃথিবীতে একমাত্র শক্তিশালী প্রাণী মানুষই। অন্য কোনো শক্তিশালী প্রাণী থাকাটাও বিচিত্র কিছু নয়। তবে তা এখনো অনাবিষ্কৃত। মানুষের শক্তি আমাদের চেনা প্রাণীদের চেয়ে অনেক গুণ বেশি। এই অমিত শক্তিশালী মানুষকে যদি ঈশ্বর নামক একটি অদৃশ্য সত্তার ধারণা দেয়া না হতো, তাবে হয়ত মানুষ নিজ নিজ শক্তি প্রদর্শনে আরো বেশি বেপরোয়া হয়ে ওঠত। তাতে বিপন্ন হতো মানবতা, বিপন্ন হতো মানুষ এবং মহাবিশ্ব। ঈশ্বর নামক এই সত্তাটির ধারণা যদি না থাকত, তাহলে মানুষ আরো বেশি বস্তুবাদী হয়ে পড়ত। কিন্তু বস্তুবাদ স্বল্প-জ্ঞানসম্পন্ন মানুষের মনে শান্তি আনতে পারে না। বস্তুবাদ তাদেরকে নৈরাশ্যের দিকে ধাবিত করে। ঈশ্বর নামক এই সত্তাটির ধারণা না থাকলে একজন মানুষ যতই সম্পদ অর্জন করুক না কেন, সে আরো বেশি সম্পদ অর্জনের জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়ত। ফলে সামগ্রিক অর্থনীতি হুমকির সম্মুখিন হতো মারাত্মকভাবে, ব্যাপকভাবে বাড়ত শ্রেণী-বৈষম্য।
অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য, শ্রেণী বৈষম্যকে একটা সহনীয় মাত্রায় রাখার জন্য, পুঁজিবাদীকে পুঁজি বৃদ্ধি থেকে নিরুৎসাহিত করবার জন্য ধর্মপ্রণেতারা অনেক ভেবে-চিন্তে ঈশ্বর নামক এই কাল্পনিক সত্তাটির ধারণা পত্তন করলেন। একজন পুঁজিবাদী যখন তার পুঁজিকে আরো বৃদ্ধির চেষ্টা করল, তখন তাকে বলা হলো—‘সাবধান হও, পুঁজি বৃদ্ধিই তোমার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য নয়। আরো একটি লক্ষ্য আছে, সেটি হচ্ছে তুমি ঈশ্বরকে জানো, তাকে ভয় করো। সম্পদশালীকে নয়, যে তার অনুগত থেকে ইবাদত-বন্দেগি বা পুজা-অচনা করে তাকেই তিনি ভালবাসেন।’ এরকম কথা শুনে তখন সে ভয় পায়। অদৃশ্য সত্তাটি তার উদগ্র বাসনাকে নিয়ন্ত্রণ করে। তাই সাধরণ মানুষগণের একটি সুস্থ সমাজ বিনির্মাণ-প্রয়াসে ঈশ্বরের ধারণা আমদানি ধর্মপ্রণেতাদের একটি নান্দনিক কৌশল বটে।

একজন বিশ্বাসী ঈশ্বরকে অর্জনের জন্য সারা জীবন যে পরিমাণ সময় ব্যয় করে, সেই পরিমাণ সময় যদি সে সম্পদ অর্জনের পেছনে ব্যয় করে, তাহলে পুঁজিবাদ পৃথিবীকে মারাত্মকভাবে গ্রাস করবে। পুঁজিবাদী তৎপরতা বৃদ্ধি পেলে মানুষে মানুষে বৈষম্য বাড়ে, দেশে দেশে যুদ্ধ লাগে। পুঁজি মানুষকে মানুষ হিসেবে গণ্য করে না। পুঁজি টিকে থাকে যুদ্ধের উপর ভিত্তি করে। অতএব অন্তত পুঁজিবাদকে নিরুৎসাহিত করার জন্য হলেও ঈশ্বর নামক একটি অদৃশ্য সত্তার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করা যায়। ধর্মপ্রণেতারা মূলত সেই কাজটিই করেছেন।
অতএব, ঈশ্বর মানুষেরই সৃষ্টি।

তৃতীয়তঃ

রোমান্টিসিজম, মর্ডানিজম, পোস্ট-মর্ডানিজম কিংবা দেহতত্ত্ব, দ্বৈতাদ্বৈতবাদ বা বিমূর্তবাদ তত্ত্বের মতো ঈশ্বরও একটি তত্ত্ব মাত্র। ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়/ধরতে পারলে মন-বেড়ী দিতাম পাখির পায়…।’ লালনের এই গানটিকে বিশ্লেষণের জন্য আমরা একটি তত্ত্বের আশ্রয় নিই; তা হচ্ছে দেহতত্ত্ব। কিংবা আচার্য সেলিম আল দীনের ‘চাকা’ ও ‘হরগজ’ নাট্যদ্বয়ের আঙ্গিক বিশ্লেষণের জন্য একটি তত্ত্বের আশ্রয় নেয়া হয়; তা হচ্ছে দ্বৈতাদ্বৈতবাদী শিল্পতত্ত্ব।

ঠিক এমনিভাবে মহাবিশ্বের যাবতীয় ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াকে, বৈশ্বিক কাঠামোটাকে বিশ্লেষণের জন্যও বিশ্বাসীদের একটি তত্ত্বের প্রয়োজন হয়। মহাবিশ্বকে একটি শিল্পকর্ম হিসেবে দেখুন। এবার এর আঙ্গিক বা কাঠামোটাকে বিশ্লেষণের চেষ্টা করুন। কিন্তু কী দিয়ে বিশ্লেষণ করবেন? তত্ত্বটি কোথায়? এই মহাবিশ্বের তাবৎ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ধরণটাকে বোঝার জন্য একটি তত্ত্ব অনিবার্য হয়ে ওঠে। বিশ্বাসীগণ ব্যাপক অনুধ্যানের পর একটি তত্ত্ব হাজির করেছেন, আর তা হচ্ছে ঈশ্বরতত্ত্ব। এ ঈশ্বরকে দিয়েই মহাবিশ্বের ক্রিয়া-পতিক্রিয়া বা কাঠামোটাকে বিশ্লেষণ করেন তারা। অতএব ঈশ্বর মূলত একটি তত্ত্বের নাম। এ তত্ত্ব মানব-সৃষ্ট।
অপরদিকে রোমান্টিসিজম, মর্ডানিজম, পোস্ট-মর্ডানিজম দেহতত্ত্ব কিংবা দ্বৈতাদ্বৈতবাদী তত্ত্বগুলোকে দেখা যায় না, অনুভব করা যায় কেবল। দ্বৈতাদ্বৈতবাদী তত্ত্বটির কথাই ধরা যাক। এ তত্ত্বটি কিন্তু দেখা যায় না। এটির কোনো আকার নেই, দেহ নেই। এ তত্ত্বটি খায় না, ঘুমায় না, বাথরুম করে না, হাসে না, কাঁদে না, চলে না, বসে না, মরে না, মার খায় না, বলে না, করে না। তত্ত্বটি নির্লিপ্ত, নির্বিকার, নিরাকার। কিন্তু সে একটি শিল্পকর্মের সর্বত্র বিরাজমান। দ্বৈতাদ্বৈতবাদী তত্ত্বের আলোকে যদি ‘চাকা’ কথানাট্যটির কাঠামো বিশ্লেষণ করতে চান, তবে নাটকটির সর্বত্র এই তত্ত্বটির অস্তিত্ব বিরাজমান হিসেবে অনুভব করবেন। সমগ্র শিল্পকর্মে সে বিরাজ করছে। এই যে তত্ত্বটি বিরাজ করছে, তা কিন্তু আপনার ধারণা মাত্র, তত্ত্বের নয়। তত্ত্ব জানেও না সে যে সমগ্র শিল্পকর্মে বিরাজ করছে। সে জানে না তার ক্ষমতা সম্পর্কে। জানবে কোত্থেকে, তার অস্তিত্বই তো নেই। আপনিই তো একটি শিল্পকর্মের অবকাঠামো নির্মাণ বা বিশ্লেষণের জন্য তাকে সৃষ্টি করেছেন।

কেউ যদি বলে এই দ্বৈতাদ্বৈতবাদী তত্ত্বটির একটি চেয়ার আছে। চেয়ারটি হীরা-জহরত-মনি-মুক্তা খচিত। সেটি স্থাপিত সাত আসমানের উপরে, শূন্যে। তত্ত্বটি সেই চেয়ারটিতে বসে শিল্পকর্মটিকে শাসন করে। এরকম যদি ভাবা হয়, তাহলে কি ভুল হবে না?

ঈশ্বরও ঠিক এরকম একটি তত্ত্ব। ঈশ্বর নামক কোনো সত্তা আদৌ নেই। তার কোনো আকার নেই। তার কোনো শক্তি নেই অথচ সর্বশক্তিমান। সে দেখতে পায় না অথচ সর্বদ্রষ্টা। মহাবিশ্বের অবকাঠামো বিশ্লেষণের জন্য বিশ্বাসীদের প্রয়োজন হয় তাকে, কিন্তু তার প্রয়োজন হয় না। সে শোনে না, বোঝে না, খায় না, ঘুমায় না। ঠিক ওই দ্বৈতাদ্বৈতবাদী শিল্পতত্ত্বটির মতো। বিশ্বাসী তার বিশ্বাসগত কারণে ঈশ^র নামক এই সত্তাটিকে প্রতিস্থাপন করেছেন। এ ঈশ্বর ধ্র“পদী, চির নতুন, চিরকালীন। বিশ্বাসীর ব্যাক্তিগত প্রয়োজনেই সে ওই সত্তাটিকে জিইয়ে রাখবে। ঈশ্বরের মৃত্যু মানেই বিশ্বাসীর অস্তিত্বের সঙ্কট।

ধর্মগ্রন্থগুলোতে যখন বলা হয়, ঈশ্বর নিরাকার, তখন ঈশ্বর যে একটি তত্ত্বের নাম ঠিক এই কথাটিরই সাক্ষ্য দেয়া হয়। যখন বলা হয় ‘ইন্নাল্লাহা আলা কুল্লিা শাইয়িন কাদীর’ অর্থাৎ নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বশক্তিমান। কিংবা যখন বলা হয় ‘ঈশা বাস্যমিদং সর্বং যৎকিঞ্চ জগত্যাং জগৎ।’ অর্থাৎ এই গতিশীল বিশ্বে যা কিছু চলমান বস্তু আছে, তা ঈশ্বরের বাসের নিমিত্ত মনে করবে তখন কিন্তু ঈশ্বর যে একটি তত্ত্ব মাত্র, তারই সাক্ষ্য দেয়া হয়। বাউলতত্ত্বে যখন বলা হয়—ঈশ্বর মানব দেহেই অধিষ্ঠিত, তখনও কিন্তু ভুল বলা হয় না। শুধু মানব দেহেই নয়, মহাবিশ্বের সব কিছুতেই ঈশ্বরের অধিষ্ঠান। বিশ্বাসীর প্রয়োজনেই সে তাকে সব কিছুতে অধিষ্ঠিত করে রেখেছে।
অতএব, ঈশ্বর মানুষেরই সৃষ্টি।

চতুর্থতঃ
কোনো ব্যাক্তি বা গোষ্ঠী ন্যায় বা অন্যায়ভাবে আপনার উপর চড়াও হলো। তখন প্রথমে আপনি ব্যক্তিগতভাবে প্রতিহত করার চেষ্টা করবেন। যখন আপনি একা পেরে উঠবেন না, তখন শত্র“র কবল থেকে নিজেকে রক্ষা করতে তার চেয়ে অধিক শক্তিমান অন্য একটি পক্ষের আশ্রয় নিবেন; হতে পারে সেই পক্ষটি পুলিশ বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী যে কোনো বাহিনী। কিন্তু তারাও যদি আপনাকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়, তখন আপনি আরো শক্তিশালী একটি পক্ষের সহযোগিতা চাইবেন; হতে পারে সেই শক্তি দেশের এমপি কিংবা মন্ত্রী। অথবা ধরা যাক একটি রাষ্ট্র। মনে করি সেই রাষ্ট্রটি বাংলাদেশ। বাংলাদেশের উপর যদি মায়ানমারের সেনাবাহিনী ন্যায় বা অন্যায়ভাবে আক্রমণ চালায়, তখন বাংলাদেশ সরকার দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য প্রথমে নিজেদের সৈন্যবাহিনী দিয়ে প্রতিহত করার চেষ্টা করবে। তাতে ব্যর্থ হলে মায়ানমারের চেয়ে শক্তিশালী কোনো প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সহায়তা চাইবে। তাতেও ব্যর্থ হলে সরকার রাশিয়া, ফ্রান্স, বৃটিশ বা আমেরিকার সাহায্য চাইবে। তারা সহযোগিতা না করলে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ কামনা করবে। কিন্তু কেউ যখন বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে চাইবে না, তখন দেশটির জনসাধারণ কী করবে? যারা অসীম সাহসী, যারা বীর, যারা প্রকৃত দেশপ্রেমিক তারা জীবনবাজি রেখে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বে। আর যারা ভীতু, কাপুরুষ, দূর্বল চিত্তের অধিকারী সবার অসহযোগিতা প্রত্যক্ষ করে তাদের ভিতর এক ধরণের নৈরাশ্য বা হতাশাবোধ কাজ করবে। এই নৈরাশ্যবোধ থেকে পরিত্রাণের জন্য তারা এমন একটি সত্তার আশ্রয় চাইবে, যে সত্তা জাগতিক সকল শক্তির চেয়ে অধিক শক্তিশালী। তারা জানে সেই অতিলৌকিক শক্তিটি কিছুই যে করতে পারবে না। তবু মনকে প্রবোধ দেয়ার জন্য হলেও তার সাহায্য কামনা করবে। তারা মনে মনে এই ভেবে সান্ত্বনা পায়—নিশ্চয়ই আল্লাহ বা ঈশ্বর আমাদের রক্ষা করবেন। বলাবাহুল্য, এটিই তাদের সান্ত্বনার জায়গা। এই জায়গাটি না থাকলে মায়ানমারের সৈন্যরা আক্রমণ চালাবার আগেই তারা প্রত্যেকে নিজের কাছে পরাজিত হয়ে আত্মহত্যা করবে, নয়ত হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে কিংবা স্ট্রোক করে মারা যাবে।

একইভাবে ঝড়-ঝঞ্জা-জলোচ্ছ্বাস এতই শক্তিশালী যে, এগুলোকে প্রতিরোধের শক্তি মানুষ এখনো অর্জন করতে পারেনি। এসবের কবলে পড়ে মানুষ খুব অসহায় বোধ করে। এই মহাবিশ্ব এতই বিশাল যে, এর সামনে দাঁড়িয়ে বিপন্ন বোধ করে মানুষ। এই অসহায়ত্ব ও বিপন্নতাবোধ থেকে পরিত্রাণের জন্য মানুষের প্রয়োজন হয় এর চেয়ে অধিক বিশাল আরেকটি শক্তির। কিন্তু কে সেই শক্তি, মানুষ তা জানে না। কিন্তু পরিত্রাণ যে পেতে হবে! ঠিক তখনই ঈশ্বর নামক একটি শক্তি সৃষ্টি করে মানুষ তার কাছে আশ্রয় চায়, পরিত্রাণের উপায় খোঁজে। নিজের মনকে এই বলে প্রবোধ দেয় যে, ঝড়-ঝঞ্চা-জলোচ্ছ্বাস কত শক্তিমান, আমরা আরো অধিক শক্তিমানের আশ্রয়ে আছি। তিনিই এ বিপদ থেকে আমাদের রক্ষা করবেন। কিন্তু ঈশ্বর শেষ পর্যন্ত রক্ষা করে না। প্রাকৃতি তার রুদ্র প্রতাপে মানুষকে ধ্বংস করে দেয়। কিন্তু যতক্ষণ ধ্বংস করে না, ততক্ষণ তাদের ভরসা কী? ভরসা হচ্ছে ওই ঈশ্বর।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, মানুষ নিজের অসহায়ত্বকে, নিজের দূর্বলতাকে ঢাকার জন্য, নিজের হতাশাবোধকে দূর করার জন্য ঈশ্বর নামক একটি সত্তার আশ্রয় নেয়। প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বর নামক কেউ নেই। মানুষই তার ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ঈশ্বরকে সৃষ্টি করেছে। এই ভরসাস্থল মানুষেরই সৃষ্টি। সে যাকে ভরসা বলে মনে করছে সে কিন্তু বলছে না আমিই তোমাদের ভরসা।
অতএব, ঈশ্বর মানুষেরই সৃষ্টি।

তিন.

ঈশ্বর যে মানব-সৃষ্ট একটি সত্তা উপরোক্ত আলোচনায় আশা করি তা পরিস্কার হয়ে উঠেছে। তাহলে স্বাভাবিক কারণেই প্রশ্ন উঠতে পারে যে, মানুষের জন্য আদৌ কোনো ধর্মের প্রয়োজন আছে কিনা? ধর্ম মানেই তো বিশ্বাসের ব্যাপার-স্যাপার। কিন্তু বিশ্বাসই যেখানে প্রশ্নবিদ্ধ হলো সেখানে কি ধর্মতত্ত্ব অসার হিসেবে প্রতীয়মাণ হয় না?

হ্যাঁ, মানুষের জন্য ধর্মের প্রয়োজন রয়েছে; তবে সব মানুষের জন্য নয়। ঈশ্বর যে মানব-সৃষ্ট এ সত্যটি বা এ উচ্চতর জ্ঞানটি সব মানুষের পক্ষে অর্জন করা সম্ভব নয়। কারণ এর জন্য যে প্রচুর সময় ব্যয় করে অনুধ্যানের প্রয়োজন! সাধারণ মানুষের এত সময় কোথায়? তাছাড়া সব মানুষের জ্ঞানও তো এক রকম নয়। এক শ পাওয়ারের বৈদ্যুতিক বাল্ব আর দুই শ পাওয়ারের বাল্বের মধ্যে বিস্তর তফাৎ; অথচ দুটোকেই বাল্ব বলা হয়। দুটোর কাজই আলো দেয়া।

কিছু কিছু মানুষ আছে, যারা নিরন্তর জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে স্বীয় প্রজ্ঞায় ভাল ও মন্দের ফারাক করে নিতে পারে, নিজেরাই নিজেদের জীবনকে একটি শৃঙ্খলায় নিয়ে আসতে পারে। তারা এ কাজটি করে স্ব স্ব বিবেক-বুদ্ধির মাধ্যমে, জ্ঞানচর্চা ও প্রাকৃতিক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে। কিন্তু একজন রিকশা চালক কিংবা একজন শ্রমিকের পক্ষে জ্ঞানচর্চার এত সময় কই? সে ভাল-মন্দের তারতম্য কীভাবে করবে? যে মানুষটি জ্ঞানচর্চায় নিরত, তার মতো এই মানুষটিও যদি জ্ঞানচর্চায় নিরত হয়, তাহলে তো পৃথিবীর স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে। সবাই যদি কাজকর্ম ত্যাগ করে এই উচ্চতর জ্ঞানচর্চা শুরু করে, তাহলে বন্ধ হবে খাদ্য উৎপাদন; ফলে শুরু হবে দুর্ভীক্ষ। বন্ধ হবে প্রজনন; ফলে পৃথিবী হবে মানব-শূন্য। সর্বোপরি মানব-সভ্যতা সম্মুখীন হবে নিদারুণ এক হুমকির। সবাই যদি শ্রীচৈতন্য হয়ে যায় তবে বিষ্ণুপ্রিয়াদের অবস্থা কী হবে? সবাই যদি বায়েজিদ বা মনসুর হাল্লাজ হয়ে যায়, তবে বস্তুজগত চলবে কী করে? অতএব কারণে সাধারণদের জন্য ধর্মের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি সামনে এসে দাঁড়ায়। সাধারণ মানুষটি অর্থাৎ যে জ্ঞান ও ধ্যানচর্চার মাধ্যমে ভাল-মন্দের তারতম্য করতে অক্ষম সে নিজ বুদ্ধিতে চলতে পারে না, অন্যের বুদ্ধিতে চালিত হয়। নিজে কোনো জ্ঞান উৎপাদন করতে পারে না, অন্যের উৎপাদিত জ্ঞানের মাধ্যমে সে জ্ঞানবান হয়। আবার কিছু কিছু মানুষ আছেন যাদের জ্ঞান-চর্চারও কোনো প্রয়োজন হয় না। জ্ঞানচর্চা ছাড়াই উন্মীলিত হয় তাদের তৃতীয় নয়ন। তারা প্রকৃতির সব কিছুকে সহজেই আঁচ করতে পারে। এদের সঙ্গে তুলনা চলে একটি হীরকখণ্ডের। হীরাকখণ্ডটিকে যখন কোনো অন্ধকার কক্ষে রাখা হয়, তখন ওটাকে দেখার জন্য কোনো আলোক-বাতির প্রয়োজন পড়ে না। কারণ হীরকখণ্ডটি নিজ আলোতেই আলোকিত।

তো সেই সাধারণ মানুষটির জন্য উচ্চতর জ্ঞানচর্চার পর্যাপ্ত সময় নেই যার একটি কাল্পনিক ঈশ্বরের প্রয়োজন রয়েছে। কারণ, সেই পার্থিব আইনে যতটা না শৃঙ্খলিত হবে, ধর্মতাত্ত্বিক কাল্পনিক আইনে তার চেয়ে অনেক বেশি শৃঙ্খলিত হবে। কারণ, অজানাকে যে তার বড্ড ভয়! নিম্নতর জ্ঞানের অধিকারী একজন চোর যখন চুরি করতে যায় তখন কিন্তু কেউ দেখে না, কেউ জানে না। পার্থিব আইন তাই অজ্ঞানী চোরকে চুরি থেকে নিবৃত্ত করতে কিছুটা অক্ষম। কিন্তু ধর্মতাত্ত্বিক কাল্পনিক আইনের কথা চিন্তা করুন! যখনই সে চুরি করার মনস্থ করে, তখনই তার সামনে ঈশ্বর নামক সত্তাটি এসে দাঁড়ায়। সে ভাবে, পৃথিবীর কেউ হয়ত আমাকে দেখছে না কিন্তু ওই ঊর্ধ্বলোকের অদৃশ্য ঈশ্বর তো দেখছে! আর সে দেখছে বলেই মৃত্যুর পর আমাকে নরকের অনন্ত শাস্তি ভোগ করতে হবে।

কিন্তু অধিকাংশ সময় সে ঈশ্বরের কথা বিস্মৃত হয়। তাই ধর্মপ্রণেতারা এ শ্রেণীর মানুষদের কু-প্রবৃত্তিকে দমিয়ে রাখতে আরো অনেক কৌশল অবলম্বন করেছেন। যেমন ইসলামের কথাই ধরুন। বলা হচ্ছে, মানুষের দুই কাঁধে দুই ফেরেশতা রয়েছে। ব্যক্তির পাপ-পুণ্যের হিসাব লিপিবদ্ধ করা তাদের কাজ। যখনই চোর উদ্যোগী হয় চুরি করতে, তখনই তার দুই পাশে অবস্থানরত কিরামান-কাতেবিনের কথা স্মরণ হয়। আচ্ছা বলুন তো, ঈশ্বর যদি সর্বদ্রষ্টা কিংবা সর্বজ্ঞই হয়ে থাকে, তাহলে কিরামান-কাতেবিন নামক এ দুই গোয়েন্দার কী প্রয়োজন? এদের কথা বলে ঈশ্বরের ক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হলো না? একবার ভাবুন তো বিষয়টি কতটা হাস্যকর। প্রকৃতপক্ষে কিরামান-কাতেবিন নামক কেউ নেই। নিম্নতর জ্ঞানী মানুষটি যখন অদৃশ্য ঈশ্বরের কথা বিস্মৃত হয়ে অপরাধে উদ্যোগী হয়, তখন তাকে নিবৃত্ত করার জন্য এটি দ্বিতীয়তম কৌশল। এতেও যদি কাজ না হয়, তাহলে তৃতীয় আরেকটি কৌশল রেখে গেছেন ধর্মপ্রণেতারা। তা হচ্ছে স্বর্গ ও নরক। বলা হচ্ছে—তুমি অপরাধ করো না। করলে নরকের অনন্ত শাস্তি ভোগ করতে হবে। আর যদি ভাল কাজ করো, তাহলে তোমার জন্য অপেক্ষা করছে স্বর্গের বিচিত্র সব খাদ্য ও পানীয়, হুর ও গিলমান। ধর্ষক যখন ধর্ষণে উদ্যত হয়, তখন তার সামনে স্বর্গের হুর ও গেলমানদের অবয়ব ভেসে ওঠে। ফলে তার ভিতর কিছুটা হলেও বৃহত্তর স্বার্থের চিন্তা কাজ করে। সে ভাবে—হায়, আমি এক নারীকে ভোগলিপ্সা দমাতে না পারলে তো স্বর্গের শত-সহস্র নারীকে হারাবো!

বস্তুত স্বর্গ-নরক বলে উৎকৃষ্ট বা নিকৃষ্ট কোনো স্থান নেই। স্বর্গ-নরকের ধারণা ঈশ্বরের মতোই কাল্পনিক। উচ্চতর প্রজ্ঞাবান ধর্মতাত্ত্বিকগণ নিম্নতর জ্ঞানবান মানুষকে সুন্দর একটি জীবন যাপনের পন্থা উপহার দিতে অনেক রকমের চেষ্টা করেছেন। তারা ভেবেছেন তুর পর্বতে গিয়ে, হেরার গুহায় বসে ভেবেছেন, বোধিবৃক্ষের নিচে বসে ভেবেছেন; কিন্তু কোনো উপায় বের করতে পারলেন না। শেষে অধিকাংশ ধর্মতাত্ত্বিক স্বর্গ ও নরক নামক একটি কাল্পনিক স্থানের ধারণার জন্ম দিলেন। এগুলো সম্পূর্ণই রূপক। রূপক কিচ্ছা-কাহিনীর মাধ্যমে নিম্নতর জ্ঞানের অধিকারী মানুষকে সৎ থাকার পরামর্শ দেয়া হয়েছে তাতে। তাই দেখা যায় ধর্ম মানুষকে শারিরীক কোনো শাস্তি দেয় না। বলা হয়, এ কাজ করো না; করলে এই শাস্তি অপেক্ষা করছে তোমার জন্য। এ কাজ করো; তাতে এই পুরস্কার অপেক্ষা করছে ইত্যাদি…।
এখানে এসে সেই নিম্নতর জ্ঞানী মানুষদের জন্য ধর্মের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করা যায়।

চার.

কিন্তু এ কঠোর ধর্মীয় বিধি-বিধানের মধ্যে চিরকাল থাকার জন্য পৃথিবীতে মানুষ আসেনি। এভাবে বেশি দিন চলতে পারে না। এসব বিধি-বিধান তো একটা নির্দিষ্ট গণ্ডি। একটি শেয়াল কিংবা সাপের জন্য এরকম গণ্ডির প্রয়োজন থাকতে পারে। মানুষের জন্য তারা ক্ষতিকর বলে বন-জঙ্গলের নির্দিষ্ট-নিরাপদ গণ্ডিই তাদের চিরকালীন বসতি। কারণ প্রকাশ্যে আসলে শত্র“র হাতে প্রাণ হারাবার ভয় থাকে তাদের। কিন্তু মানুষকে সারা জীবন এ গণ্ডিতে থাকতে হবে কেন? কীসে ভয় মানুষের? তাহলে স্বীয় দাবী অনুযায়ী নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব আর থাকল কোথায়? ধর্মীয় এসব বিধি-বিধান তো একটি কারাগার। কারগারে তো সুস্থ মানুষ বেশি দিন থাকতে পারে না। সুস্থ মানুষকে বেশিদিন কারাগারে রাখা হলে সে অসুস্থ হয়ে পড়ে, তার চিন্তা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে।

এই যে ধর্মীয় বন্দিদশা এর থেকে মুক্তির উপায় কী? লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, কঠোর বিধি-বিধানের পাশাপাশি ধর্মগুলো মুক্তির উপায়ও কিন্তু বলে দিচ্ছে। যখন বলা হয় : ‘জ্ঞান অর্জন করো; জ্ঞান অর্জনের চেয়ে শ্রেষ্ঠ অর্জন আর কিছু নেই।’ ইসলাম জ্ঞান অর্জনকে প্রত্যেক নর ও নারীর জন্য ফরজ করে দিয়েছে। বলা হচ্ছে, ‘তালাবুল ইলমি ফারিজাতুন আলা কুল্লি মুসলিমাতুন ওয়াল মুসলিমাহ’। আবার বলা হচ্ছে, ‘মান আরাফা নাফসাহু, ফাক্বাদ আরাফা রাব্বাহু’ অর্থাৎ তুমি আগে নিজেকে চেনো, তারপর তোমার রবকে (ঈশ্বর) চেনো। উপনিষদে বলা হচ্ছে আত্মজ্ঞান কিংবা ঈশ্বর জ্ঞান লাভের কথা। বলা হচ্ছে, ‘ন হি জ্ঞানেন সদৃশং পবিত্রামিহ বিদ্যতে।’ অর্থাৎ ইহলোকে জ্ঞানের সদৃশ পবিত্র কিছুই নেই। কী সেই আত্মজ্ঞান বা ঈশ্বর জ্ঞান? আত্মজ্ঞান মানে হচ্ছে, অন্যের জ্ঞানে নয়, স্ব-অর্জিত জ্ঞানে তুমি নিজেকে জানো। নিজেকে জানলে বুঝতে পারবে তুমিই যে তোমার নিয়ন্তা। নিজের ব্যাপারে এ সত্যটি যখন উপলব্ধি করতে পারবে তখনই তোমার কাছে ঈশ্বর নামক সেই অদৃশ্য সত্তাটি গৌণ হয়ে ওঠবে। তোমার জীবনে তার আর কোনো প্রয়োজন হবে না।

কিন্তু কীভাবে নিজেকে জানবে? এর জন্য একটি প্রক্রিয়া রয়েছে আর তাহচ্ছে জ্ঞান। এ জ্ঞানচর্চার মধ্য দিয়ে তুমি তোমাকে জানতে পারবে। এ জ্ঞানচর্চার মধ্য দিয়েই তুমি ঈশ্বর যে তোমারই সৃষ্ট একটি সত্তা তা সহজে উপলব্ধি করতে পারবে। প্রশ্ন-উপনিষদে উত্তরায়ণ ও দক্ষিণায়ন সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, উত্তরায়ণ সূর্যের পথ। সূর্য প্রাণ, জ্যোতি ও জ্ঞানের প্রতীক। এই কারণে যারা ইহজীবনে আত্ম-জ্ঞানলাভ করেন, তারা উত্তরায়ণ দ্বারা সূর্যলোকে গমন করেন। দক্ষিণায়ন চন্দ্রলোকের পথ আর চন্দ্রলোক হচ্ছে অজ্ঞানের লোক। সুতরাং যে সকল অজ্ঞানী ইহজীবনে আত্ম-জ্ঞানলাভের কোনো চেষ্টা না করে সংসারে কেবল পুত্র-কন্য উৎপাদন করে এবং স্বর্গলাভের আকাক্সক্ষায় ইষ্টপূর্তাদি কর্মানুষ্ঠান করে, তারা দক্ষিণায়ন দ্বারা চন্দ্রলোকে গমন করে কিছুকাল স্বর্গসুখ ভোগ করে পুণ্যক্ষয়ে পুনরায় পার্থিব লোকে ফিরে আসে। তারা কখনোই মোক্ষ লাভ করতে পারে না।

জন্মান্তরবাদ দ্বারা জ্ঞানচর্চাকে দারুণভাবে উৎসাহিত করা হয়েছে এখানে। আত্মজ্ঞান মানেই তো সেই জ্ঞান, যে জ্ঞানের মাধ্যমে ব্যক্তি নিজেকে চিনতে পারবে, জানতে পারবে। তাই তো লালন বলেন, ‘…আপনারে আপনি চিনিনে/..আপনারে চিনতাম যদি/হাতে মিলত অটল নিধি/মানুষের করণ হতো সিদ্ধি/ শুনি ওগো পুরাণে/… দিব্যজ্ঞানী যে-জন হইল/নিজ তত্ত্বে নিরঞ্জন পেল…।’

একটু আগে ধর্মকে কারাগারের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, সুস্থ মানুষ দীর্ঘদিন কারাভোগে অসুস্থ হয়ে পড়ে। এ সত্যটি ভালভাবে যাতে উপলব্ধি করা যায় তাই ছোট্ট একটি গল্পের উল্লেখ প্রয়োজন বোধ করছি।
পত্রিকায় অনিয়মের সংবাদ পরিবেশনের কারণে কতিপয় প্রভাবশালী ব্যক্তির রোষানলের শিকার হয়ে এ প্রবন্ধকারকে ছয়দিন কারাভোগ করতে হয়েছিল। একজন সুস্থ, বোধসম্পন্ন কিংবা একজন সৃজনশীল মানুষের জন্য কারাগার যে কী যন্ত্রণাদায়ক স্থান তা যে কারাভোগ করেনি তাকে ছাড়া আর কাউকে সহজে বোঝানো যাবে না।

প্রবন্ধকারকে যে ওয়ার্ডে রাখা হয়েছিল, সেই ওয়ার্ডে সাত-আটটি হত্যা মামলার এক যুবক আসামিকেও রাখা হয়েছিল। যুবকটি অর্ধ মাতাল। জীবনের প্রতি সে বিতৃষ্ণ। আত্মহত্যার চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না। রাত গভীরে সবাই যখন ঘুমায়, সে তখন ত্রস্ত পায়ে পায়চারি করতে থাকে। একবার ওয়ার্ডের এদিক, আরেকবার ওই দিক। যার তার সঙ্গে মারামারিতে লিপ্ত হয়। তার অত্যাচারে অতীষ্ঠ হয়ে কয়েদি ও হাজতিরা একাতাবদ্ধ হয়ে মাঝে মাঝে তাকে বেদম প্রহার করে। সেও ছাড়ে না। হাতের কাছে যাকে পায় কিল-ঘুষি দিয়ে জখম করে ছাড়ে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেল, আরো তিন-চার বছর আগে যখন এ যুবক প্রথম কারাগারে আসে তখন তার অবস্থা এরকম ছিল না। দেড় দুই বছর সে সম্পূর্ণ সুস্থ এক মানুষ ছিল। এরপর সে অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করে। দীর্ঘ বন্দি জীবনে কারাগারের কঠিন বিধি-নিষেধ জীবনের প্রতি তার বিতৃষ্ণা এনে দিয়েছে, অসুস্থ করে তুলেছে তাকে। ডাণ্ডাবেড়ি দিয়েও তাকে নিবৃত্ত করা যায় না। লাফ-ঝাঁপ দিয়ে সে অন্য বন্দিদের অস্থির করে তোলে।
ধর্মও ঠিক এমনই একটি বন্দিদশা। এতে বেশিদিন থাকা চলে না। একটা সময়ে এসে এ গণ্ডি থেকে নিষ্ক্রান্ত হতে হয়। নয়ত সেই বন্দির মতো অবস্থা হবে, যে অর্ধ-মাতাল, কঠিন বিধি-নিষেধ যাকে শৃঙ্খলে আনার পরিবর্তে উচ্ছৃঙ্খল করে তুলেছে।

আজকের বিশ্বে জিহাদের নামে, ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধের নামে যেভাবে মানব-নিধন চলছে, তার প্রকৃত কারণটা তাহলে এবার একটু ভাবুন। হুজি, আল-কায়দা, লস্কর-ই-তাইয়্যেবা, জেএমবি কিংবা অন্যসব ধর্মীয় উগ্র সম্প্রদায় কেন এভাবে হত্যার উন্মাদনায় মেতে ওঠেছে? কারণ ওই একটাই। দীর্ঘদিনের বিধিবদ্ধ জীবন তাদের ভাল লাগছে না আর। একরৈখিক জীবন-ব্যবস্থা তাদের ভিতর একগুঁয়েমি ও বিতৃষ্ণা এনে দিয়েছে। তারা এ বিধি-বিধান ভিতর থেকে মেনে চলার চেষ্টা করছে, কিন্তু পেরে উঠছে না। পারবেই বা কীভাবে? এসব বিধি-বিধানের মধ্যে চিরকাল মানুষ যে থাকতে পারে না। মানুষের জন্য মুক্তি অপরিহার্য। অন্যের দেয়া বিধানে নয়, কোনো শাস্ত্রীয় আইনে নয় নিজের তৈরি বিধি-বিধানে চলতে ভালবাসে মানুষ। এটা মানুষের সহজাত বৈশিষ্ট্য। মানুষ কঠোর বিধি-বিধান চায় না, চায় স্বাধীনতা। কিন্তু ধর্ম মানুষকে সেই স্বাধীনতা দেয় না।

এই বিধিবদ্ধ ধর্ম চর্চার কারণে, দীর্ঘদিনের স্বর্গের হুর-গেলমান, শরাব-সাকির স্বপ্ন মনের ভিতর জাগরুক রাখতে রাখতে সাধারণ মানুষ এসব কিছু পাওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে ওঠে। তখন তাকে যদি বলা হয়—ধর্মের নামে জিহাদ করো, হত্যা করো, লুণ্ঠন করো। ঝাঁপিয়ে পড়ো তুমি। মরণে ভয় করো? মরলে তো শহীদের মর্যাদায় স্বর্গের শ্রেষ্ঠতম রাজ্যটিতে স্থান পাবে। বিনিময়ে তো পাচ্ছো এক অনন্ত সমৃদ্ধ জীবন; যে জীবনের শুরু আছে, শেষ নেই। তারপর চোখ বন্ধ করে ভাবো। স্বর্গে তোমার জন্য অসংখ্য-অগুণিত হুর ও গিলমান শরাব হাতে দাঁড়িয়ে আছে। স্বর্গীয় কুরসিতে বসে তুমি তা পান করবে আর তারা তোমার মাথার উপর বীজন করবে।

যে ধর্মের জন্য তারা ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত, সেই ধর্মটিকেও তারা ঠিক মতো আত্মস্থ করার চেষ্টা করে না। কারণ, তারা যে নিম্নতর জ্ঞানের অধিকারী! অন্যের জ্ঞানেই যে পরিচালিত হয় তারা! ভাল-মন্দ তারতম্য করার সেই বোধ তাদের ভিতর যে নেই! তারা তো এরকম ছিল না। দীর্ঘদিন ধর্মের নির্দিষ্ট কঠোর বিধি-বিধানের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে থাকার ফলেই তো তারা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তারা মুক্তি পাচ্ছে না কিছুতেই। তাহলে মুক্তির জন্য কী প্রয়োজন? প্রয়োজন সেই উচ্চতর জ্ঞান, সেই উচ্চতর দর্শন। যে জ্ঞানের মাধ্যমে, যে দর্শনের মাধ্যমে সে প্রথমে নিজেকে চিনতে পারবে। স্ব-অর্জিত জ্ঞান অর্জনের পর তারা এই বলে পরিতাপ করবে—হায়, এতদিন তো আমি মারাত্মক ভুলের মধ্যে ছিলাম। কে ঈশ্বর? ঈশ্বর নামক কেউ তো কখনো ছিল না। আমিই তো ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ঈশ্বরকে সৃষ্টি করেছি। আমার বিবেকই তো প্রকৃত ঈশ্বর। যে ধর্মের জন্য আমি ধ্বংসে উন্মত্ত হয়েছি, প্রাণ বিসর্জনের জন্য প্রস্তুত থেকেছিÑ সেই ধর্মই তো মূলত অসার। স্বর্গ-নরক বলে তো কিছু নেই। আমার কু-প্রবৃত্তিগুলোকে দমিয়ে রাখার জন্যই তো আমার অগ্রজ মানুষরা আমাকে ধর্মীয় এই মন্ত্র শিখিয়েছেন।

পাঠক, এত বিধি-বিধান আরোপ করার পরও কেন ধর্মশাস্ত্রগুলো বারবার জ্ঞান অর্জনের কথা বলছে একবার চিন্তা করে দেখুন তো! কোরআনে বার বার বলা হচ্ছে—‘আমি জ্ঞানীদের জন্য ইহাতে উৎকৃষ্ট নিদর্শন রাখিয়াছি।’ কী সেই নিদর্শন? ভাল করে পাঠ করুন না একবার! সকল ধর্মশাস্ত্র কিন্তু রূপক। শাস্ত্রের বিষয়গুলো আক্ষরিক অর্থে নয়, রূপক অর্থে বিশ্লেষণ করুন। তাহলেই সেই শাস্ত্র প্রণেতাদের প্রতি আপনার মাথা নত হয়ে আসবে। তাহলেই লালনের মতো বলতে পারবেন : ‘বেদ বিধির পর শাস্ত্র কানা…।’

বেদ-তাওরাত-যাবুর-বাইবেল-কোরান-উপনিষদ-কিংবা গীতা কোনো ঐশ্বরিক গ্রন্থ নয়। এগুলো মানুষই লিখেছেন। লিখেছেন মানুষেরই কল্যাণার্থে। এ গ্রন্থগুলোর দুটো দিক রয়েছে : আক্ষরিক ও পারিভাষিক। বাস্তব ও রূপক। মানবিক ও আধ্যাত্মিক। আক্ষরিক মর্ম তাদের জন্য, যাদের জ্ঞান সীমিত। এ সমীতি জ্ঞানের মানুষদের জন্য শাস্ত্রপ্রণেতারা রূপকের আশ্রয় নিয়েছেন। সব কথা খোলামেলাভাবে বলেননি। বললে যে তারা বিপদগ্রস্থ হবে! তারা আক্ষরিকতার ভিতর দিয়ে আধ্যাত্মিকতা বা গুঢ়তত্ত্বে প্রবেশ করবে এমনটিই চেয়েছেন শাস্ত্রপ্রণেতারা। এতেই তাদের জ্ঞান পরিপূর্ণ হবে। শুরুতেই যদি তারা এর রূপকতাকে জেনে যায়, তাহলে তারা বিপথগামী হবে। ঈশ্বর কিংবা স্বর্গ-নরকের ভয় থাকবে না তাদের ভিতর। এ ভয় না থাকলে হেন অপরাধ নেই, যা তারা করতে পারবে না। কিন্তু যারা আক্ষরিকতার ভিতর দিয়ে আধ্যাত্মিকতায় পৌঁছে যায়, তাদের কোনো ভয় থাকে না। কারণ, প্রকৃত সত্যকে তারা জেনে যায়। পাপ-পূণ্য তাদের কাছে একাকার হয়ে যায়। তারা ইচ্ছে করলেই আর পাপ করতে পারে না। বিবেক তাদের বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তারা নিজেরাই নিজেদের নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে। এদেরকেই বলা হয় ‘ইনসানে কামিল’, ‘সুপারম্যান’ বা পরিপূর্ণ মানব।

অতএব, মানুষের মুক্তির একমাত্র শর্ত সেই উচ্চতর জ্ঞান অর্জন। এছাড়া মানুষের মুক্তি নেই। মুক্তি অসম্ভব। ঈশ্বর বলে কিছু নেই। তা মানুষেরই সৃষ্ট একটি সত্তা। এই সত্তাটিকে অতিক্রম করার মধ্য দিয়েই মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব।