আজ একুশে ফেব্রুয়ারি। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। দেশ মাতাকে আর আমার বাংলা ভাষাকে আজ অনেক অনেক শ্রদ্ধা জানাই। ফেসবুক ভরে দিয়েছি আমার ভালবাসা দিয়ে। আজ পত্রিকা, টেলিভিশন, রেডিও জুড়ে কত আয়োজন একুশ কে স্মরণ করব বলে। বিশেষ সংখ্যা, বিশেষ অনুষ্ঠান, আবৃত্তি-ভাষণ এ জাতীয় কত শত কর্মসূচী! রফিক, জব্বার, সালাম বরকতকে আজ শ্রদ্ধা, শ্রদ্ধা দেশমাতাকে, শ্রদ্ধা তার দেয়া বুলিকে, আমার বাংলা ভাষাকে। আমরা এমনকি গণস্বাক্ষরও করছি বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে গ্রহন করার জন্য। তো আসুন দেখে নেই আমাদের আশেপাশে কিভাবে পালিত হল এই মহান দিনটি ।
১. আজ একুশে ফেব্রুয়ারি। আজ ছুটির দিন। তাই ছুটির আমেজকে আরেকটু বাড়িয়ে তোলবার জন্য চাই গান। শুনলাম পাশের বাড়িতে কম্পিউটারে গান ছাড়া হয়েছে… “মুন্নি বদনাম হুয়ি”… “শিলা কি জাওয়ানি”… ইত্যাদি।
সে বাসার জনৈক দেশ ও ভাষা প্রেমিকের বোধহয় মনে পড়ে গেল আজ একুশে ফেব্রুয়ারি! তাই হঠাৎ আগের গান বদলে বাজতে শুরু করল, “আমি বাংলার গান গাই…
তা সেই প্রাক্তন সঙ্গীত শ্রবণকারীর এটা সহ্য হলনা, তাই আবার গান বদল। এবার “শিলা কি জাওয়ানি…”
আবার গান বদল। শেষ পর্যন্ত যে শব্দাবলি কর্ণগোচর হল তা ছিল এরকম, “আমি বাংলায় গান গাই, মাই নেম ইস শিলা, আমি বাংলার গান গাই, শিলা কি জাওয়ানি…”

২. আজ একুশে ফেব্রুয়ারি। একদল বাঙালির জন্য খুব গর্বের ও আনন্দের দিন। কারণটা আপনারা সবাই জানেন। সেটা হল, আজ তারা বহু প্রতীক্ষার পর সদ্য কেনা কালো বা সাদা শাড়ি এবং পাঞ্জাবি-ফতুয়া পরতে পেরেছেন। গতকাল অনেক রাত পর্যন্ত শাড়ির সাথে মিলিয়ে যে গয়নাগুলি কিনেছেন তা পরতে পারবেন। ২১শে ফেব্রুয়ারি বলে একটা ব্যাপার আছেনা? শুধু পাঞ্জাবি পরলে কেমন যেন সাদামাটা লাগে। তাই কালকের কেনা সাদাকালো ওড়না আজ গায়ে জড়িয়েছেন এইসব বাঙালিরা। কালো জিপসি ড্রেসের সাথে একুশের কালো ব্যাজও মানায় বেশ। একুশ আমাদের অহংকার, আমাদের দেশ ও ভাষা সবই আমাদের অহঙ্কার। তাই তো আজ শোকের রঙ্গে ছোপান কালো শাড়ি, পাঞ্জাবি,ফতুয়া, জামা কনেছি অনেক ফ্যাশন হাউজ ঘুরে ঘুরে।

কিছু বর্বরেরা বাঙালিদের নামে মিথ্যে কলঙ্ক ছড়ায়। বলে কিনা আমরা নাকি উৎসব করতে জানিনা, আমাদের নাকি স্বদেশ প্রেম নেই। দেখুননা আমরা আজ গায়ে পরে ঘুরছি অ, আ, ক, খ লেখা সাদা বা কালো শাড়ি বা পাঞ্জাবি বা ফতুয়া পরে? মাটির গয়না পরে? (তা আমাদের মোবাইলের কলার টিউন যতই হিন্দি গান থাকুক না কেন।) কেমন একটা উৎসবের দিন বানিয়ে ফেলেছি একুশে ফেব্রুয়ারিকে! এই দিন মানে আমাদের নতুন কাপড় পরে বাইরে বেরিয়ে হইচই করার দিন, হাসতে হাসতে বইমেলায় যাওয়ার দিন(বই কিনি আর না কিনি) একুশে ফেব্রুয়ারি কত জোসভাবে পালন করলাম সে স্ট্যাটাস কি যাবেনা ফেসবুকে?(তা নাই বা জানলাম এই দিনে ভাষা শহীদেরা এজন্য প্রাণ দেননি যাতে আমরা এ দিন উপলক্ষ্যে নতুন ফ্যাশনের কাপড় পরতে পারি)কারণ আজ একুশে ফেব্রুয়ারি। আমাদের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস! বাঙালি কি এই দিনে কম ঘটা করতে জানে?

৩. আজ একুশে ফেব্রুয়ারি। একুশে বইমেলায় তো যেতেই হবে। কারণ আজ যদি হূমায়ুন আহমেদ আসেন মেলায়? আচ্ছা উনি আজ আসবেন তো? “অন্যপ্রকাশ” থেকে বই কিনতে হবে কিছু। হূমায়ুন আহমেদের অটোগ্রাফ নেয়া যাবে তাহলে! আজ মেলা প্রাঙ্গন ভরে যাবে শাড়িপরা ললনায়। নিজের মানুষ যিনি তার সাথে হেঁটেও সুখ, আর নিজের কেউ না থাকলে অন্যদের দেখেও সুখ। অন্যদিন তো মেলা ভরে থাকে বেশির ভাগই অসুন্দর কিছু মানুষের ভিড়ে! আজ মেলায় যাওয়াটাও মজা। অনেক ছবি তোলা যায় রফিক চত্বর, সালাম চত্বর এগুলোর সামনে, বইমেলার সামনে। হাতে মুখে আজ বাংলাদেশের পতাকা, শহীদ মিনার এঁকে ঘোরার মজাই আলাদা। ফেসবুকে ছবি দেয়া যায়, ফেসবুকে লেখা যায় “aj amar ekusha boi malay giachilam, joss lagse melay ghurta, tsc ta ghurta,aj amar favourit writer er autograph nilam, dujona mila sharadin ghurlam…ekush tomay salam, rofik jabbar salam barkat der salam…ekush amar ahankar” ইত্যাদি ইত্যাদি।
শুধু এত কাজের মাঝে, এত ভিড়ের মাঝে বইটা কেনাই একটু ঝামেলার হয়ে যায় এই আর কি।

(লেখার প্রথমে যাদের কথা বললাম তারা হচ্ছে আমাদের ডিজুস প্রজন্ম যারা একুশ আসছে এটা জানতে পারে পত্রিকায় ফ্যাশন হাউজগুলোর বিজ্ঞাপন দেখে! এরা প্রতিনিয়ত অশুদ্ধ বাংলা তো বলে ও লেখে এবং সবচেয়ে দুঃখজনক হল ওরা ব্যাপারটি অনুভবই করেনা যে এটা সংশোধন করা দরকার।
অবশ্য তারা একুশে ফেব্রুয়ারিতে এটা উপলব্ধি করে “ভাষা শহীদদেড় কনট্রিবিউশন যে আমাদেড় লাইফ এ কতটা তা চিন্তারও বাইরে। তারা না থাকলে আমাদেড় নিজেদেড় মায়ের ভাষায় কথা বলা ইম্পসিবল হত। উই আর প্রাউড অফ দেম।”
আরো দুঃখজনক হল এরা নিজেদেরকে স্মার্ট প্রমাণ করতে বাংলিশ কথা বলে কিন্তু ইংরেজিটাও শুদ্ধভাবে বলতে পারেনা। তাদের অনেকের “ইস্মাট” কথাবার্তা শুধুমাত্র “ইয়া ইয়া, ইয়াপ, নোপ, লোলজ, গ্রেইট, ইয়ো ম্যান ” এর মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে! ওরা না বাংলা বলতে ও লিখতে পারে ঠিকভাবে, না পারে ইংরেজিতে কথা বলতে। অবশ্য হিন্দিটা বেশ ভালই বোঝে তারা।
এদের অনেকেই রবীন্দ্র সঙ্গীতকে ঘুমপাড়ানি গান মনে করে। এবং এটা মনে করে কোন রবীন্দ্র সঙ্গীত না শুনেই। এরা জানেনা হূমায়ুন আহমেদ ছাড়াও যে আরো লেখক আছেন। এরা জানেনা বইমেলায় যাওয়া মানে কিছু প্রচলিত জনপ্রিয় লেখকদের বই খুঁজে খুঁজে কেনা নয়, বরং বিভিন্ন প্রকাশনীর বিভিন্ন লেখকদের বইয়ের ফ্ল্যাপ দেখে সিদ্ধান্ত নেয়া সেখানে আগ্রহের কিছু আছে নাকি। আমি বলছিনা প্রচলিত লেখকদের বই কিনবেননা, হূমায়ুন আহমেদ ভক্তরা হয়ত আমার উপর ক্ষেপে যাবেন এতবার তার নাম নেয়ার জন্য, কিন্তু দয়া করে বোঝার চেষ্টা করুন আমি উনার লেখা নিয়ে কোন মন্তব্য করতে চাইছিনা, শুধু ডিজুস প্রজন্মের বইমেলার ও একুশে ফেব্রুয়ারির আসল চেতনা ধরতে না পারার ও উদ্ভট আচরণের সমালোচনা করছি। ওরা ৫০০ টাকার ফাস্টফুড খাবে তবু ১০০ টাকার বই কিনবেনা, বইমেলায় যাবে ঘুরতে(!)
সেদিন একজন জিজ্ঞাসা করেছিল আমি কার কার বই কিনলাম, তখন বললাম আহমদ ছফা, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, রাহুল সাংকৃত্যায়ন প্রমুখদের বইয়ের কথা। উত্তর আসলঃ কিরে তুই তো দেখি সব অজানা অচেনা লেখকদের বই কিনলি! এই হল অবস্থা। ওরা যদি না জানে আমাদের এত ভাল ভাল লেখকদের কথা, শিল্প সাহিত্যে চলচ্চিত্রে নাটকে আমাদের ভাল কাজগুলোর কথা তাহলে কি করে হবে। কেউ আবু সায়ীদের “অপেক্ষা” চলচ্চিত্রের কথা না জানলেও “থার্ড পার্সন সিঙ্গুলার নাম্বার” ঠিকই দেখে ৩/৪ বার! অনেকেই জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসানের নাম জানে শুনে শুনে কিন্তু অনেকেই হয়ত এস. এম সুলতানের নাম জানেনা। মানিক, রবীন্দ্রনাথ, হূমায়ুন আজাদ, আহমদ ছফা আহমদ শরীফ অনেকেই পড়েনি অথচ অনেকে শুধুমাত্র অন্যপ্রকাশের সব বই পড়েছে!
এরা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয় শাহরুখ খানকে দেখতে না পারার দুঃখে কেঁদে কেটে বা হাজার হাজার টাকার টিকেট কেটে শাহরুখ খানকে সামনে দেখে মূর্ছিতপ্রায় হয়ে। শাহরুখ খান তার ক্রিকেট টিমের জন্য কারো পেটের বাচ্চাকেও বুকিং দিয়ে রাখলে এরা হিন্দিতেই কৃতজ্ঞতা জানায়, গর্বিত বোধ করে শাহরুখের লাত্থি খায়ে, তার সাথে নেচে এবং হিন্দিতে কথা বলে।
বিশ্বসাহিত্যকেন্দ্রের পাঠচক্রে নির্বাচনের সাক্ষাতকারে আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারকে দেখে গদগদ হয়ে অনেকে বলে পাঠচক্রে আসার জন্য সে কত উৎসাহী অথচ নির্বাচিত হবার পর অবলীলায় প্রশ্ন করতে পারে “এখানে আসলে কি হবে?”
এরা আসলে ধরার জন্য সবসময় পা খোঁজে, অটোগ্রাফের খাতা ভরাতে কলম ধরা এক বিখ্যাত হাত খোঁজে, খোঁজেনা কাজকে, দর্শন বা ধারণাকে।
এদের নিয়ে এত কিছু লিখছি কারণ এরা কিন্তু কোনখানেরই হতে পারেনা।আমি শুধু ভাবি এই সঙ্কর প্রজাতির প্রাণীরা নিজেদেরকে কোথাকার বলে পরিচয় দেবে? এরা যেমন এদেশের শিল্প-সাহিত্য-চলচ্চিত্র-দর্শন সম্পর্কে জানেনা, তেমনি বিশ্বসাহিত্য-শিল্প-চলচ্চিত্র-দর্শনও জানেনা। আর নিজের দেশের কথা, অন্তত নিজের কথা নিজের প্রকৃতি জানার চেষ্টা না করলে বিশ্বকে কি করে চেনা যায়? তাই এরা শুধু জানে আমরা জওয়ান আমরা বাঙালি। তাই তাদের আচরণ এমন “মাই নেম ইজ বাংলা…বাংলা কি জাওয়ানি…”

একটা প্রজন্মের বড় একটি অংশ এমন অন্তঃসারশূন্য ব্যর্থ জীবন কাটিয়ে দিলে তাদের সম্পর্কে হতাশ না হয়ে উপায় আছে?
একুশকে সবসময় যারা আমাদের আমাদের ভাষাগত অস্তিত্বের রক্তাক্ত প্রসবের দিন হিসেবে দেখেছেন, শ্রদ্ধা করেছেন, বুঝেছেন আসলে একুশ আমাদের কি দিয়ে গেছে এবং ভাষাশহীদদের সামনে দাড়াবার জন্য প্রতিনিয়ত অন্তত নিজে বাংলা ভাষাকে শুদ্ধভাবে বলা লেখা ও এর চর্চা করে চলেছেন এবং অন্যদের মধ্যে এ ব্যাপারটি ছড়িয়ে দেবার চেষ্টা করছেন তাদেরকে জানাই শুভেচ্ছা।

শেষে শুধু একটা কথাই বলতে চাই, (কার কথা জানিনা, ব্লাডি সিভিলিয়ানের এই লেখা থেকে নেওয়া)

“ছিঃ ছিঃ ছিঃ একুশ কি পত্রিকা বাহির করিবার জন্য জন্মিয়াছিল? ছড়া, কবিতা, গল্প লিখিবার জন্য? আপনাদের কি একটু লজ্জা নাই, মৃতের প্রতি কৃতজ্ঞতা নাই, সম্ভ্রমবোধ নাই?…না পারিলে [থাকিলে], আর কিছু নয়-এই খেলা-খেলা একুশে ফেব্রুয়ারি বন্ধ করুন। সুবোধ বালকের মতো ঘরে বসিয়া থাকুন, পান চিবাইতে-চিবাইতে অফিস করুন, প্রেমিকাকে লইয়া টি-এস-সির চত্বর মধুময় করিয়া তুলুন। কিন্তু, খবরদার, সালাম বরকত জব্বারদের নাম মুখে আনিবেন না।”

)

*সবশেষে একটা অনুরোধঃ দয়া করে আদিখ্যেতা করে বইমেলায় ঘুরতে আসবেননা যদি বই না কেনার ইচ্ছে থাকে। সারা বাংলাদেশ পড়ে রয়েছে আপনাদের জন্য। শুধু ফেব্রুয়ারির ২৮ টি দিন (লিপ ইয়ারের সময় ২৯ দিন) আমাদের তীর্থে আমাদের বইয়ের জগতে অবাঞ্ছিতের মত এসে ঝামেলা করবেননা। একুশে বইমেলার অপমান হয় যখন আপনারা ফ্যান্টাসি কিংডমের সাথে এই মেলাকে নামিয়ে ফেলেন ঘোরার জায়গা হিসেবে(অবশ্য ফ্যান্টাসি কিংডমে আপনারা রাইড কেনেন, কিন্তু এই মেলায় অনেকেই বই কেনেননা)। আজ আমি দেখলাম মেলায় উপচে পড়া ভিড়। অথচ যারা বেরিয়ে আসছে তাদের মাঝে ৯৫% এর হাতে কোন বই নেই! প্লিজ আমাদেরকে ঝামেলায় ফেলবেননা, এ মেলাকেও অপমান করবেননা। এমনিতেই অপমান করে চলেছেন প্রতিদিন দেশকে, ভাষাকে, সংস্কৃতিকে, মানুষকে, এমনকি ইংরেজি ভাষাটাকেও যেটা অশুদ্ধ করে হলেও বলেন “ইস্মাট ও মডান” হতে।