যেকোন কথা যখন বায়বীয়-বিষয়াদির ভুল ঠিক-এ গড়ায়, আমার পক্ষে যুক্তি দিয়ে সে বিষয়ে কথা বলা তখন কঠিন হয়ে পড়ে। এবং আজকাল অধিকাংশ বিষয়ই গড়াচ্ছে ভুল ঠিক-এ। বাংলাদেশে হিন্দি ভাষায় গান শোনা ভুল কি ঠিক, হিন্দি সিরিয়াল দেখা ভুল কি ঠিক। তথাকথিত ‘ডিজ্যুস’ বা অপ্রমিত ভাষায় কথা বলা ভুল কি ঠিক। অপ্রমিত ভাষায় গল্প েলখা, ব্লগ লেখা, টিভি বা রেডিওতে অনুষ্ঠান করা ভুল কি ঠিক। এগুলোর উত্তর অনেকের কাছে তৎক্ষণাৎ আছে। অনেকেই জানে কি করাটা আসলে দরকার। আমার পক্ষে সেই ভুল-ঠিক বলাটা খুব কঠিন।
আমার মনে হয় না এখানে ভুল-ঠিক ধরে এগুনোটা ফলপ্রসূ। যদিও আমরা সে দৃষ্টিতেই ব্যাপারগুলোকে দেখে এসেছি। আমরা যদি আমাদের ভাষা আন্দোলনের দিকে তাকাই, সেখানে কি ভুল ঠিকের বিচার ছিল? নাকি এটাই প্রধান ছিল, মানুষের নিজস্ব চাওয়ার উপর কোন বিশেষ নির্ণীত চাওয়া চাপিয়ে দেওয়াটা সমস্যাজনক। আমার কাছে এটাই ইতিহাসের শিক্ষা। ভাষা আন্দোলনের শিক্ষা। এবং ঠিক এই শিক্ষাটাই আমাদের বর্তমান ভাষাদিবসের অনুভূতিতে অনুপস্থিত। এ কয়দিনে আমার আশেপাশের মানুষের ভাষাদিবসের অনুভূতিতে যা উদ্ধার করতে পারলাম: ১) হিন্দি না বলার প্রতিজ্ঞা, ২) অপ্রমিত বাংলা না বলার প্রতিজ্ঞা, ৩) বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠত্ব উদ্ঘাটন। এ সবের প্রতিই আমি শ্রদ্ধাশীল। ভাষাদিবসের অনুভূতি নিশ্চয়ই নিজের ভাষার প্রতি সচেতন হবার ধারণা দেয়। সেটা ছিল নিপীড়িতের শিক্ষা। কিন্তু এখানে কিন্তু না-নিপীড়িতেরও একটা শিক্ষাও থাকার কথা। আর তা হল অন্যের ভাষা অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধা করতে শেখা। সেটায় কিছু ঘাটতি দেখেছি বটে।
একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হবার পেছনে আমাদের একটা গর্ব কাজ করতে দেখা যায় যে “দেখো দেখো, ওই দিনটা কিন্তু আমাদের দিন।” এই অনুভূতিটাও ওই নিপীড়িতের অনুভূতি বা নিজের ভাষার প্রতি সচেতনতার অনুভূতির কাতারে পড়ে। আমাদের মধ্যে অন্যের ভাষা চর্চার প্রতি যে শ্রদ্ধা, তাতে মোটের উপর অভাব আছে।
নিপীড়িত তার নিপীড়নের অবস্থা থেকে উদ্ধার পাবার পরেও নিপীড়নের একটা আতঙ্ককে ধারণ করে রাখে অনেক সময়। এটা অনেকটা তেমনটাই। অনেকটা এমন, যেন বাংলা ভাষাটা যেকোন সময়েই আবার হামলা-আক্রমণের মুখে পড়ে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। ফলে বাংলার শ্রেষ্ঠত্ব অনেক সময় অনুভব করতে হয় হিন্দি, উর্দু, পাঞ্জাবির অবজ্ঞায়, যার চর্চা আমাদের হাসি ঠাট্টায়, খিস্তিতে, সাধারণ আড্ডায় আর ব্লগগুলোতে বিদ্যমান। সেগুলো নিজস্ব ভাষা সচেতনতার বেড়ে ওঠায় একটা পর্যায় পর্যন্ত গ্রহণযোগ্যই অনেকে বলবেন, এবং ভুল ঠিকের তর্কের ঝামেলা এড়াতে সেগুলো নিয়েও আমি তর্ক এড়াই।
তবে ভিন্ন এবং এক অর্থে আমার কাছে আবশ্যিক চেতনাটা, অর্থাৎ অন্যের ভাষার প্রতি শ্রদ্ধার যে চেতনা, সেটার যে অভাব আমাদের মধ্যে বিদ্যমান, সেটার সাথে নিজের ভাষার অতিসচেতনতা মিলেমিশে কিছু নির্ণয়যোগ্য-আগ্রাসী চেতনার সৃষ্টি হয়। সেটা আমাদের ভুলে থাকতে দেয় আমাদের দেশে বিদ্যমান ভিন্ন ভাষাভাষীদের নিজের ভাষায় কথা বলার অধিকারের কথা। অনেকটা মুসলিমপ্রধান দেশের মুসলমান তার নিজের ধর্ম সানন্দে পালনের সুযোগ থাকার পড়েও নিজের ধর্মের প্রতি তার অতিরিক্ত অতিসচেতনতা যেভাবে ভিন্নধর্মাবলম্বীদের ধর্মচর্চার সুযোগ-সুবিধার অভাব বা অবহেলাকে উপেক্ষা করতে সাহায্য করে। সেদিন বিপ্লব রহমানের লেখাটা পড়ে সেটা আবার খুব করে উপলব্ধি করেছি।
আরও সূক্ষ্ম বিষয় হচ্ছে অপ্রমিত ভাষার ব্যবহার। আজকে নাটক, সিনেমা, গল্প, কবিতা, ব্লগে ও মুখের ভাষায় অপ্রমিত ভাষার ব্যবহার অনস্বীকার্য। এটার অস্তিত্ব আছে। এবং এটা মানুষ জোর ক’রে করে তা আমি বিশ্বাস করি না। আমার মুখের ভাষাও প্রমিত না। আমার পাঠকদের অধিকাংশেরই তা না, আমি হলফ করে বলতে পারি। কিন্তু লেখার ভাষাটা প্রমিত রাখার একটা চল আমাদের শিক্ষা-ব্যবস্থায় আছে। ক্ষেত্রবিশেষে এটার প্রয়োজনীয়তা তর্কাতীত। কিন্তু নাটকে, গল্পে, সাধারণ আড্ডায়? চাই সে মিডিয়াতেই না হয় হলো। সেখানে মানুষ যখন জোর না করেই, স্বতস্ফূর্তভাবে অপ্রমিত ভাষায় কথা বলে, সেটাকে কি কেউ পারে আইন করে বন্ধ করে দিতে (সে চেষ্টা হয়েছে)? সেটা কি মানুষের মুখের ভাষা নয়? তবে অনেক ভাষা-সচেতন মানুষ আর তাদের সমর্থিত সরকারের এমন আচরণে আমি অবাক হই না। এই দ্বন্দ্বটা অস্বাভাবিক না আমার কাছে।
আর আরেকটা পর্যায় আছে – যারা সে অপ্রমিত ভাষায় কথা বলে তাদের প্রতি অবজ্ঞা। তাহলে তো চট্টগ্রামের মানুষকেও অবজ্ঞা করা চলে। আঞ্চলিক ভাষাকে অবজ্ঞা করার চলও একটা ছিল এককালে। অনেক সময় লেগেছে আঞ্চলিকভাষাগুলোর মর্যাদা ও স্বীকৃতি পেতে। এখন শহুরে অপ্রমিত ভাষাগুলো আঞ্চলিকভাষা নয় বলে কি আরো কিছু সময় অপেক্ষা করা লাগবে সেই মুখের ভাষাগুলোকেও শ্রদ্ধা করতে শেখার? ভাষাটা একটা ভিন্ন গোষ্ঠির হলে ঠিক আছে। একটা ভিন্ন অঞ্চলের হলে ঠিক আছে। কিন্তু আমার গোষ্ঠিতে এসে র-কে-ড়-করা যাবে না বাপু। হাস্যকর লাগে ভাবতে যে, যেদিন আজকের শহুরে অপ্রমিত ভাষাটা কেবল শ্রদ্ধার আসন নয়, বরং প্রমিতের মর্যাদা লাভ করবে, সেদিন সেই ভাষাভাষীরা নতুন কোন ‘অপ্রমিত’ ভাষাভাষীকেই আবার একইভাবে অবজ্ঞা করবে।
বুঝতে পারলামনা কোনটা ঠিক আর কোনটা বেঠিক।একবার চট্টগ্রামে গিয়ে খুব বিপদে পড়েছিলাম। যতই জিজ্ঞসা করি হামিদ লাইন কোথায়? উত্তের একটা কথাই বুঝ েত পারিছলাম অিক্সেজন। আিমতা জানতামনা অিক্সেজন েকান জায়গার নাম। েশষেমষ বলেত বাধ্য হলাম আমার বাড়
ী উত্তরবেঙ্গ, আিম আপনােদর কথা িকছুই বুঝেত পারিছনা। তারপর েস রক্ষা।
আমরা যারা মন্তব্য করছি, তাদের ভাষা এই থ্রেডেই যেন বিশেষ ভাবে রাবীন্দ্রিক, প্রায় “শেষের কবিতা”ভ। এর কারণটা কি?
@রৌরব, সবই বিবর্তন হতে শুরু করেছে বলে আমার ধারণা। অপেক্ষা করছি বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যার :))
@টেকি সওদাগর,
এর জন্য মুক্তমনার বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানীদের জন্য অপেক্ষা ছাড়া গতি নাই (H) ।
@টেকি সওদাগর,
প্রথমেই যে জিনিষটা পরিস্কার করা দরকার সেটা হচ্ছে যে , ভাষা কোন বিজ্ঞান নয়। এখন ভাষা কেন বিজ্ঞান নয় যেখানে ভাষার উপরে হাজার হাজার গবেষক এবং পান্ডিত্যপূর্ন গবেষনা জার্নাল পাওয়া যায় ?
সে প্রশ্নের উত্তরের জন্য দেখতে হবে যে, কোন কিছুকে বিজ্ঞান বলতে হলে তার একটা কেন্দ্রীয় এবং পরিস্কারভাবে সুসংজ্ঞায়িত তত্ত্বীয় কাঠামো থাকতে হয় যা নিয়ন্ত্রিত পরীক্ষার মাধ্যমে পুনরাবৃত্তি সহকারে খন্ডনযোগ্য। এখন কেন্দ্রীয় এবং পরিস্কারভাবে সুসংজ্ঞায়িত তত্ত্বীয় কাঠামো বলতে কি বোঝায় ? একটা উদাহরন দেয়া যাক:
যেমন , আপনাদের কেউ কেউ যে জিপিএস ব্যবহার করে থাকেন তাকে মহাশূন্যের কৃত্রিম উপগ্রহের আনবিক ঘড়ির উপর নির্ভর করতে হয় যা আবার বিশেষ এবং সাধারন আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্বের উপর নির্ভর করে। এখন এই আপেক্ষিকতবাদ পদার্থবিজ্ঞানের একটা অন্যতম কেন্দ্রীয় তত্ত্ব। শুধুামাত্র পান্ডিত্যপূর্ন গবেষনা জার্নাল হলেই তা বিজ্ঞান হয় না। এখন দেখা যাক ভাষার ক্ষেত্রে কি ঘটে।
যে কোন ভাষায় যে কোন শব্দের অর্থ নির্ধারিত হয় ভাষাভাষীদের ঐক্যমতের ভিত্তিতে , কোন অভিধান দিয়ে নয়। অভিধান শুধু দেখায় যে একটা শব্দের কতগুলো ভিন্ন , এমনকি পরস্পর বিরেধী অর্থ মানুষ ব্যবহার করছে যা অভিধান ঘাটলেই চোখে পড়বে।
একটা ভাষা সংজ্ঞায়িত হয় সেই ভাষার ব্যবহারকারীদের দ্বারা । কোন পন্ডিত বা অভিধান ভাষাকে সংজ্ঞায়িত করে না।সবচেয়ে বড় কথা , ভাষার সৃষ্টি এবং বিকাশের মূল উদ্দেশ্য যোগাযোগ মাধ্যম প্রতিষ্ঠা করা যাতে সহজে একজন মানুষ আরেকজনের কাছে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে। কুলীন পান্ডিত্য দেখানো ভাষা সৃষ্টির উদ্দেশ্য নয়।
@সংশপ্তক,
যদিও প্রসঙ্গটা আদিতে হালকা ধরণের ছিল, তারপরও আপনার কথার প্রেক্ষিতে কিছু বলি। ভাষা বিজ্ঞান নয় তো বটেই, কিন্তু ভাষা একটা প্রাকৃতিক phenomenon, গাছ থেকে আম পড়বার মতই। কাজেই সে বিষয়ে বৈজ্ঞানিক প্রশ্ন করা যেতে পারে। যেমন, এই মন্তব্যক্রমের প্রথমে আমার প্রশ্নটি একটি সম্ভাব্য বৈজ্ঞানিক প্রশ্ন (যদিও সে ভেবে আমি প্রশ্নটি করিনি)। এধরণের প্রশ্নের জবাব দেয়ার মত অবস্থায় বিজ্ঞান পৌঁচেছে কিনা সেটা ভিন্ন বিষয়।
@রৌরব,
ধন্যবাদ। শুধু ভাষা নয় , সংস্কৃতিও একটা প্রাকৃতিক phenomenon, গাছ থেকে আম পড়বার মতই। বিজ্ঞান মহলে এ ব্যপারে যথেষ্ট আগ্রহ লক্ষ্য করা যায় এবং এ নিয়ে প্রচুর কাজ চলছে । তিমি সহ কয়েকটা স্তন্যপায়ীদের ভাষা , সঙ্গীত এবং ব্যাকরণগত জটিলতা আবিস্কার এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। মানুষের ক্ষেত্রে বড় বাধাটা বৈজ্ঞানিক নয় বরং রাজনৈতিক কেননা রাজনৈতিক এবং দার্শনিকভাবে ভাবে মানুষকে ‘অতিপ্রাকৃতিক’ বলে এখনও বিবেচনা করা হয়। প্রশ্ন হচ্ছে যে, রাজনীতিক, দার্শনিক এবং ‘আঁতেলরা’ বিজ্ঞানের এসব অগ্রগতি কিভাবে গ্রহন করেন সেটা।
@রৌরব,
তা তো বটেই। অন্যান্য ক্ষেত্রের কথা জানি না। এআইতে ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং বলে একটা শাখা আছে (বা বলা যায় অন্য অনেক শাখার মত এআইতে এটি গবেষণার একটি বিশেষ শাখা)। সেখানে ভাষাকে মেশিনবোধগম্যভাবে লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়। বা বাক্যের উদ্দিষ্ট অর্থকে মেশিনসাধ্যভাবে পূর্বাভাসযোগ্য করে তোলার চেষ্টা করা হয়। যেহেতু ভাষা তত্ত্বীয়ভাবে তৈরি নয়, পরস্পরবিরোধিতা আছে, সংশপ্তক যেমনটি বললেন, তাই পদার্থবিজ্ঞানের অনেক শাখার মত নিখুঁতভাবে সূত্রবদ্ধ করাটা দূরাশা। স্ট্যাটিস্টিক্যাল বা ম্যাশিন লার্নিং অ্যাপ্রোচ নেয়া হয় সে কারণে। তারপরেও কনটেক্সচুয়াল নির্ভরতার জন্যে কনটেক্সটের বাইরে এনে অনেক বাক্যের বিশ্লেষণ প্রায় অসম্ভব। কিন্তু তার মানে এই নয় যে বাক্যের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ বা মেশিনবোধন অসম্ভব। কতটুকু পারা যায়, তার একটা সীমা আছে বটে। ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিংয়ের প্রকৃষ্ট উদাহরণ গুগল ট্রান্সলেট (উইকিভুক্তি) -ও তেমনি বেশ কার্যকর হলেও নিখুঁত আউটপুটের গ্যারান্টি নেই তার। কিন্তু অনেক ভাষার ক্ষেত্রেই যে ট্রান্সলেশান দেয় সে, অধিকাংশ সময় কাজ চলে যায়।
@রূপম (ধ্রুব),
গুগল ট্রান্সলেট বেশির ভাগ সময়ই চমৎকার কাজ করে 🙂 ।
পদার্থও কিন্তু তত্বীয়ভাবে তৈরি নয়, তত্বটা আমাদের (H) । আর পরিসংখ্যানের কথা বলছেন, স্ট্যাটিস্টিক্যাল পদার্থবিদ্যা ছাড়া পদার্থবিদ্যা নড়তে পারবে একচুল? ভাষা স্রেফ অনেক অনেক বেশি জটিল। :-[
@রৌরব,
পদার্থও কিন্তু তত্বীয়ভাবে তৈরি নয়, তত্বটা আমাদের (H) । আর পরিসংখ্যানের কথা বলছেন, স্ট্যাটিস্টিক্যাল পদার্থবিদ্যা ছাড়া পদার্থবিদ্যা নড়তে পারবে একচুল? ভাষা স্রেফ অনেক অনেক বেশি জটিল। :-[
ঠিক বলেছেন। অ্যাগ্রি!
জীববিজ্ঞানেও সেরকম স্ট্যাটিস্টিক্সের ব্যবহার নেই?
@রূপম (ধ্রুব),
বায়োস্ট্যাটিস্টিক্স , বায়োমেট্রিক্স ইত্যাদি। :-[
@সংশপ্তক,
ও তাই তো। আমি অবশ্য মলিকিউলার বায়োলজির কথা ভাবছিলাম।
আপনার উত্তর পেয়ে ভালো লাগলো। জীববিজ্ঞানে কাঁচা দেখে তো লোকজন আমার বোকা বোকা প্রশ্নের উত্তরও দিতে চায় না। 😉
@রৌরব,
জাতীয়তা, মৌলবাদ আর অবজ্ঞার দমবন্ধ চেতনা থেইকা বাইর হইয়া নতুনের উদার গ্রহণে একুশের চেতনারে যে পুনরায়িত করতে পারা গেছে, সেইটার যে মহৎ অনুভূতিগুলা, সেই অনুভূতিগুলা দিয়া ভাবলে হয়তো বুড়া লোকটার মত কইরা ভাবা হইয়া যায়। তয় ডিস্ট্রিউবিউটেড পুনর্জন্মবাদীরা এর থেইকা উত্তম কোনো অপব্যাখ্যা দিতে পারতে পারে।
@রূপম (ধ্রুব),
:))
@রৌরব,
এইটা কী কইলেন? দিস টাইম আমি সিরিয়াস্লি অফেন্ডেড হইসি 😉 ।
@বন্যা আহমেদ,
হে েহ।
প্রশ্নটা ঠিক প্রাসাঙ্গিক কিনা বুঝতেছিনা কিন্তু নিজের সাথে নিজেই বির্তক করে বেড়াচ্ছি কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল। আর ভাষা নিয়েই যখন কথাগুলো তাই ভাবলাম এখানে বলাটাই ভাল হবে 🙂
ঝামেলাটা শুরু হলো যেভাবে, আমাদের প্রিন্সিপাল একজন কর্নেল এবং আমাদের কলেজটা নতুন বলে এতটা নাম-ধাম নেই কিন্তু আমি বলব এটিও একটা সেরা কলেজ হতে চলেছে। কলেজে ঢুকার পর থেকেই লক্ষ্য করছি আমাদের প্রিন্সিপাল বাংলায় খুব কম কথা বলেন, তিনি সবার সাথেই ইংরেজিতে কথা বলেন। এটা ভাল করেন না মন্দ করেন সে নিয়ে আমি মাথা ঘামাইনি কখনো।
কিন্তু সেদিন ২১শে ফেব্রুয়ারিতে একটা ভাল কাদা ছোড়াছুড়ি হলো। সবাই কলেজ প্রাংগনে বক্তব্য দিচ্ছিল।
বাংলা পরিষদের একজন শিক্ষক বলছিলেন আমাদের রাষ্ট্রভাষা হলো বাংলা আর এটা পাওয়ার জন্যই এতকিছু কিন্তু আমারা যদি ২১শে ফেব্রুয়ারির বক্তব্যটাও ইংরেজিতে দেই তাহলে এর চাইতে বড় লজ্জা আর কি হতে পারে আমাদের জন্য?
এরপর আমি গেলাম, আমার আগে থেকে যা কিছু প্রস্তুত করা ছিলো সেগুলো বাদ দিয়ে আমি বললাম, আমি মনে করি ২১শে ফেব্রুয়ারি ছিলো ভাষার স্বাধিনতার জন্য, আমরা সেটা পেয়েছি। অন্তরে দেশপ্রেম থাকুক অটুট, আমি বাংলাই বলছি নাকি ইংরেজিতে বলছি সেটা নিয়ে ঝগড়া করে মরুক ভূড়িমোটা রাজনীতিবিদরা। আমি ছোট কিন্তু আমি আমার মত করে ভাবতে ভালবাসি, বাংলার প্রতি হীনমন্যতা অথবা বিদেশী ভাষার প্রতি ভালবাসা যদি আমাদের করে অন্ধ তাহলে আমাদের কাছ থেকে জাতির আর কিছুই থাকবে না আশা করার মত।
চলুন দেশকে ভালবাসি। দেশের একমুঠো মাটি পকেটে পুটলি করে নিয়ে ঘুরাকে আর যে যাই বলুক আমি এটাকে দেশপ্রেম বলি না। তেমনই বলিনা শুধু শুদ্ধ ভাষাতে কথা বলাকে। আমি যা বলতে চাচ্ছি তা হলো আমরা দেশপ্রেমের কথা ভুলে গিয়ে মারামারি করছি “দেশ-প্রেম” নাকি “দেশপ্রেম” হবে এটা নিয়ে।
আমিও “ইয়া, ইয়েস অথবা ইয়েপ” বলি কিন্তু বুকের ভিতরে স্বপ্ন নিয়ে ঘুরি, আমি নির্মাণ করবো “স্কুল গেম” পুরো বাংলাতে। আমার ছোট ভাইকে দিব ওর পুরো গনিত বইয়ের গেমিং সংস্করণ! দেশের বাচ্চাগুলো ইওরোপ-আমেরিকার এইসব জিনিস উপভোগ করতে পারেনা দেখে আমার কষ্ট লাগে।
দেশপ্রেম মানে দেশের মানুষকে ভালবাসা!
আমার কথাগুলো কি ভুল? আবার বলছি, আমি ছোটমানুষ, আমি শিক্ষার্থী, আমি শিখছি। ভাষা নিয়ে, বাংলায় কথা বলতে হবে নাকি ইংরেজীতে তা নিয়ে আমার ভাবনাগুলো এমন। কেও মন্তব্য করবেন?
@টেকি সওদাগর,
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ আপনার মনের কথাগুলো জানানোর জন্যে। আমার ছোটবেলার কথা, স্কুল কলেজের জীবনের কথা মনে করিয়ে দিলেন। 🙂
কি করেছি আমি তখন? কাঁচা-পাঁকা, যে অবস্থায় পেয়েছি, জ্ঞানের উপকরণকে গোগ্রাসে গিলেছি। অথৈ জ্ঞানক্ষুধা ছিল অন্তরে। আজও আছে। আজও শিখছি। শেখার শেষ নেই। প্রতিদিন নতুন বানান শিখছি, ভুলে যাওয়া বানান শিখছি। কোনটা বানানের নতুন সৃজন, সেটা নির্ণয় করতে পারতে তো আমাকে জানতে হবে, কোনটাকে প্রমিত বলা হয়। নতুন উদ্ভাবনের জন্যে আমাকে জানতে হয়, পুরাতন কোনটা। বাংলা, ইংরেজি, দুটোর ক্ষেত্রেই।
এটুকুই আপনাকে বলতে পারি, শেখার কোন বিকল্প নেই। আপনার প্রিন্সিপাল চোস্ত ইংরেজিটা বলতে পারেন দেখেই না, সেটার উপর ওনার এতোটা দখল দেখেই না, তিনি গর্ব করে সেটা বলেন! আর বাদবাকি যা থাকলো, কোনটা ভুল, কোনটা ঠিক, সেটা আপনি আপনার অর্জিত জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে নিজে খুঁজে নেবেন, জীবনভর। উত্তর খুঁজে পেলে সেটাকে আবার প্রশ্ন করবেন, আবার খুঁজবেন। ভয় নেই! পৃথিবীর অধিকাংশ (বা কোন) মানুষই জানে না ভুল ঠিকের সন্ধান। খুঁজে পাবার চেয়ে এই খোঁজাটা জীবনে বেশি জরুরি এবং সঙ্গি হয়ে থাকবে। আরেকটা ব্যাপার চমৎকার হবে, যদি সকলের নিজ নিজ খুঁজে পাওয়া ভুল-ঠিকগুলোকেও শ্রদ্ধা করা যায়, সেটা এমনকি আপনার প্রিন্সিপাল তার নিজের এই ইংরেজি বলার ভুল-ঠিক যেটা খুঁজে পেলেন সেটার প্রতিও। একটু কঠিন হলেও, এর জুরি নেই!
@রূপম (ধ্রুব),
ঠিক ধরেছেন। ইংরেজিতে বুঝতে কষ্ট হতো, অন্যদের বুঝাতেও কষ্ট হতো। এখন পেয়েছি মুক্তমনা। এখানে রাত দুটো ধরে পড়তে থাকি তানভীরুল ভাইয়ের লেখাগুলো অথবা অভিজিৎ ভাইয়াদের শীতল কিন্তু ভীষণমার্কা কমেন্টগুলো। :))
তবে জীববিজ্ঞানের উপর আর জীববিজ্ঞানের ম্যাডামের উপর বিরক্ত হয়ে কয়েকদিন আগে সারাদিন অফিসে দোড়াদোড়ি করে জীববিজ্ঞান বাতিল করলাম। এখন বুজতে পারছি, কি একটা জিনিস হারাইলাম, আগে যদি মুক্তমনা দেখতাম, আদে যদি জীববিজ্ঞানের আসল মজা পেতাম…ইসসস! :-X ব্যর্থতা আপনাদের! আমাদের বিজ্ঞানের মজা পেতে দিচ্ছেন না, আমি আমাদের স্কুল-কলেজগুলোর কথা বলছি।
তারপরেও আনন্দ যে আমার আঁধার দেরিতে হলেও কাটছে, সবেত ১৭ (H) 🙂
আপনার লেখাটা ভালো লাগলো। মানভাষার দরকার আছে সেটা অস্বীকার করছি না, কিন্তু আমার মতে আজকের যুগে যে কোন ভাষাকে টিকে থাকতে হলে তাকে ক্রমশঃ আন্তর্জাতিক মানের হয়ে উঠতে হবে, অন্যান্য ভাষার সাম্রাজ্যবাদী ( 🙂 ) আগ্রাসনের সাথে প্রতিযোগিতা করে নিজেকে টিকে থাকতে হবে, শুধু আবেগ দিয়ে আর ভাষা টিকিয়ে রাখা যাবে না। সারা পৃথিবীতে জ্ঞান বিজ্ঞান সাহিত্য অর্থনীতিসহ সব শাখায় যে নতুন নতুন কাজ এবং আবিষ্কারগুলো হচ্ছে, চারদিকে আলোর বেগে যে অগ্রগতিগুলো ঘটছে তার সাথে পাল্লা দিয়ে তাকে অভিযোজিত হতে হবে, উঁচুমানের সৃজনশীল অবদান রাখতে হবে, সেই সাথে সাথে পরিভাষা যোগ করতে হবে, নতুন নতুন শব্দের দ্যোতনা গড়ে তুলতে হবে। জনসংখ্যার দিক থেকে চিন্তা করলে আমরা পৃথিবীতে বেশ সামনের দিকে জাতি হিসেবেই পরিগণিত হব, তারপরও যদি আমাদের ভাষাটাকে সুস্থ বিকাশ এবং অভিযোজনের মধ্য দিয়ে টিকিয়ে রাখতে না পারি তাহলে সে ব্যর্থতা একান্তই আমাদের নিজেদের।
আর অন্যান্য জাতিসত্ত্বার উপর আমরা বাংলাভাষাভাষীরা যে আগ্রাসী ভূমিকা পালন করি তা শুধু আমাদেরকে ছোটই করে না, একুশের ব্যাপ্তি এবং অর্জনগুলোকেও বৃথা প্রমাণ করে দেয়। সেখানেই দুঃখটা…
@বন্যা আহমেদ,
আমি ভাষা সমৃদ্ধির দিকে সতর্ক না থেকেই বিভিন্ন রূপের অভিযোজনকে সুযোগ দেবার সম্ভাব্যতা নিয়ে আলোচনা করছিলাম, অনেকটা ভাষা-মৌলবাদের অসাড়তাকে মূলত ইঙ্গিত করে, অনেকটা উদার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। আপনার মন্তব্যের পর মনে হচ্ছে, এই বিভিন্নতার চর্চা নানা অকার্যকর জঞ্জাল তৈরির পাশাপাশি অভাবিত উন্নয়নের পথও খুলে দিতে পারে (কোনটা জঞ্জাল আর কোনটা উন্নয়ন, সেটা নির্ণয়ের ভার না নিয়েই কথাটা বলা যায় বৈকি 🙂 )।
ভাঙ্গার মাঝেই গড়ার শুরু!
@রূপম (ধ্রুব),
ভালো লাগলো লেখাটা। একটা মানভাষার হয়তো দরকার আছে, এবং সেটাকে রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য একদল নিয়ন্ত্রক থাকলেও মন্দ হয় না। সেটাকে শিক্ষা, সরকারী কাজ কর্মে বা বই লেখার জন্য সীমিত রাখাটাই মনে হয় যথেষ্ট। আর বাকিটা মুক্তবাজার অর্থনীতির মত মুক্ত অভিযোজনের হাতে ছেড়ে দিলেই ভালো। ধরুন ব্লগীয় ভাষা, ভাষার বিকৃতি, অন্য ভাষার প্রভাব এগুলো নিজেদের মধ্যে মারামারি কাটাকাটি করে যত্টুকু টিকে থাকবে ততটা পরবর্তীতে মানভাষায় যুক্ত করে দিলেই হল। আজকে রকেটের গতিতে বৈশ্বয়িক যোগাযোগ চলছে, সেখানে কোন একটা ভাষাকে টুটি চেপে আগলে রাখা কি করে সম্ভব। কোথায় যেন শুনেছিলাম রবীন্দ্রনাথের চলিত ভাষায় লেখেলিখি দেখে সেকালের ‘ভাষাগুরুরা’ ভাষা গেল ভাষা গেল বলে কান্নাকাটি করতেন:-) ।
@ফাহিম রেজা,
ভাষাটাও ধর্মের মত একটা অনুভূতি (একদম মোটা দাগে কথাটা বললাম, যে দাগে গিয়ে মিলটা পাওয়া যায়, সে দাগে)। কিন্তু এর সবই প্রায় ভালো। এই অনুভূতি থেকে হানাহানি বা ব্যাক্তিস্বাধীনতা লংঘনে সহজে যাওয়া যায় না কিনা।
ধর্মানুভূতির মত ভাষানুভূতিও মানুষের অন্যরকমভাবে হলেও প্রকট। ফলে ভাষা-মৌলবাদ একটা সসম্ভব ব্যাপার। ওতে কারও জীবন যায় না সচরাচর। তাই জোর কন্ঠে তেমন আপত্তিও নেই। যেমনটা রৌরব বললেন, ডিজুসীয় সহকারে ভাষার বিভিন্নরূপীতার অভিযোজনকে অভিনন্দন জানানোটা যে অনেকটাই নবীণ ধারণা হলেও অভাবনীয় বা হলফ করে বলার মতো ভাষা-শৃঙ্খলার ক্ষতিকারক নয়, সেটা নির্ণয় করার চেষ্টা করছি।
আপনার ভাবনাগুলো বেশ ভাল লাগলো। ভাষা নিয়ে এ ধরনের ভাবনা আমারো ছিল, এখনো আছে। আসলেই মান ভাষায় লেখাটা জরুরী কিনা সেটা সম্বন্ধে আমি নিশ্চিত নই। আজকে নাটক, সিনেমা, কিংবা আড্ডায় মুখের ভাষায় অপ্রমিত ভাষার ব্যবহার শুরু হয়েছে, তেমনি অনেকে লেখালেখিতেও অপ্রমিত ভাষা ব্যবহার করেছেন। আমি ব্রাত্য রাইসু, ভাস্কর সহ অনেককেই অপ্রমিত ভাষাতেই লিখতে দেখেছি। আমি নিজেও পরীক্ষা করার ছলে এক বার দুবার অপ্রমিত ভাষায় লেখালিখির চেষ্টা করেছি। বিল মারের রিলিজুলাস মুভিটা দেখার পর আমি আর বন্যা মিলে একটা রিভিউ করেছিলাম, সেটা আছে এখানে। আমার মনে হয় আস্তে আস্তে ভাষার এই কৃত্রিম দেয়াল ঘুচে যাবে। আমরা মুখের ভাষায় যেভাবে বলি, লেখ্য ভাষা অনেকটা সেরকমই হয়ে উঠবে। চিন্তা করুন ব্যাপারটা – আমরা আমাদের ছাত্র বয়সে সাধু ভাষায় রচনা পড়তাম, লিখতামও। সাধুভাষাই ছিল আমাদের লেখ্য রূপ। আর এখন – সাধু ভাষা কোথাওই খুঁজে পাওয়া যায় না – আসলে সাধু ভাষা মৃত। আজকের চলিত তথা মান ভাষাও যে দশ বিশ বছর পরে শাধু ভাষার মত পরিনতি বরণ করবে না, তা কে বলতে পারে?
আর সার্বজনীনভাবে আপনি লেখাটাতে যে স্ট্যান্ড নিয়েছেন, সেটা ব্যক্তিগতভাবে আমার পছন্দের। বিশেষ করে এই লাইনগুলো অমূল্য –
আমি খুবই একমত এ ব্যাপারটাতে। আমার মনে হয় মুক্তমনার অনেক সদস্যই এ ব্যাপারে একমত হবেন। সত্য বলতে কি – আমার মনে হয় মুক্তমনা ছাড়া অন্য কন ব্লগ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে আদিবাসীদের ভাষার অধিকার সম্বলিত কোন শ্লোগান হাজির করে ব্যানার করেনি, যেটা আমরা করেছিলাম। আপনি বিপ্লবের যে লেখাটার লিঙ্ক দিয়েছেন সেটা খুবই গুরুত্ব পূর্ণ। এর পাশাপাশি কিছুদিন আগে আরো একটি চমৎকার লেখা প্রকাশিত হয়েছিল নিঃসঙ্গ বায়সের –
ভাষা আন্দোলনের ভিন্ন প্রেক্ষিতঃ ইতিহাসের কিছু সুপ্ত বয়ান…
লেখক সেই লেখায় দেখিয়েছেন যে, আমরা যে খুব ঢালাওভাবে মনে করি কেবল বাঙালিরাই ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছে তা মোটেও সঠিক নয়। এই উপমহাদেশ ছাড়াও বিভিন্ন স্থানে মাতৃভাষা-নিজ সংষ্কৃতির জন্যে অনেক রক্ত ঝড়েছে।
একুশের চেতনা আসলে রূপান্তরিত হয়েছে মোটা দাগে জাতীয়তাবাদী চেতনায়। এর মধ্যে লাগানো হয়েছে দেশপ্রেমের আস্তরণ। আমি কিন্তু বারবারই বলি, দেশপ্রেম, স্বজাত্যবোধ এগুলোও একধরণের ডগমা। সেই ডগমার অন্ধবিশ্বাসে আমরা ভাবি আমাদের ইতিহাস এমনই ইউনিক যে বিশ্বাসের আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। একদিকে আমরা ভাষা আন্দোলন নিয়ে যার পর নাই গর্বিত থাকি, আবার একই হাতে আবার আদিবাসীদের উপদেশ দেই তাদের ভাষা সংস্কৃতি সব ভুলে গিয়ে ‘বাঙ্গালি হয়ে’ যেতে। তাদের গায়ে ট্যাগ লাগাই বিচ্ছিন্নতাবাদের। কী মহান আমাদের দ্বিচারিতা! এ কথাগুলোর দু’ চারটি নিঃসঙ্গ বায়সের লেখটাতেও কিছুটা বলেছিলাম।
@অভিজিৎ,
আপনারা তো দেখি বহু পাপেরই পুরান পাপী! আমিই বরং এখন পর্যন্ত এই প্রাঞ্জল ভাষাটা ব্যবহার করতে পারলাম কোন লেখায়।
একুশ বলুন, মুক্তিযুদ্ধ বলুন, প্রতিটাই সময়ের অতি জরুরি দাবীতে সংঘটিত হয়েছিল। কোন সংহত চেতনা তৈরি হয় নি সংঘটনের পূর্বে। দাবী মিটিয়ে ফেলার পরে অলস অসংগ্রামীরা প্রতিষ্ঠিত জাতীয়তার সুসময়ে বসে চেতনাগুলোকে নানাভাবে আবিষ্কার করেছে। তাই সেগুলোতে জাতীয়তাবাদকেই মূলত খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে যে, সেটাই স্বাভাবিক। জাতীয়তাবাদ, দেশপ্রেম এগুলো অবশ্যই ডগমা। সুবিধাবাদী ডগমা। আগ্রাসী ডগমা। কিন্তু নিপীড়নকালের অবয়বটা মিমিক করে বসে থাকে। অতীতের নিপীড়ককে যত্রতত্র কল্পিত নিপীড়ক হিসেবে বর্তমানে আনয়ন করে। সেটা সাহায্য করে বিদ্যমান সত্যিকারের নিপীড়িতকে না দেখতে পাবার। নিজের নিপীড়কের ভূমিকাগুলোকে অস্বীকার বা বৈধ করার।
একুশ আর মুক্তিযুদ্ধ চেতনার যে আদলটা এই জাতীয়তাবাদের আদলে গড়ে উঠেছে, সেটা আমরা একটা সময়ে অসতর্কভাবে গ্রহণ করে ফেলেছি। ফলে দেখবেন, মানবতাবাদী বা ব্যাক্তিস্বাধীনতাবাদী একটা ভাবধারা এই চেতনাগুলোর বাইরে তৈরি হচ্ছে। আরও হবে, আরও প্রকট করে দেখতে পাবেন। সেটার প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু জাতীয়তাবাদী চেতনাগুলো মৌলিক কারণেই মানবতা ও মুক্তচিন্তার ভাবধারা ধারণে অপারগ। সে অতীতের শত্রু র ভয়ে এখনো ভীত। ফলে মুক্তিযুদ্ধ আর মানুষের মুক্তি তার কাছে এক কথা না। মুক্তিযুদ্ধ মানে একই শত্রু , একটাই প্রলম্বিত জাতিগত সংগ্রাম।
কিন্তু একুশ আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে জাতীয়তাবাদীদের দখলে চলে যেতে দিব কেন আমরা, যারা আমরা মুক্তচিন্তায় ও সর্বোপরি মানুষের মুক্তিতে বিশ্বাস করি? তারা তো ঘটনাটা ঘটে যাবার পরে চেতনাটাকে এই বানানো রূপ দিয়েছে। একুশ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আমার কাছে মানবতার, মুক্ত চিন্তার আর মানুষের মুক্তির আদর্শ সঙ্গীন চেতনা। এই চেতনা সর্বদাই নিপীড়িতের পক্ষে, নিপীড়কের বিরুদ্ধে। জাতীয়তাবাদীরা দখল করেছে বলে সেই চেতনাগুলোর হিস্যা আমি ছেড়ে দিতে রাজি নই। বরং একুশের ও মুক্তিযুদ্ধের মানবতাপূর্ণ এই চেতনার আদলে আমি প্রয়োজনে জাতীয়তাবাদীদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-অপক্ষতা বিচার করতে প্রস্তুত।
গতকাল ফেইসবুকে লিখেছিলাম:
প্রমিত ভাষার দরকার কি, আসলে? আমার মতে, জাতি নির্মাণ (বা নির্মিত হয়ে গেলে ধরে রাখা), আর শিক্ষা ব্যবস্থা। প্রমিত ভাষা একটা নোঙর, যার চার দিকে অপ্রমিত ইনোভেশনগুলো একটি গাউসিয়ান কার্ভের মত বিস্তৃত হবে (আঞ্চলিক ভাষার ব্যাপারটা কিছুটা ভিন্ন)। এই বিস্তারিত হতে দেয়ায় সমস্যা দেখিনা। ক্ষেত্র বিশেষে নোঙরটিকে টেনে সরিয়েও হয়ত নেবে তারা, সেটাও বৈধ।
ডিজুস প্রজন্মের অন্য সত্যি বা কল্পিত সমস্যাকে দেখি ভাষার ব্যাপারটার সাথে জড়িয়ে ফেলা হয়। যেমন ধরুন, তারা হুমায়ুন আহমেদ ছাড়া কিছু পড়ছেনা, এটা সমস্য অবশ্যই, কিন্তু অন্তত কিছুদিন আগে পর্যন্তও হুমায়ুনের ভাষা যথেষ্ট প্রমিতই ছিল।
@রৌরব,
প্রমিত ভাষার প্রয়োজনীয়তার ক্ষেত্রের ব্যাপারে আমি আপনার সাথে একমত। গাউসিয়ান কার্ভের ভ্যারিয়েন্সের প্রতি উদারতা দেখালে সেটা একটা নির্মিত জাতির বিবিধ সম্ভাবনাকেই খুলে দেবে বলে ভাবা যায়। কিন্তু আমার কাছে প্রমিতের প্রয়োজনীয়তা বেশ সীমিতই মনে হয়। বিশেষ করে কথ্য ভাষায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় যে বোঝা গেলেই কাজ চলে যায়। বাকি আপত্তিগুলো কানের আরাম সংক্রান্ত। মানে সেগুলোর সাথে মূল্যবোধের মতো বায়বীয় বিষয়গুলোই বেশি জড়িত। ওগুলোকে ঠিক প্রকৃত সমস্যা মনে হয় না।
@রূপম (ধ্রুব),
কানের আরাম বা মূল্যবোধের বায়বীয়তায় আমি আপনার সাথে একমত। তবে…
বোঝা যায় কেন্দ্রে ওই নোঙরটা আছে বলে। প্রমিত বাংলার অস্তিত্ব এবং সেই অস্তিত্বের প্রায়োগিক ফল — বাংলা একাডেমি, খবর পাঠের ভাষা, শিক্ষার ভাষা, অভিধানে কি থাকবে না থাকবে তার নির্ণয়, রবীন্দ্রনাথ পড়ে বোঝার ক্ষমতা — সেগুলি থাকা দরকার বলেই মনে করি। কিন্তু মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রিত করার ভীষণ বিপক্ষে, সত্যি বলতে কি এসব ডিজুসিয় অভিযোজনকে অভিনন্দনই জানাই।
ভালো লাগলো আপনার ভাবনাগুলো।
আমার মনে হয় আমরা কার সাথে কী ভাষায় কথা বলি – মূল আপত্তিটা সেখানে নয়। মূল আপত্তিটা হলো প্রচার মাধ্যমে ব্যাপক হারে অপ্রমিত বাংলার ব্যবহার হতে থাকাটা। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় যারা কথা বলেন – তাঁরা অন্য অঞ্চলের মানুষের সাথে পারতপক্ষে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলেন না।
@প্রদীপ দেব,
এটা ঠিক বলেছেন। বা বললে অন্য অঞ্চলের মানুষরা যে ক্ষেদ প্রকাশ করে, শহুরে অপ্রমিত ভাষার প্রতি অনেকের ক্ষেদ অনেকটা সেরকমই, রকমের ভিন্নতার কারণে হয়তো প্রকাশটা অন্যরকম।
প্রচার মাধ্যম তারপরেও সে ভাষার লালন করে কারণ পরিশেষে সেটা তাদের একদল ভোক্তাদের মুখের ভাষাই। তাদের কানে নিশ্চয়ই সে ভাষা মধুরই শোনায়। যাদের শোনায় না, তাদের আপত্তি তোলাটাও অস্বাভাবিক নয়।
প্রথমত, প্রশ্নটা বোধহয় এভাবে উঠতে পারে যে, আসলেই আমাদের মান ভাষা কী বা মান ভাষা বলতে কিছু আছে কি না?
যদি ইতিবাচক হয় উত্তর, তাহলে সেটার সীমানা নির্দেশ করা যায় যদ্দূর সম্ভব, আবারো বলি, যদ্দূর সম্ভব। এবং, এর বিচ্যুতিটাই, যে কোন ভাবেই হোক, মান ভাষা থেকে বিচ্যুতি হিসেবে পরিগণিত হতে পারে।
আর যদি নেতিবাচক হয়, বা সত্যিকার অর্থে কোন মান ভাষার অস্তিত্ব নেই বলেই আমরা মনে করি, বা থাকার কোন প্রয়োজনীয়তা নেই বলেই মনে করি, তাহলে লড়াই হবে। লড়াইটা এক আঞ্চলিক ভাষা বা এর অপভ্রংশের সাথে অন্যটার হতে পারে। কিংবা, এখন যেটা আমরা ‘কলকাত্তাই বাংলা’ বলে ব্যাঙ্গাত্মকভাবে অভিহিত করি, সেটার সাথে ঢাকার ‘মেট্রো বাংলা’-র হতে পারে, কিংবা এর সাথে অন্য অঞ্চলের ভাষারও।
আপনার কথা সত্য ধরি যদি, তাহলে লেখ্য ভাষার মান বা মানদণ্ড আছে, কিন্তু কথ্য ভাষার নেই। এটাও কি সত্যি বা, প্রয়োজনীয়? আলোচনা চলুক।
আপনি সব ধরনের নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধবাদী। আমি ঠিক অতোটা নই, তাহলে বানানসংশোধন বা উচ্চারণানুগতার মতো সর্বজনগ্রাহ্য ব্যাপারগুলো ab initio void হয়ে পড়ে, বোধহয় আপনি এটা চানও না।
@ব্লাডি সিভিলিয়ান,
আসলে মানদণ্ডের অস্তিত্ব নিয়ে আমি অতোটা সতর্ক নই। লেখার ভাষার মান আছে, কথার ভাষার নেই, তেমনটাও আমার কথা থেকে বোঝা যায় কিনা নিশ্চিত নই। তবে অপ্রমিতের ব্যবহার বলতে আমি কথ্যের পাশাপাশি লেখ্যের কথাও বোঝাতে চেয়েছি। যদি সেটা বোঝাতে ব্যর্থ হই, এখন বলে নিচ্ছি।
বড় প্রশংসা হয়ে গেল। ইস্ এতটা প্রশংসার যোগ্য যদি আমি হতাম। 🙂
আমার মতে প্রমিতকরণে নিয়ন্ত্রণ আবশ্যক নয়। প্রস্তাবনা বা পরামর্শ আকারে আসাটাই যথেষ্ট। মানুষের সংঘবদ্ধ গোষ্ঠী মিলে প্রমিত আকার প্রস্তাব করতে পারে। একাধিক প্রমিতের অস্তিত্ব থাকতে পারে। বিশেষ সংগঠন বিশেষ প্রমিত আকারের সাথে তার সংশ্লিষ্টতা ঘোষণা করতে পারে। প্রমিত ভাষা ব্যবহারের যে কয়টি উপযুক্ত বা প্রয়োজনীয় ক্ষেত্র, তার সবকয়টি আমার মতে এই প্রপঞ্চে মেটানো সম্ভব। এর বাইরে সর্বজনগ্রাহ্যতার প্রয়োজনীয়তা একরকমের অতিরঞ্জন।
প্রমিত ভাষার একান্ত প্রয়োজনীয় ক্ষেত্র বাদে আর সব ক্ষেত্রে মানুষের যেমনটা ইচ্ছে হয় উচ্চারণের, শব্দ আনয়ন ও ব্যবহারের এবং লেখার স্বাধীনতার পক্ষে আমি। সেগুলোর দ্বন্দ্ব, রাগ-বিরাগ, পারস্পরিক অশ্রদ্ধা, অবজ্ঞা আমার কাছে বোধগম্য। কিন্তু ক্ষেত্রটা যে প্রমিতের প্রয়োজনীয়তার বাইরের অঞ্চলে, আমার ইচ্ছে পক্ষগুলোর কাছেও সেটা বোধগম্য হোক।
‘ড়’ ওয়ালাদের উৎপত্তি জানা যায় বা ধারনা করা যায়, কিন্তু খাইছি ওয়ালাদের কারনটা অনিশ্চিৎ। তাই আমার এদুটিকে এক মনে হয় না।
শেষের কবিতায়, অমিত রায়কে- অমিত ট্রয় বলার বাংরেজি উচ্চারনের ব্যপারটা যখন দেখি, তখন বুঝি এই রোগ সুপ্রাচিন।
ইদানিং আরো লক্ষ্য করছি, এই দুই গ্রুপের ব্যাপারটা আর শ্রেনীগত নেই। ওভার ল্যাপিং হচ্ছে আকছার।
বাকি সব ব্যাপারে একমত।
@আতিক রাঢ়ী,
ভালোই তো। শ্রেণীযোজন। 😉
@রূপম (ধ্রুব),
খারাপ না। :))
আচ্ছা এই অপ্রমিত ভাষার ব্যাবহার নিয়ে আমার একটা পর্যবেক্ষন আছে।
এইখানে দুইটা গ্রুপ আছে।
গ্রুপ ১)
খেয়েছি > খাইছি
আসছি > আসতেছি
গ্রুপ ২)
আমার > আমাড়
তোমার > তোমাড়
আমি নিজে প্রথম গ্রুপের সদস্য। ছোট বেলার বন্ধুদের আড্ডায় ‘খেয়েছি’ ‘আসছি’ বললে কি হবে ভাবা যায় না। কান ধরে আড্ডা থেকে বের করে দেয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না।
কিন্তু ভাই, ২য় গ্রুপ টারে দুই চক্ষে দেখতে পারিনা। এমনকি কথা বলতেই ইচ্ছা করে না। আর কি কি ইচ্ছা করে সেগুলি নাই বললাম। এই গ্রুপটারে
আমার কাছে বাংলা ভাষা নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগা গ্রুপ মনে হয়। ইংরেজি শব্দের শেষে R যেভাবে উচ্চারণ করা হয় সেটাকে অনুকরনের একটা অপচেষ্টা দেখতে পাই এদের মধ্যে।
আবার আমার নিজের গ্রুপ সম্পর্কে ঢাকার বাইরে থেকে আগতরা প্রচন্ড যুদ্ধাংদেহী। কিন্তু আমার গ্রুপটাকে আমার কাছে খুব নির্দোষ মনে হয়। আমরা যারা ঢাকায় বেড়ে উঠেছি তারাযে কখন, কিভাবে খাইছি, গেছি বলা শুরু করলাম তা বলতে পারবো না। তবে সেটা এই বিতর্ক শুরুর অনেক আগের ঘটনা।
নাটক বা গল্প যদি সমাজের দর্পণের কাজ করে তবে এটাতো সত্য যে এই ধরনের চরিত্র আছে, যারা এভাবে কথা বলে। কেউ যদি তার গল্পে বা নাটকে এই ধরনের চরিত্র উপস্থাপন করতে চায়, সেটাতে অমত করার কি আছে তা আমার মাথায় আসেনা।
অন্যদিকে সংবাদ পাঠক বা পাঠিকারা অবশ্যই প্রমিত বাংলা বলবেন। কারন তার কাজ হচ্ছে সর্বস্তরে সংবাদটা পৌঁছান।
শেষ পর্যন্ত কোন শব্দ প্রমিত হয়ে উঠবে, কোনটা বাতিল হয়ে যাবে, সেটা সময়ের উপরে ছেড়ে দেয়াই ভাল।
@আতিক রাঢ়ী,
সেদিন দেখলাম, একজন বলছেন, খেয়েছি কে খাইছি বলা যাবে, কিন্তু খাইসি বলা যাবে না। ভাষাবিশুদ্ধতাবোধ একটি সর্বগ্রাসী ভাবনা।
এখন ‘তোমাড়’কে আপনার যে ভালো লাগে না, সেটা না লাগার হক তো আপনার আছেই। এই বায়বীয় দ্বন্দ্বটা অনেকটা আবশ্যিক। তোমাড় বলনেওয়ালাদের সেই দ্বন্দ্বটা বোঝাপড়া করে নেবারও প্রয়োজন আছে। তবে সেটা করে নিতে পারলে আখেরে তাদেরই লাভ। তখন ‘হীনমন্যতায় ভোগা’-এর চাইতে আরও উত্তম কোন কারণে র-কে-ড় বলতে পারবে তারা, আরাম করে।
আমার নিজেরও ব্যক্তিগত ভালো ও খারাপ লাগা আছে বিভিন্ন প্রমিত ও অপ্রমিত ভাষাভঙ্গি নিয়ে। পশ্চিমবঙ্গীয় আর বাংলাদেশীয়ের মধ্যে কোন বাংলাটা ‘প্রমিত’ প্রমিত, সেটা নিশ্চিত নই। পশ্চিমবঙ্গের কথ্য ভাষাটা অনেক বেশি এফিশিয়েন্ট মনে হয় আমার কাছে। অন্তত ওই এক্সেন্টটা মিমিক করে আমার কাছে মনে হয়েছে অনেকগুলো শব্দ একসাথে দ্রুত বলা যায় প্রাঞ্জলভাবে। আবার বাংলাদেশীয় যে কথ্য প্রমিত ভাষা, সেটাকে আমার বরং হীনমন্যতায় ভোগা ভাষা মনে হয়। মুখের ভাষা খাইছি, গেছি বা অন্য কোন ‘আঞ্চলিক’ ভাষা, কিন্তু শহুরে ‘মার্জিত’ সামাজিকতায় সেটা নিয়ে সংকোচিত। সেই সংকোচটা যেন আরও প্রকোট হয় পশ্চিমবঙ্গীয় প্রমিত কথ্য ভাষাভাষীর সান্নিধ্যে। কিন্তু আবার তাদের বাচনভঙ্গিটা নিতে নারাজ। ফলে সেটা হয়ে ওঠে একটা বাংলাদেশীয় প্রমিত কথ্যরীতি। ঠিক কারও মুখের ভাষা না আবার। এই দেখার ভুল-ঠিক জানি না। আপনার কাছে র-কে-ড়-বলাটার মাঝে হীনমন্যতা দেখাটা যেমন, আমার দেখাটাও তেমন।
আর ঢাকাই অপ্রমিত ভাষার দুই গ্রুপ আমার কাছে একইরকম মনে হয়। দুটোই শহরের প্রমিত ভাষাটার কাছাকাছি থেকে কিন্তু দুটো ভিন্ন সামাজিক প্রেক্ষাপটে বেড়ে উঠেছে। দুজনেই কিন্তু নিজের বাচনঢঙ্গের কাছে ভাষাটাকে আপন করে নিয়েছে। ‘খাইছি’ বলা মানেই কিন্তু বলা যে ‘খাইছি’টা ‘খেয়েছি’র চেয়ে আমার কাছে বেশি আপন। সেটা বলেও যদি ‘খেয়েছি’টাকে শুদ্ধতর মানতে হয়, তাহলে ‘খাইছি’ নিয়ে, মানে নিজের মুখের ভাষা নিয়ে হীনমন্যতায় ভুগতে হয়। সেদিক দিয়ে ‘আমাড়’ বলারা বরং আরামে আছে। হীনমন্যতাটা নিজের মুখের ভাষাটা নিয়ে না অন্তত।
আবার অন্যদিক দিয়ে, খাইছিটা গেছি বলাটার উৎস ধরা কঠিন। কিন্তু আমাড় তোমাড়ে ইংরেজির প্রভাব সহজেই চোখে পড়ে। তো, তাতে খুব ফারাক পড়ে না আমার কাছে। যে বলে, তার মুখে আরাম লাগে, আমি অহেতুক হয়রান হই ক্যান? আমাড় তোমাড়টা একটা বাচনভঙ্গি। আঞ্চলিক বা গোষ্ঠিগত নয়, আর্থ-সামাজিক বাচনভঙ্গি। এই বাচনভঙ্গির প্রতি রাগ-ক্ষোভ সংশ্লিষ্ট-আর্থ-সামাজিক শ্রেণীটার প্রতি শ্রেণীগত ঈর্ষা বা ক্ষোভের সহিত বর্তমান থাকবে মনে হয়। যে কারণে আমরা ঠিকই বুঝি যে আমড়া বলনেওয়ালারা আমাদের নির্ণীত প্রমিত ভাষাটা নিয়ে হীনমন্যতায় আছে, আর খাইছি গেছি বলনেওয়ালারা খুব সম্ভব তাদের নিজেদের মুখের ভাষাটা নিয়েই হীনমন্যতায় আছে।
এই রাগারাগিটা ভালোই লাগে। কিন্তু সেটা আর মজার থাকে না, যখন গুরুতর লোকজন ভাষা-বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্যে মিডিয়ায় বা বাংলা একাডেমীতে হানা দেয়। বিশুদ্ধতাবাদিতার প্রতি কিছু মানুষের এই একমুখীভাবে এগোনোটাকে আমি দেখি সহনশীলতা বা ভিন্নদৃষ্টিতে দেখার অচর্চার ফলস্বরূপ। আমি তাদের চেয়ে বড় সমঝদার, বা তারা বড় ফ্যাসিবাদী চিন্তক, এমন কিছু মনে হয় না। তাই ভিন্ন-বিভিন্ন চিন্তা-ভাবনার চর্চা ও লালন পালনের দরকার। সেটাই করলাম। তারপর তো যত তর্ক কুতর্ক, মত অমত, ভালো লাগা না লাগা, রাগারাগি, অবজ্ঞা, সেটা আজকের মতই সত্য।
@রূপম (ধ্রুব),
এটা হবে, খাইছি লেখা যাবে, কিন্তু খাইসি লেখা যাবে না।