বাঙালি পদার্থবিজ্ঞানীদের মধ্যে দু’জন বসুর কথা আমরা অনেকেই জানি। তাঁরা হলেন স্যার জগদীশচন্দ্র বসু ও অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসু। জগদীশচন্দ্র বসু ছিলেন প্রথম বাঙালি পরীক্ষণ পদার্থবিজ্ঞানী – যাঁর কথা উঠলেই আমরা বাঙালিরা এই ভেবে কষ্ট পাই যে বেতার যোগাযোগে অগ্রগতি সাধনের জন্য ১৯০৯ সালে গুগলিয়েলমো মার্কনি ও কার্ল ফার্দিনান্দ ব্রাউন যে নোবেল পুরষ্কারটা পেয়েছেন তা আমাদের জগদীশ বসুরই প্রাপ্য ছিল। আর অধ্যাপক সত্যেন বসু ‘বোস-আইনস্টাইন সংখ্যায়ন’ (Bose-Einstein Statistics) ও বোসন কণার জন্য বিখ্যাত। সত্যেন বসুর ‘বসু-আইনস্টাইন ঘনীভবন’ (Bose-Einstein Condensation) সংক্রান্ত গবেষণার জন্য ২০০১ সালে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন কলরাডো ইউনিভার্সিটির এরিক কর্নেল (Eric Cornell) ও কার্ল ওয়াইম্যান (Carl Wieman) এবং এম-আই-টি’র ভলফ্গ্যাং কেটেরি (Wolfgang Ketterie)। এক্ষেত্রেও দুঃখ এই যে – যাঁর তত্ত্বের ওপর কাজ করে এতজন নোবেল পুরষ্কার পেলেন, সেই সত্যেন বসু নোবেল পুরষ্কার পান নি।
আমাদের আরো একজন বসু আছেন যাঁর নাম বাঙালিদের মধ্যে জগদীশচন্দ্র বসু বা সত্যেন বসুর মত অতটা ব্যাপকভাবে উচ্চারিত নয়, কিন্তু মহাজাগতিক রশ্মি, পারমাণবিক ও নিউক্লিয়ার পদার্থবিদ্যার গবেষণায় যাঁর অবদান অসীম – তিনি অধ্যাপক দেবেন্দ্রমোহন বসু [1]। তিনিই প্রথম ফটোগ্রাফিক ইমালশন পদ্ধতিতে ‘মেসন’ এর ভর নির্ণয় করেছিলেন। এ কাজের জন্য নোবেল পুরষ্কার তাঁরই পাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু এক্ষেত্রে তাঁর অবস্থাও আমাদের অন্য দু’জন বসুর মতই। তাঁর পদ্ধতি অনুরসণ করে মেসনের ভর নির্ণয়ের জন্য ১৯৫০ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী সিসিল পাওয়েল (Cecil Frank Powell)।
ময়মনসিংহের বিখ্যাত বসু পরিবারের সন্তান দেবেন্দ্রমোহন। স্যার জগদীশচন্দ্র বসু তাঁর আপন মামা। তদানিন্তন ব্রিটিশ ভারতে ময়মনসিংহ জেলার জয়সিদ্ধি গ্রামের বসু পরিবারের নাম-ডাকের কথা আমরা অনেকেই জানি। সে গ্রামটি বর্তমানে বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলার ইট্না উপজেলায়। এই পরিবারের পদ্মলোচন বসু ও উমাকিশোরী দেবীর দুই ছেলে- মোহিনীমোহন ও আনন্দমোহন। দু’জনই খুব চৌকশ। মোহিনীমোহন হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার হিসেবে খুব পসার জমিয়েছিলেন। তখনকার দিনে আমেরিকা থেকে পড়াশোনা করে এসেছিলেন। আর আনন্দমোহন বসুর কথা তো সব বাঙালিই জানেন। তিনিই প্রথম ভারতীয় যিনি কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির রেঙলার (wrangler) হয়েছিলেন। (কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির তিন বছরের গণিতের ট্রাইপোস্ কোর্স প্রথম শ্রেণীর অনার্স সহ সম্পন্ন করতে পারলে এই সম্মান পাওয়া যায়)। আনন্দমোহন বসু বাংলার সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃত, ব্রাহ্মসমাজের নেতা। ১৮৯৮ সালে আনন্দমোহন বসু ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি হয়েছিলেন। ময়মনসিংহের সরকারী আনন্দমোহন কলেজ এই আনন্দমোহন বসুর নামেই।
১৮৭০ সালে বসু পরিবার ময়মনসিংহ থেকে কলকাতার মেছুয়াবাজার স্ট্রিটের একটা বাড়িতে উঠে এলেন। তাঁদের বাড়ির দক্ষিণে থাকতেন কেশবচন্দ্র সেন, পশ্চিমে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর আর উত্তরে রাজা রামমোহন রায় [2]। মোহিনীমোহন বসুর সাথে বিয়ে হয় জগদীশচন্দ্র বসুর ছোট বোন সুবর্ণপ্রভার। ১৮৮৫ সালের ২৬শে নভেম্বর মোহিনীমোহন ও সুবর্ণপ্রভার সন্তান দেবেন্দ্রমোহন বসুর জন্ম হয়।
শৈশব থেকেই দেবেন্দ্রমোহন বাংলার বিখ্যাত সব বৈজ্ঞানিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্য পেয়ে বড় হয়েছেন। ১৮৯৮ সাল পর্যন্ত মামা জগদীশচন্দ্র বসু তাদের বাড়িতেই থাকতেন। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রও অনেকদিন ছিলেন তাদের বাড়িতে। শিবনাথ শাস্ত্রী, নীলরতন সরকার, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, লোকেন পালিত, সরলা দেবী, চারুচন্দ্র দত্ত, ভগ্নি নিবেদিতা – সবাই আসতেন তাঁদের বাড়িতে।
ব্রাহ্ম বালিকা বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু হলো দেবেন্দ্রমোহনের। বালিকা বিদ্যালয় হলেও প্রাথমিক পর্যন্ত সহশিক্ষা চালু ছিল সেখানে। হাইস্কুলের পড়া কাকা আনন্দমোহন বসুর প্রতিষ্ঠিত সিটি স্কুলে। এখান থেকেই এন্ট্রান্স পাশ করলেন দেবেন্দ্রমোহন। ১৯০১ সালে তাঁর বাবা মারা যান। অভিভাবক হিসেবে পাশে এসে দাঁড়ালেন জগদীশচন্দ্র বসু ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। দেবেন্দ্রমোহন এন্ট্রান্স পাশ করে ভর্তি হয়েছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর দ্রুত সংসারের হাল ধরতে হবে ভেবে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। ভর্তি হলেন শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা শুরু হলো। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই প্রচন্ড জ্বরে পড়লেন। ম্যালেরিয়ায় কাবু হয়ে ফিরে এলেন বাড়িতে। শিবপুরে আর ফিরে যাওয়া হলো না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরামর্শ দিলেন মামা জগদীশচন্দ্রের মত পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে পড়তে। দেবেন্দ্রমোহন পদার্থবিদ্যা আর ভূতত্ত্ব নিয়ে ভর্তি হলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে। প্রথম শ্রেণী পেয়ে বিএসসি পাস করলেন। ১৯০৬ সালে এমএ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হলেন।
জগদীশচন্দ্র বসু তখন বায়োফিজিক্স ও প্ল্যান্ট ফিজিওলজি নিয়ে গবেষণা করছেন। দেবেন্দ্রমোহন যোগ দিলেন জগদীশচন্দ্রের রিসার্চ গ্রুপে শিক্ষানবিশ গবেষক হিসেবে [3]। ১৯০৭ সালে দেবেন্দ্রমোহন পাড়ি দিলেন ইউরোপে। ভর্তি হলেন কেমব্রিজের ক্রাইস্ট কলেজে। কেমব্রিজে এসে দেবেন্দ্রমোহনের সুযোগ হলো ক্যাভেনডিশ ল্যাবে স্যার জে জে থমসন ও চার্লস উইলসনের সাথে কাজ করার। ১৯০৫-১৯০৬ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থবিদ্যায় এমএ পড়ার সময়েই দেবেন্দ্রমোহন থমসনের বই ‘এলিমেন্ট্স অব ইলেকট্রিসিটি এন্ড ম্যাগনেটিজম’ পড়ে চার্জের ক্ষেত্রে নিউটনের ভরের স্থিরতার সূত্র কাজ করছে না দেখে ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন। আগ্রহী হয়ে উঠছিলেন পদার্থবিজ্ঞানের এই নতুন শাখাটির দিকে [4]।
পদার্থবিজ্ঞানের জগতে তখন নতুন নতুন আবিষ্কারের উৎসব চলছে। পরমাণুর গঠন বদলে যাচ্ছে চোখের সামনে। তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কৃত হয়েছে। এক্স-রে আবিষ্কারের পর পরমাণুর অভ্যন্তরে দৃষ্টি দিচ্ছে বিজ্ঞানীরা। পরমাণুর অন্যতম উপাদান ‘ইলেকট্রন’ আবিষ্কার করে থমসন তখন পৃথিবীবিখ্যাত। নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন ১৯০৬ সালে। কিন্তু তখনো অনেকেই মেনে নিতে পারছিলেন না যে পরমাণুর চেয়ে ছোট কিছু থাকতে পারে। প্রমাণ স্বরূপ ইলেকট্রনের গতিবিধি সরাসরি দেখাতে পারলে কাজ হতো। কিন্তু ইলেকট্রনের আকার এত ক্ষুদ্র আর ভর এত কম অথচ গতিবেগ এত বেশি যে কিছুতেই ইলেকট্রনের বা ইলেকট্রনের গতিপথ সনাক্ত করা যাচ্ছিলো না।
ঠিক এই সময়ে দেবেন্দ্রমোহন এলেন কেমব্রিজে। ১৯০৮ থেকে ১৯১১ পর্যন্ত ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবে কাজ করেছেন। এ সময় থমসন নিয়ন গ্যাসের দুটো আইসোটোপ নিয়ে গবেষণা করেছেন। ১৯০৮ সালে আর্নেস্ট রাদারফোর্ড রসায়নে নোবেল পুরষ্কার পেলেন তেজষ্ক্রিয় পরমাণুর বিক্রিয়া ও পারমাণবিক বিভাজন সংক্রান্ত গবেষণার জন্য। রাদারফোর্ডই প্রথম হিলিয়াম নিউক্লিয়াস বা আল্ফা কণার বিকিরণ পর্যবেক্ষণ করেন। ১৯১১ সালে তিনি পরমাণুর নিউক্লিয়াস আবিষ্কার করেন। একই বছর থমসনের প্রিয় ছাত্র চার্লস উইলসন ‘ক্লাউড চেম্বার’ এর মধ্যে ইলেকট্রনের গতিপথ দেখাতে সমর্থ হলেন। এ কাজের জন্য উইলসন নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন ১৯২৭ সালে। ১৯১০ সালে দেবেন্দ্রমোহন লন্ডনের রয়েল কলেজ অব সায়েন্সে ভর্তি হলেন। ১৯১২ সালে এখান থেকে ডিপ্লোমা ও প্রথম শ্রেণীর অনার্স সহ বিএসসি ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯১৩ সালে কলকাতায় ফিরে এলেন দেবেন্দ্রমোহন। বাড়িতে তখন আনন্দের বন্যা। ধরতে গেলে বাড়িরই একজন – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন এ বছর। দেবেন্দ্রমোহন পদার্থবিজ্ঞানের প্রভাষক হিসেবে যোগ দিলেন সিটি কলেজে। ১৮৭৮ সালে এই কলেজটি স্থাপন করেছিলেন তাঁর কাকা আনন্দমোহন বসু। ১৮৮৩ সালে ময়মনসিংহে এ কলেজের একটি শাখা খোলা হয়। (সেদিনের সেই শাখা কলেজটিই বর্তমান আনন্দমোহন কলেজ)। সিটি কলেজে বেশিদিন ছিলেন না দেবেন্দ্রমোহন। ১৯১৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। দেবেন্দ্রমোহন নব-প্রতিষ্ঠিত সায়েন্স কলেজে পদার্থবিজ্ঞানের ‘রাসবিহারী ঘোষ প্রফেসর’ পদে যোগ দেন। এই পদে তিনি ছিলেন ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত।
বিজ্ঞান কলেজে যোগ দিয়েই উচ্চশিক্ষার জন্য ‘ঘোষ ভ্রমণ বৃত্তি’ পেলেন দেবেন্দ্রমোহন। ১৯১৪ সালেই রওনা দিলেন ইউরোপ। ভর্তি হলেন বার্লিনের হামবোল্ড ইউনিভার্সিটিতে। দু’বছর পড়াশোনা ও গবেষণা করলেন প্রফেসর এরিখ রিগনারের ল্যাবে। চার্জের একক নির্ভুলভাবে মাপার জন্য এরিক রিগনারের তখন খুব নামডাক। রিগনার দেবেন্দ্রমোহনকে কাজ দিলেন নতুন একটা ক্লাউড চেম্বার তৈরি করে আলফা ও বিটা কণিকার গতিপথ সনাক্ত করার [2]।
ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবের অভিজ্ঞতা কাজে লেগে গেলো দেবেন্দ্রমোহনের। উইলসনের কাছ থেকে শিখেছিলেন কীভাবে ‘ক্লাউড চেম্বার’ তৈরি করতে হয়। ‘ক্লাউড চেম্বার’ নামটা উইলসনের দেয়া। তিনি শুরুতে মেঘের সৃষ্টি কীভাবে হয় তা নিয়ে গবেষণা করছিলেন। উইলসন দেখেছেন – মেঘের মধ্যে যে জলকণা থাকে তা খুব ছোট ছোট ধূলিকণা এবং আয়নের (চার্জিত পরমাণূ) চার পাশে জমতে থাকে। কিন্তু বাতাসে যদি কোন ধূলিকণা বা আয়ন না থাকে তাহলে মেঘ জমতে পারে না। তখন বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ হয় স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি। ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবে উইলসনের পরীক্ষা পর্যবেক্ষণ করেছিলেন দেবেন্দ্রমোহন। ক্লাউড চেম্বারে ধূলি-মুক্ত বিশুদ্ধ বাতাস ঢুকিয়ে পিস্টনের সাহায্যে চেম্বারের মুখ বন্ধ করে দিলে চেম্বারের ভেতরের বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ হয় স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। তখন পিস্টনকে বাইরের দিকে টানলে চেম্বারের বাতাসের আয়তন বেড়ে যায়, ফলে তাপমাত্রা কমে যায়। তাপমাত্রা কমে গেলে বাতাসের অতিরিক্ত জলীয় বাষ্প জমে পানি হয়ে যায়। কিন্তু বাষ্প জমার জন্য কোন ধূলিকণা বা আয়ন না থাকলে বাষ্প জমতে পারে না। এ অবস্থায় চেম্বারের বিশুদ্ধ বাতাস হয়ে পড়ে ‘সুপার স্যাচুরেটেড’ বা অতিসম্পৃক্ত। সেই অবস্থায় কোন অব-পারমাণবিক (সাব-এটমিক) কণিকা চেম্বারে প্রবেশ করলে তার গতিপথের পরমাণুগুলো আয়নিত হতে থাকবে এবং সেই আয়নকে ঘিরে বাতাসের জলীয় বাষ্প জমতে থাকবে। ফলে অব-পারমাণবিক কণিকাগুলোর গতিপথে একটা জলবিন্দুর ধারা দেখা যাবে [5]।
দেবেন্দ্রমোহন উইলসনের পদ্ধতি অনুসরণ করে তৈরি করলেন নতুন ধরণের ক্লাউড চেম্বার। হাইড্রোজেন গ্যাস দিয়ে ভর্তি করা হলো চেম্বার। এরপর চেম্বারে পাঠানো হলো আলফা-কণার স্রোত। এই আলফা-কণা হাইড্রোজেন থেকে ইলেকট্রনকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। ঋণাত্বক চার্জের ইলেকট্রন হারিয়ে হাইড্রোজেন হয়ে পড়লো ধনাত্বক চার্জের প্রোটন। এই প্রোটনের গতিপথ সনাক্ত করতে সমর্থ হলেন দেবেন্দ্রমোহন। এখান ত্থেকে এরকম কণার মধ্যে সংঘর্ষের ফলে যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হয় তার একটা হিসেব পাওয়া গেল। এই কাজ দিয়েই পি-এইচ-ডি থিসিস লিখে ফেললেন দেবেন্দ্রমোহন। কিন্তু ততদিনে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে ইউরোপে। যুদ্ধের কারণে থিসিস জমা দিতে পারলেন না তিনি। পাঁচ বছর তাকে জার্মানিতে থাকতে হলো। প্রোটনের গতিপথ সনাক্তকরণের ওপর দেবেন্দ্রমোহন বসুর প্রথম বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় ১৯১৬ সালে – জার্মানির Physikalische Zeitschrift এ [6]।
ইউরোপে থাকার সময় তখনকার সময়ের বিখ্যাত অনেক বিজ্ঞানীর সংস্পর্শে আসার সুযোগ হয় দেবেন্দ্রমোহনের। ম্যাক্স প্ল্যাংক, আলবার্ট আইনস্টাইন, পিটার ডিবাই, ওয়ালথার নার্নস্ট, হেনরিখ হার্ট্জ, ম্যাক্স বর্ন, সামারফেল্ড – সবার বক্তৃতা শুনেছেন, সরাসরি অংশ নিয়েছেন তাঁদের সাথে বৈজ্ঞানিক আলোচনায় [7,8]।
১৯১৯ সালের মার্চ মাসে পিএইচডি সম্পন্ন করে দেশে ফিরে আসেন দেবেন্দ্রমোহন। যোগ দিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর আগের পদে। পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে তখন উজ্জ্বল সব ব্যক্তিত্ব – চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রমন, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহা, শিশির কুমার মিত্র প্রমুখ। দেবেন্দ্রমোহন এঁদের সবার সিনিয়র। সবাইকেই স্নেহ করেন খুব। নানারকম গবেষণায় উৎসাহ দেন। জার্মানি থেকে ফেরার সময় সত্যেন বসুর জন্য তিনি ম্যাক্স প্লাংকের দুটো বই (Thermodynamik and Warmestrahlung) নিয়ে গিয়েছিলেন যা তখন ইন্ডিয়াতে পাওয়া যেতো না। এ বই দুটো পড়ে সত্যেন বসু প্ল্যাংক এর কাজের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। প্ল্যাঙ্কের ব্যাখ্যার মধ্যে অসংগতি লক্ষ্য করেন এবং পরে সেই অসংগতি দূর করতে গিয়েই প্রকাশিত হয় সত্যেন বসুর বিখ্যাত তত্ত্ব।
ছাত্র-শিক্ষক নির্বিশেষে সবার বৈজ্ঞানিক কাজের প্রতিই সমান উৎসাহ ছিল দেবেন্দ্রমোহনের। একটা ঘটনা এখানে উল্লেখযোগ্য – ১৯২০ সালে ‘গ্রিফিথ মেমোরিয়েল প্রাইজ’ এর বিচারক নির্বাচিত হয়েছেন দেবেন্দ্রমোহন। প্রতিযোগীরা ছদ্মনামে বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ জমা দিতেন। বিচারে যেন কোন পক্ষপাতিত্ব না থাকে তাই এ ব্যবস্থা। হিলিওফিলাস (Heliophilus) নামে একজন প্রতিযোগীর রচনা পড়ে দারুণ উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন দেবেন্দ্রমোহন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন “Origin of Lines in Stellar Spectra প্রবন্ধটি এতটাই অসাধারণ যে সিদ্ধান্ত নেবার ব্যাপারে আমাকে একটুও ইতস্তত করতে হয়নি”। পরে জানা গেছে প্রবন্ধটি ছিল মেঘনাদ সাহার।
ইতোমধ্যে ডাক্তার নীলরতন সরকারের বড় মেয়ে নলিনীর সাথে বিয়ে হয় দেবেন্দ্রমোহনের। পাশ্চাত্য সঙ্গীতে পারদর্শী ছিলেন নলিনী। দেবেন্দ্রমোহন নিয়মিত খেলাধূলা করতেন। স্ত্রীর সঙ্গীত অনুরাগে অকুন্ঠ উৎসাহ ও সহযোগিতা দিয়েছেন দেবেন্দ্রমোহন।
১৯২৩ সালে দেবেন্দ্রমোহনের পি-এইচ-ডি গবেষণায় প্রাপ্ত গ্যাসীয় মাধ্যমে আলফা ও বিটা কণার গতি-প্রকৃতির বিস্তারিত প্রকাশিত হয় জার্মানির বিখ্যাত Zeitschrift fur Physik এ [9]। প্রবন্ধটি দেবেন্দ্রমোহনের সম্মতি নিয়ে প্রফেসর এরিখ রিগনারই পাঠিয়েছিলেন। দেবেন্দ্রনাথের এই গবেষণাপত্রটির গুরুত্ব অনেক। এ প্রবন্ধে তিনি দেখিয়েছিলেন কীভাবে পরিবর্তিত ক্লাউড চেম্বারের সাহায্যে আলফা ও বিটা কণার পাশাপাশি বিক্ষিপ্ত ইলেকট্রনের গতিপথেরও ছবি তোলা যায় [8]। আর্থার কম্পটন ও চার্লস উইলসন একই ধরণের কাজ করেছেন। পারমাণবিক বিক্ষেপণ তত্ত্বে (Atomic Scattering Theory) বিক্ষিপ্ত ইলেকট্রনের ‘কম্পটন ইফেক্ট’ আবিষ্কারের জন্য আর্থার কম্পটন নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন ১৯২৭ সালে। একই বছর উইলসনও নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন তাঁর উইলসন চেম্বারের সাহায্যে অপ-পারমাণবিক কণার গতিপথ সনাক্ত করে।
এখানে প্রশ্ন উঠতেই পারে যে জার্মানিতে এসে এত উন্নতমানের গবেষণা করেছিলেন দেবেন্দ্রমোহন, অথচ দেশে ফেরার পর তা চালিয়ে গেলেন না কেন? মূল কারণ – অর্থ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর ভারতে গবেষণার জন্য কোন অর্থ বরাদ্ধ ছিল না। দেবেন্দ্রমোহনের গবেষণার জন্য তেজষ্ক্রিয় পদার্থের দরকার। কিন্তু সেগুলোর অনেক দাম। শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবে দেবেন্দ্রমোহনের গবেষণা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। ১৯২৩ সালের ১০ মে তারিখে রাদারফোর্ডকে লেখা এক চিঠিতে দেবেন্দ্রমোহন লেখেন – “ইংল্যান্ড থেকে মাত্র ৫ মিলিগ্রাম রেডিয়াম ব্রোমাইড পেয়েছি যার অর্ধেকটাই আমাকে ব্যবহার করতে হয়েছে গামা-রেডিয়েশানের উৎস হিসেবে। পত্রিকায় পড়লাম বেলজিয়ামে রেডিয়াম আকরিকের একটা বড় খনি আবিষ্কারের ফলে রেডিয়ামের দাম কিছুটা কমেছে। কম দামে রেডিয়াম ব্রোমাইড কোথায় পাওয়া যাবে আপনি যদি দয়া করে আমাকে জানান আমি আপনার প্রতি অসীম কৃতজ্ঞ থাকবো। পর্যাপ্ত রেডিয়ামের অভাবে আমি এখন পঙ্গু হয়ে আছি” [8]।
১৯২৩ সালে দেবেন্দ্রমোহন তাঁর গবেষক ছাত্র এস কে ঘোষকে সাথে নিয়ে ক্লাউড চেম্বারে কৃত্রিম তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে কাজ শুরু করলেন। হিলিয়াম গ্যাসের মধ্যে পোলোনিয়াম থেকে উৎসরিত আলফা কণার গতিপথ পর্যবেক্ষণ করেন এবং নিউক্লিয়াস ও ইলেকট্রনের গতিপথের ছবি তোলেন। ছবিতে ধরা পড়লো যে নাইট্রোজেন নিউক্লিয়াস বিয়োজিত হয়েছে। বিখ্যাত নেচার সাময়িকীতে প্রকাশিত হলো তাঁদের তোলা ছবি ও গবেষণাপত্র [10]। আন্তর্জাতিক মহলে সাড়া পড়ে গেল। রাদারফোর্ড চিঠি লিখে অভিনন্দন জানালেন দেবেন্দ্রমোহনকে [2,8]।
আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক পরিমন্ডলে দেবেন্দ্রমোহনের গবেষণা স্বীকৃতি পেতে শুরু করেছে ১৯২৩ সাল থেকে। ভারতে নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞান গবেষণার সূচনা করেছেন তিনি। জার্মানির প্রফেসর হেবসি ও প্যানেথ “এ ম্যানুয়েল অব রেডিওএক্টিভিটি” নামে একটি ক্লাসিক বই লেখেন ১৯২৩ সালে জার্মান ভাষায়। ১৯২৫ সালে বইটির রাশিয়ান ও হাঙ্গেরিয়ান অনুবাদ বের হয়। ১৯২৬ সালে প্রফেসর লসন বইটির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করেন অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে [11]। বইটিতে দেবেন্দ্রমোহনের গবেষণাপত্রের উপর বিশদ আলোচনা করা হয়েছে। ১৯২৮ সালে জার্মানি থেকে প্রকাশিত ‘এনসাইক্লোপিডিয়া অব এক্সপেরিমেন্টাল ফিজিক্স – রেডিওএক্টিভিটি’ -র বিভিন্ন পাতায় দেবেন্দ্রমোহনের গবেষণালব্ধ ফলাফল আলোচিত হয়েছে [12]।
চৌম্বকত্বের গবেষণাতেও প্রচুর উল্লেখযোগ্য অবদান আছে দেবেন্দ্রমোহনের। চৌম্বকক্ষেত্রে ইলেকট্রনের ধর্ম পরীক্ষা করতে গিয়ে অনেকগুলো ফ্যাক্টর বিবেচিত হচ্ছিলো তখন। এম্পিয়ার, বার্নেট, আইনস্টাইন, ডি হাস, উলেনব্যাক, গুডস্মিট সহ অনেকেই কাজ করছিলেন তখন চৌম্বকত্বের সাথে ইলেকট্রনের প্রবাহ তথা বিদ্যুৎ এর সম্পর্ক নিয়ে। ১৯২৫ সালে চৌম্বকক্ষেত্রের প্রভাবে ইলেকট্রন-স্পিনের ওপর অনেকগুলো গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। ইলেকট্রন-স্পিন ব্যাখ্যা করে পাউলি তাঁর বিখ্যাত এক্সক্লুসান প্রিন্সিপাল (বর্জন নীতি) প্রকাশ করেন সেই বছর [13]। তিনি দেখিয়েছেন পরমাণুর ভেতর ইলেকট্রনগুলো বিভিন্ন কক্ষপথে অবস্থান করে এবং একই রকম কোয়ান্টাম অবস্থা সম্পন্ন দুটো ইলেকট্রন একই কক্ষপথে থাকতে পারে না। প্রায় একই সময়ে গটিনগেন ইউনিভার্সিটির প্রফেসর হুন্ড (F. Hund) পরমাণুর চৌম্বক ভ্রামক (magnetic moment) হিসেব করার একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেন [14]। দেবেন্দ্রমোহন দেখলেন হুন্ডের পদ্ধতি রেয়ার আর্থ গ্রুপের ত্রিযোজী ও চতুর্যোজী মৌলের ক্ষেত্রে সঠিকভাবে কাজ করলেও আয়রন গ্রুপের কোন আয়নের ক্ষেত্রেই সঠিক ভাবে কাজ করে না। তিনি বিখ্যাত নেচার সাময়িকীতে লিখে জানালেন এ কথা [15]। নতুন একটা পদ্ধতি আবিষ্কার করলেন দেবেন্দ্রমোহন যা হুন্ডের পদ্ধতির চেয়েও অনেক বেশি কার্যকর। ১৯২৭ সালে দেবেন্দ্রমোহনের এই গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে বিখ্যাত জার্মান সাময়িকী Zeitschrift fur Physik তে [16]। সে বছর লাহোরে অনুষ্ঠিত ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেসে চৌম্বকত্বের সাম্প্রতিক গবেষণা বিষয়ে বক্তৃতা করেন দেবেন্দ্রমোহন। চৌম্বকত্বের গবেষণায় ভারতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন দেবেন্দ্রমোহন। ফলে বিখ্যাত ‘কোমো কনফারেন্স’এ চৌম্বকত্বের ওপর বক্তৃতা দেয়ার আমন্ত্রণ পান দেবেন্দ্রমোহন।
ইতালীয় বিজ্ঞানী আলেসান্দ্রো ভোল্টা’র (১৭৪৫-১৮২৭) মৃত্যুর শতবার্ষিকী উপলক্ষে ইতালির লেক কোমো-তে ১৯২৭ সালের ১১-২০ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হয় এই কনফারেন্স। পৃথিবীর চৌদ্দটি দেশ থেকে ৬০ জন বিজ্ঞানী এখানে আমন্ত্রিত হন – যাদের মধ্যে ১১ জন ছিলেন নোবেল বিজয়ী। ভারত থেকে দু’জন বিজ্ঞানী এ সুযোগ পেয়েছিলেন- যাদের একজন দেবেন্দ্রমোহন এবং অন্যজন মেঘনাদ সাহা।
কোমো কনফারেন্সে দেবেন্দ্রমোহনের আমন্ত্রণ পাওয়া নিয়ে কেউ কেউ অনভিপ্রেত কিছু বিতর্ক সৃষ্টি করেছেন। ১৯৯৪ সালের ‘ইকোনমিক টাইম্স’ এর ৩১ মে সংখ্যায় সত্যেন্দ্রনাথ বসুর জন্মশতবার্ষিকী স্মরণে “দি রং বোস এট কোমো” শিরোনামে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব এস্ট্রোফিজিক্সের অধ্যাপক রাজেশ কোচার লিখেছেন কোমো কনফারেন্স কর্তৃপক্ষ ভুল করে সত্যেন বসুর বদলে দেবেন্দ্রমোহন বসুকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন [17]। কোন প্রামাণিক সূত্র উল্লেখ ছাড়াই লেখক ১৯৬৪ সালের একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেনঃ সত্যেন বসুর সত্তরতম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষে কলকাতায় আয়োজিত এক অনুষ্ঠানের বক্তৃতায় দেবেন্দ্রমোহন যখন ১৯২৭ সালের কোমো সম্মেলনের কথা উল্লেখ করেন – তখন মঞ্চে বসা সত্যেন বসু নাকি নিচুস্বরে বলেন যে – কোমো সম্মেলনে আসলে তাঁকেই (সত্যেন বসু) নিমন্ত্রণ করতে চেয়েছিল সম্মেলন কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ভুলে এস এন বসুর বদলে ডি এম বসুর নামে আমন্ত্রণপত্র চলে এসেছিল। ১৯৬৪ সালের এই ঘটনা নিয়ে তখন তেমন কোন আলোচনা হয়েছিল বলে জানা যায় নি। সত্যেন বসু কিংবা দেবেন্দ্রমোহন বসুর জীবদ্দশায় এ নিয়ে কোন বিতর্ক হয়েছিল কিনা তাও অজানা। আরো ত্রিশ বছর পর ১৯৯৪ সালে এসে লেখক সত্যেন বসুর কোমো সম্মেলনে আমন্ত্রণ পাবার পক্ষে যুক্তি দেখাচ্ছেন এই যে – ১৯২৪ সালে আলবার্ট আইনস্টাইনের সাথে বৈজ্ঞানিক সহযোগিতা স্থাপনের পর “বসু-আইনস্টাইন তত্ত্ব’ প্রকাশিত হবার প্রায় সাথে সাথেই বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিলেন সত্যেন বসু। যেহেতু জার্মান সাময়িকীতে সত্যেন বসুর প্রবন্ধ পাঠিয়েছিলেন আইনস্টাইন নিজে, তখন অসাবধানতা বশতঃ আইনস্টাইন প্রথম পেপারে শুধু ‘বোস’ লিখেই পাঠিয়ে দেন। পরে আইনস্টাইন নাকি সত্যেন বসুর কাজ উল্লেখ করতে গিয়ে ‘মিঃ ডি বোস’ বলে উল্লেখ করেন। কোমো সম্মেলনের আয়োজকরা নাকি সত্যেন বসুকে নিমন্ত্রণ করার জন্য আইনস্টাইনের পেপার ঘেঁটে ‘ডি বোস’ দেখে ‘ডি বোস’ এর নামেই আমন্ত্রণ পত্র পাঠিয়ে দেন। আর সত্যেন বসুর বদলে দেবেন্দ্রমোহন বসু কোমো কনফারেন্সে যোগ দেন [17]!
এই বিতর্ক যতটুকু ইচ্ছাকৃত তার চেয়েও বেশি অজ্ঞানতাবশত। আইনস্টাইন যখন সত্যেন বসুর গবেষণা-পত্র জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে প্রকাশের জন্য পাঠান – লেখকের নাম শুধু ‘বোস’ লেখা হয়েছিল ঠিকই – কিন্তু লেখকের ঠিকানা “ঢাকা ইউনিভার্সিটি, ইন্ডিয়া” লেখা ছিল। ২০০৯ সালে ওয়ার্ল্ড সায়েন্টিফিক থেকে প্রকাশিত সত্যেন বসুর রচনা সংকলন [18] দেখলেই ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে যায়। কোমো সম্মেলনের ছয় বছর আগে (১৯২১) থেকেই সত্যেন বসু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। অথচ আমন্ত্রণপত্র পাঠানো হলো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে! কোমো কনফারেন্সের মত এত উঁচুমানের একটা কনফারেন্সের আয়োজকরা সত্যেন বসুকে আমন্ত্রণ করতে চেয়েছেন অথচ তিনি কোন্ বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করেন তা জানতেন না এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? তাছাড়া আইনস্টাইনের কাছ থেকে ‘ডি বসু’র নাম পেয়ে থাকলে তাকে আইনস্টাইনের ‘অসাবধানতা’ বলা ধৃষ্টতার শামিল। আইনস্টাইনের সাথে দেবেন্দ্রমোহন বসুরও যে পরিচয় থাকতে পারে তা হয়তো ভাবতেও পারেন নি প্রফেসর রাজেশ কোচার [17]। কোমো সম্মেলনে যে ‘ভুল বসু’ নয় – ‘ঠিক বসু’ই যোগ দিয়েছিলেন তা জার্মানির ওল্ডেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর রাজিন্দার সিং বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করেছেন ২০১০ সালে প্রকাশিত তাঁর একটি প্রবন্ধে [8]।
সত্যেন বসুর সাথে পরিচয় হবার অনেক আগেই দেবেন্দ্রমোহন বসুর সাথে পরিচয় হয়েছে আইনস্টাইনের। দেবেন্দ্রমোহন যখন বার্লিনে পি-এইচ-ডি করছিলেন (১৯১৪-১৯১৯) আইনস্টাইন তখন বার্লিনে ছিলেন [19]। দেবেন্দ্রমোহনের সাথে বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে তাঁর। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসার পর ১৯২৩ সালে সত্যেন বসু ও মেঘনাদ সাহার একটা বই এর ব্যাপারে দেবেন্দ্রমোহনের সাথে পত্র-যোগাযোগ হয়েছে আইনস্টাইনের। আইনস্টাইন ও মিনকাউস্কির কিছু গবেষণাপত্র মূল জার্মান থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করে “দি প্রিন্সিপাল অব রিলেটিভিটি” বইটি লিখেছিলেন সত্যেন বসু ও মেঘনাদ সাহা। আইনস্টাইন শর্ত দিয়েছিলেন বইটি শুধু ইন্ডিয়াতে বিক্রি করা যাবে। কিন্তু বইটির কপি ইংল্যান্ডে পাওয়া যাচ্ছে জানতে পেরে আইনস্টাইন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেন ১৯২৩ সালের ২৮ জানুয়ারি। সিন্ডিকেট মেম্বার হিসেবে দেবেন্দ্রমোহন ৭ই মার্চ ১৯২৩ ইংরেজি তারিখে আইনস্টাইনকে চিঠি লিখে জানালেন – “ভাইস চ্যান্সেলর ও সিন্ডিকেটের সভায় আপনার চিঠিটি পেশ করা হয়েছে। সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে যে প্রিন্সিপাল অব রিলেটিভিটি বইটা ভারতের বাইরে বিক্রি করা হবে না। ইংল্যান্ডের বুক এজেন্সিকে বলে দেয়া হয়েছে যেন বইটার সব কপি ভারতে পাঠিয়ে দেয়। ইংল্যান্ডে বইটা বিক্রির ফলে আপনার যে অসুবিধা হয়েছে তার জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দুঃখ প্রকাশ করছে” [8]।
১৯২৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে প্রফেসর পদের অফার পেলেন দেবেন্দ্রমোহন। ১৯২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এই পদের জন্য দরখাস্ত আহ্বান করা হয়। তখনকার দিনে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আন্তর্জাতিক মানের প্রফেসরদের কাছে যোগ্য লোকের সন্ধান চাওয়া হতো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী আর্নল্ড সামারফেল্ডের মতামত জানতে চেয়েছিলেন সত্যেন বসু ও দেবেন্দ্রমোহন বসু সম্পর্কে। সত্যেন বসু ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের রিডার হিসেবে আছেন ১৯২১ সাল থেকে। সামারফেল্ড লিখেছিলেন- “দু’জনই যোগ্য। এস এন বসু বিখ্যাত তত্ত্বীয় পদার্থবিদ, ডি এম বসু চমৎকার পরীক্ষণ ও তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানী। আমি ডি এম বসুকে প্রাধান্য দিচ্ছি”। এদিকে সত্যেন বসুর ব্যাপারে সুপারিশ করেছেন স্বয়ং আইনস্টাইন। সিলেকশান কমিটি দেখলেন- সত্যেন বসুর উচ্চতর ডিগ্রি (পিএইচডি) নেই। অফার পাঠানো হলো দেবেন্দ্রমোহন বসুকে। সত্যেন বসু তখন শিক্ষাছুটি নিয়ে ইউরোপে। তাঁকেও অফার পাঠানো হলো এই শর্তে যে – যদি দেবেন্দ্রমোহন বসু অসম্মতি জানান তবেই তাঁকে (সত্যেন বসু) নিয়োগ দেয়া হবে [20]। দেবেন্দ্রমোহন বসু ঢাকায় যেতে অসম্মতি জানিয়েছিলেন।
১৯২৭ সালে ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেস এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন দেবেন্দ্রমোহন। কোমো কনফারেন্সে যাবার আগে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এক বছরের শিক্ষাছুটি নেন। কোমো কনফারেন্সের ১২ সেপ্টেম্বর বক্তৃতা দেন দেবেন্দ্রমোহন। বিষয় ছিল – “On the magnetic moments of ions of the transitional group of elements”। একই অধিবেশনে আরো বক্তৃতা করেছেন রাদারফোর্ড, স্টার্ন, ল্যাংগমুয়ের, ডি ব্রগলি, কম্পটন, ব্র্যাগ – প্রমুখ বিশ্ববিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী। দেবেন্দ্রমোহনের বক্তৃতা খুবই প্রশংসিত হয় [21]।
কোমো কনফারেন্সের পর দেবেন্দ্রমোহন ‘ব্রিটিশ এসোসিয়েশান ফর দি এডভান্সমেন্ট অব সায়েন্স’- এর সভায় অংশগ্রহণ করেন। ১৯২৮ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত ইংল্যান্ড, জার্মানি, ও নেদারল্যান্ডের বিভিন্ন ল্যাবে গবেষণা পর্যবেক্ষণ করেন তিনি। জটিল যৌগের চৌম্বকধর্ম নিয়ে পরীক্ষা করার সময় (১৯২৯) স্টোনারের তত্ত্বে (E. C. Stoner) ত্রুটি দেখতে পেয়ে সংশোধন করেন তিনি। স্টোনারের সূত্র তাঁর সংশোধনী সহ পরিণত হয় ‘বোস-স্টোনার’ তত্ত্বে [2]।
১৯২৯ সালে নোবেল পুরষ্কার মনোনয়ন কমিটি দেবেন্দ্রনাথ বসুর কাছ থেকে ১৯৩০ সালের পদার্থবিজ্ঞান/রসায়নে নোবেল পুরষ্কারের জন্য যোগ্য ব্যক্তির মনোনয়ন আহ্বান করেন। দেবেন্দ্রনাথ পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কারের জন্য মেঘনাদ সাহার নাম প্রস্তাব করেছিলেন [22]।
১৯৩৩ সালের ২৪ ও ২৫ এপ্রিল রয়েল ইনস্টিটিউশান অব লন্ডনের ফ্যারাডে সোসাইটির আমন্ত্রণে তরল স্ফটিকের (liquid crystal) ওপর বৈজ্ঞানিক আলোচনায় অংশ নেন দেবেন্দ্রমোহন। ১৯৩৫ সালে সি ভি রমন ব্যাঙ্গালোরের ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সের পরিচালক পদে যোগ দিলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘পালিত প্রফেসর’র পদ খালি হয়। দেবেন্দ্রমোহন ‘ঘোষ প্রফেসর’ পদ ছেড়ে ‘পালিত প্রফেসর’ পদে যোগ দিলেন। কারণ একটাই- ‘পালিত প্রফেসর’ পদে গবেষণার জন্য একটু বেশি টাকা বরাদ্ধ থাকতো। তিন বছর ছিলেন তিনি এই পদে।
১৯৩৭ সালের ২৩ নভেম্বর জগদীশচন্দ্র বসুর মৃত্যুর পর বসু বিজ্ঞান মন্দিরের পরিচালনার ভার এসে পড়ে দেবেন্দ্রমোহনের ওপর। ১৯৩৮ সালে দেবেন্দ্রমোহন বসু বিজ্ঞান মন্দিরের পরিচালক নিযুক্ত হন। ১৯৬৭ পর্যন্ত তিনি বসু বিজ্ঞান মন্দির পরিচালনা করেন। এসময় দেবেন্দ্রমোহন নতুন নতুন ডিপার্টমেন্ট খুলে প্রতিষ্ঠানের একাডেমিক ও গবেষণা কাজের ব্যাপক প্রসার ঘটান।
১৯৩৮ সালের একটি সায়েন্স কনফারেন্সে গিয়ে জার্মান নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞানী ওয়ালথার বোথের (১৯৫৪ সালে বোথে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন) সাথে আলাপের পর ফটোগ্রাফিক প্লেটের ওপর কসমিক রে বা মহাজাগতিক রশ্মির প্রভাব বিষয়ক গবেষণার উৎসাহ জাগে দেবেন্দ্রমোহনের। সহকর্মী বিভা চৌধুরির সাথে গবেষণা শুরু করলেন। তখনো পার্টিক্যাল এক্সিলারেটর আবিষ্কৃত হয় নি। ফলে অব-পারমাণবিক (সাব-এটমিক) কণার একমাত্র উৎস সূর্য। ওয়ালথার বোথে তাঁদের পরামর্শ দিলেন ফটোগ্রাফিক ইমালশনকে ক্লাউড চেম্বারে ডিটেক্টর হিসেবে ব্যবহার করে তার ওপর মহাজাগতিক রশ্মির গতিপথের ছাপ পড়ে কি না দেখতে। ফটোগ্রাফিক প্লেট ব্যবহার করলে তার ওপর স্থায়ী ছাপ আশা করা যায়।
১৯৩৯-১৯৪২ সালের মধ্যে দেবেন্দ্রমোহন ও বিভা চৌধুরি দার্জিলিং এর পাহাড়ে গিয়ে ইলফোর্ড হাফ-টোন ফটোগ্রাফিক প্লেটের ওপর দিনের পর দিন সূর্যালোকের বিচ্ছুরণ ঘটান। প্লেটের ওপর লম্বা বক্রাকার আয়নিত গতিপথ দেখতে পান। তাঁরা ব্যাখ্যা করে দেখান যে এগুলো প্রোটনের ট্র্যাক বা আলফা কণিকার ট্র্যাক থেকে ভিন্ন। তবে নিশ্চয় এরা অব-পারমাণবিক কণা ‘মেসোট্রন’ এর গতিপথ। তাঁদের ফলাফল প্রকাশিত হয় বিখ্যাত ‘নেচার’ সাময়িকীতে [23]। কিন্তু গতিপথগুলোকে তাঁরা ঠিকমত বুঝতে পারছিলেন না। তাঁরা আরো পরীক্ষা করার জন্য ফটোগ্রাফিক প্লেটগুলোকে এক নাগাড়ে ২০২ দিন সূর্যালোকে রেখে দিলেন। কিন্তু উচ্চ-শক্তির প্রোটন কণার গতিপথ দেখলেন না। তাঁদের গবেষণা এতই চাঞ্চল্যকর ছিল যে ‘নেচার’ সাময়িকীতে তা ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হতে থাকে [24]।
দেবেন্দ্রমোহন ও বিভা চৌধুরির গবেষণার প্রতি সবার এত আগ্রহের কারণ হলো অব-পারমাণবিক কণা ‘মেসোট্রন’ বা ‘মেসন’ এর আবিষ্কারের প্রত্যাশা। জাপানী পদার্থবিজ্ঞানী হাইডেকি ইউকাওয়া ১৯৩৫ সালে (নোবেল পুরষ্কার ১৯৪৯) তত্ত্বীয় ভাবে প্রমাণ করেছেন যে নিউক্লিয়ার বলের আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে কিছু নতুন ধরণের কণা বিনিময় হয় – যে গুলোকে ইউকাওয়া নাম দিয়েছেন এক্সচেঞ্জ পার্টিক্যাল (বিনিময়-কণা)। এই কণাগুলোর ভর হতে হবে ইলেকট্রনের ভরের চেয়ে সামান্য বেশি – কিন্তু প্রোটনের ভরের চেয়ে অনেক কম। ইউকাওয়া হিসেব করে দেখিয়েছেন যে এ ধরণের অব-পারমাণবিক কণার ভর হবে ইলেকট্রনের ভরের ২৭০ গুণ (প্রোটনের ভর ইলেকট্রনের ভরের ১৮৪০ গুণ) [5]। এদের ভর ইলেকট্রনের ভর ও প্রোটনের ভরের মাঝামাঝি বলে এদের নাম দেয়া হয় ‘মেসোট্রন’ – গ্রিক ভাষায় যার অর্থ ‘মধ্যবর্তী’। ‘মেসোট্রন’ থেকে আরো সংক্ষিপ্ত হয়ে এদের নাম হয় ‘মেসন’।
ইতোমধ্যে ক্যালটেকের প্রফেসর কার্ল এন্ডারসন ইলেকট্রনের ভরের সমান ভর ও ধনাত্মক চার্জ বিশিষ্ট পজিট্রন আবিষ্কার করেছেন। (এজন্য তিনি নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন ১৯৩৬ সালে)। একই বছর তিনি আরেক ধরণের অব-পারমাণবিক কণা আবিষ্কার করে ভেবেছিলেন সেগুলো ইউকাওয়ার মেসন। কিন্তু দেখা গেলো এন্ডারসনের কণাগুলোর ভর ইলেকট্রনের ভরের ২০৭ গুণ। ইউকাওয়ার মেসনের ভর ইলেকট্রনের ২৭০ গুণ। এন্ডারসন তাঁর কণাগুলোর নাম দিলেন ‘মিউ-মেসন’ বা সংক্ষেপে ‘মিউয়ন’।
দেবেন্দ্রমোহন ও বিভা চৌধুরি তাঁদের কণাগুলোর ভর হিসেব করে দেখলেন ইলেকট্রনের ভরের ১৬০ গুণ [25]। বুঝতে পারলেন কোথাও ভুল হচ্ছে। যে ফটোগ্রাফিক প্লেট ব্যবহার করছেন তা ‘হাফ-টোন’। কিন্তু যুদ্ধের বাজারে ভারতে বসে ‘ফুল-টোন’ প্লেট পাওয়া অসম্ভব। তবুও পরীক্ষণ পদ্ধতি যতটুকু সম্ভব নিখুঁত করে আবার পরীক্ষা করলেন। এবার কণাগুলোর ভর পাওয়া গেলো ইলেকট্রনের ভরের ১৮৬ গুণ [26]। দেবেন্দ্রমোহন বুঝতে পারলেন আরো উন্নতমানের আরো স্পর্শকাতর ফটোগ্রাফিক প্লেট ছাড়া তাঁদের পরীক্ষা চালিয়ে যাওয়া অর্থহীন। আক্ষরিক অর্থেই অর্থের কারণে তাঁরা কাঙ্খিত ফলাফল পেলেন না। ১৯৪৫ সালে বিভা চৌধুরি ইংল্যান্ডে চলে যান প্যাট্রিক ব্ল্যাকেটের সাথে কাজ করার জন্য। দেবেন্দ্রমোহন গবেষণা আর বেশিদূর চালিয়ে নিতে পারেন নি।
এদিকে ইংরেজ পদার্থবিদ সিসিল পাওয়েল দেবেন্দ্রমোহনের পদ্ধতি অনুসরণ করে পরীক্ষা শুরু করলেন বলিভিয়ায় গিয়ে। কসমিক রশ্মি এখানে ইংল্যান্ডের চেয়ে প্রবল। ইংল্যান্ডের ইলফোর্ড লিমিটেডএ অর্ডার দিয়ে উন্নতমানের ফটোগ্রাফিক প্লেট বানিয়ে নিয়েছেন পাওয়েল। পরীক্ষার ফলাফল হিসেব করে দেখলেন নতুন কণিকার ভর হয়েছে ইলেকট্রনের ভরের ২৭৩ গুণ। ইউকাওয়ার মেসনের ভরের সাথে প্রায় হুবহু মিলে গেছে পাওয়েলের ফলাফল। ১৯৫০ সালে এ কাজের জন্য তিনি নোবেল পুরষ্কার পান। পদ্ধতি জানা থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র উন্নতমানের উপাদানের অভাবে বাঙালির হাত ছাড়া হয়ে গেল আরো একটি নোবেল পুরষ্কার।
সিসিল পাওয়েল তাঁর ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত “The study of elementary particles by the photographic method” বইতে দেবেন্দ্রমোহন ও বিভা চৌধুরির অবদানের কথা স্বীকার করেছেন [27]। তিনি লিখেছেন, “In 1941, Bose and Choudhuri had pointed it out that it is possible, in principle, to distinguish between the tracks of protons and neutrons in an emulsion. The method was based on the difference for a given value of the residual range, in the momenta of particles of different mass. This has the consequences that the ‘scattering’ of the particles will be different, the smaller its mass, the more the track of a particle deviates from a straight line as it approaches the end of its range. Bose and Choudhuri exposed ‘half-tone’ plates at mountain altitudes and examined the scattering of the resulting tracks. They concluded that many of the charged particles arrested in their plates were lighter than protons, their mean mass being 200 me … the physical basis of their method was correct, and their work represents the first approach to the ‘scattering method’ of determining momenta of charged particles by observation of their tracks in emulsion”. পাওয়েল নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছেন যে দেবেন্দ্রমোহনের পদ্ধতি ছিলো এরকম পরীক্ষার পথ-প্রদর্শক।
ভারতে বিজ্ঞানের প্রসারে নিরলস কাজ করে গেছেন দেবেন্দ্রমোহন। ১৯৪৩ সালে প্ল্যানিং কমিশনের সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। সাথে ছিলেন মেঘনাদ সাহা, কে এস কৃষ্ণান, শান্তিস্বরূপ ভাটনগর। ১৯৪৫ সালে নিউক্লিয়ার কেমিস্ট্রি বিশেষজ্ঞ হিসেবে এটমিক এনার্জি কমিশনের সদস্য নির্বাচিত হন। লখনৌতে অনুষ্ঠিত ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন তিনি ১৯৫৩ সালে। সিটি কলেজের ব্যবস্থাপনার সাথেও জড়িত ছিলেন তিনি। দীর্ঘ আঠারো বছর বিশ্বভারতীর সাম্মানিক কোষাধ্যক্ষ ছিলেন দেবেন্দ্রমোহন। ২৫ বছর ‘সায়েন্স এন্ড কালচার’ ম্যাগাজিনের সম্পাদক ছিলেন তিনি। প্রেসিডেন্ট ছিলেন ইন্ডিয়ান সায়েন্স নিউজ এসোসিয়েশনের। এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতি ছিলেন। সমরেন্দ্রনাথ সেন ও সুব্বারাপ্পার সাথে যৌথভাবে সম্পাদনা করেছেন ভারতবর্ষের বিজ্ঞানের ইতিহাস। ‘ইন্ডিয়ান জার্নাল অব হিস্ট্রি অব সায়েন্স’ সাময়িকীর প্রধান সম্পাদক ছিলেন দেবেন্দ্রমোহন।
এটাই আশ্চর্যের যে এরকম একজন কর্মবীর এবং প্রথম সারির বিজ্ঞানী হওয়া সত্ত্বেও দেবেন্দ্রমোহন কেন যেন রয়ে গেছেন লোকচক্ষুর আড়ালে। তিনি যে প্রচারবিমুখ ছিলেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। নইলে যিনি জগদীশচন্দ্র বসু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আনন্দমোহন বসুর মত মানুষের উত্তরসুরি – শুধু জন্মসূত্রে নয় – নিজস্ব মেধা ও যোগ্যতায়ও – তিনি কেন তুলনামূলক ভাবে অপরিচিত-প্রায়!
১৯৭৫ সালের ২রা জুন দেবেন্দ্রমোহন বসু মৃত্যুবরণ করেন।
তথ্যসূত্রঃ
[1] Indian National Science Academy. Biographical memories of fellows of the Indian National Science Academy vol. 7,. Calcutta: INSC, 1983.
[2] শ্যামল চক্রবর্তী. বিশ্বসেরা বিজ্ঞানী. কলকাতা: শিশু সাহিত্য সংসদ
১৯৯৯.
[3] Indian Science Congress Association. The shaping of Indian Science: 1948-1981,. Calcutta: University Press, 2003.
[4] D. M. Bose. Indian J. Hist. Sci., 1967;2:62-70.
[5] Isaac Asimov. Understanding Physics,. New York,: Barnes and Noble Books,, 1966.
[6] D. M. Bose. Physikalische Zeitschrift, 1916;17:388-90.
[7] S. C. Roy. D. M. Bose: A Scientist Incognito. Science and Culture 2010;76 (11-12):491-3.
[8] Rajinder Singh. Celebrating 125th birth anniversary of DM Bose invitation to the Como Conference. Science and Culture 2010;76 (11-12):494-501.
[9] D. M. Bose. Zeitschrift fur Physik, 1923;12:207-17.
[10] D. M. Bose, S. K. Ghosh. Nature 1923;111:463-4.
[11] R. W. Lawson. A manual of radioactivity. London: Oxford University Press, 1926.
[12] W. Wien, F. Harms, editors. Handbuch der Experimental Physik – Radioaktivitat. Leipzig: Akademische Verlagsgesellschaft, 1928.
[13] W. Pauli. Zeitschrift fur Physik, 1925;31:765-83.
[14] F. Hund. Zeitschrift fur Physik, 1925;33:345-61.
[15] D. M. Bose. Nature 1926;117:84.
[16] D. M. Bose. Zeitschrift fur Physik, 1927;43:864-82.
[17] Rajesh Kochhar. The wrong Bose at Como. Economic Times, http://rajeshkochhar.com/tag/debendra-mohan-bose/,, 1994.
[18] kameshwar C. Wali, editor. Satyendra Nath Bose His Life and Times. Singapore: World Scientific, 2009.
[19] প্রদীপ দেব. আইনস্টাইনের কাল. ঢাকা: মীরা প্রকাশন, ২০০৬.
[20] A. Harun ar Rashid. Satyen Bose in Dhaka. Dhaka: University of Dhaka, 1994.
[21] D. M. Bose. On the magnetic moments of ions of the translational group of elements. In: Congresso internationale dei Fisici. Bologna: Nicola Zanichelli, 1928. pp. 119-25.
[22] Rajinder Singh. Notes. Rec. R. Soc. London, 2007;61:333-45.
[23] D. M. Bose, B. Chowdhury. Nature 1940;145:894-5.
[24] D. M. Bose, B. Chowdhury. Nature 1941;147:240-1.
[25] D. M. Bose, B. Chowdhury. Nature 1941;148:259-60.
[26] D. M. Bose, B. Chowdhury. Nature 1942;149:302.
[27] Cecil Frank Powell. The Study of Elementary Particles by the Photographic Method,. London: Pergamon Press, 1959.
খুব ভাল লাগল আমার কাছে অজানা এই বিজ্ঞানীর জীবন ও কাজের কথা পড়ে। ভাবতে আসলেই অবাক লাগে তখন কিরকম বিশ্বমানের বিজ্ঞানী ও মানুষ পেয়েছি আমরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দেয়ার ব্যাপারে যে উচ্চমানের রিকোয়্যারমেন্ট দেখলাম তা দেখে আরো ঈর্ষা হচ্ছে সেই সময়কে। এখন ভাল শিক্ষকেরা দেশে থাকেননা। অনেক শিক্ষক আছে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যাদের মান, আমাদের প্রতি শিক্ষক হিসেবে দায়িত্বের প্রতি অবহেলা, আমাদের শিক্ষাজীবন নিয়ে খেলাধূলা দেখে আমরা অনেকেই হতাশ হয়ে পড়ছি।
যে আমি ছোটবেলা থেকে পাগল হয়েছিলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ব বলে, সেই আমি এখন হতাশ। তবে অনেক ভাল শিক্ষকও আছেন, তবে তাদের অনেকেরই ক্লাস পাইনি এখনো, কেউ কেউ ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের মত বিদেশে চলে যাচ্ছেন ঠিক যখন আমাদের তাদের ক্লাস পাবার সময় এসেছে ;-(
প্রদীপ দেব, লেখাটার জন্য অনেক ধন্যবাদ। আপনার কাছ থেকে এ ধরণের আরও অনেক লেখা আশা করছি।
সুন্দর লেখা।আমার কাছে খুব আশ্চর্য লাগে এই ভেবে যে, হাজা্রো প্রতিকূলতার মধ্যেও পরাধীন দেশে একশো বছর আগে আমরা একগাদা বিশ্বমানের বাঙালি বিজ্ঞানী পেয়েছিলাম, অথচ স্বাধীন দেশে এসে মাত্র একজনকেও পেলাম না। কষ্ট!
এই অসাধারণ মনীষীর একেবারেই অদেখা জীবনচিত্র বিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে তুলে ধরার জন্যে আপনাকে শ্রদ্ধা।
এবং, তাঁকেও।
@ব্লাডি সিভিলিয়ান,
অনেক ধন্যবাদ।
এখানে অপ্রাসঙ্গিক হলেও আবারো একই প্রশ্ন করছি আপনাকে – যা আরো একবার করেছিলাম অনেক দিন আগে – কেন আপনার ছদ্মনাম ‘ব্লাডি সিভিলিয়ান’? বাংলা ভাষা প্রসঙ্গে আপনার প্রাণবন্ত লেখাটা পড়লাম একটু আগে। প্রমিত বাংলা ব্যবহারে ক্ষেত্রে আপনার সাথে সম্পূর্ণ একমত আমি। আপনাকে ‘ব্লাডি সিভিলিয়ান’ বলে সম্বোধন করতে অস্বস্তি হয় আমার।
খুব ভালো লাগলো প্রদীপ দা। আপনার লেখনীতে কাঠখোট্টা বর্ণের সমাহার ভেঙে কখন যে প্রাণবন্ত, স্পন্দনশীল হয়ে ওঠে টেরই পাই না। একমনে পড়ে ফেলা যায় অনায়াসেই।
জীবনী যে শুধু জন্ম-মৃত্যু, বিবাহের বর্ণনা নয়, বাপের বাড়ি, মায়ের বাড়ির জমিদারি প্রথার বয়ান নয়, আত্মীয়স্বজনের আত্মম্ভরী পরিচয় নয়, এর বাইরে গিয়েও যে একজন ব্যক্তির কর্ম, জগৎ, দর্শন নিয়ে জীবনী লেখা যায়, তা বোধহয় আপনার চেয়ে কেউ বেশি জানে না।
@অনন্ত বিজয় দাশ,
অনেক ধন্যবাদ অনন্ত।
কেন যে লজ্জা দেন আমাকে।
দেবেন্দ্রমোহন স্বীকৃতি পান নি-এই কথাটা ঠিক না। কলকাতা সহ ভারতীয় নানান বিজ্ঞান সংস্থায় তার নামে হল বা ল্যাবেরটরী আছে।
উনি কোলকাতায় বোস ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতাও। শেষ বয়সে “বিজ্ঞান এবং ধর্ম” নিয়ে কিছু অপকর্ম এবং কিছু শুভকর্ম ও করেছেন। সেই অপ্রীতিকর প্রসঙ্গ এখানে তুললাম না।
১৯১৪-১৯৪০ সাল পর্যন্ত ভারত তথা কলকাতায় বিজ্ঞানে স্বর্ণযুগ ছিল। এর অনেক কারন। সেই সময় কোলকাতা ছিল বৃটিশদের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী-বিজ্ঞান এবং জ্ঞান চর্চায় লন্ডনের সাথে যোগাযোগ ছিল ্নিবিড়। স্কুল কলেজে শিক্ষার মান ও ছিল ইউরোপের সমকক্ষ। এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন বিজ্ঞানী না তৈরী হওয়ার কোন কারন নেই।
স্বাধীন ভারতে আমরা বিজ্ঞান চর্চায় পিছিয়ে গেলাম। কেন? সত্যেন বোস ত বেঁচে ছিলেন ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত। স্যার রামন ও বেঁচে ছিলন অনেক দিন। তারা অনেক নতুন বিজ্ঞান কেন্দ্র তৈরী করলেন-কিন্ত বিজ্ঞানী বাহির হইল না!
এর উত্তর খুঁজতে আমাদের সমাজের দিকে তাকাতে হবে। ভারতে গবেষণার কাঠামো যথেষ্ঠই ভাল -আরো ভাল হচ্ছে। আমি ১৯৯৯ সা্লে এ্ম আই টির অধ্যাপক রাজীব রামকে আমাদের আই আই টির মাইক্রোইলেকট্রনিক্স ল্যাব ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলাম। উনি বল্লেন এখানে ত সবই আছে-তাহলে ভাল কাজ হয় না কেন?
এই ধাঁধার একটা বড় কারন এই যে, আমাদের দেশের সেরা মেধাবী ছাত্ররা তখন দেশ ছেরে বিদেশে গিয়ে পড়ে থাকত না। জগদীশ চন্দ্র থেকে সব বিখ্যাত ভারতীয় বিজ্ঞানীর কাছেই বিদেশের ল্যাবেটরীতে কাজ করার চাকরী ছিল। কেও তা নেন নি-কারন প্রত্যেকেই জাতীয়তাবাদি বিজ্ঞানী ছিলেন। মেঘনাদ সাহা থেকে সবারই জ্যাতাভিমান ছিল সাংঘাতিক।
তাছারা সেই সময় পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানের ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হত। সেটাও আস্তে আস্তে ফিকে হয়ে আসে। স্কুল কলেজে বিজ্ঞান শিক্ষার মানও নিম্নগা্মী হতে থাকে।
@বিপ্লবদা,
অনেক ধন্যবাদ আপনার বিশ্লেষণী মন্তব্যের জন্য।
দেবেন্দ্রমোহনের এই ব্যাপারগুলো বিস্তারিত জানতে ইচ্ছে করছে। আমার কাছে এ ব্যাপারে কোন তথ্য নেই। আপনার কাছে কোন লিংক বা রেফারেন্স থাকলে কি একটু দেবেন?
দারুণ! এই না হলে কী আর প্রদীপ দেব!!
আমার কাছে খুব আশ্চর্য লাগে এই ভেবে যে, হাজা্রো প্রতিকূলতার মধ্যেও পরাধীন দেশে একশো বছর আগে আমরা একগাদা বিশ্বমানের বাঙালি বিজ্ঞানী পেয়েছিলাম, অথচ স্বাধীন দেশে এসে মাত্র একজনকেও পেলাম না।
@ফরিদ ভাই, অনেক ধন্যবাদ।
গত একশ’ বছরে বৈজ্ঞানিক গবেষণার ক্ষেত্র ও পদ্ধতিটা অনেক বদলে গেছে বলে আমার ধারণা। বিজ্ঞানের বাণিজ্যিক ব্যাপারটাও কিছুটা দায়ী বলে মনে হয়। সামাজিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এর ওপর একটা বিশ্লেষণী লেখা আশা করছি আপনার কাছ থেকে।