সেভেন এইটের সময়, আস্তে আস্তে লাটিম মারবেল ছেড়ে টেনিস বলের দিকে দখল নিচ্ছিলাম। আমরা আবার টেনিস বল দিয়ে ক্রিকেট খেলতাম। প্রতিদিন ভোরে বিছানায় থেকে সাদা কাপড়ে মা’কে দেখতাম পাটিপাতার বিছানায়। আঙ্গুলের করে সৃষ্টিকর্তার পুঁথিপাঠ করেন। ওই সময় মা’কে নিস্ক্রিয় এক অকার্যকর প্রাণীর মতো লাগতো। আমার অসহায় মা তখন শক্তি অর্জনের জন্য সাধনা করতেন। মা’কে খুব পরপর মনে হতো। বাবা আর মা একসাথে শক্তি অর্জনের সাধনা করতেন না। মা আমার রুমে এসে এ কাজটি করতেন। শুয়ে শুয়ে মা’র দিকে তাকিয়ে থাকতাম আর এক ভয়ংকর স্বার্থপর রমনীকে দেখতাম।

সন্ধ্যা হলে ভাইবোনগুলো দলবেঁধে পুকুর ঘাটে পা ধু’তে যেতাম। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিলো। কারণ তারপরই সবাই গোল হয়ে বসে জিকির করতে হতো। “আল্লায় যদি দিতো পাখি বানায়া//উড়ে উড়ে যাইতাম আমি মদীনায়//মদিনাতে যাইয়ারে সেলাম জানাইতাম…..।” এসব বুঝতাম। কিন্তু “হাঁসকি রাব্বি সল্লাল্লাহ”, “মাফি কলমি গাইরুল্লাহ”- এসবের অর্থ বুঝতাম না। তবুও মা’ শিখিয়ে দিতেন বলে বকে যেতাম। মা মানেতো “মা”। ঈশ্বরের কাছাকাছি। আর এ কাছাকাছি থাকার উদ্দেশ্য ভয়াবহ খারাপ। মা’কে ঈশ্বরের কাছাকাছি রেখে ঈশ্বর একটা মই বানিয়ে নিলেন আসলে। বাংলা ভাষায় জিকির করতে কবিতার মতো ছন্দ পেতাম। এক ধরনের মেলোডি খুঁজে পেতাম। তাই ভালোও লাগতো। কিন্তু আরবী নাকি ফার্সি ভাষায় যেটা পড়তে বলতেন সেটা ভালো লাগতো না। চিরতার মতো তিতা লাগতো। মাঝে মাঝে আইষ্টার গন্ধ পেতাম।

ভাইবোনদের কথা বলতে পারবো না। আমি এসবে ফাঁকি দিতে চাইতাম। অল্প কিছুক্ষণ বকাবকি করে প্রিয় “পরিবেশ পরিচিতি সমাজ” বইটা নিয়ে বসে পড়তাম। মা বলতেন “বাংলা পড়লে চলবে? আরবী না পড়লে আগুনে জ্বালাবে, রাসুলের জিকির না করলে তিনি সুপারিশ করবেন না, ইত্যাদি ইত্যাদি।” আমি তখন বড়জোর পরের দিনের পাশের গ্রামের সাথে ক্রিকেট ম্যাচ নিয়েই বেশি চিন্তা করতাম। মা’র কথায় কান দেয়ার মতো টাইম ছিলো না।

গ্রামে হিন্দু ধর্মালম্বীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। আমাদের বাড়ি আর তার সামনের বাড়িতে বেশ ঘনবসতি। এ দু’বাড়ির পুরুষেরা ছিলো উগ্র এবং কালা বধির মুসলমান। হিন্দু পাড়ার মানুষগুলো আমাদের বাড়ি ক্রস করে বাজারে যেতো। যাওয়ার পথে তাদেরকে নানা ধরনের উস্কানীমূলক কথা বলতো। হিন্দুদেরকে ব্যঙ্গ করে “ডান্ডি” “ড্যাঁডা” ইত্যাদি শব্দে ডাকতো। “ড্যাঁডারা-হ্যাঁডারা”-এ অপমানজনক কথাটি হিন্দুদেরকে দেখলেই মুসলমানরা চিৎকার করে উচ্চারণ করতো। এমনকি বাপ পোলা একসাথেও বলতে দেখেছি। হয়তো এক ভাই আরেক ভাইকে “শালারপুত” বলে গালি দিলেই সমস্যা হতো। কিন্তু বাপ পোলা মিলে অন্য ধর্মের মানুষকে এতো বিশ্রি গালি দেয়াও জায়েজ ছিলো।

পাশের পাড়া হিন্দু অধ্যুষিত বলে মুসলমানদের অঞ্চলে গালগল্পের বেশিরভাগ জুড়েই ছিলো হিন্দুদের বেহেশতে না যাওয়া নিয়ে। মুসলমানদের মধ্যে যারা কোন হিন্দুকে পছন্দ করতো, সুযোগ পেলেই তাকে ধর্মান্তরিত হওয়ার সুপারিশ করতো। না পারলে যেনো অন্তত মরার সময় কালেমা পড়ে মরে। … এ বিষয়টি আমার মাথায় ইট ভাটা বসিয়েছিলো। কেন হিন্দুরা বেহেশতে যাবে না? তাদেরকে কে সৃষ্টি করেছে? তাদের হায়াত মওত রিজিক এসবের ব্যবস্থাপনায় কে আছেন? হিন্দুরা তাদের মূল উপাস্যকে বলেন “ভগবান”। ভগবানের অর্থ খুঁজতে গিয়ে পেলাম “যৌনাঙ্গে সমৃদ্ধ”! মানে তাদের উপাসকের অনেকগুলো যৌনাঙ্গ আছে! মুসলমানরা বলেন “আল্লাহ”। এটার আবার ৯৯টা গুনবাচক মানে আছে। তার মানে হিন্দুদেরকে অধিক যৌনাঙ্গ সমৃদ্ধ একজন আর মুসলমানকে মাত্র ৯৯ গুনের অধিকারী একজন নিয়ন্ত্রন করেন। এভাবে করে অন্যান্য ধর্মেরও একজন করে আছেন।

হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, ইসলাম আর ইহুদী ধর্ম ছাড়া অন্য কোন ধর্ম সম্পর্কে জানতাম না। ভাবতাম মোট পাঁচজন মহাপরাক্রমশালী মানুষ আছেন যারা এ পৃথিবী দখল করেছেন। বাংলাদেশ দখল করেছেন আল্লাহ। তাই এখানে মুসলমান থাকেন। তাহলে অন্য ধর্মালম্বীদেরকে তাদের উপাসক কিভাবে নিয়ন্ত্রন করতেন? মসজিদের ইমাম আর পুরোহিতের মাঝে যে বাজে সম্পর্ক! নিশ্চয় উপাসকদের মাঝেও এমন সম্পর্ক। হিসেব মিলতো না।

একবার খরায় হিন্দুদের নামযজ্ঞের মঞ্চে ব্যাপক আরাধনার ব্যবস্থা করা হয় বৃষ্টি নামানোর জন্য। পরদিনই বৃষ্টি হলো। গ্রামের মুসলমানরা তখন ঠিকমতো বাজারে উঠতো না। তাদেরকে লজ্জা পেয়ে বসলো। তবে ধর্মান্তরিত হওয়ার কোন ঘটনা ঘটেনি। পরের বছর হিন্দুদের পূঁজার পাশাপাশি মুসলমানদের মুনাজাতও অনুষ্ঠিত হয়। এমন আরাধনার ১ মাসের মধ্যেও বৃষ্টি না হওয়ায় হিন্দুরা মুসলমানদেরকে দোষারোপ করা শুরু করে। … পুরো বিশ্ব নিয়ে ভাবতে পারতাম না। ভাবতাম আমাদের বাড়িতে বৃষ্টি হলেও বড়বোনের জামাইর বাড়িতে বৃষ্টি হয়নি। বিটিভির খবরে দেখতাম কতগুলো জেলায় বৃষ্টি হবে আর কতগুলো জেলায় আকাশ আংশিক মেঘলা থাকবে। বৃষ্টিপাতের জন্য স্থানগুলো কিভাবে নির্বাচিত করা হতো? কখন এ কাজ করতো? কই, কাউকেতো ফিতা দিয়ে আমীনশীপের কাজ করতে দেখিনা! আর বৃষ্টিপাত বা ভূমিকম্প সহ অন্যান্য কিছু কিভাবে ঘটতো? এটা কি ওই পাঁচ মহাপরাক্রমশালীর মধ্যে যুদ্ধ বিগ্রহ থেকে ঘটতো? আবার ভাবতাম- না, তাহলেতো পৃথিবী পুরো ধ্বংস হয়ে যেতো। হিসাব মেলাতে পারতাম না।

সূর্যটা যেভাবে উদিত হয় :

আমার চোখে খড়ের টুকরো পড়ে। অনেক চেষ্টা করেও কুঁটোখানা বের করতে পারেনি। বড়বোন চোখে পানি দেয়ার জন্য নিয়ে যাবার সময় আমার কুরআনের হাফেজ ফুফা “পাকাশাফনা আন্কাগিতাকা ফাবাশ্বারুকাল ইয়াহুমা হাদীদুন” পড়ে চোখের পাতা উল্টিয়ে ফুঁ দিতে থাকলেন। তার মুখের গন্ধ নাকে এসে লাগতে বমি করে দিই। তারপর বমির জন্য কোন দোয়া পড়লেন কি না আর জানি না।

ঘুমের মাঝে খালি ভয়ংকর স্বপ্ন দেখতাম। মা ঘুমানোর সময় “আল্লাহুমা বিহিসমেকা আহমুতোয়াহা” পড়ার জন্য শিখিয়ে দিলেন। এতোদিন দেখতাম কেউ একজন আমার কল্লা কেটে নেয়ার জন্য দৌড়াচ্ছে। দোয়া পড়ার রাতে দেখি কল্লা কেটেই নিয়ে গেছে। তখন বুঝিনি- বাড়ির পাশে কালভার্ট বানানোর সময় কল্লা লাগবে বলে একটা গুজব উঠেছিলো। সে ভয় থেকেই স্বপ্নের উৎপত্তি। যাহোক, পরে আয়াতুল কুরসী সুরাও এমন স্বপ্ন থেকে আমাকে বাঁচায়নি। উল্টো স্বপ্ন নিয়ে পানিপড়া আর তাবিজ আনার জন্য মায়ের উৎকন্ঠা আমাকে আরো ভীত বানিয়েছিলো।

অমৃত লাল ঘোষ নামে আমার একজন প্রিয় স্যার ছিলেন। তার সুনাম করতে গেলেই মা বলতেন- ভালো হলে কি হবে? উনিতো বেহেশতে যাবেন না! – এটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে আমি বেশিরভাগ সময় আল্লাহকে খুঁজতাম। কিন্তু পেতাম না।

কোরআন শরীফের শক্তি নিয়ে কথা উঠলেই শুনতাম- অমুক বাড়িতে আগুন লাগার পর সবাই কোরআন শরীফ খুঁজতেছে। আগুন নিভে গেলে কোরআন শরীফকে নারিকেল গাছের আগায় খুঁজে পায়। কোথাওবা পেয়ারা গাছের ডালে। একবার আমাদের পাশের বাড়িতে আগুন লাগলে লোহার রেলের উপর ভস্মীভূত কোরআন দেখতে পাই।

জন্মের সময় নাকি হায়াত মওত লেখা হয়ে গেছে। তবুও আবার চিকিৎসার জন্য কোরআনের আয়াত বন্দোবস্ত রাখা হয়েছে। এটা খুবই বিস্ময়কর। এরকম ভাবনা পেয়েছিলো ক্লাস নাইনে উঠার পর।

একবার বলে আমাকে বিবেক বুদ্ধি সব দেয়া আছে। আবার বলে আল্লাহর হুকুম ছাড়া একটা ধূলির কণাও নড়ে না! আল্লাহর মা বাপ তুলে গালি দিলে সেটার দায়ভার আল্লাহ নেয় না কেন?

কোরআনের আয়াত দিয়ে নাকি আরোগ্যলাভ করা সম্ভব। কিন্তু পাঠের পর আরোগ্যলাভ না হলে তখন বলে- আমল না থাকলে এসবে হবে না। হায় হায়! তাহলে অসুস্থ থেকে নিজেকে শুধরানোর উপায় কি?

কোন এক ব্যক্তি নাকি কেয়ামতের দিন বেহেশতের টিকিট পেলেন। কিন্তু সে ইহলোকে খুবই বদ ছিলো। পরে সে আল্লাহকে জিজ্ঞাসা করলে আল্লাহ নাকি বলেন- তুমি একদিন শীতের রাতে একটি বিড়ালকে কম্বলের নীচে আশ্রয় দিয়েছিলে, তাই তোমার জন্য এ পুরস্কার! – ভাবলাম, কেয়ামতই এখনো হয়নি, লোকটা বেহেশতের চাবি পেলো কিভাবে?

এক বর্ষায় শুনলাম আমাদের ইউনিয়নের ৩ ইউনিয়ন পরের ইউনিয়নের এক গ্রামে মা’কে লাত্থি দেয়ার কারণে সাথে সাথে ছেলে পঙ্গু হয়ে গেছে! মা’কে লাত্থি দেয়ার বিষয়টিতে খুব ঘেন্না লেগেছে। কিন্তু মা’র অভিশাপে সাথে সাথে পঙ্গু হবার বিষয়টি মেনে নিতে পারিনি। সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। পথে বৃষ্টি ধরলেও থামিনি। ভিজতে ভিজতে ওই গ্রামে পৌঁছে গেলাম। মসজিদের ইমামের কাছে গিয়ে বিষয়টি জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন উনাদের ইউনিয়নে নয়, এটা আসলে কোম্পানিগঞ্জ উপজেলার (পাশের উপজেলা) এক গ্রামে ঘটেছে। কিন্তু উনি দেখেননি, শুনেছেন। বললাম চলেন আমার সাথে। ভদ্রলোক কিছুতেই রাজি নয়।

আমি আসলে অন্তত একটি সত্য নিদর্শনের অপেক্ষায় ছিলাম। এভাবে বেশ কিছুদিন অলৌকিক গজব কিংবা রহমতের খবর পেলেই ছুটে যেতাম। কিন্তু রেফারেন্সের পর রেফারেন্স পাড়ি দিয়েও গজব উল্লা আর রহমত মিয়ার একটা কেশের সন্ধানও পাই নাই।

(চলবে)