অর্গানাইজড রিলিজিয়নের মতো উগ্র জাতীয়তাবাদও প্রচন্ড ভয়ঙ্কর। যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নিই যে, অধিকাংশ মানুষই আর প্রচলিত ধর্মে বিশ্বাসী থাকলো না (বর্তমান পৃথিবীতে ২০ থেকে ৩০ ভাগ মানুষ নাকি আর কোনো প্রচলিত ধর্মে বিশ্বাসী নয়), তবুও কি পৃথিবী থেকে হিংসার উন্মত্ততা থামবে?
ইতিহাস থেকে যতটুকু জানা যায় যে, প্রবল জাতীয়তাবাদ এবং আধিপত্যবাদের কারণে এ পৃথিবীতে যতো মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, ধর্মীয় হিংস্রতার কারণে ততো হারায়নি। একমাত্র প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে কোটি কোটি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, তার পেছনের কারণ উগ্র জাতীয়তাবাদ ও প্রবল আধিপত্যবাদ।
তাই ব’লে ধর্মীয় বিভেদের কারণে যে কম মানুষ মরেছে সেটা কিন্তু নয়। ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ ধর্মীয় সম্প্রসারণবাদের বলী হয়েছে সবচেয়ে বেশী। ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগ কিংবা ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে এই বাংলাদেশেরই লাখ-লাখ মানুষ ধর্মীয় বিভাজনের জন্য প্রাণ হারিয়েছেন। সে ক্ষতচিহ্ন এখনও বাংলার অসংখ্য মানুষ বহে বেড়াচ্ছে।
অতি সম্প্রতি নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে এক উগ্র শ্বেতাংগ জাতীয়তাবাদী পবিত্র মসজিদে নামাজরত নিরীহ মানুষকে যে ভাবে হত্যা করেছে, তার নিন্দে ও ঘৃণা জানানোর ভাষা নেই। সারা পৃথিবী এ হত্যাকান্ডের ভয়াবহতায় শিউরে উঠেছে। ঠিক এ রকম কান্ডজ্ঞানহীন হত্যাকান্ড এ বিশ্ব প্রত্যক্ষ করছে যুগ যুগ ধরে। পেছনের কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধর্মান্ধতা কিংবা উগ্র জাতীয়তাবাদ।
প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা গেছে, অস্ট্রেলিয়ার এক শ্বেতাংগ উগ্র জাতীয়তাবাদী ইউরোপে পাঁচ বছর আগে ঘটে যাওয়া এক হত্যাকান্ডের প্রতিশোধ হিসেবেই এই বর্বরতা চালিয়েছে। অথচ নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে যাঁরা হত্যাকান্ডের শিকার হলেন তাঁরা হয়ত ইউরোপের সে ঘটনার কথা জানেনই না। এভাবেই হয়ত উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপিয়ে সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হয়। পৃথিবীও অবাক বিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করে উগ্র ধর্মান্ধতা এবং উগ্র জাতীয়তাবাদের উন্মত্ততা।
অথচ এ দু’ধরণের উগ্রতাই মানব সভ্যতার জন্য এক বিরাট অভিশাপ ছাড়া আর কিছু নয়। উগ্র জাতীয়তাবাদ একটি জাতিগোষ্ঠীকে অন্যদের বিনাশ এবং নিজেদের আধিপত্যের অজুহাতে একীভূত করে, উগ্র ও উন্মত্ত করে। প্রবল ধর্মান্ধতাও তেমনি একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীকে নানাভাবে উত্তেজিত ক’রে হিংসায় উদ্বুদ্ধ করে।
প্রায় সব প্রচলিত ধর্মেই শান্তি ও মানবতার কথা বলা হয়েছে। যদিও কোনো ধর্মের অতীত ইতিহাসই সে স্বাক্ষ্য দেয় না। প্রচলিত প্রায় সকল ধর্মই শক্তি এবং প্রতিশোধ স্পৃহা দিয়েই প্রচার ও প্রসার লাভ করেছে। যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গোষ্ঠী কিংবা ব্যক্তির নিজস্ব স্বার্থ উদ্ধারের কাজে ধর্ম ব্যবহ্নত হয়েছে।
এক ধর্মবিশ্বাসীদের দ্বারা অন্য ধর্মবিশ্বাসীদের নিঃশেষ করার সে ইতিহাসবর্ণিত কাজটি এখনও চলছে। হয়ত চলবেও ততোদিন, যতোদিন ধর্মকে গোষ্ঠীবদ্ধতা থেকে মুক্ত ক’রে একান্ত ব্যক্তিগত বিশ্বাস কিংবা অবিশ্বাসের স্তরে নামিয়ে আনা সম্ভবপর না-হবে।
তাহ’লে এই হিংসার উন্মত্ততা থেকে মুক্তির উপায় কী? সত্যি কথা বললে, হিংসার উন্মত্ততা ও বিভাজনের হানাহানি থেকে মুক্তির আপাতত কোনো সহজ পথ নেই। তবুও মানুষের শুভবু্দ্ধির উপর ভরসা রাখতেই হবে।
আগামীদিনে আইনের শাসন যতো প্রতিষ্ঠা পাবে; মুক্তবুদ্ধি ও বিজ্ঞানভিত্তিক জ্ঞানচর্চা যতো বাড়বে; মানুষের মধ্যে যতো শাশ্বত মানবিক মূল্যবো্ধের চর্চা, লালন ও উন্মেষ ঘটবে; মানুষের মধ্যে উগ্র ধর্মান্ধতা ও উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রভাব যতো কমবে; পারস্পারিক বিভেদের দেয়াল ততোই ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হবে। একদিন হয়ত বিভেদের দেয়ালটাই উঠে যাবে। সেদিন মানুষ মানুষকে কোনো বিশেষ ধর্ম-গোত্র-বর্ণের আবরণে নয়,শুধু মানুষ হিসেবেই দেখবে।
কয়েক শত বছর আগে বাংলার মধ্যযুগের এক কবি বড়ু চন্ডীদাস বলে গেছেন, “সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই”। এই বাংলারই আরেক কবি শেখ ফজলুল করিম মাত্র একশ’ বছর আগে কী সহজ কথায় বলেছেন,
“কোথায় স্বর্গ?
কোথায় নরক?
কে বলে তা বহুদূর?
মানুষের মাঝেই স্বর্গ-নরক
মানুষেতে সুরাসুর”।
বিশ্বময় মানবিক মূল্যবোধ স্থান-কাল-পাত্রভেদে সব সময়ের জন্য জেগে উঠুক। ধর্মান্ধতা এবং উগ্র জাতীয়তাবাদ ছাপিয়ে মানুষ, শুধুই মানুষ বড় হয়ে দেখা দিক – এ প্রত্যাশা সকলের।
অসাধারণ!
গভীর চিন্তাকে সম্মান জানায়।ভেদাভেদ থাকবেনা হানা হানি রক্তপাত ও বন্ধ হবে।
মানুষের বিবেক কবে জাগ্রত হবে,,,, কেই জানে!!
কোনটি এখন প্রবল হয়ে দাঁড়িয়েছে, ধর্মীয় মেরুকরণ, নাকি জাতিভেদ? কোনটিতে সমর্থন দিলে দ্রুত জনপ্রিয়তা পাবার পাশাপাশি দেশপ্রেমের তৃপ্তি পাওয়া যায়? ধর্মভিত্তিক বিভাজনে পৃষ্ঠপোষকতা না দিলে শাসন ক্ষমতা ধরে রাখা যেতো/যায় না – সেটি এখন প্রজন্মের কাছে প্রকাশিত হয়ে গেছে। পুজিবাদের নতুন সংস্করণে, ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে সেকুলার ইমেজ দেবার জন্য প্রয়োজন শৌভিনিজম। অর্থাৎ যোগাযোগ প্রযুক্তি আর নব্য পুঁজিবাদের এই সময়ে ধর্মীয় রাজনীতির চেয়েও প্রবল শক্তিধর হয়ে দাঁড়িয়েছে উগ্র জাতীয়বাদ, যাকে প্রগতিশীল পশ্চিম থেকেই প্রমোট করা হচ্ছে।
এক সময় কিছু দার্শনিক স্বপ্ন দেখতেন একটি বসুন্ধরা সরকার (World Government) এর যেখানে কোন দেশের সীমান্ত থাকবে না। হয়ত সোভিয়েত কম্যুনিস্টরা সেই স্বপ্নের কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু যে কারনেই হোক সেই স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। এখন পুঁজিবাদই একমাত্র বিকল্প। যদিও দেশে দেশে পুঁজিবাদের অসারতা যতই দৃষ্টি গোচর হচ্ছে ততই মানুষ বিকল্প কিছু খুঁজছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত পৃথিবী দ্বিধা বিভক্ত। চিন্তার জগতে ভাঙ্গা গড়া চলছে, চলুক।
এরই মাঝে ইউরোপে দেশে দেশে জাতীয়তাবাদের উত্থান দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। অনেক দেশেই মুসলিম বিরোধী জাতীয়তাবাদ মাথা চাড়া দিচ্ছে। ভারতেও তার ব্যতিক্রম নয়। কেন হল এমন পণ্ডিতরা তার ব্যাখ্যা দিক। তবে একটা বিষয় মনে হয় পরিস্কার যে দেশে দেশে ধর্মনিরপেক্ষতা সফল হয় নি। অন্য দিকে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যে মানুষ নিরাপত্তা হারিয়েছে। ফলত যে যার মত আত্মরক্ষা করতে ব্যস্ত। উন্নত বিশ্বে গনতন্ত্রের ছিদ্র দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সামাজিক ন্যায় দুটোই অন্তর্হিত হয়েছে। ফল যা হবার তাই হয়েছে। এর সমাধানের কোন শর্ট কাট রাস্তা তো নেইই উপরন্তু পৃথিবীর সমাজ ব্যবস্থা ও রাষ্ট্র দিন দিন আরও জটিল হচ্ছে। সেই সাথে উন্নত প্রযুক্তির প্রয়োগ সামাজিক আবেগ গুলির উপর সর্বাত্মক ধ্বংস লীলা সম্পূর্ণ করতে চলেছে। এখন শুধু অপেক্ষা করা ……।
ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য।উগ্র জাতীয়তাবাদ খুবই খারাপ, সেটার উদাহরণ জার্মানি।বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের পেছনের ইতিহাস শুধুই কি জাতীয়তাবাদ।আমার সেটা মনে হয় না।বাংগালী জাতীয়তাবাদই যদি হবে তবে পশ্চিমবংগের বাংগালীদের অংশগ্রহন নেই কেনো? ৪৭ থেকে ৭১ এর পূর্বপাকিস্তানের আন্দোলনের অংশবিশেষ হয়ত জাতীয়তাবাদ ছিল কিন্তু অধিকাংশই ছিল ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চনা। আমরা কেনো পৃথিবীব্যাপিই মানুষ বিশেষ বিশেষ সময়ে জাতীয়তাবাদী হয়ে ওঠে কিন্তু উগ্রতার বিশেষণে যখন তা ঢেকে যায় সমস্যা হয় সেখানেই।বাংলাদেশের বাংগালী বেশী বেশী জাতীয়তাবাদী হলে পাহাড়ি কিংবা সমতলের আদিবাসী অবাংগালীদের অবস্থা কেমন হবে ভেবে দেখুন।তাই আমি ধর্মের মতোই জাতীয়তাবাদেরও বিপক্ষে।ধন্যবাদ
প্রচলিত ধর্ম মানুষকে হিংসা বিদ্বেষ শিক্ষা দেয়, মানুষের মধ্যে সৃষ্টি করে বিভাজন। আদিকাল থেকে কল্পিত এক সৃষ্টিকর্তাকে সৃষ্টি করে ধর্ম নামক জুজুর ভয় দেখিয়ে আসছে। ধর্মের আধিপত্যে বিস্তারের কারণে যত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে অন্য কিছুতে তা নয়। এখনো এই একবিংশ শতাব্দীতে জ্ঞান বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষের সময়ে এসেও তা থামেনি। মানুষ হতে ধর্মের প্রয়োজন নেই। মানুষের ধর্মই মানবতা। মনুষ্যত্ব অর্জনের মধ্য দিয়েই একদিন নিশ্চয়ই বিভাজন দূরীভূত হবে।