২০০৭ সালের ১৯ নভেম্বর ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় সিডরের আঘাতে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির দক্ষিণাঞ্চল। অপরিসীম ক্ষতির শিকার হয়ে অজস্র মানুষ জীবনযুদ্ধের এক স্পর্শকাতর সময়ের মুখোমুখি হয়। জীবন তবু থেকে থাকে না। এগিয়ে যায় প্রকৃতির নিয়মে। মানুষও উঠে দাঁড়ায়। কিশোর-কিশোরীরা ফিরে পায় প্রাণচাঞ্চল্য। কিন্তু কী তাদের এমন উৎসাহিত করে? সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই এই লেখা
ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় সিডরের ১৫ দিন পর, একটি দলের সঙ্গে পটুয়াখালীর গলাচিপায় গিয়েছিলাম। হরিদাপুর আগুনমুখা চ্যানেলের সামনে দাঁড়িয়ে বারবার মনে আসছিল পথের পাশে ফেলে আসা বিধ্বস্ত বাড়িঘর আর অসংখ্য স্কুল অবশেষের কথা। পাশেই দেখলাম রমনাবাদ নদীর ফেরি নদী থেকে অনেক ওপরে চলে এসেছে। এ দৃশ্য এক কথায় অবিশ্বাস্য লাগছিল। ফেরিটি খাল কেটে বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে এখন। এসবই ১৫ ফুট জলোচ্ছ্বাসের ফল। কী ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে এই নদী_ তারই প্রমাণ এটা। অথচ সূর্যের আলোয় ভরা এই খরস্রোতা নদী ঝিকমিক করে যেন মহাপৃথিবীর কথা বলছিল।
একের পর এক হারানোর বেদনায় ভারাক্রান্ত নারী-পুরুষের দেখা পেলাম। অনেকে তাদের পরিবারের চার-পাঁচজনকে খুঁজে পায়নি। কোনো কোনো পরিবারের সবাই হয়তো আগুনমুখা চ্যানেলের স্রোতে চিরকালের জন্য ভেসে গেছে। মারাত্মক হতাশা তাদের চারদিকে বিরাজমান। এরপরও তারা বেঁচে থাকতে চাইছে।
কিসের তাগিদে?
এই তাগিদটা মানুষ পায় কীভাবে?
পর্যবেক্ষণ শেষে ফিরে যাওয়ার পথে হরিদাপুর স্কুলে গেলাম। দেখলাম ছাদহীন শ্রেণীকক্ষে ছেলেমেয়েগুলো কী উচ্ছলতা আর গতি নিয়ে ক্লাস করছে। হঠাৎ মনোরম বাতাস আর ঢেউ খেলে যাওয়া বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত পরিবেশ-পরিস্থিতিকে কেমন বদলে দিল। যেন কোনোদিন কোনো বিপর্যয় ঘটেনি এখানে_ মুগ্ধতায় ভরা এক জগৎ, শুধু আপন ভাবনায় ডুবে থাকা!
বিস্তীর্ণ ধানক্ষেতের মধ্য দিয়ে চিন্তার স্রোতগুলো কেমন যেন তীর বেগে ছুটতে থাকে প্রাচীন পৃথিবীর পানে, ৩৮৫ কোটি বছর আগের, জীবন-উদ্ভবের সেই সময়ে। প্রধান রাস্তার পাশ দিয়ে বাস চলতে লাগল। বেশিরভাগ ধান পানির তোড়ে চিটা হয়ে গেলেও দু’পাশের দিগন্ত বিস্তৃত ধানক্ষেত কেমন যেন আবিষ্ট করে রেখেছিল। তারই পাশ দিয়ে স্কুল শেষে এক দল কিশোরী গল্প করতে করতে যাওয়ার সময়, ঢেউ খেলে যাওয়া ধানক্ষেতের উচ্ছ্বাসে একে অপরের ওপর গড়িয়ে পড়াটা সময়কেই অন্যমাত্রায় নিয়ে গেল। মনে হলো, জীবন ডাকছে অনাবিল সম্ভাবনা নিয়ে। যেন ৯ কোটি ৩০ লাখ মাইল দূর থেকে ছুটে আসা দুপুরের রোদেলা আলো একটু আবিষ্ট আর ঘোরের মধ্য নিয়ে যাচ্ছে, নিয়ে যাবে হয়তো বিশাল ব্যাপ্তির মাঝে। ওরা যেন আলয়ে ফিরছে না, ফিরে যাচ্ছে ওদের গন্তব্যে। কখনও কাউকে দেখে মনে হলো, দূর দিগন্তের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবছে। হয়তো স্বপ্ন দেখছে আগামী দিনগুলোর, সম্ভাবনাময় সময়ের।
সবকিছু মিলিয়ে এক ধরনের রোমান্টিক পরিবেশ তৈরি হলো। ওদের দৃষ্টি ছিল আলোর পানে, আকাশের দিকে। কারণ চেতন কিংবা অবচেতন_ যেভাবেই হোক তারা যেন নক্ষত্রের কাছে যেতে চায়। কেননা, নাক্ষত্রিক উপাদান দিয়েই তৈরি তাদের তো সেখানেই ফিরে যেতে হবে!
অথচ যে জায়গায় দু’সপ্তাহ হয়নি সিডর বয়ে গেছে, ১৫ ফুট তীব্র জলোচ্ছ্বাসের দগদগে ঘা বিরাজ করছে, কারও বাবা, কারও মা-ভাইবোন আরও অনেক স্বজন রমনাবাদ নদীর আগুনমুখা চ্যানেলের তীব্রতায় ভেসে গেছে চিরকালের জন্য_
তারপরও বয়ে যাওয়া বাতাসে, দুপুরের হেঁটে যাওয়া কিশোরীরা কী ভাবছে?
এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে কীভাবে স্বপ্নের জাল বোনে, আর হাসির উদ্দামে জীবনকে স্পন্দিত করে?
জীবন আসলে কী?
প্রাচীনকালের উদ্ভবের সময় সরল জীবন আর ৩৮৫ কোটি বছরের বিবর্তনের পর বহুকোষী জটিল জীবনের টিকে থাকার ক্ষেত্রে মৌলিক কোনো পার্থক্য কি আছে?
অনেকে বলেন, জীবন হলো ছায়ার পুতুল বা পুতুলের ছায়া। আর বিজ্ঞানের ভাষায়, জীবন হলো প্রোটিন নিউক্লিক এসিড সমাবেশের নিখুঁত গতিময় ছন্দ। ব্রিটিশ জীববিদ জেডি বার্নাল [১৯৫১] তার ‘দ্য ফিজিক্যাল বেসিস অব লাইফ’ গ্রন্থে জীবনের সংজ্ঞা দেন_ একটি নির্দিষ্ট আয়তন বা স্থানের মধ্যে স্বচালিত রাসায়নিক প্রক্রিয়াদির নাম জীবন। তিনি আরও বলেন, জীবন হচ্ছে এক অতি জটিল ভৌত-রাসায়নিক ব্যবস্থা_ যা একগাদা সুসংহত বা একীভূত ও স্বনিয়ন্ত্রিত রাসায়নিক ভৌত বিক্রিয়ার মাধ্যমে তার পরিপাশর্ে্বর বস্তু ও শক্তিকে স্বীয় বৃদ্ধির কাজে ব্যবহার করে।
কিন্তু কোনো ভিন্ন গ্রহে বা জগতে রাসায়নিক প্রক্রিয়া ছাড়া অরাসায়নিকভাবে প্রাণ গড়ে উঠতে পারে_ তার কিছু কিছু ইঙ্গিত দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। এই হিসেবে জীবনের সংজ্ঞা এভাবেও দেওয়া যেতে পারে_ প্রাণ বলতে আমরা এমন একটি ব্যবস্থাকে বুঝি যার ভৌতভিত্তি নির্ভর করে শক্তি সংগ্রহ, সঞ্চয় ও তা কাজে লাগানোর সামর্থ্যের ওপর। যেমন, জীবন আয়োনাইজড গ্যাস ও বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় ক্ষেত্রের ওপর ভিত্তি করেও গড়ে উঠতে পারে। কিন্তু এখনও এ রকম প্রাণের সন্ধান পাওয়া যায়নি।
আবার বলা যায়, যেহেতু এনজাইম পরিচালিত রূপান্তরের জন্য খুব অল্প শক্তি প্রয়োজন, সে জন্য তাপের বিশেষ কোনো পরিবর্তন না করে জীবের পক্ষে বিপুল রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব। সেই কারণে জীবনকে এক অল্প তাপের আগুনও বলা যায়। তবে যেভাবেই ঘটে থাকুক, জীবন পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করবে। তাহলে দাঁড়াচ্ছে, যদি একবার জীবনের উৎপত্তি ঘটে, তাহলে তা প্রাণপণে পরিবেশের সঙ্গে অভিযোজনের মাধ্যমে টিকে থাকার চেষ্টা করবে।
কিশোরীদের উচ্ছলতা নিয়ে চলা আর এককোষী প্রাণীদের অন্তহীন পথপরিক্রমা তো তা-ই দেখিয়েছে_ জীবন সবসময় গুঞ্জন আর স্পন্দিত হয় বিকশিত হওয়ার সম্ভাবনা আর নিজেকে উপলব্ধি করার প্রবণতা নিয়ে। এটা হলো জীবনের সেই গন্তব্য_ যা তাকে পরিচালিত করে টিকে থাকা, নিজের আগমন আর পরিণতিতে পেঁৗছানোর দিকে। কারণ মহাজাগতিক বীক্ষণই তার গন্তব্য।
আহ্, ওদের মনে যদি ঢুকে পড়া যেত! চারদিকে ধানক্ষেত। হলুদ আর সবুজ ফসলে ভরা পৃথিবী। ওই দলের প্রত্যেকেই এক একটি জীবন, তাদের মিলে যে সামষ্টিক উচ্ছ্বাস তৈরি হয়েছে, তাও একটি জীবন। আর ওই প্রত্যেক মানুষের ভেতরে যে কোটি কোটি কোষ আছে_ তাও একেকটি জীবন। আসলে প্রতিটি কোষই স্বনিয়ন্ত্রিত এক একটি জীবন। প্রয়োজনের তাগিদে একত্র হয়ে প্রত্যেকে ছাড় দেয়, গড়ে তোলে বহুকোষী জীবন। মানুষের দেহের কোটি কোটি কোষও সেই লক্ষ্যে কাজ করে চলে।
আসলে আমরা প্রত্যেকেই হলাম বহু জীবনের একীভূত রূপ। আমাদের সমাজ জীবনেও যদি দেহের কোটি কোটি কোষের মতো মানুষেরা নিজেদের পরস্পরকে টিকিয়ে রাখার জন্য কাজ করে যেত!
রচনাকাল ২০০৭
আপনার এই উক্তি খুব`ই মূল্যবান।
@ আসিফ, অনেকদিন পর দেখলাম আপনাকে। আপনার কি কোন বই বেরুচ্ছে এই বই মেলায়? আচ্ছা, মহাবৃত্তের খবর কী? কবে বেরুচ্ছে?