পূর্ব সমুদ্র হতে
মীজান রহমান
এক
ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে মেঘ দেখছিলাম। ঠিক যেন মাথার ওপর মেঘগুলো—হাত বাড়িয়ে ছোঁয়া যায় এমন। সামনে পাহাড়, ধ্যানমগ্ন ঋষির মত নির্বিকার বিশালতায় দাঁড়িয়ে। তেমন উঁচু হয়ত নয়—হংকং এর সর্বোচ্চ পাহাড়ই ৩,১০০ ফুটের মত। কিন্তু আমার চোখে তো ছ’ফুট লম্বা মানুষও পাহাড়। গোটা হং কং শহরটাই যেন পাহাড় কেটে তৈরি। প্রকাণ্ড সব ফ্ল্যাটবাড়ি—সরু, লম্বা, আকাশচুম্বী—বাঁশের মত শরীর তাদের, কংক্রীটের বাঁশ। সার বেঁধে দাঁড়ানো সারা শহর জুড়ে। হংকংকে ওরা ‘ভার্টিক্যাল সিটি’ নাম দিয়েছে। আকাশ ছাড়া আর কোনদিকে যাবার জায়গা নেই তাদের, তাই আকাশই তাদের গন্তব্য। গোটা দেশটার আয়তন ৪২৬ বর্গমাইল—লোকসংখ্যা ৭০ লক্ষ। মূল হংকং শহর আর পার্শ্ববর্তী কৌলুন মিলিয়ে ৬০ লক্ষের মত। ঘনবসতি। ঢাকার সঙ্গে তুলনা চলেনা তা নয়—শুধু ঢাকায় পাহাড় নেই এখানে আছে, ঢাকায় নদীনালা খালবিল সব ভরাট হয়ে গেছে, হংকংএ নদীনালার ওপরই ডেরা বেঁধে বাস করে অনেক পরিবার। ঢাকায় গাছ কেটে ফ্ল্যাট বানায় নব্যধনীরা, হংকংএর মানুষ গাছ ভালবাসে, গাছেদের সঙ্গেই বসবাস তাদের। ওরা ছাদের ওপর জমি কেনে, সেই জমির ওপর বাড়ি তোলে, বাড়ির সঙ্গে বাগান করে, গাছ বোনে, সবজির চাষ করে। হংকং সবুজের স্বর্গ।
মোটমাট দু-সপ্তাহ ছিলাম হংকংএ। এনিয়ে তৃতীয়বার আসা এখানে। বেড়ানোর জন্যে আসিনা, কাজে আসি, বেড়ানোটাও হয়ে যায় কাজের সাথে। কৌলুনের অপেক্ষাকৃত নতুন বিশ্ববিদ্যালয় সিটি ইউনিভার্সিটি, যেখানে আমি বারবার আসি, আমার লাইনে ভাল কাজ হয় এখানে, সারা চীন থেকে মেধাবী ছাত্রছাত্রিরা আসে সিটিতে পড়তে, আসে বাঘা বাঘা অধ্যাপক, গবেষক, বিজ্ঞ পণ্ডিত। বিশাল ক্যাম্পাস, প্রকাণ্ড সব ছাত্রাবাস, নিটোল, নির্মল, পরিচ্ছন্ন পরিবেশ। একটুকরো ছেঁড়া কাগজ নেই কোথাও, নেই কমলার খোশা, নেই পানখাওয়া পিচকির দাগ। একটি দেয়াল দেখিনি আমি যেখানে একফোঁটা কালির দাগ, যেখানে বালি খসে ইঁট বেরিয়ে গেছে ভাঙ্গা দাঁতের মত, যেখানে সিঁড়ি দিয়ে উঠানামা করতে সাবধানে পা ফেলতে হয় পাছে না ঝুরঝুরে সুড়কিতে পা মচকায়। সিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা বোধ হয় কল্পনাই করতে পারেনা যে পৃথিবীতে এমন কোনও দেশ আছে যেখানে বিএ এমএ পড়তে যাওয়া ছেলেমেয়েরা তাদের শিক্ষাঙ্গনের প্রতিটি দেয়াল মোটা কালির অক্ষরে দাগিয়ে দাগিয়ে পঁচা বস্তীর আঁস্তাকুড়ের অশ্লীলতায় পরিণত করতে পারে। তারা বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়নি, তাই তাদের পক্ষে কল্পনা করা শক্ত যে কোনও সুস্থ সমাজের পক্ষে এতটা নিচুতে নেমে যাওয়া সম্ভব।
দুটি সপ্তাহের প্রতিটি দিন আমি একই রুটিন পালন করেছি। সকাল পাঁচটায় নিদ্রাভংগ—বরাবর যা করি— আমার শরীর এর কোনও ব্যতিক্রম সহ্য করবে না, যেখানেই যাই না কেন। নাস্তা খেয়ে সাড়ে ছ’টার দিকে রোওয়ানা দিতাম অফিসের দিকে। সাতটায় বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা খোলে, শনি রবি সোম মঙ্গল যা’ই হোক। ছুটিছাটাতেও এর কোন ব্যতিক্রম হয়না—উচ্চশিক্ষার পীঠভূমিতে বিরতি বলে কোন জিনিস নেই, থাকা উচিতও নয়। জ্ঞানচর্চায় আবার বিরতি কিসের। আমি শনি রোববারও অফিসে যেতাম। ঘরে থেকে করারই বা কি আছে। তাছাড়া ঘরে বসে আঙ্গুল চোষার জন্যে তো এত টাকা খরচ করে যাইনি সেখানে। যাবার পথে প্রতিদিন দেখতাম হংকংএর প্রাত্যহিক জীবন। বিরাট একটা পার্ক ঠিক আমার ফ্ল্যাটের সামনে। সেই সাত সকালেও লোকের ভিড় সেখানে। আড্ডার ভিড় নয়, শরীরচর্চার। তরুনরা দৌড়ুচ্ছে, প্রৌঢ়রা বৃদ্ধরা তাইচি করছে, যোগ করছে, হাঁটছে, ব্যায়াম করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে ঢোকার পথে ছোট্ট একটা পদ্মপুকুর, সেখানে নানারঙ্গের মাছ, মাছেরা খেলছে, ছুটছে, নিশ্চিন্তে নির্বিঘ্নে। পাশে বর্ধিষ্ণু মহিলাদের সমাবেশ, তারাও শরীরচর্চায় ব্যস্ত। আমি মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাই তাদের দিকে—স্মিত হাসিতে মৌন অভিবাদন জানাই। প্রত্যুত্তরে তারা মিষ্টি করে তাকায় আমার দিকে, তাদের চোখ বলে আমাকেঃ স্বাগতম হে পরবাসী, স্বাগতম এবং সুপ্রভাত। একটা ফুরফুরে মসৃণ বোধ নিয়ে আমি অফিসে ঢুকি, ডুবে যাই কাজের জগতে।
কাজের জগতে ডুবে যাওয়াটা সহজ এখানে। পরিবেশটাই ওরকম। ইউনিভার্সিটির সদর দরজা দিয়ে ঢোকার সাথে সাথেই মনে হয় এটা হংকং শহরের একটি উচ্চ বিদ্যানিকেতন নয়, এটা বিশ্ব বিদ্যালয়, সত্যিকার অর্থেই যার বিস্তার সারা বিশ্বব্যাপী। একটি জ্ঞানমন্দির, যেখানে সাধনা হয় বিশুদ্ধ জ্ঞানের। সেজ্ঞানের কোনও সীমানা নেই, কোনও জাতিভেদ নেই, কোনও রাজনৈতিক কূ্টনৈতিক বা পরজাগতিক লক্ষ্য-উপলক্ষ্য নেই। এ-জ্ঞানের আবহাওয়া পশ্চিমে আছে, প্রাচ্য আর মধ্যপ্রাচ্যেও ছিল একসময়, এখন নেই। পশ্চিমের প্রধান সম্পদ ধন নয় জন নয়, জ্ঞান। সে-জ্ঞানের চর্চা হংকংএ আছে, তাই হংকং উন্নত, চীনে আছে তাই চীন উন্নতির পথে দ্রুত ধাবমান্, ভারতেও সৃষ্টি হতে চলেছে, তাই ভারতও প্রথম বিশ্বের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। হংকংএর কাজের জগতে জ্ঞানসৃষ্টির যাবতীয় আয়োজন দেখে একদিকে আনন্দে ভরে ওঠে মন, আরেকদিকে কষ্টে কাতর হয়। আমাদের অভাগা দেশটা কেন এত পিছিয়ে পড়ল। শুধু কি দারিদ্র্যের কারণে? শুধু কি বহিঃশক্তির শোষণ পীড়ন, না, তার চেয়েও গভীরতর কিছু?
নগন্য আয়তনের এই দেশ। অন্যান্য দেশের তুলনায় পায়রার খোপ ছাড়া কিছু নয়, অথচ ব্যবসাবানিজ্য শিল্পসংস্কৃতি আর জ্ঞানবিজ্ঞানের দিক থেকে কত অগ্রসর তারা। সিটি ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরিতে গেলেই অনুভব করা যায় এজাতির হৃদস্পন্দন। গ্রীক দর্শন থেকে শুরু করে আধুনিক প্রযুক্তিজগতের এমন কোনও গ্রন্থ নেই যা তারা সংগ্রহ করেনি। একদিকে যেমন বইএর পাহাড় আরেকদিকে মাইক্রোফিল্মস, টেপ—আধুনিক শিক্ষামাধ্যমের সবগুলো শাখাতেই তারা সমান সজাগ। সর্বোপরি তাদের রয়েছে জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রতিটি শাখার প্রতিটি মুখ্য জার্নালের অত্যাধুনিক সংস্করণ—যা আমাদের দেশের অধিকাংশ শিক্ষাঙ্গনেই নেই। আধুনিক জার্নাল ছাড়া আধুনিক গবেষণা সম্ভব নয়, সেটা বোঝার জন্যে বিদেশি ডিগ্রির প্রয়োজন হয়না, সাধারণ বুদ্ধিই যথেষ্ট। বাংলাদেশে এই জার্নাল জিনিসটির প্রতি তেমন অনুরাগ আমি কোথাও লক্ষ্য করিনি। বিদেশি জার্নাল, বিদেশি বই, এসব ছাড়াও গবেষণা হয়, এমন একধরণের মূর্খ আত্মম্ভরিতার ভাবও যে নেই একটু আধটু তা নয়। অথচ যারা সৃষ্টিশীল জ্ঞানচর্চার সংস্কৃতিতে আজন্ম নিবেদিততারা ভাল করেই জানেন যে একটা দেশের বুদ্ধিসম্পদের পরিচয় পেতে হলে সেদেশের বড় বড় পাব্লিক লাইব্রেরিগুলোতে একবার ঢূঁ মারলেই কিছুটা আভাস পাওয়া যায়। আমার জানামতে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় মিশরের আলেকজান্দ্রিয়াতে। খৃঃপূঃ ৩৩২ সালে সম্রাট আলেকজাণ্ডার মিশর জয় করার কিছুদিন পর তাঁর সত্ভাই প্রথম টলেমির হাতে রাজত্ব আসে। তিনি নিজে উঁচুমানের জ্ঞানীপুরুষ হয়ত ছিলেন না কিন্তু জ্ঞানের প্রতি তাঁর প্রচণ্ড ভক্তি ছিল। সেসময় ডেমোক্রিটাস ফ্যালেরুস নামক এক বিখ্যাত বিজ্ঞজন ছিলেন তাঁর রাজ্যে। ফ্যালেরুসই তাঁকে পরামর্শ দেন বিশ্বের যত জ্ঞানসম্পদ গ্রন্থাকারে প্রকাশ হয়েছে সব যেন আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরিতে এনে জড় করা হয়। তাঁর যুক্তি ছিল যে ভাল বইএর আকর্ষণই টেনে আনবে দেশবিদেশের জ্ঞানীগুণি ব্যক্তিদের, এবং তাঁরাই কালে কালে রচনা করবে একটি নেতৃস্থানীয় জাতি—সারা ভুবন জোড়া থাকবে যাদের প্রভাবপ্রতিপত্তি। মধ্যযুগের ইসলামী আমলেও অভাব ছিল না জ্ঞানের প্রতি সেই নিষ্ঠার। রেনেসাঁর ইউরোপে অবশ্যই ছিল, বর্তমান যুগের পশ্চিমে তো বটেই—হার্ভার্ড-প্রিন্সটন-এমাইটির সুনাম তাদের বড় বড় দালানকোঠার জন্যে নয়, বড় বড় লাইব্রেরির জন্যে। লাইব্রেরির মূল্যটা আনাদের দেশ এখনো পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেনি। হংকং এর মত ক্ষুদ্র দেশ, পেরেছে।
সুবিধা থাকলেই যে সবাই তার সমান সদ্ব্যবহার করার ক্ষমতা রাখে তা নয়। দেশে দুয়েকটা লাইব্রেরিতে (লাইব্রেরি বলতে আমি বইএর দোকান বোঝাচ্ছি না, বোঝাচ্ছি পাব্লিক লাইব্রেরি, কলেজ ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরি, ইত্যাদি) গিয়ে আমি ল্পক্ষ্য করেছি, বই হয়ত আছে, কিন্তু পাঠকের অভাব। দীর্ঘদিনের অব্যবহার বইগুলো কেমন স্যাঁতসেঁতে হয়ে গেছে, ফুঁ দিলে ধূলো বেরোয়, পাতা খুললে ছাতা দেখা যায়। কিন্তু হংকংএ তা নয়। বই যেমন আছে পাঠকও তেমন। পাব্লিক লাইব্রেরি বা ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরিতে মাঝে মাঝে বসার জায়গা পাওয়া যায় না, এত ভিড়। আসলে এরা যে এত পড়ুয়া জাতি এটা আগে জানা ছিল না আমার। ইউরোপ-আমেরিকা-ক্যানাডাতে যেমন বিরাট বিরাট বইএর দোকান, সারা দেশব্যাপী যাদের শাখাপ্রশাখা ছড়ানো, যেমন বার্ন্স এণ্ড নোবল, কোলস, চাপটার্স—হং কংএ ঠিক একইরকম পুস্তকবিক্রেতার চেইন আছে গোটা দেশব্যাপী। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় বোধ হয় পেইজ ওয়ান। এ চেইন শুধু হং কং এ নয়, সিঙ্গাপুরেই দেখেছি। সম্ভবত বেইজিং-সাংহাইতেও আছে। এবং সেসব দোকানে ক্রেতার অভাব নেই। আমি একটা বই কিনতে গিয়েছিলাম হং কংএর পেইজ ওয়ানে—বইটা মাত্র বেরিয়েছে আমেরিকার বাজারে। গিয়ে দেখি ‘ সোল্ড আউট’! এ-ঘটনা বাংলাদেশের বাজারে ঘটে কিনা জানিনা। হয়ত ঘটে, বইমেলাতে হুমায়ূন আহমেদের বইএর ক্ষেত্রে সেটা স্বচক্ষেই দেখবার সুযোগ হয়েছে। কিন্তু কোনও সদ্যপ্রকাশিত বিদেশি বই, বিশেষ করে গল্প-উপন্যাস নয় এমন বই, তার কতখানি চাহিদা সেটা আমার জানা নেই। আমার দেশের মানুষ টাকা খরচ করে সিরিয়াস বিষয়ের ওপর বিদেশি ভাষায় লিখিত বই কেনে, ভাবতে অবিশ্বাস্য মনে হয়—অন্তত প্রবাসে তার খুব একটা দৃষ্টান্ত দেখিনি।
দুই
এশিয়া-আফ্রিকার অপেক্ষাকৃত অনুন্নত দেশগুলোর অধিকাংশেরই ঔপনিবেশিক ইতিহাস। এবং তাদের সার্বিক উন্নয়ন প্রচেষ্টার ধীরগতি সাফল্যের জন্যে সাধারণত সেই ইতিহাসকেই দায়ী করা হয়। এবং সঙ্গত কারণেই—শুধু রাজনৈতিক মহলে নয়, চিন্তাশীল বুদ্ধিজীবি মহলেও। ঔপনিবেশিক শাসন কোন জাতির জন্যেই কল্যানকর হতে পারেনা সেটা অনস্বীকার্য, কিন্তু এই সরল সমীকরণের একট ব্যতিক্রম বোধ হয় হংকং। হংকংএ ব্রিটেনের উপনিবেশ স্থাপনের সূচনা হয় ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে। আফিম বানিজ্য বন্ধ করার নাম করে তারা হংকং দ্বীপে প্রথম আবির্ভূত হয় ১৮৩৯ খৃষ্টাব্দে। তারপর ছলে-বলে-কৌশলে সেই ব্যবসাটি তারা নিজেরাই আয়ত্ত করে নেয়। তাতে যে সঙ্ঘাত সৃষ্টি হয় দুই দলে তার পরিসমাপ্তি ঘটে তিন বছর পর, ১৮৪২ সালে। ব্রিটিশ রাজ তার শক্তিশালী নৌবাহিনীর সাহায্যে গোটা অঞ্চলটাতেই আধিপত্য স্থাপন করে ফেলে। বলতে গেলে তখন থেকেই হংকংএ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার শুরু। তবে উপনিবেশ হিসেবে হংকং ছিল খানিক স্বতন্ত্র—ভারতবর্ষের মত সরাসরি কলনি বা উপনিবেশ না হয়ে তাদের অবস্থান দাঁড়ালো ‘প্রটেক্টরেট’ বা রক্ষিত এলাকা বলে। কার্যত হংকং ব্রিটেনের একটি বানিজ্যবন্দরে পরিণত হয়ে গেল। এবং অত্যন্ত লাভজনক বানিজ্য। ভারতের মত ‘সোনার মুকুটে হীরকখণ্ড’ হয়ত ছিল না হংকং, কিন্তু দূরপ্রাচ্যের যত ব্যবসাবানিজ্য তার কেন্দ্রস্থল হিসেবে হংকংএর ভূমিকা ছিল অপরিমেয়। তাই নিজেদের স্বার্থেই ভারতবর্ষের মত সেখানেও একটি দক্ষ, ইউরোপিয়ান শিক্ষাদীক্ষায় দীক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজ গড়ে তোলে। আয়তন ছোট হওয়ার ফলে সেই পশ্চিমায়নের প্রক্রিয়া ভারতে যতটা সফল হয়েছিল তার চেয়ে শতগুণে বেশি সফল হয়েছিল হংকংএ। স্কুলকলেজে ইংরেজী শিক্ষার ব্যাপক প্রসার, ইংরেজী বইপত্র দিয়ে বাজার ছেয়ে ফেলা, ব্রিটিশ পণ্যদ্রব্যের প্রতি স্থানীয় লোকেদের একটা দুর্বলতা সৃষ্টি করা—অর্থাত সর্বদিক থেকেই হংকং শুধু কলনি নয়, কার্যত ব্রিটেনেরই একটি অংশ হয়ে দাঁড়ায়। সেখানে ইংরেজী বলতে পারেনা বা বুঝতে পারেনা এমন লোক খুব বেশি নেই। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে যখন কমুনিষ্ট রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় চীনে তখন হংকংএর বেশির ভাগ লোক কমুনিষ্ট শাসনের সঙ্গে যুক্ত হবার চাইতে বরং ব্রিটিশ প্রটেক্টরেট হিসেবেই থাকতে পছন্দ করে। ব্রিটেন সেখানে পশ্চিমের মুক্তসমাজের বিবিধ মূল্যবোধ ও আইনকানুন প্রবর্তন করার ফলে নাগরিকদের মধ্যে গণতন্ত্র, মুক্ত ধনতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, মানবাধিকার, এসবের প্রতি আসক্তি সৃষ্টি হয়ে যায়। এগুলোকে বিসর্জন দিয়ে মাওবাদি সাম্যবাদকে মুক্তহস্তে গ্রহণ করার ব্যাপারে অন্তত মধ্যবিত্ত শ্রেনীতে ছিল প্রচণ্ড দ্বিধা। শেষে যখন মার্গারেট থ্যাচার আন্তর্জাতিক চাপ এবং হংকংএরই মুক্তিকামী মানুষদের দাবিদাওয়ার মুখে নতি স্বীকার করে ১৯৯৭ সালে ব্রিটেনের পতাকা অপসরণ করে নেবার প্রতিশ্রুতি দেন তখন ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের মধ্যে বেশ একটা আতঙ্কের আবহাওয়া সৃষ্টি হয়ে যায়—পালাই পালাই বলে অনেকেই অস্ট্রেলিয়া-ক্যানাডায় বসবাস স্থাপন করার পরিকল্পনা নিতে শুরু করে। কিন্তু তাদের আশঙ্কা শেষ পর্যন্ত অমূলক প্রমানিত করে চীনের কমুনিষ্ট সরকার হংকংএর রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান অপরিবর্তিত রাখার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ২০৪৭ সাল পর্যন্ত তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলেছে। তাতে নাগরিকদের প্রাথমিক ভয়ভীতি অনেকখানিই প্রশমিত হয়ে গেছে। আজকের হংকং ঠিক সেই আগেকার হংকংএরই মত—পশ্চিমা পণ্য দিয়ে বাজার বোঝাই, পশ্চিমা পোষাকআশাক খাবার দাবার, ব্যবসাবানিজ্য, চলনবলন, আগে যা ছিল এখনও তাই। এ যে আসলে একটি কমুনিস্ট রাষ্ট্রের অংশ সেটা হংকংএর রাস্তাঘাটে অন্তত টের পাবার উপায় নেই। আমি ১৯৯৯ সালে প্রথম গিয়েছিলাম হংকংএ। তারপর গেলাম ২০০১ সালে। এবার গিয়ে মনে হল আগের চেয়ে বরং আরো বেশি পশ্চিমায়িত হয়ে গেছে দেশটি। ছেলেমেয়েরা প্রকাশ্য রাস্তায়, মলে, মাঠে, কোলাকুলি করছে, চুমু খাচ্ছে, কেলি করছে, ঠিক যেমন দেখি পশ্চিমের পথেঘাটে। উচ্চমধ্যবিত্ত পাড়ার কোন মলেটলে গেলে বোঝাই যাবে না যে এটি নিউইয়র্ক মায়ামীর কোন মল নয়। এসব দেখে সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে হয় যে বিদেশি শাসন-দখল হংকংএর অর্থনৈতিক বা সামাজিক জীবনে অপূরনীয় কোন ক্ষতি হয়ত করতে পারেনি, হয়ত তাদের নিজেদেরই কোনও সুপ্ত প্রতিরোধ শক্তির কারণে।
তবুও কথা থেকে যায় যে বিদেশি রাজত্ব যত আপাতসুখই আনুক দেশে সেটা কখনোই পূর্ণ স্বাধীনতার সঙ্গে তুলনীয় হতে পারেনা। বিলেতের অধীনে থেকে তারা প্রায়-বিলেতি হয়ে গেছে বটে, বিলাস বৈভব হয়েছে প্রচুর, কিন্তু তা না হয়ে তারা চীন সংস্কারানুগ একটি মুক্ত ও সুস্থ সবল জাতি হয়ে উঠতে পারত। হতে পারত দক্ষিণ কোরিয়ার মত একটি বিপুল প্রভাব প্রতিপত্তিসম্পন্ন সমৃদ্ধ জাতি। হতে পারত ক্ষুদ্র সিঙ্গাপুরের মত একটি শীর্ষস্থানীয় দেশ। তা তারা এখনও হয়নি, ভবিষ্যতে হবে কিনা তারও কোনও নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু সম্ভাবনা আছে, বিপুল সম্ভাবনা। এজাতির প্রাণে সেতৃষ্ণা আছে, তার লক্ষণ সর্বত্র।
হংকংএর সাম্প্রতিক ইতিহাসের একটি মর্মান্তিক অধ্যায় আছে—দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জাপানের দখলে চলে যাওয়া। পুরো ৩ বছর ৮ মাস সেই দখলের যাঁতাকলে আবদ্ধ ছিল তারা। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রথমদিকে জাপান তাদের বোমারু বিমানের ঝটিকা আক্রমন দ্বারা দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় পুরোটাই দখল করে ফেলেছিল। বার্মা হয়ে ভারতবর্ষের পথেও তারা অগ্রসর হচ্ছিল দ্রুতবেগে। কোলকাতার বন্দরে বেশ কবার বোমাবর্ষণ হয়। ঢাকাতে রোজ রাতে আমরা খাটের নিচে লুকিয়ে থাকতাম জাপানি হামলার ভয়ে। সেসময় সুভাষ বসুর মুক্তিফৌজ ব্রিটিশ শাসনের পতন ঘটানোর উদ্দেশ্যে জাপানের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল—-আমাদের স্বদেশী আন্দোলনের অনেক কর্মীরই সমর্থন ছিল তাতে। তখন অবশ্য আমাদের জানা ছিল না, বা থাকলেও তার পূর্ণ গুরুত্ব উপলব্ধি করবার পরিস্থিতি হয়ত ছিল না যুদ্ধের উত্তেজনাতে যে বিদেশি আক্রমণকারি শক্তিসমূহের মধ্যে পৃথিবীতে যদি সত্যিকার কোনো বর্বর জাতি থেকে থাকে সে হল জাপান। জাপানের অধীনে একদিনও জীবনযাপন করতে হয়নি আমাদের, এ যে কত বড় ভাগ্য সেটা বুঝতে হলে হংকংএর কাহিনী জানতে হবে।
যুদ্ধের প্রথমাবস্থায় ব্রিটেনের অবস্থা বেশ শোচনীয়। একদিকে ইউরোপের জার্মান বাহিনী একে একে রাজ্য দখল করে যাচ্ছে, খোদ ব্রিটেনে কখন আক্রমন হয় সেভয়ে তটস্থ সবাই। অপরদিকে দক্ষিণপুর্ব এশিয়ার উপনিবেশগুলোতে অনবরত বোমা নিক্ষেপ করে যাচ্ছে জাপান, দখল করে যাচ্ছে একের পর এক দেশ। ‘৪১সালের ৮ই ডিসেম্বর জাপানের হামলা শুরু হয় হংকংএর ওপর। ব্রিটেন তখন এতই দুর্বল যে জাপানের বিশাল বাহিনীকে বেশিক্ষণ ঠেকিয়ে রাখবার ক্ষমতা তাদের ছিল না। ২৫শে ডিসেম্বর তারা শর্তহীনভাবে আত্মসমর্পন করে জাপানের কাছে। হংকংএর তখন কোনও রক্ষক বা অভিভাবক বলএ কিছু থাকে না—হানাদার বাহিনীর করুনার ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। কিন্তু করুনার হৃদয় নিয়ে আসেনি জাপানীরা। নিঃশর্ত আত্মমসমর্পন সত্ত্বেও নিরস্ত্র অসহায় চীনাদের ওপর বন্য জন্তুর মত ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা। যেন গোটা চীন জাতির ওপরই কি এক আক্রোশ তাদের। তাদের মেরুদণ্ড চিরতরে ভেঙ্গে দেওয়ার জন্যে প্রতিজ্ঞা নিয়ে এসেছে যেন। দেশ দখল করার পরমুহূর্ত থেকে শুরু হয়ে যায় তাদের চরম ধংসলীলা। নির্বিচার খুনজখম, ধর্ষণ আর ব্যাপক লুটতরাজ সারা হংকংব্যাপী। প্রথম স্তরে তারা হংকংএর মুদ্রাকে প্রায় অচল করে ফেলে—-হাজার ডলার দিয়ে হয়ত বড়জোর একবেলার বাজার হত একটা পরিবারের। তারপর নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য, বিশেষ করে খাদ্যবস্তুর ওপর শুরু হয় চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রন। রেশনকার্ড ছাড়া কারুরই খাদ্যসংগ্রহ করার কোনও উপায় ছিল না। একটা পরিবারের যতটুকু খাবার না হলেই নয় তার চেয়ে হয়ত অর্ধেক বা তারও কম খাদ্য দেওয়া হত রেশনে। অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবেই সারা দেশটিকে অনাহার আর পুষ্টিহীনতার অস্ত্র দিয়ে জব্দ করার আয়োজন। বন্দুক দিয়ে যাদের মারা যায়নি তাদের তারা না খাইয়ে মারার উদ্যোগ নেয়। এবং বেশ সাফল্যের সঙ্গেই। ‘৪৫ সালে যখন যুদ্ধের মোড় ঘুরতে শুরু করেছে তখন হংকংএর ১৬ লক্ষ লোকের মধ্যে ১০ লক্ষই দেশ ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়—অধিকাংশই চীনের মূল ভূখণ্ডে। ‘৪১ সালে হংকংএর স্কুলগুলোতে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ছিল ৪৫,০০০ হাজারে ওপর। ‘৪৫ সালে সেটা দাঁড়ায় মাত্র ৪ হাজারে। তার দ্বিবিধ কারণ। এক, ব্যাপক হারে দেশত্যাগ, দুই স্কুলগুলোতে পুরোপুরি জাপানি শিক্ষা প্রবর্তন করার চেষ্টা। ছেলেমেয়েদের বাধ্য করা হত জাপানি অনুষ্ঠানাদিতে জাপানি জাতীয় সঙ্গীত গাইতে, জাপানি পোশাক পরিচ্ছদ পরতে। তাদের জাপানি ভাষা শিখতে বাধ্য করা হত। হং কং এর গতানুগতিক উত্সবাদি বাতিল করে জাপানের জাতীয় উত্সবে যোগ দিতে হত তাদের। পুরো জাতিটাকেই তারা আগাগোড়া জাপানের ধাঁচে গড়ে তোলার জন্যে উঠেপড়ে লেগে যায়। সাম্রাজ্যবাদ কখনোই কাম্য হতে পারেনা কোনও জাতির, কিন্তু জাপানি সাম্রাজ্যবাদের স্বাদ যারা পায়নি তারা বুঝবে না সাম্রাজ্যবাদের নিগড় কাকে বলে।
মহাযুদ্ধের আগেও একটা বড়রকমের পৈশাচিক ঘটনা ঘটেছিল—সেটা হং কংএ ঘটেনি, ঘটেছিল মূল ভূখণ্ডে—বিশেষ করে নানকিং শহরে। জাপানিদের অকথ্যরকম বর্বরতার অভিজ্ঞতা নানকিংবাসীদের যতটা ততটা হয়ত হংকংএরও নেই। সেসময়কার বেশ কিছু ভুক্তভোগীর সঙ্গে সাক্ষাত্কার নিয়ে এক প্রামান্য গ্রন্থ রচনা করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের এক অভিবাসী চাইনিজ পরিবারে জন্মলব্ধ লেখক-সাংবাদিক আইরিস চ্যাং( ১৯৬৮-২০০৪)। তাঁর এই বিখ্যাত (এবং কিঞ্চিত্ বিতর্কিত) গ্রন্থটির নাম ‘ রেইপ অফ নানকিং’, ১৯৯৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত। কাহিনীটা এরকম। ১৯৩৭ সালে জাপান নানকিং দখল করে নেয় এক তুচ্ছ অজুহাতে। দখল করার অব্যবহিত পর থেকেই শুরু হয়ে যায় তাদের গণহত্যা আর গণধর্ষণের মহাতাণ্ডব। জাপানি আইনের বইতে পরাস্ত শত্রুর কোনও নারীকে ধর্ষণ করার বিরুদ্ধে কড়াকড়ি বারণ। কিন্তু যুদ্ধের সময় আইন থাকে আদালতে, আর নারী হল চোখের সামনে। শত্রুপক্ষের নারী—জোয়ানদের থামায় কে? আইনের খাতিরে অবশ্য ধর্ষণ করার পর তারা মেয়েগুলোকে মেরে ফেলত যাতে জীবিত থেকে কোনদিন কাচারিতে সাক্ষী দিতে না পারে। মারা হত কিভাবে সেটা শুনলে আপনার গায়েরলোম দাঁড়িয়ে যাবে। গুলি করলে অনর্থক একটা গুলি খরচ হবে সেকারণে তারা পেটে বেয়নেট ঢুকিয়ে মেরে ফেলত, কিম্বা লম্বা ছুরি দিয়ে কেটে ফেলত মস্তক। হত্যা করেও তাদের যেন মন ভরতনা। অনেক সময় মেয়েগুলোর স্তন কেটে আঁস্তাকুড়ে ফেলে দিত, যোনিতে কাগজের মোড়ক ঠেসে রাখত। এমনই অবিশ্বাস্য পাশবিকতার ক্ষমতা ছিল তাদের। পুরুষদেরও ছাড় দেওয়া হয়নি। কাছাকাছি কোন মেয়ে না পেলে তারা পুরুষদের ওপরই চড়াও হয়ে যেত। বলাত্কারের পর তাদেরও তত্ক্ষনাত কতল করে ফেলত তারা। গুজবে প্রকাশ যে সম্রাট হিরোহিতোর এক চাচা গোপন নির্দেশ দিয়েছিলেন জাপানি সৈন্যবাহিনীকে যেন কোন জ্যান্ত চীনাকে কয়েদ না করা হয়। অর্থাত্ পাকড়াও করামাত্র কতল। গোটা শহরটাকেই একরকম শ্নশানে পরিণত করে ফেলেছিল তারা। রাস্তায় কোন চীনা পুরুষ থাকা মানে তার আয়ু শেষ। আর মেয়ে থাকলে তো কথাই নেই। আইরিস চ্যাঙ্গের বইতে অবিশ্বাস্যরকম সব বর্ণনা আছে যা পড়ে আমি সারাদিন খাবার মুখে দিতে পারিনি—-এত বীভত্স একটা জাতি হতে পারে কি করে। ‘৭১ এ আমরা পাকিস্তানীদের বর্বরতার কাহিনী শুনে ভাবতাম এর চেয়ে লোমহর্ষক ঘটনা নিশ্চয়ই পৃথিবীর আর কোথাও ঘটেনি। না, ঘটেছিল বইকি। নানকিং এ ঘটেছিল। ১৯৯৪ তে ঘটেছিল রোয়াণ্ডাতে—হয়ত ‘৭১ এর চাইতেও জঘন্য। গণহত্যা আর গণধর্ষণ ইতিহাসের এক অতি পরিচিত এবং অতি পুরাতন অধ্যায়। ধর্মযুদ্ধের সময় একাধিকবার ঘটেছে, দুপক্ষেই। এবং আমার দৃঢ় বিশ্বাস ভবিষ্যতে আরো ঘটবে।
নানকিংএ জাপানিদের বর্বরতার মাত্রা কোথায় পৌঁচেছিল তার একটা আভাস পাওয়া যায় আইরিস চ্যাঙ্গের বই থেকে তোলা এই পংক্তিটিতেঃ
“ জাপানিদের এক বিকৃত আমোদের উত্স ছিল চীনা পরিবারের সদস্যদের বাধ্য করা পরস্পরের সঙ্গে যৌনকর্মে লিপ্ত করা। পিতাকে দিয়ে জোর করে ধর্ষণ করানো হত কন্যাকে, ভাইকে তার সহোদরা বোনকে, পুত্রকে তার জন্মদায়িনী মাতাকে। এতে যদি কেউ সামান্যতম আপত্তি বা বিরোধিতা প্রকাশ করত তাহলে তত্ক্ষণাত্ তাকে মেরে ফেলা হত।“ (রেপ অফ নানকিং, ৯৫ পৃঃ)।
চ্যাং তাঁর বইতে লিখেছেন যে এক ইয়াংসি নদীর পারেই জীবন দিতে হয়েছিল দেড় লক্ষ চীনা বন্দীকে।
নানকিংএর এই করালরাত্রি অল্পতেই কেটে গিয়েছিল তা নয়। ‘৩৭ থেকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষ পর্যন্ত জাপানের দখলে ছিল তারা—অর্থাত্ অবিরাম প্রায় আট বছর!
এই যে নৃশংসতার ইতিহাস জাপানের হানাদার বাহিনীর, আন্তর্জাতিক সবরকম আইন আর রীতিনীতি নির্বিকারে লঙ্ঘণ করে যাওয়ার অবিশ্বাস্য কাহিনী (‘৭১ সালে পাকিস্তানী বর্বররাও প্রায় একই কাজ করেছিল), এই ইতিহাস কি কারও মনে আছে এখন? নানকিংএ যে এত বড় একটা ঘটনা আদৌ ঘটেছিল, এবং এত দীর্ঘকালব্যাপী সেটাই বা জানে কতজন? মানুষের সচেতন স্মৃতিতে জাপান সম্পর্কে কেবল একটা ঘটনাই জ্বলজ্বল করে সবসময়—হিরোশিমা আর নাগাসাকির ওপর ‘সাম্রাজ্যবাদী’ আমেরিকার আনবিক বোমাবর্ষণ। আমার কি মনে হয় জানেন? ‘৪৫ সালের সেই বোমাদুটি জাপানের মত গর্বিত জাতিকে পরাস্ত করেছিল ঠিকই, কিন্তু সাথে সাথে তাদের ইতিহাসকেও মুক্তি দিয়েছিল অমানুষিক অত্যাচারের যে সুদীর্ঘ ইতিহাস তাদের তার দায়ভার থেকে। মানুষ আজকে নানকিং এর নাম উল্লেখ করে না, করে কেবল হিরোশিমা ও নাগাসাকির। একেই বলে ইতিহাসের বিচার। আমি বলি ইতিহাসের স্মৃতিভ্রম।
তিন
কিন্তু চীন দুর্বলচিত্ত জাতি নয়। তারা ভাঙ্গবে কিন্তু নুইবে না। এত লাঞ্ছনা অপমান আর নির্যাতন অত্যাচারের পরও তারা নিজেদের দুঃখদুর্দশার জন্যে সর্বক্ষণ অন্যের ওপর দোষ চাপিয়ে নিজেদের দায়দায়িত্ব থেকে খালাস পাবার প্রবণতাকে প্রশ্রয় দেয়নি। দুর্যোগ কেটে যাবার পরমুহূর্ত থেকেই তারা পুনর্গঠনের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছে তুমুল উত্সাহ নিয়ে। আজকে তারা শুধু মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে বললেই সব বলা হয়না, বলতে অন্য সকল জাতির মাথা ছাড়িয়ে যেতে শুরু করেছে। আজকে চীনের কাছে বলতে গেলে গোটা পশ্চিম বিশ্বই আর্থিকভাবে জিম্মি। ইউরোপ-আমেরিকার অনেকগুলো অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান, এমনকি সরকারও, প্রায় দেউলিয়ার অবস্থায়— চীন হল কার্যত সারা বিশ্বের ব্যাঙ্কার। দশ বারো বছর আগে চীনের সামান্য দোষত্রুটির গন্ধ পেলে পশ্চিম বিশ্ব থেকে লম্বা লম্বা বয়ান শুনতে হত তাদের, এখন বরং লম্বা বয়ান পশ্চিমকেই সহ্য করতে হয়। এমনকি জাপানেরও সুর বদলে গেছে চীনের প্রতি—তাদের কথাবার্তা আচার আচরণে নম্রতা এসেছে। এর নাম ইতিহাসের প্রতিশোধ।
চীনের এই শক্তির উত্স কোথায় সেটা ভাববার বিষয়। সব ঘটনারই একটা কার্যকারণ সম্পর্ক আছে–‘দৈবাত্ ভগবানের ইচ্ছায় ঘটে গেছে’ জাতীয় কেতাবি ব্যাখ্যায় আশ্বস্ত হবার মানুষ আমি নই। এটা কি মাওবাদেরই বিলম্বিত ফলাফল? নাকি উত্তরমাও নব্য বস্তুবাদী সমাজতন্ত্র? পণ্ডিতরা এনিয়ে অনেক চিন্তাভাবনা করছেন—তাত্ত্বিক অর্থনীতিবিদ থেকে শুরু করে ইতিহাসবিদ প্রত্নতত্ত্ববিদ সমাজতাত্ত্বিক, সবার কাছেই চীন এক মহা বিস্ময়। আমি কোনও বিজ্ঞব্যাক্তি নই—ছোটখাট দুতিনটে ডিগ্রি থাকলেও কার্যত একটি প্রায়মূর্খ মানুষ। তবে আমারও একটা দৃষ্টিকোন আছে। আমার দৃষ্টিতে চীনজাতির এই দ্রুত উর্ধগতির যে চালিকাশক্তি তার মূলে তাদের হাজার হাজার বছরের দীর্ঘ ইতিহাস, তাদের কালচার। এই কালচারের প্রধান ভিত্তি হল কনফুসিয়াস নামক এক অসাধারণ জ্ঞানীগুনি ব্যাক্তির শিক্ষা ও বাণী। কনফুসিয়াসের জন্ম চীনের স্যানডং (বর্তমান নাম) প্রদেশের লু অঞ্চলে, খৃঃপূঃ ৫১১ সালে, মৃত্যু ৪৭৯ তে। তিনবছর বয়সে বাবা মারা যাবার পর তাঁর মা কোনও ক্ষমতাবান ব্যক্তির রক্ষিতা হয়ে ছেলের ভবিষ্যত বিপন্ন করার ঝুঁকি না নিয়ে পালিয়ে যান অন্যত্র, এবং যে ভাবেই হোক ছেলেকে মানুষ করে তোলার ব্রত গ্রহণ করেন। নিজের সব সাধ আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে তিনি মনোযোগ দেন ছেলের পড়াশুনাতে। কিন্তু ষোল বছর পার হতে না হতেই কনফুসিয়াস দ্বিতীয়বার এতিম হয়ে পড়েন। তার তিন বছর পর একটি বড় ঘরের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হয় তাঁর এবং তার কিছু পর থেকেই, অনেকটা গৌতম বুদ্ধেরই মত, সংসারধর্মের প্রতি অনীহা সৃষ্টি হয়। তবে বুদ্ধের মত পূর্ণ বৈরাগ্য অবলম্বন না করে তিনি জ্ঞানচর্চার সাধনাতে মগ্ন হয়ে পড়েন। কালে কালে তিনি দেশের অন্যতম সেরা চিন্তাবিদ ও সামাজিক দার্শনিক হিসেবে স্বীকৃতি পেতে শুরু করেন। তাঁর নিজের রচনায় বা সম্পাদনায় গোটা পাঁচেক গ্রন্থ প্রকাশিত হবার কথা জানা যায় ইতিহাসে—যার মধ্যে ‘Classics of Rites’ (ed.), ও ‘Springs and Autumn Arrivals’ (authored) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
কনফুসিয়াস কোনও ধর্মনেতা ছিলেন না, ছিলেন না দৈবপ্রেরিত ‘মহাপুরুষ’, কোনও ঝাড়ফুঁককরা সাধুসন্ন্যাসী। ছিলেন কেবলই একজন বড়মাপের বিজ্ঞব্যক্তি। খানিকটা প্লেটোর মত—যদিও কনফুসিয়াস ছিলেন প্লেটোর গুরু সক্রেটিসের (খৃঃপূঃ ৪৬৯-৩৯৯)প্রায় সমসাময়িক। কনফুসিয়াসের মৃত্যুর প্রায় একশ’ বছর পর তাঁর শিক্ষা ও বাণীসম্বলিত একটি সংকলন প্রকাশ করা হয়। শেষে যখন হান গোত্রের হাতে রাজ্যশাসন আসে খৃঃপূঃ২০৬ তে, তখন তাঁর বাণী আর শিক্ষাই হয়ে ওঠে নতুন সংবিধানের ভিত্তি। হান রাজত্ব বলবত্ ছিল ২২০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত। অবশ্য তার পরও কনফুসিয়াসের মূল শিক্ষা থেকে চীন জাতি কখনোই সরে যায়নি। বলতে গেলে গোটা জাতিটাই গড়ে ওঠে তাঁর মতাদর্শকে অনুসরণ করে।
কনফুসিয়সের চিন্তার প্রধান লক্ষ ছিল ব্যক্তিগত ও সামাজিক নৈতিকতা, মূল্যবোধ। একটা সুস্থ সুশীল ও সুন্দর সমাজ গড়ে তোলা—এই ছিল তাঁর মূলমন্ত্র। মানুষে-মানুষে গোত্রে-গোত্রে সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন কর, পরস্পরকে সম্মান করতে শেখ, পরস্পরের সঙ্গে মিলেমিশে চলতে শেখ, নম্রতা শেখ, ভদ্রতা শেখ। এসবই ছিল কনফুসিয়াসের সব কথার মূল কথা। হংকংএর চীনাদের সঙ্গে কথা বলে মনে হল, আহা, আমরা যদি এমন একজন শিক্ষক পেতাম। তাদের মধ্যে বুদ্ধের চাইতে বরং কনফুসিয়াসেরই বেশি প্রভাব বলে মনে হয়েছে আমার। দুহাজার বছরের পুরোনো একটা অভ্যাস যেজাতির সে অভ্যাস সহজে মুছবার নয়, যুগের হাওয়া যত প্রবলই হোক।
চীনের ইতিহাস যাঁরা জানেন মোটামুটি তাঁরা হয়ত বলবেন ওদেরও তো নিষ্ঠুরতার কাহিনী আছে, আছে নারীর প্রতি চরম অবজ্ঞা অসম্মান, আছে গৌত্রিক রেষারেষি ও যুদ্ধবিগ্রহের রক্তাক্ত অধ্যায়। সেটা আমি অস্বীকার করছিনা। কিন্তু সেই লজ্জার অতীত থেকে নির্গত হতে পেরেছে তারা অত অল্প সময়ের মধ্যে। আমি মনে করি তার পেছনে অলক্ষ্যে কাজ করেছে তাদের সেই কনফুসিয়ান ঐতিহ্য, যা তাদের জাতীয় চরিত্রের শেকড়ে পুষ্টি জুগিয়েছে যুগ যুগ ধরে। আমার একান্ত আশা, আমার অভাগা দেশটি, আজকের এই বিপুল অন্ধকারের সুড়ঙ্গতে পথহারা পথিকের মত ক্রমাগত হাতড়ে বেড়াচ্ছে চতুর্দিকে, আমরাও একদিন জাতীয় বিবেকের সেই নির্বাপিত শিখাটি পুনঃপ্রজ্বলিত করে একটি সত্যিকারের সুস্থ সমাজ গড়ে পৃথিবীর অন্যান্য শক্তিশালী জাতির শামিল হতে পারব।
চার
এবার আমি হংকং প্রসঙ্গে ফিরে যাব। চীনের ইতিহাস টেনে আনার উদ্দেশ্যটাই তাই—হং কংএর লোকজনদের দেখে যে একটা মুগ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে আমার মনে তার একটা ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা খোঁজার চেষ্টা। ওখানে গিয়ে সবচেয়ে প্রথমে যে জিনিসটা দৃষ্টি আকর্ষণ করল আমার সেটা হল ওদের ব্যবহার, ওদের সৌজন্যমূলক আচার আচরণ।
হংকং বিমানবন্দর থেকে ট্যাক্সি করে ইউনিভার্সিটির ফ্ল্যাটে যাবার কথা। ইউনিভার্সিটির অফিস থেকে ই-মেইল যোগে আগেই জানানো হয়েছিল আমাকে কোথায় কোন ঠিকানায় যেতে হবে, এবং ঠিকানাটি চাইনিজ ভাষায় লিখে দেওয়া হয়েছিল যাতে ড্রাইভার ভুল করে অন্য কোথাও না নিয়ে যায়। বিমান থেকে নেমে কতদূর যাবার পর কোন্দিকে মোড় নিলে ট্যাক্সি পাওয়া যাবে এবং আনুমানিক ভাড়া কি হতে পারে (৩৫০ হংকং ডলার), তা’ও উল্লেখ করতে ভোলেননি অফিসের সুদক্ষ মহিলাটি। তুমুলবেগে গাড়ি চালিয়ে ট্যাক্সিওয়ালা আমাকে গন্তব্যে পোঁছে দিল মাত্র ২৫ মিনিটের মধ্যে, মিটারে ভাড়া উঠল ২৩০ ডলার! ইংরেজিতে বললামঃ সব ঠিক আছে তো ড্রাইভার সাহেব? কারণ আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না ৩৫০ থেকে ২৩০এ নেমে যায় কি করে ভাড়া? নিশ্চয়ই কোন গোলযোগ আছে মিটারে। কিন্তু ড্রাইভার আমাকে অমায়িকভাবে জানালেন যে কোনও ভুল হয়নি, ইচ্ছে করলে ২৩০ না দিয়ে ২২৫ দিলেও তিনি অখুশি হবেন না! কথা শুনুন। যাই হোক আমি তার হাতে ২৩০এর পরিবর্তে ২৪০ দিয়ে নেমে পড়লাম বাক্সপ্যাঁটরা নিয়ে। কিন্তু যেখানে নামলাম সেখানে কোন বড় গেট ছিল না, কেবল একটা উঁচু সিঁড়ি, সোজ়া উঠে গেছে ছাত্রাবাসের দরজা পর্যন্ত। সন্দেহ হলঃ এটা মূল প্রবেশপথ হয় কি করে? দুহাতে দুই বোঁচকা নিয়ে অত উঁচু সিঁড়ি ভাঙ্গার তো কোন উপায়ই নেই আমার। ড্রাইভারেরও কোন দোষ ছিল না—সিঁড়ির মুখে একই ঠিকানা লেখা ছিল ছোট করে, অবিকল সেই ই-মেইলের ঠিকানা অনুযায়ী। মহামুস্কিলে পড়ে গেলাম। রাত তখন সাড়ে আটটা—-ইউনিভার্সিটিতে গ্রীষ্মের ছুটি—রাস্তাঘাট খালি। কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করব তারও কোন উপায় দেখছি না। কি আর করব। হাঁটা শুরু করলাম, মন খারাপ করে। নিশ্চয়ই সামনে একটু হাঁটলেই মেইন গেট পাওয়া যাবে, বোঝালাম নিজেকে। এই সিঁড়িতে কোন ছাত্রাবাসের অফিস থাকতে পারেনা। ড্রাইভার আমাকে সঠিক ঠিকানায় এনেছে বটে, কিন্তু না জেনে ভুল গেটে নামিয়ে দিয়েছে। মনে মনে ভাবছি। এমন সময় একটা ট্যাক্সি আমার পাশ দিয়ে উল্টোদিকে যাচ্ছে বলে মনে হল। একবার ভাবলাম ডাকা যাক। তারপর দেখি ট্যাক্সিওয়ালা নিজেই এসে থামল আমার কাছে। তাকিয়ে দেখি সেই একই ট্যাক্সিওয়ালা যে একটু আগেই নামিয়ে দিয়েছিল আমাকে। অত্যন্ত কাঁচুমাচু হয়ে বেচারি ক্ষমা চাইল আমার কাছে—সামনে গিয়ে মেইন গেট দেখার পর সে বুঝতে পারল তার ভুল, তাই ফিরে এসেছে আমাকে মূল গেটে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। সে যে কি স্বস্তি আমার। গরমে ঘামছিলাম সারাক্ষণ। পেটে দারুন ক্ষিদে—সেই প্লেনের খাওয়া সাতঘন্টা আগে তার পর আর মুখে দানা পড়েনি। কৃতজ্ঞতায় ভরে গেল মনটা।
পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও এধরণের সত্ ভদ্র ও সহৃদয় ট্যাক্সিচালক আছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই, তবে আমার চোখে খুব পড়েনি। হংকংএ বেশ কবারই ট্যাক্সির প্রয়োজন হয়েছিল। প্রতিবার প্রায় একই অভিজ্ঞতা আমার। এটা একটু ব্যতিক্রমী বলেই মনে হয়।
রাস্তাঘাট চিনতাম না। পথ হারিয়ে ফেলতাম মাঝে মাঝে। চেহারাতে আন্দাজ করতাম কে ইংরেজি বুঝবে কে বুঝবে না। জিজ্ঞেস করতাম অমুক জায়গায় কিভাবে যেতে হবে। লোকটি দিকনির্দেশ দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করতেন। না বুঝলে নিজের কাজ ফেলে আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন একটা সুবিধামত জায়গায় যেখান থেকে বাকি পথটা আমি নিজেই যেতে পারতাম। রেস্টুরেন্টে খেতে গেলে ম্যানেজার নিজে এসে সনম্র অভিবাদন জানিয়ে মেনু তুলে দিতেন হাতে, দেখিয়ে দিতেন কোন খাবারটা পশ্চিমারা পছন্দ করে বেশি (আমি পশ্চিমা অবশ্যই নই, তবে পশ্চিমেই থাকি সেটা হয়ত টের পেতেন), কোন খাবারে কি আছে ইত্যাদি ইংরেজিতে ব্যাখ্যা করে দিতেন। ওদের ভদ্রতা রীতিমত অস্বস্তিকর হয়ে দাঁড়াচ্ছিল, আমি যেন তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পেরে উঠছিলাম না। এত ভদ্র মানুষ হয় কি করে। আমার জন্যে বরাদ্দ করা অফিসটিতে একটি সদ্য-ডিগ্রি-করা পোস্টডক্টরেট ছাত্র ছিল চ্যান নামে। লম্বা সুপুরুষ চেহারা। আমাকে দেখামাত্র সে টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়াল, ঠিক আমাদের দেশের ছেলেদের মত, আমার চেয়ারটা ঠিকমত ঘুরিয়ে দিল যাতে আমার বসতে সুবিধা হয়। আমার মনে হল ৪০ বছরের দীর্ঘ অধ্যাপনার জীবনে এই ছেলেটির মত ভদ্র নম্র ও মার্জিত ব্যবহারের ছেলে আর দেখিনি—ক্যানাডায় না, বাংলাদেশেও না।
ভাবলাম, কনফুসিয়াসের শিক্ষা বোধ হয় জাতিটার মজ্জায় মজ্জায় ঢুকে গেছে—ভদ্রতা আর বিনীত ব্যবহার তাদের সহজাত প্রকৃতিরই একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ যেন।
হংকংএর নগর পরিকল্পনাও আমাকে চমত্কৃত করেছে। রাস্তাঘাট প্রশস্ত, পরিস্কার পরিচ্ছন্ন, সুনিয়ন্ত্রিত যানবাহন। এবং অবিশ্বাস্যরকম শৃংখলাবদ্ধ। গাড়ির পথে গাড়ি, হাঁটার পথে হাঁটামানুষ, সাইকেলের পথে সাইকেল, কোনরকম জটপাকাল নেই। সবুজ বাতিতে রাস্তা পারাপার হবে পথচারি নতুবা নয়, রাস্তা খালি থাকলেও কেউ লাল বাতিতে পার হতে চেষ্টা করবে না। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম আর ভাবতাম, আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন শিক্ষা বুঝি এইভাবে মানুষের রক্তস্রোতে প্রবেশ করে। হংকংএর দৈনন্দিন জীবনের যানবাহন ব্যবস্থা আমাকে সত্যি মুগ্ধ করেছে। এত মানুষ সেখানে অথচ এমন মসৃণভাবে চলছে সবকিছু যেন কোনও অদৃশ্য যন্ত্রের পরিচালনায়।
হংকংএর পাতাল ট্রেন (subway) হল আরেক বিস্ময়। এত সুন্দর সাজানো গোছানো ব্যবস্থা আমি অন্য কোথাও দেখেছি বলে মনে পড়ল না। লণ্ডনের মত বিশাল নেটওয়ার্ক হয়ত নয়, আবার টরন্টো মন্ট্রিয়লের মত স্বল্প এলাকা জুড়েও নয় হংকংএর পাতাল ট্রেন। বড় কথা যানবাহন ব্যাপারে তাদের চমত্কার পরিকল্পনা এবং দূরদর্শিতার ছাপ সর্বত্র। এত অসংখ্য লোক ওদের, ক্ষিপ্রগতি নদীর মত চলছে জনস্রোত, প্রতি রাস্তায় প্রতিমুহূর্তে, তবুও কোথাও নেই জানজট নামক কোনও বস্তু, নেই কোনও জটলা, ঠেলাঠেলি, বাকবিতণ্ডা, কথা কাটাকাটি। প্রতি এক মিনিট পর ট্রেন আসে স্টেশনে। দিনের বেশির ভাগ সময় প্রতিটি ট্রেনই যাত্রীবোঝাই—বসার জায়গা পাওয়া যায় না। প্রতিটি স্টেশনের প্রতিটি প্ল্যাটফর্মে দু’টি ট্র্যাক। জায়গায় জায়গায় বড় করে লেখা, ইংরেজি ও চাইনিজে, কোন ট্রেন কোনদিকে যাবে, কোন ট্র্যাকের ট্রেন কোন্ কোন্ জায়গায় যাত্রী বহন করবে এবং তাদের অবস্থান ঠিক কোথায় এই বর্তমান স্টেশন থেকে, সব পরিস্কার চিহ্নিত করা। ভিন্ন ভিন্ন লাইন ভিন্ন ভিন্ন রং দিয়ে দাগানো। একেক লাইন শহরের একেকটা এলাকাতে যাত্রী সরবরাহ করে। কোন্ লাইনের ট্রেন কোন কোন্ স্টেশনে অন্য লাইনের সঙ্গে মিলিত হয় তা’ও পরিস্কার করে লেখা, ট্রেনের বাইরে ও ভেতরে কয়েক গজ পর পর। ট্রেনের ভেতরে গোটা পাতালরেলের মানচিত্রটি চোখের সামনে, কামরার দেয়ালে। ট্রেনটির গতির সঙ্গে ছোট একটা আলোর ফোঁটা এগিয়ে যাচ্ছে পরবর্তী স্টেশনের দিকে, যাতে কোন যাত্রীই ভুল করে তার গন্তব্য ছাড়িয়ে অন্যত্র চলে না যায়। আজকাল ইউরোপ আমেরিকায় এই ব্যবস্থা চালু হয়েছে, কিন্তু কিছুদিন আগেও তা ছিল না। তবে হংকংএর পাতাল ট্রেনের স্টেশনগুলোতে একটা জিনিস দেখেছি আমি যা অন্য কোথাও দেখিনি। সেটা হল প্ল্যাটফর্ম আর ট্রেনের মাঝখানে একটা লম্বা উঁচু কাচের দেওয়াল। ট্রেন স্টেশনে এসে পূর্ণ যতিতে না আসা পর্যন্ত সেই দেওয়াল খুলবে না। খুলবে ট্রেনের দরজা খোলার সাথে সাথে। এবং ঠিক যেখানে ট্রেনের দরজা কেবল সেখানে, অন্য কোথাও নয়। ফলে যাত্রীবহনের জন্যে কেবল একটা জায়গাই নির্দিষ্ট, এবং সেজায়গাগুলো ট্রেন কর্তৃপক্ষ বুদ্ধি করে এরো দিয়ে দাগিয়ে রেখেছেন প্ল্যাটফর্মে। ট্রেনের দরজাগুলো ঠিক ওই দাগবরাবরই উন্মোচিত হয়, অন্য কোথাও না। এব্যবস্থার তাত্পর্য কি? নিরাপত্তা, শক্ত মজবুত নিরাপত্তা। এখানে কেউ ট্রেন ট্র্যাকের ওপর ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করতে পারবে না বা কেউ কাউকে ধাক্কা দিয়ে ট্র্যাকের ওপর ফেলে দিতে পারবে না। তাছাড়া যাত্রী পরিবহনের শৃংখলা তো আছেই।
সাবওয়েতে বেশ কবারই চড়বার সুযোগ হয়েছিল আমার দুসপ্তাহের মধ্যে। প্রতিবারই আমার যেন বিস্ময় কাটতে চায়না। আরো একটা জিনিস লক্ষ্য না করে পারিনি— যাত্রীদের স্বাভাবিক শৃংখলা ও পারস্পরিক সৌজন্য। যন্ত্রচালিতভাবেই তারা একে অন্যকে পথ করে দিচ্ছে, সিঁড়ি দিয়ে উঠানামা করতে সবসময় বাঁদিকে থাকছে—দেয়ালের গায়ে এরো দিয়ে পরিস্কার দাগানো না থাকলেও বোধ হয় তারা নিজে থেকেই তা পালন করত। এ কেমনতরো জাতিরে বাবা। এরা কি মানুষ না যন্ত্র? গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সত্ত্বেও তারা এতটা আত্মশৃংখলিত হতে শিখল কেমন করে?
ওই যে বললাম, আড়াই হাজার বছরের শিক্ষা।
তবে সব অভিজ্ঞতার সেরা অভিজ্ঞতা, যা নিজের চোখে না দেখলে হয়ত বিশ্বাসই করতে পারতাম না সেটা হল জাতিটার মৌলিক সততা। উদাহরণ দিই।
প্রথম যেদিন সাবওয়েতে চড়েছিলাম আমি সেদিন পুরো ভাড়া দিয়েই উঠেছিলাম—এর যে কোনও ব্যতিক্রম হতে পারে তা জানা ছিল না। পরের দিন আমার হংকংএর বন্ধুটি বলল, তুমি সিনিয়র, তোমার পুরো ভাড়া দেবার প্রয়োজন নেই, অর্ধেক দিলেই চলবে। ভাল কথা। ইউরোপ আমেরিকার মতই মনে হচ্ছে। কিন্তু আমি তো বিদেশি, আমার ভাড়া কমাবে কেন তারা? না, দেশি-বিদেশিতে কোনও তফাত্ নেই, ৬৫র ওপর হলেই হল। খুশি হয়ে বললাম, ঠিক আছে, চল যাই টিকিট অফিসে, সিনিয়ার টিকিট কেনা যাক। গেলাম অফিসে। লোকটা আঙ্গুল দিয়ে ইলেক্ট্রনিক মেশিনগুলো দেখিয়ে বলল, ওটাতে ‘কন্সেশন’টিকিটের বোতাম আছে, টিপলেই হবে। ওমা! আমি যে সত্যি সত্যি সিনিয়ার তার কোন প্রমান দেখাতে হবে না? লোকটা হাসল। না, লাগবে না, আমরা আপনাকে বিশ্বাস করি। চোখ ছানাবড়া করে আমি ‘কন্সেশন’এ বোতাম টিপে অর্ধেক ভাড়ায় টিকিট কিনলাম। কেনার পর মজা দেখার জন্যে টিকিট মেশিনের সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ নিশ্চিত ধারণা নিয়ে যে হংকংবাসীরা নিশ্চয়ই এই অসাধারণরকম ঢিলেঢালা ব্যবস্থার পূর্ণ সুযোগ নিচ্ছে। কেউ যখন পাহারা দিচ্ছে না, কোন দলিল প্রমানের প্রয়োজন হয়না, যে-কোন যাত্রী সিনিয়র বোতাম টিপে অর্ধেক ভাড়ায় যাতায়াত করতে পারে তাহলে তার সদ্ব্যবহার তারা কেন করবে না? ঢাকা-দিল্লি দূরে থাক নিউইয়র্ক-টরন্টোতেও নেহাত্ গর্ধভ না হলে কেউ পুরো ভাড়ায় ট্রেনে চড়ত বলে মনে হয়না। কিন্তু না, হংকংএ তা নয়। আমি ছাড়া আর একটি লোককেও দেখলাম না ‘কন্সেশনে’ বোতাম টিপতে। আমি হাঁ করে চেয়ে রইলাম। এ দেশ উন্নতি না করলে কে করবে? এরই নাম সততা। যে সততার পাহারাদার মানুষ নিজেই, বাইরের খবরদারির প্রয়োজন হয়না, সেটাই সত্যিকার সততা।
আরো একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম সেখানে—হংকংবাসীদের স্বাস্থ্যসচেতনতা। রাস্তাঘাটে বহু লোককে দেখেছি নাকে পট্টি( mask) লাগানো। রোগজীবানুর ভয়। খোঁজ নিয়ে জানলাম ২০০৩ সালে বড়রকমের একটা ফ্লু মহামারি হয়ে যাওয়ার পর থেকে হংকংবাসীরা ভীষণ সাবধান হয়ে গেছে। শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবরকম মানুষই এখন মাস্ক পরে। পৌরসভার কর্মী যারা রাস্তাঘাট পরিস্কার করে তারা তো অবশ্যই—কোনও ব্যতিক্রম দেখিনি। ফ্লুটির নাম সার্স—যার ঝাপটা ক্যানাডাসহ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল সেসময়। কিন্তু হংকং ছাড়া অন্য কোথাও আমি এতটা সতর্কতা দেখিনি রোগ প্রতিরোধের ব্যাপারে। এর মানে কোন কোন ব্যাপারে হংকং পশ্চিমের সমকক্ষ শুধু নয়, পশ্চিমকে বরং ছাড়িয়ে গেছে কিছুটা।
আমার এক ওলন্দাজ বন্ধু ছিল সেখানে। দুজনে মিলে একদিন হংকংএর মিউজিয়াম পাড়ায় গিয়েছিলাম। পাড়া বলার কারণ শহরের সব বড় বড় মিউজিয়ামগুলো সব এক জায়গায়—যেন একটা তোড়ায় সাজানো। এমন সুন্দর ব্যবস্থা সেখানে যে ভিন্ন ভিন্ন মিউজিয়ামের ভিন্ন ভিন্ন টিকিট তো আছেই, তদুপরি আছে একই টিকিটে সবগুলো মিউজিয়াম দেখে ফেলার ব্যবস্থা। এবং সেগুলো একই দিনে দেখে ফেলতে হবে তা নয় (মিউজিয়াম কি কখনো একদিনে শেষ করা যায় নাকি?), লম্বা মেয়াদ নিয়েও দেখা যায়। ব্যক্তিগতভাবে আমার বিশেষ আকর্ষণ ছিল ওদের ইতিহাসের মিউজিয়ামটি। তার ঠিক পাশেই বিজ্ঞানের মিউজিয়াম। উল্টোদিকে আর্ট মিউজিয়াম। কি সুন্দর পরিকল্পনা। পর্যটককে বারবার ম্যাপ দেখে শহরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত ঘুরপাক খেতে হয়না। সময় থাকলে আমি হয়ত সবগুলোতেই যেতাম, কিন্তু সময় কোথায়। গবেষণা এক জিনিস যার কোন দয়ামায়া নেই, ফাঁকি দেবার কোন ওজুহাতই তার কানে যাবে না। ছুটিছাটা বলে কিছু নেই সেজগতে। তাই হংকংএর কিছুটা ইতিহাস জেনেই ইতি টানতে হল। তবুও পরম তৃপ্তি নিয়ে আমরা দুজন ইউনিভার্সিটিতে ফিরে এসেছিলাম সেদিন। অনেক চড়াই উত্রাই আর উত্থানপতনের ইতিহাস দেশটার। খানিকটা চীনেরই মত। জানলাম ওদের আদিপুরুষদের পরিচয়—তারা কোত্থেকে, কিভাবে এবং কেন হংকং দ্বীপে এসে বসবাস স্থাপন করেছিলেন, কেমন ছিল তাদের জীবনধারা, কি খেতেন কি পরতেন, মোটামুটি সবকিছুরই একটা প্রাথমিক ধারণা পাওয়া গেল। আমাদের ঢাকার ‘কুট্টি’দের সঙ্গে অনেক বিষয়েই তাদের মিল আছে। ঢাকার কুট্টিদের মত হংকংএর কুট্টিসম্প্রদায়ও নতুন যুগের স্রোতে প্রায় অবলুপ্তির পথে।
একদিন বন্ধুরা আমাকে নিয়ে গিয়েছিল এক ভারতীয় রেস্টুরেন্টে—সাবওয়েতে বেশ কিছুটা পথ যাওয়ার পর একেবারে ডাউনটাউনের এক ঘনবসতি এলাকায়। ক্যানাডা আমেরিকার মত ভারতীয় রেস্টুরেন্ট নামেমাত্র কিন্তু কার্যত সিলেটি রেস্টুরেন্ট, সেখানে তা নয়। ভারতীয় মানে সত্যি সত্যি ভারতীয়। ওই রেস্টুরেন্টটির রকমসকম দেখে বুঝলাম শিখ মালিকানা—-অনেক পাগড়ি-দাড়িওয়ালা লোক সেখানে। ভিড় ছিলনা মোটেও—সন্ধ্যা ছটাতে পাকভারতের প্রায় কেউই রাতের খাবার খায়না সচরাচর, আমার মত উজবক প্রকৃতির লোক ছাড়া। অবশ্য খাওয়া শেষ হতে হতে প্রায় আটটা বেজে গেল, এবং লোকজনের ভিড়ও ভাড়তে লাগল দ্রুত। আমরা বিল চুকিয়ে উঠে আসব, তখন এক ভিন্নরকমের জিনিস দেখতে পেলাম যা বিলেত-আমেরিকার কোনও পাক-ভারতীয়-সিলেটি রেস্টুরেন্টে দেখিনি আজ পর্যন্ত—-গানের আসর। হারমোনিয়াম-তানপুরা সহকারে খাঁটি ভারতীয় সঙ্গীত। বলিউডি গান নয়, একেবারে চোস্ত ওস্তাদী গান। শুনতে ইচ্ছে হল বসে, কিন্তু সাথের অভারতীয় বন্ধু দুটির খাতিরে লোভ সংবরণ করতে হল। ভেবেছিলাম শহরের কোন ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের বিশেষ অনুষ্ঠান হবে হয়ত, কয়ানাডাতে যেমন দেখেছি। কিন্তু না, ম্যানেজার সাহেব জানালেন যে প্রতি শুক্রবারই এরকম জলসার আয়োজন হয় এখানে, রেস্টূরেন্ট কর্তৃপক্ষেরই সৌজন্যে, বোদ্ধা অতিথিদের মনোরঞ্জনের জন্যে। চমত্কার আইডিয়া, তাই না?
দুদিন পর বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি আবার বিমানবন্দরে। জীবনের অনেকটা সময়ই কাটল আমার বিমানবন্দরে—এক বন্দর থেকে আরেক বন্দরে। কখন গেলাম সেখানে কখন বেরুলাম সব যেন কেমন একাকার হয়ে গেছে। প্লেন আসছে যাচ্ছে, যাত্রীরা উঠছে নামছে, কেউ কাউকে চেনেনা জানেনা, তবুও তারা একে অন্যের সহযাত্রী, সবাই এক বিমানবন্দর থেকে আরেক বিমানবন্দরে জীবনের ঘাটে ঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
আকাশ থেকে দেখলাম নিচের দক্ষিণ চীন সাগর আমাকে হাতছানি দিয়ে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। মনটা কেমন ভার হয়ে রইল। আর কি আসা হবে এখানে? হয়ত না। আমার বেলা তো ফুরোবার পথে। কুলায় ফিরতে হবে শিগগির। মনে মনে বললামঃ বিদায় তুমি পূর্বসাগর। বিদায় হংকং, তুমি জানবেনা কখনো কত ধন আমি নিয়ে গেলাম তোমার ভাণ্ডার থেকে।
অটাওয়া, ১৭ই সেপ্টেম্বর, ‘১০
মুক্তিসন ৩৯
চীনে জাপানীদের নৃসংশতার ইতিহাস অতি জঘন্য। আপনার নীচের বক্তব্যটি খুবই অকাট্য মনে হল।
তারপরেও ভিন্ন কথা থাকে। জাপানে জাপানীদের দেখলে কিন্তু মনে হয় না, জাপানীরা এরকম জঘন্য কাজ করে থাকতে পারে। আপনি জাপান ঘুরে এলে মনে আপনার “চার” নম্বর অধ্যায়টি হুবহু জাপানীদের জন্যও এভাবেই লিখবেন।
@নৃপেন্দ্র সরকার,
ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্যে। আপনি ঠিকই বলেছেন—-জাপানে গেলে আমার নিশ্চয়ই একই ধারণা হত ওদের সম্বন্ধে। আসলে জাপানে না গিয়েও বোঝা যায় অনেকখানি। ওদের মত ভদ্র, নম্র, শান্ত, অমায়িক জাতি ক’টা আছে সংসারে। মানবচরিত্রের এই এক রহস্য—–ব্যক্তিমানুষ একরকম, গোষ্ঠীমানুষ সম্পূর্ণ ভিন্ন। একজন যখন বহুজন হয়ে যায় তখন তারা এক মানুষ থাকে না যেন। একজন কেবল তার নিজের জীবনের কথাই ভাবে, বহুজন হয়ত কিছু না ভেবেই হুজুগের বশে ধাবিত হয়। একেই বোধ হয় পণ্ডিতরা ‘মব মেন্টালিটি’ বলে আখ্যায়িত করেন। জানিনা। ভালো থাকুন, মীজান রহমান।