আমার মেয়ের পাসপোর্ট করতে আবেদন জমা দিয়েছি গত ৩০ নভেম্বর ২০১০ হরতালের দিন। ভিড় কম। আবেদন ফর্মে এক জায়গায় বড় হরফের জায়গায় ছোট হরফ লিখে ফেলার পরও ফর্মটি অযোগ্য ঘোষণা করে ফেরত না দিয়ে আর্মির লোকটি ঠিক করে দিলেন। এক দিনে দালাল ছাড়া টাকাসহ সব সেরে জমা দিয়েছি। পাসপোর্ট সরবরাহের তারিখ ৩০ ডিসেম্বর ২০১০। মাঝে পুলিশ ভেরিফিকেশন হয়ে গেল। ২২ ডিসেম্বর ২০১০ তারিখে আমার মেয়ের মোবাইলে এস এম এস এবং ই মেইলে বার্তা আসল পাসপোর্ট তৈরি। যেন সংগ্রহ করা হয়। অর্থাৎ নির্ধারিত তারিখের সাতদিন আগেই ২৩ ডিসেম্বর পাসপোর্ট সংগ্রহ করে নিয়ে আসলাম। চমৎকার সেবা। মনে হল যেন একটি আধুনিক দেশে বাস করছি। এর আগে আমার পাসপোর্ট করা নিয়ে নাইটমেয়ারের ইতিহাস মনে হল। সে স্মৃতি থাক। আমার মেয়ে অনায়াসে পাসপোর্ট পেল আর আমি যেন নাগরিক অধিকার উপভোগ করলাম। মনটা ফুরফুরে। আওয়ামীলীগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির ডিজিটাল বাংলাদেশ। তাদের সাফল্যের একটি উদাহরণ মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট সরবরাহ।
মেয়ে পাসপোর্টটি উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখে আমার হাতে দিল। আমি দেখতে দেখতে পাতা উল্টিয়েই মনে মনে খুশী। মায়ের নাম, বাবার নাম, উচ্চতা, ঠিকানা — এসবের বালাই নেই। চশমাটা পড়ে ভাল করে খেয়াল করে দেখে খটকা লাগল।
লেখা বংশগত নাম (Surname) ও প্রদত্ত নাম (Given Name) । আমার মেয়ের নাম প্রত্যাশা প্রাচুর্য। কাজেই বংশগত নামের নীচে লিখেছে প্রাচুর্য আর প্রদত্ত নাম লিখেছে প্রত্যাশা। হা হা করে হাসি ছাড়া উপায় কি? আমার মেয়ের বংশগত পরিচয় প্রাচুর্য!!! শেখ হাসিনার বংশগত নাম কি হাসিনা হবে আর প্রদত্ত নাম শেখ হবে? তবে কীভাবে পাসপোর্ট অফিস তা ঠিক করবে? নামের প্রথম (first), মধ্য (middle) এবং শেষ (last) অংশ লিখলে কি ভাল ছিল না?
তাছাড়া,আমি যতই ‘জন্ম হোক যথা তথা / কর্ম হোক ভাল’ দর্শনে বিশ্বাসী হই না কেন, রাষ্ট্রীয় সেবা মাধ্যম আমাকে তা করতে দিবে না। আমার আইডেন্টিটি বংশে তথা ধর্মীয় পরিচয়েই সীমাবদ্ধ রাখবে। আমার মেয়ে বাংলাদেশে বংশগত নামের আবরণে ধর্মীয় সংখ্যালঘু আর আমার বন্ধুর মেয়ে খানম ইউরোপে গিয়ে ধর্মীয় সংখ্যালঘু । সংখ্যালঘু হিসেবে জন্মই আজন্ম পাপে বাংলাদেশীদের বন্দী করে রাখাই যেন নিয়তি। মানুষ হিসেবে বসবাসের অধিকার নেই।

‘আমি বাংলায় গান গাই
আমি বাংলার গান গাই
আমি আমার আমিকে চিরদিন এই বাংলায় খুঁজে পাই।’
খুঁজে পাই কি? বাংলায় কথা বলার সময় শব্দ চয়নে হিন্দু মুসলমানকে চিহ্নিত করা যায়। পার্থক্য পাওয়া যায়। নিজেকে সীমাবদ্ধ বলয়ে আবিষ্কার করে বিমর্ষ হই। জল আর পানি পান করা ছাড়াও হিন্দুরা পাঠা বলির মাংস পছন্দ করে, আর মুসলমানের খাসী জবাই করে গোসত খাওয়া ফরজ। মুসলমানরা খাসী জবাই করা গোসত না খেলে ইসলাম যায়। হিন্দুরা গলা ধর থেকে আলগা করে খায় বলির মাংস। পাশাপাশি থেকেও আলাদা। আর একই বাড়ির বিভিন্ন ফ্ল্যাটে বসবাসের সুবাদে হিন্দু মুসলিম মিলে ভাগে খাসী কিনে আর্থিক সুবিধার জন্য। কিন্তু হিন্দুর আর বলির মাংস খাওয়া হয় না। নিজের তথাকথিত ধর্মীয় আচারকে জবাই করতে হয় মানিয়ে নেওয়ার সভ্যতা ও ভব্যতার কারণে। এর ফলে নিজেরা স্নায়বিক দুর্বলতায় ভোগেন। হারাম আর হালালের আবর্তে পড়ে আমি তো মাঝে মাঝে আদেশ আর নিষেধ ঘুলিয়েই ফেলি। আমি জবাই করা গোসতে আর বলির মাংসে স্বাদের কোন পার্থক্য পাই না। পশু হত্যা চলে দুটোভাবেই।

‘মা কথাটি ছোট্ট অতি’ জানা থাকলেও বেশিরভাগ মুসলমান আম্মার সাথে বেশি আবেগীয় সম্পর্ক অনুভব করে এবং বাবার স্নেহের আবরণে আব্বাকে দেখেন।
কাজেই আমার আমিকে চিরদিন এই বাংলায় খুঁজে পাই না।
আবার অনেক শব্দ কোন কোন পরিবারে ধর্মীয় পরিচয় হিসেবে নিলেও সাংস্কৃতিক প্রভাবে অন্য ধর্মের পরিবারেও ব্যবহার করে। যেমন—- বিসমিল্লাহ বলে শুরু করে দাও। এক হিন্দু পরিবারের সদস্যের সংলাপ। সিনেমা দেখার জন্য সিডি চালানো শুরু করার আগের সংলাপ। অথচ ঔ পরিবারই সংবিধান থেকে বিসমিল্লাহ শব্দটি সরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে সোচ্চার।

আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বন্ধুর স্বামী সরকারী কর্মকর্তা এক এগারো এর ঝামেলায় পড়েছিল। চাকরি ছেড়ে পালিয়েছিল। দৈনিক পত্রিকার খবর পড়ে খোঁজ খবর নেওয়ার জন্যে চেষ্টা করেও পাইনি। পরে শুনেছি ভয়ে মোবাইল বদলে ফেলেছিল এবং সীমান্তের ওপারে পাড়ি জমিয়েছিল। । তবে আমার এ বন্ধুটি এক এগারো এর ঝামেলাকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক চর্চার নেতিবাচকদিক হিসেবে দেখে না, স্বামীর দুর্নীতির বিষয়টি বেমালুম মুছে দিয়ে বিষয়টিকে সাম্প্রদায়িক ইস্যু হিসেবে দেখে।
এখন আওয়ামীলীগ আমলে আমার সহকর্মীর এক স্বামী বাসস এর মুসলিম ধর্মাবলম্বী সাংবাদিক চাকরিচ্যুত হয়ে বিষয়টিকে সাম্প্রদায়িকতার কালিতে চিহ্নিত করেন ঘরোয়া কথাবার্তায়। তাঁর জায়গায় হিন্দু ধর্মালম্বী একজনের নিয়োগ নিয়মানুযায়ী হলেও আওয়ামীলীগ আমল বলে হিন্দুরা রাজত্ব চালাচ্ছে এমনটাই মনে করেন তিনি।
সাম্পদায়িকতার এ মনোভাব কাটানোর উপায় কে বলে দেবে? আর কে ই বা তা দূরীকরণে এগিয়ে আসবে। নিজের অক্ষমতা, অসম্পূর্ণতা, অরাজকতা,অপরিপক্কতা ঢাকতে সাম্প্রদায়িকতার অস্ত্রহানে এবং জানে এ বড্ড ধারালো, শক্ত ও দীর্ঘস্থায়ী অস্ত্র।