১.
বিশ্বাস ও বিশ্বাসের জগৎ
একথা নিশ্চয় করে বলা চলে মানুষের সামগ্রিক ইতিহাসে তার সবচেয়ে অর্থহীন আবিষ্কার হলো বিশ্বাস। বিশ্বাস জ্ঞান বিরোধী এমন এক দূর্গম আঁধার যাকে মানবাবিষ্কারগুলোর মধ্যে নিকৃষ্টটি বিবেচনা করলে বাড়াবাড়ি হবে না। বিশ্বাস প্রাচীন, বিশ্বাস আদিম, বিশ্বাস অনর্থক। বিশ্বাসের বয়স প্রায় মানুষের বয়সের সমান। কারণ মানুষ যেদিন জান্তব স্তর ছেড়ে আলোয় মাথা উঁচু করেছে, সেদিনই তার পিছু নিয়েছে বিশ্বাস নামের কিম্ভূত এক ছায়া। সেজন্য বিশ্বাসকে বলা হয় অস্পষ্ট মনের বোধহীন আবর্জনা। বিশ্বাস জ্ঞানহীন খর্বাকৃতি এক বামন। তাই জ্ঞানের শীর্ষবিন্দুতে কখনই তা উঠতে পারেনি। বাংলা ভাষায় মানুষের একটা মূল্যহীন সান্ত্বনা আছে- ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর।’ আমার মনে হয় বাংলাতে এর চেয়ে বড় কৌতুক আর নেই। অভিজিৎ রায় এ প্রসঙ্গে যথার্থই মন্তব্য করেছেন, ‘এ যেন ডুবন্ত মানুষের শেষ খড়কুটো ধরে অনেকটা যুক্তিহীন ভাবেই অন্ধ বিশ্বাসের পক্ষে সাফাই গাওয়ার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা’[১] বিশ্বাসে কোন বস্তু মিলতে পারে এমনতর দূর্ঘটনা আজও শুনিনি। রায়ের সাথে সম্পূর্ণ একমত হয়ে বলব বিশ্বাসে যদি বস্তু মিলত তাহলে আজও বোধকরি সূর্য পৃথিবীর চারিদিকে ঘুরত। মোসেনিগো একবার ব্র“নোকে নাকি জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তাহলে আপনি কোন ধর্ম বিশ্বাস করেন? উত্তরে সে বলেছিল ‘যা প্রত্যেকটি আইন ও প্রত্যেকটি বিশ্বাসের শত্র“।’[২] এজন্য বিশ্বাসের শত্রু হলো জ্ঞান, অন্য কথায় জ্ঞান বিশ্বাসের শত্রুঘ্ন। জ্ঞান ও বিশ্বাস যেন একই মূদ্রার দুই ভিন্ন পীঠ। তাই জ্ঞানের অন্য নাম সত্য। তবে এ সত্য বাস্তবের সাথে চিন্তার এক দ্বান্দ্বিক মিথষ্ক্রিয়া, নিছক আবোল-তাবোল ছেলে ভুলানো ছড়া নয়।
বিশ্বাস হলো এ জগৎ জীবন সম্পর্কে অতি আজগুবি, সরল, কল্পনাবৃত, চিন্তাহীন ও পর্যবেক্ষণবিমূখ আষাঢ়ে গল্প। বিশ্বাসের মাঝে কোন জিজ্ঞাসা নেই; নেই কোনরকম কৌতুহলের ছিটেফোঁটা। সম্ভবত বিশ্বাসের মাঝে আছে অবদমিত উৎকণ্ঠা। বিশ্বাস অনন্তকালের এক থিতু পাথর। বহুদিন ধরে মানুষকে ঠকিয়ে আসছে বাটপাড়ের মত। বিশ্বাস কী কারণে সৃষ্টি তা কেউ জানে না। এ যেন পিতৃহীন সত্যকাম, ভর্তৃহীনা জবলার কোলে আচমকা আগমন। বিশ্বাসকে কেউ কোনদিন প্রশ্ন করে না। মনে করে প্রশ্ন করা পাপ। পাপের বয়সও মানুষের বয়সের সমান। অর্থাৎ বিশ্বাস হলো স্পর্শকাতর এক ভঙ্গুর পবিত্রতা। কারো ছোঁয়ার সাধ্যি নেই।
বিশ্বাস পুস্তকে ও প্রথায়। বিশ্বাস সামাজিক দেওয়ালে যা কিনা দাঁড়িয়ে আছে জরাজীর্ণ দূর্গন্ধ ফাটল নিয়ে সহস্রাব্দ ধরে। বিশ্বাস মানুষকে সাম্যবাদী করেছে, ভেদাভেদ ভুলিয়েছে স্থান-কালের। তাই বিশ্বাসের জায়গায় অক্ষর জ্ঞানহীন প্রাকৃতজনের সংগে উচ্চ সনদধারী অধ্যাপকের কোন ফারাক নেই। এজন্য প্রাচীন গ্রীসের কল্পনাশ্রয়ী মানুষদের সাথে হালের অধ্যাপকদের কোন তফাৎ দেখিনা। বিশ্বাসের তীব্রতা অভ্রভেদী। জগৎ ছেড়ে নি:সীম শূন্যের দিকে প্রলম্বিত। এর জন্য অতিতুচ্ছ কীটের হাতে জ্ঞানীর প্রাণ বিয়োগ ঘটে, বিজ্ঞানীকে পুড়ে মরতে হয়, এমনকি হাসি মুখে নিজের প্রাণ পর্যন্ত বিসর্জিত হয় নিমিষে। এটা মানব-আবেগের সবচেয়ে ব্যয়বহুল মর্মান্তিক প্রকল্প।
বিশ্বাসের সাথে ভন্ডামির আছে নিবীড় যোগ, বিশ্বাস এজন্য সম্ভবত লোভী আর সন্ত্রাসীদের অফলা আস্থা। অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের ‘ বিশ্বাস’ নামের একটা কবিতা মনে পড়ছে-
‘জানো, তুমি, মহৎ ও সফল হওয়ার জন্য ভীষণ বিশ্বাসী হতে হয়?
বিশ্বাস রাখতে হয় সব কিছুতেই।
বলতে হয়, আমি বিশ্বাসী, আমি বিশ্বাস করি সভ্যতায়
বলতে হয় মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ
তাই এখন সবাই খুব বিশ্বাস করে
চারিদিকে এখন ছড়াছড়ি বিভিন্ন শ্রেণীর বিশ্বাসীর।’[৩]
বিশ্বাসীদের শত্রু হলো শিশু আর বিজ্ঞানীরা। কিছু কিছু দার্শনিকও আছেন এ দলে। তবে দর্শনের চাদর মুড়ি দিয়ে অনেক ছদ্মবেশী বিশ্বাসী মানুষকে পথভ্রষ্ট করেছেন অনেক কাল। শিশুরা বিজ্ঞানীদের মতই জগৎটাকে বুঝে নিতে চায় বস্তুকে চিন্তার কাগড়ায় দাঁড় করিয়ে। তাইতো সে মা’কে প্রশ্ন করে ‘এলেম আমি কোথা থেকে কোনখেনে তুই কুড়িয়ে পেলি আমাকে’। এ প্রশ্ন যেন যথার্থ দার্শনিকের। তবে পরিতাপের বিষয় বয়স বাড়লে সে জিজ্ঞাসায় মরচে পড়ে। হয়ে পড়ে সে সকরুণ বিশ্বাসী। এজন্য গত দিনের জ্ঞানী শিশু আজ অজ্ঞানী বুড়ো। এর কারণ চারিদিকে সুবিস্তৃত বিশ্বাসের ফাঁদ। তবে উল্লেখ না করলে অসম্পূর্ণ থাকবে কথিত কিছু বিজ্ঞানীকেও খুঁজে পাওয়া যাবে যারা বিশ্বাসের পচা নর্দমায় সাঁতরাচ্ছেন। এরা জ্ঞানের সম্ভ্রম কেড়েছেন উপর্যপুরী, নষ্ট করেছেন এর পবিত্রতা। বাংলাদেশে একজন পদার্থবিজ্ঞানের ইসলামী ব্যাখ্যাকারক আছেন যাঁকে টেলিভিশনে জ্ঞান ছিটানোর কাজে দেখা যায়। কী অদ্ভুত সাদৃশ্যানুসন্ধান করে যাচ্ছেন বিজ্ঞানে সাথে বিশ্বস্থ আপ্ত বাক্যগুলোর। মানুষের অন্ধত্বের সুযোগ নিয়ে সুকৌশলে বিজ্ঞানের বলাৎকারের কী অপূর্ব চেষ্টা!
বিশ্বাসের সাগর আজ পূর্ণ। জ্ঞানের একটা ফোঁটাও ধারণের অবকাশ নেই সেখানে। কয়েক হাজার বছর ধরে প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের ভুল মানুষেরা অস্পষ্টতা আর ধুয়াসার মাঝে মানুষকে চুবিয়ে রেখেছে। অন্ধ আর লোভী মানুষদের এই প্রক্রিয়াকে প্রতিহত করতে কত প্রাণ বলি হয়েছে তার খবর কে রাখে? এই পৃথিবীটা বিশ্বাসের এক মহা কৃষ্ণগহ্বর। অজস্র মানুষ এই অসীম ঘনত্বের মাঝে নিজের জ্ঞানকে হারিয়ে ফেলে। তবে সংখ্যায় অত্যল্প হলেও কিছু মানুষ জ্ঞানের এই অজস্র প্রতিবন্ধীদেরকে পেছনে ফেলে এগিয়েছে বিপ্লবের মশাল নিয়ে। জগৎটা এগিয়েছে এঁদের জন্য। জানিয়ে দিই এসব সাহসী ও প্রখর ধীশক্তির মানুষগুলোর চিন্তা নিয়ে সমকালে রচিত হয়েছে অপূর্ব বিজ্ঞান-সন্দর্ভ অভিজিৎ রায়ের ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ গ্রন্থখানি। পাঠকদের পড়তে বলব। এরপর দেখি বিশ্বাসের রকমফের গুলো কী কী?
২.
বিশ্বাসের ধরন
বিশ্বাস নানান পদের, নানান কিসিমের। পৃথিবীতে এর মতো বিচিত্রাভিমূখী প্রতীতি আর নেই। যত মানুষ, তত বিশ্বাস। আর যত বিশ্বাস, তত আদিমতা। অর্থাৎ জগৎ সম্পর্কে মানুষের ধারণা যত আদিম সেখানে অস্পষ্টতা তত বেশী। এ কারণে প্রাচীন গ্রন্থগুলো বিশ্বাসের জড়পিন্ড। এগুলো অন্ধকার এক প্রদেশ। আলো প্রবেশের রাস্তা নেই সেখানে। ইতিহাস শিক্ষা দেয় জগৎ ও জীবন সম্পর্কে মানুষের ধারণা যত প্রাচীন বিশ্বাসের গভীরতা তত বেশী। যত জ্ঞান এগিয়েছে, বিশ্বাসের বাঁধন তত শিথিল হয়েছে। তবু উদ্বেগের ব্যাপার হলো বিশ্বাস রয়ে গেছে মানুষের মনের সুগভীর প্রকোষ্ঠে সযতেœ লালিত স্বর্ণদানার মত। কিছুতেই এর মৃত্যু নেই।
বিশ্বাসকে মোটাদাগে দু’ভাগে ফেলা যায়। একভাগ বেশ খানিকটা উচ্চমার্গীয় অন্যটা ধারণাতীত ভাবে নিকৃষ্ঠ। ভাববাদ এই উচ্চমার্গীয় বিশ্বাসের এক সূক্ষ্মতম ফলাফল। অন্যদিকে যাকে নিচু বিশ্বাস বলা হয়েছে তা যেন যুগব্যাপী পরিভ্রমনান্তেও এক অক্লান্ত বৃদ্ধ। কিছুতেই তার যেন শেষ নেই।
ভাববাদকে সোজাসাপ্টা বলতে হবে, এটি হলো মানুষের অতি পৌরাণিক বিশ্বাসের নগরায়িত রূপ। নগরের শিক্ষিত মানুষ এই বিশ্বাসের নাম রেখেছেন ভাববাদ। তা বাদে সাধারণ খেটে খাওয়া গা ঘামানো মানুষ কিন্তু কোনদিনই ভাববাদের পাতা জালে ধরা দিইনি। লোকায়িত চিন্তা মানেই বস্তুবাদী চিন্তা। আর সাধারণত যে মানুষগুলোর গায়ে আছে মাটির গন্ধ তারাই লোকায়াতিক। এসব মানুষদের সহজ জীবন ভাবনা দৃশ্যমান জগতের প্রাচীর ভেঙে অতীন্দ্রিয়ালোকে ঢুকিনি। যা কিছু আমরা দেখছি, শুনছি, উপলব্ধি করছি তার প্রতি আস্থা নেই ভাববাদের। অথচ যা আমরা কষ্মিনকালেও পায়নি, ভাবনায় আনতেও কষ্ট হয় তা নিয়ে এই বিদ্যার মাখামাখি। দেবী প্রসাদ চট্রপাধ্যায় অতি সরল এই মানুষগুলোর চিন্তাকে ব্যক্ত করেছেন এভাবে-
‘লোকায়ত হলো ইহলোক-সংক্রান্ত দর্শন; যারা পরলোক মানে না, আত্মা মানে না, ধর্ম মানে না, মোক্ষ মানে না, তাদেরই বলে লোকায়াতিক। তারা মনে করে জল-মাটি-আগুন-হাওয়া দিয়ে গড়া মূর্ত পৃথিবীটাই একমাত্র সত্য, আত্মা বলতে দেহ ছাড়া কিছুই বোঝায় না। কথায় বলি বটে আমার দেহ, যেন আমি আর দেহ দুটো আলাদা কিছু। কিন্তু এ হলো নেহাতই কথার কথা। যেমন কিনা বলা হয় রাহুর মাথা। আসলে রাহু তো আর সত্যিই মাথাটুকু ছাড়া কিছুই নয়। তাহলে এই মানে অনুসারে লোকায়ত হলো দেহাত্মবাদ, বস্তুবাদ। ইংরেজী পরিভাষায় যাকে বলে মেটিরিয়ালিসম।’ [৪]
প্লেটোর কথাই ধরুন। তিনি বললেন এই প্রপঞ্চের সব কিছু ‘আনরিয়েল’। সবকিছুই ছায়া। তাহলে আসল কী? আসল হলো সেই পরমার্থ জগত। আমরা সেই জগতেরই ছায়া বৈ কিছু নয়। প্রাচ্যের শংকরাচার্য বলেছেন তার থেকেও কঠিন কথা। তিনি সোজাসাপ্টা বলে দিয়েছেন এ-জগৎ মিথ্যা। নিছক অজ্ঞানতার কারণে জগৎকে সত্যি ভাবা। ব্রহ্মবিদ্যায় পারঙ্গম হলে এ ভ্রম সংশোধন হয়। তখন বোঝা যায় ব্রহ্মণ ছাড়া এ জগতের সব কিছুই হেঁয়ালী, অলিক আর ধুয়াসা।
জগতকে মিথ্যে ভাবার প্রবণতা শুধু প্রাচীনকালের মানুষদেরই নয়, সমকালের দার্শনিক প্রবর ব্রাডলি, বোসাঙ্কে, ম্যাকটেগার্ড সহ আরো অনেকেই এ দৃশ্যমান জগতকে অবভাস ও অসত্য বলেছেন। দৃশ্যমান জগতের সবকিছু যদি মিথ্যে হয় তাহলে আমাদের বেঁচে থাকা, বেড়ে ওঠা, চিন্তা করার কি কোন মূল্য নেই? যদি চিন্তাকারীরই কোন মূল্য না থাকে তাহলে অবভাসিক জগতের পেছনে যে কথিত সত্তার জগৎ আছে সে ভাবনা কে ভাবল? যে অন্ন বস্ত্রে পরিপুষ্ট হয়ে চিন্তা করার সামর্থ পাওয়া গেছে সে জগতকে আমি মিথ্যা ভাবব কী করে?
বিশ্বাসীরা জিজ্ঞাসুদের নিরুৎসাহিত করেছে। অনেকক্ষেত্রে ভীতি প্রদর্শন করেছে। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই অস্ত্র দিয়ে থামাতে চেয়েছে। ভাববাদকে বলা যায় বৈদিক চাদরে মোড়া এক অর্থব দেহ। তবে লক্ষ্যনীয় ব্যাপার হলো এই প্রচেষ্টার সাথে সমকালে যুক্ত করার চেষ্টা হয়েছে যুক্তির। বিনা যুদ্ধে সূচাগ্রের অগ্রভাগও তারা ছাড়তে চায়নি। আপনাদের মনে আছে বার্ট্রান্ড রাসেল ও ফাদার কপলেস্টনের বিতর্কের কথা? বিষয়বস্তু ছিল ঈশ্বরের অস্তিত্ব । ১৯৪৮ সালে বিবিসির থার্ড প্রোগ্রামে এক বিরাট তর্কযুদ্ধ হয় এঁদের মধ্যে। প্রচন্ড যুক্তিবাদী ও নিরেশ্বরবাদী রাসেল যুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ন হয়েছিলেন ফাদার এফ.সি. কপলেস্টনের সঙ্গে।[৫] বেশ নাস্তানাবুদ হলেও ফাদার কিন্তু হাল ছাড়তে রাজী না। যুক্তির নামে ছাই-পাশ ঝগড়া করে রাসেলকে কাবু করতে চেয়েছিলেন। আদতে এরা হারলেও কিন্তু হারানো কষ্ট।
প্রশ্ন হলো মানুষ তাহলে কী বিশ্বাস করে? মানুষ বিশ্বাস করে এই প্রকান্ড জগৎ একজন দয়ালু পরমেশ্বরের ইচ্ছার পুতুল। কবির ভাষায়, ‘খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে বিরাট শিশু আনমনে’। যে বিরাট শিশু আনমনে খেলে চলেছে সে একাধারে পরম দয়ালু আবার সর্বোচ্চ বিচারকও। একাধারে দয়ালু ও বিচারক কিভাবে হওয়া সম্ভব মাথায় খেলে না। কারণ ভালো বিচারক হবেন দয়াহীন আবার দয়ালু হলে বিচারকই হতে পারবেন না। দন্ডিতের সাথে দন্ডদাতার প্রাণ কেঁদে উঠতে পারে, তাই বলে তিনি দন্ডিতকে মওকুফ করেন না। এ দুয়ের সমন্বয় কখনই সম্ভব নয়। জ্যাঁ পল সার্ত্র একটু ভিন্ন ভাবে দুটি ভিন্ন বৈশিষ্টের সমন্বয়হীনতার কারণে পরমেশ্বরকে বাতিল করেছেন। তিনি বলতে চেয়েছেন যিনি পরমেশ্বর হবেন তিনি হবেন পূর্ণসত্তা। কিন্তু কোন প্রাণযুক্ত সত্তা পূর্ণ হতে পারে না। কারণ যা কিছু প্রাণযুক্ত তাই সম্ভাবনাময়। অর্থাৎ সে যা সে তা নয়। অন্যদিকে একমাত্র জড়পদার্থই হবে পূর্ণ। কারণ সে ইচ্ছে করলে কিছুই হতে পারবে না। সে যা ঠিক সে তাই। সুতরাং ঈশ্বরকে একই সাথে প্রাণযুক্ত ও পূর্ণসত্তা হওয়া একেবারেই অসম্ভব। ঈশ্বরকে পূর্ণ হতে গেলে তাকে মৃত হতেই হবে। একই সাথে এই দুটি প্রত্যয়ের সমন্বয় কী করে সম্ভব? সার্ত্রের এই যুক্তিকে খন্ডন করতে কাউকে আমি এ পর্যন্ত দেখিনি।
মানুষ বিশ্বাস করে আসছে তাদের নিজ নিজ ধর্ম আর ধর্ম গ্রন্থই শ্রেষ্ঠ- অন্যগুলো মেকী। কেউ এ পর্যন্ত বলেনি তাদের নিজ ধর্মগ্রন্থে মিথ্যে কথা লেখা আছে। তবে অল্প কিছু মানুষ পাওয়া গেছে যারা আন্ত:ধর্মের মাঝে কিছু মিল অনুসন্ধান করে ধর্মগুলোকে চুড়ান্তভাবে অভিন্ন মনে করেছেন। এটা বেশ খানিকটা চালাকি। যদি ধর্মগুলো অভিন্নই হবে তবে এক ধর্ম ছেড়ে অবলীলায় মানুষ অন্য ধর্মে চলে যায় না কেন? আসলে ধর্মগুলো একে অন্যের থেকে ভয়ংকরভাবে আলাদা। যদিও প্রায় সব ধর্ম (বৈদ্ধ ধর্ম ও জৈন ধর্ম বাদে) ঈশ্বর কে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে তবুও তার ধরন, বৈশিষ্ট্য, কর্মকান্ড, রীতিনীতি গুলো একে অন্যের থেকে ভিন্ন। পৌত্তলিকতা, মদ্যপান, বেহায়াপনা, পর্দাহীনতা, উল্গধ্বনির বিরুদ্ধে জেহাদ করে ইসলাম প্রবর্তিত হয়েছিল। সেই ধর্ম কী করে এগুলোকে মানবে? সত্যিটা হলো ধর্মকে মানুষ মানেনি। বিভিন্ন ধর্মের মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান আজ সম্ভব হয়েছে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও ভাষিক মেলবন্ধনের কারণে। মানবতার জন্য। কারণ সব মানুষই এক, ধর্ম নয়। ধর্মের উপজাত হিসেবে জন্ম নিয়েছে নানান বিশ্বাস। সঙ্গতকারণেই বিশ্বাসগুলোর মাঝে সৃষ্টি হয়েছে বিরাট ফারাক। জগতের উৎপত্তি, জীবনের আবির্ভাব, মৃত্যু, মৃত্যু পরবর্তী অবস্থা, নৈতিকতা, জীবনের চরম পূর্ণাঙ্গতা ইত্যাদি বিষয়ে তাই ধর্মগুলো একমত হতে পারেনি। পারার কথাও নয়। কারণ এদের মাঝে আছে মৌলিক পার্থক্য। ফলশ্র“তিতে এসবের দার্শনিক সম্প্রদায়ের মাঝেও রয়েছে পার্থক্য। যেমন- জীবনের পূর্ণাঙ্গতা নিয়ে ভারতীয় দার্শনিকরা যা বলেছেন মুসলিম দার্শনিকরা তার সাথে একমত হননি। একমত হননি শুধু বৌদ্ধিক কারণে নয়, কারণটা হলো গ্রন্থ, যে গ্রন্থকে ভর করে গড়ে উঠেছে স্ব-স্ব দর্শন।
এসব বেশখানিকটা উচ্চ মার্গীয় দর্শন-বিশ্বাস ছাড়াও মানুষ অতি নিকৃষ্ট মানের প্রথাসিদ্ধ বিশ্বাস দ্বারাও আক্রান্ত। ভুত-পেত, জ্বীন-পরি, যাদু-টোনা, বানমারা, বশিকরণ, নষ্ট করা, বাটি চালান, বদনা পড়া, তুক-তাক, তন্ত্রমন্ত্র, শীতলা-শনির দশা, নজর বান ইত্যাদির সাথে যুগ যুগ ধরে ভেসে আসা সংস্কার দ্বারাও মানুষ আষ্টে পৃষ্টে বন্দী। এগুলো তীব্র যুক্তিবাদী মনকেও অনেক সময় পূর্ণগ্রাস করে। আমরা দেখেছি অনেক সমাজতন্ত্রীকে, তাদের সহকর্মীর মৃত্যুর পর আত্মার শান্তি কামনায় মিলাদ মহফিলের আয়োজন করতে। পশ্চিমবঙ্গে অনেক কমরেডকে পুজা মন্ডবে দেখা যায় ঠাকুরের পদরেনু সংবাহন করছেন। নির্বাচন কালে এসব দৃশ্য বেশী দেখা যায়। এফ.সি.পি.এস পরীক্ষার আগে ঘন ঘন মন্দিরে যাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন আমার নামকরা ডাক্তার ভাগিনা। যুক্তিবিদ্যা পড়ানো অনেক অধ্যাপককে দেখেছি কাকতালীয় ঘটনার উপর আস্থা রাখতে। টিকটিকি ডাকলে ‘সত্যি’, ‘সত্যি’ বলে বিড়বিড় করা মানুষ প্রচুর পাওয়া যাবে। যাত্রাকালে হাঁছি দিলে অমঙ্গলের গন্ধ পান শতকরা নিরানব্বই জন। সপ্তাহের সাতটি দিনই পবিত্র। কতনা ভাল-মন্দের স্বাক্ষী। তারপরও শনিবার অশুভ, বৃহস্পতিবার বার বেলা অমঙ্গলের, ‘মংগলে ঊষা বুধে পা যথা খুশি তথা যা’- ইত্যাদি সংস্কারে বাঙ্গালী প্রাণ পরিপূর্ণ। জ্ঞানের পূণ্যভূমি খোদ ইংল্যান্ডের মানুষও অনেক সংস্কারে আক্রান্ত। এক জরিপে পাওয়া গেছে ইংল্যান্ডের প্রায় ৬৪ শতাংশ মানুষ সে দেশে বসবাসরত সংখ্যালঘুদের নিয়ে নানা কুসংস্কারে বিশ্বাস করে (দেখুন Prejudice of England ওয়েব পেজে)। ভাগ্যরেখাগুলো কপাল থেকে সোজাসুজি হাতে কীভাবে উঠল আমার কোনমতেই ধারণায় আসে না। এর পর ভর করে গড়ে উঠেছে পামিষ্ট্রী (Palmistry) নামে এক অপবিদ্যা। অনেক মানুষের রুটির জোগাড় হয়ে যাচ্ছে বেশ এখান থেকেই। হাত দেখানোর উপর মানুষের উৎসাহ দেখে রীতিমত বিস্মিত হয়েছি আমি। আমার পরিচিত এক হস্তরেখাবীদ (পেশায় অধ্যাপনা) একদিন আমার সামনে মনখারাপ করে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কী ব্যাপার মন খারাপ কেন? উত্তরে বললেন, তার স্ত্রী এম.এ পরীক্ষায় বাজে ফল করেছে তাই। আমি বললাম, সেটা কবে জানলেন? বললেন, গতকাল রেজাল্ট দিয়েছে। আমি বললাম, সে কী, আপনি তো বিয়ের পর পরই হাত দেখে আদ্যপাস্ত সব জেনেছেন, এটা আবার নতুন কী? যে মানুষ অন্যের পাশ-ফেল, বদলী, স্বাস্থ্য, বিবাহ, উন্নতি, বিদেশগমন পট্ পট্ কর বলে দেন, তিনি নিজের স্ত্রীর রেজাল্ট টের পাননি- এ ক্যামন কথা? মোটকথা বিচিত্র বিশ্বাসে আচ্ছাদিত মানুষ দম বন্ধ হওয়া গুমট ধুয়ায় পরিশ্রান্ত। কেবলই পথ খুঁজেছে মুক্তির। ইতিহাসের সিঁড়ি বেয়ে মানুষ এগিয়েছে সামনে- আলোর খোঁজে। আর এরই মাঝে, আবির্ভাব ঘটেছে নবযুগের, আবির্ভূত হয়েছে বিপ্লবী চিন্তা নায়কদের।
৩.
বিশ্বাসের দেওয়াল ভেঙে বিজ্ঞানে
আগেই বলেছি আমরা এক অদ্ভুত সমাজে বাস করছি। যেটা কে বলা যেতে পারে বিশ্বাস আর বিজ্ঞানের ‘খিচুড়ি’। একই অঙ্গে দু’রূপ। কখনো বিশ্বাস কখনো বিজ্ঞান। আবার আছে বিশ্বাস বিজ্ঞানের যুগলবন্দী। ড. অজয় রায় এ চিত্রটি উন্মোচন করেছেন অপূর্ব ভঙ্গিতে-
‘বিজ্ঞানের যুক্তি চাইনা, চাই তার ফসল; পাশে থাকে অন্ধ বিশ্বাস আর ভাগ্যের কাছে আত্মসমর্পন। এই সমাজেই সম্ভব- ড্রইংরুমে রঙিন টেলিভিশন সেট স্থাপন এবং হিস্টিরিয়া আক্রান্ত কন্যাকে পীরের চিকিৎসা কেন্দ্রে প্রেরণ। এ সমাজেই সম্ভব অণুরসায়ন বিদের রসায়ন চর্চার পাশাপাশি তথাকথিত পীরের পদচুম্বন। এই সমাজেই সম্ভব রাষ্ট্রবিজ্ঞানী পন্ডিত কর্তৃক লোকায়ত রাষ্ট্রবিজ্ঞান শাস্ত্রে গবেষনাধর্মী পুস্তক প্রণয়ন, আর একই সাথে আটরশীর কামারঙের পীরের দরগায় গিয়ে তার চেয়ে কমশিক্ষিত ব্যক্তির কাছে আর্শীর্বাদ কামনায় ধর্না দেওয়া।’[৬]
একে যথার্থভাবে খিচুড়ি না বলে কি পার আছে? সুকুমার রায়ের ‘খিচুড়ি’[৭]-র কথা মনে করুন।
‘হাঁস ছিল সজারু (ব্যাকরণ মানি না),
হয়ে গেল “হাসজারু” কেমনে তা জানি না।’
বক কহে কচ্ছপে- “বাহবা কি ফুর্তি।
অতি খাসা আমাদের বকচ্ছপ মূর্তি।”
… … …
হাতিমির দশা দেখ-তিমি ভাবে জলে যাই
হাতি বলে “এই বেলা জঙ্গলে চল ভাই”
সিংহের শিং নেই, এই তার কষ্ট-
হরিণের সাথে মিলে শিং হল পষ্ট।
যুক্তি আর বিশ্বাসের এই অপূর্ব ‘খিচুড়ি’ যেন আমাদের চরিত্রের এক বিশেষ আয়না। একই অংগে এই দুই ভিন্ন রূপ ধারণ করে মানুষ দিব্যি আছে। বিশ্বাস এজন্যই মানুষকে একচোখা করেছে। এক সমাজের মানুষ অন্য সমাজকে অবলীলায় অপমান করে, এক ধর্মের ব্যক্তি অন্য ধর্মকে খুব সহজেই পদদলিত করে। আমরা দেখেছি, যুক্তরাষ্ট্রে রীটা আর ক্যাটেরিনার তান্ডবে মানুষ মারা গেলে পাকিস্তানে উল্লাস করতে। বলতে শুনেছি এটা স্রেফ গজব। অন্যদিকে পাকিস্তানের মোজাফারাবাদে ভূমিকম্প হলে তারা সম্পূর্ণ চুপচাপ। একেই বলে একচোখা কানা বিশ্বাস। এটা মুখটিপে হাসির মত কৌতুক। মানুষের এই অন্ধত্বের কোন ঔষুধ আছে বলে মনে হয় না।
যাইহোক একথা আজ ইতিহাস থেকে বোঝা গেছে, মানুষের সামগ্রিক জ্ঞানের ইতিহাসে অন্তত: চারজন বিপ্লবী মানুষকে পাওয়া গেছে যারা বিশ্বাসের জগৎকে পদদলিত করে মানুষকে জ্ঞানের আলোয় স্মান করিয়েছে। এঁরা হলেন মহাবৈশ্বিক জগতে নিকোলাস কোপার্নিকাস (১৪৭৩-১৫৪৩), প্রাণিজগতে চার্লস ডারউইন (১৮০৯-১৮৮২), সমাজ বিজ্ঞানে কার্লমার্কস (১৮১৮-১৮৮৩), ও মনজগতে সিগমন্ড ফ্রয়েড (১৮৫৬- ১৯৩৯) এঁরা বাদেও যে কেউ ছিলেন না তা নয়। তবে জ্ঞানের ভিন্ন ভিন্ন পরিমন্ডলে এঁরা এক একজন যুগন্ধর।
হিরন্যগর্ভ (Cosmic Egg) থেকে মহাবিশ্ব সৃষ্টির রোমাঞ্চকর অনুভূতিগুলো মানুষকে মোহাবিষ্ট করে রেখেছিল বহুযুগ। ছান্দোগ্য উপনিষদে বর্ণিত আছে এসব শ্বাসরুদ্ধকর কল্পনাগুলো। প্রাচীন ইসলামী সাহিত্যে বিশ্বকে গরুর শিং-এর-উপর দাঁড়ানো অবস্থায় পাওয়া গেছে। পরযুগে অ্যরিষ্টটল ও টলেমী এই কল্পনাকেই টেনে লম্বা করেছেন। পৃথিবীকে বসিয়েছেন মহাবিশ্বের মাঝখানে। আর ঈশ্বরকে স্থাপন করেছেন স্তরশেষে দেবলোকে। কিন্তু এই অসত্য কল্পনাকে পদদলিত করে যিনি সৌরজগতের কেন্দ্রে পৃথিবীর জায়গায় সূর্যকে স্থাপন করেছিলেন তিনি সর্বকালের সেরা জ্যোর্তিবিজ্ঞানী পোলিশ যাজক নিকোলাস কোপার্নিকাস। মানুষের চেতনার জগতে এর থেকে বড় বিপ্লব বলতে গেলে খুব কমই ঘটেছে। বিশ্বাসের জমাট বরফ গলিয়ে তিনি মানুষের জন্য জ্ঞানের উষ্ণতা এনেছিলেন।
এই পৃথিবী যে অগনিত প্রাণীকূলের পদভারে মুখরিত তা একরাতের ভিতর কারো বিশেষ ইচ্ছায় তৈরী হয়নি। বরং অতি কালিক, ধীর ও ধারাবাহিক পরিবর্তনের মাঝ দিয়ে আজকের এই জীবকুলের আবির্ভাব। বহু বছর আগে আজকের মতো এই সভ্য মানুষগুলো পাওয়া যেত না। এরা কোনো অসভ্য জন্তু ও জানোয়ারদের বিবর্তনিক প্রক্রিয়ার ফলাফল। দেবলোক থেকে মর্তলোকে নামিয়ে যিনি জগতের অন্যান্য প্রাণীর সাথে মানুষকে অভিন্ন যোগসূত্রে গ্রথিত করেছেন তিনি সর্বকালের অন্যতম সেরা মানুষ চার্লস ডারউইন। চালর্স ডারউইন জৈব বিবর্তন তত্ত্বের মধ্যে বলেছেন, মনুষ্যকুল কোন দেবলোক থেকে হঠাৎ মর্তে আসেনি। এরা অপেক্ষাকৃত সরল নররূপী কোন স্তন্যপায়ী প্রাণীর উত্তরসূরী জ্ঞাতি-গোষ্ঠী। বিশ্বাসীদের পবিত্র গ্রন্থে এই আচমকা বর্জ্রপাতের জন্য আজও ডারউইন তাদের নিকট অনাহূত। কিন্তু যে সত্যটা তিনি উন্মোচন করেছেন তা বড্ড কঠিন। বিভিন্ন বিজ্ঞান তার সমর্থনও দিয়েছে। ফলে পবিত্র বিশ্বাসের মসনদ উঠেছে কেঁপে।
মানুষের তৈরী সমাজ এগিয়েছে এক দ্বান্দ্বিক সংঘাতের মাঝ দিয়ে। আদিম সমাজ থেকে শুরু হয়ে এই সংঘাত সামনে চলেছে নয় প্রতি নয়ের নিরন্তর মিথষ্ক্রিয়াকে অতিক্রম করে। এখানে বহির্জগতের কোন পবিত্র সত্তার ভূমিকা নেই। নেই কোন হস্তক্ষেপের খেলা। ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ট মানবতাবাদী দার্শনিক কার্ল মার্কস সমাজ বিকাশের অমোঘ নিয়ম দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী তত্ত্বের মাধ্যমে এটাই বলেছেন। মানুষের সমগ্র ইতিহাস হলো শ্রেণী দ্বন্দ্বের ইতিহাস। আর অর্থনৈতিক কর্ম প্রক্রিয়ার মাঝ দিয়ে সেই দ্বন্দ্ব আমাদেরকে নিয়ে চলেছে সাম্যবাদী এক মানবিক সমাজের দিকে। তাই কার্ল মার্কসকে ইতিহাসের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাকারক হিসেবে এক নতুন প্যারাডাইম প্রবক্তা বলা হয়েছে। এজন্য বিশ্বাসীদের তীব্র গাত্রদাহ এই সমাজ বিজ্ঞানীর জন্য।
মানব মনের বিভিন্নরকম ক্রিয়া প্রক্রিয়া এবং মানসিক গঠন সংক্রান্ত একটা সুস্পষ্ট কাঠামো তৈরী করেছিলেন মনোবিজ্ঞানী সিগমন্ড ফ্রয়েড। মানুষের অবচেতন মনের মাঝে যে-সব ঘুমন্ত প্রেষণা থাকে সেগুলো কিভাবে মানসিক ভারসাম্যের জন্য কাজ করে, তার মনোবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আমরা পেয়েছি ফ্রয়েডের নানান তত্ত্বে। কোপারনিকাস যেমনি বিরাট বিশ্ব কাঠামো সংক্রান্ত মানুষের বিশ্বাসের পরিবর্তন করে দিয়েছিলেন ফ্রয়েড তেমনি ক্ষুদ্র মনের ভিতর ঢুকে তার অব্যক্ত কথাগুলোর বিজ্ঞানভিত্তিক সমীকরণ বের করে এনেছেন। ‘স্বপ্ন’, ‘ব্যক্তিত্বের বিকাশ’, ‘সম্মোহন’ ইত্যাদি সংক্রান্ত নানা অলৌকিকতার বাঁধন ছিঁড়ে ফ্রয়েড সূচনা করেছেন এক নতুন যুগের।
পুরোনো, বাসি, মলিন আর অথর্ব চিন্তা আজ জ্ঞানীরা পরিত্যাগ করেছে। বিশ্বাসের সুকঠোর দূর্গ ভেঙে জ্ঞানের আলো ফেলেছে সেখানে। হাজার বছর ধরে অল্প কিছু বিপ্লবী হলেও এই জ্ঞানের মশালকে এগিয়ে নিয়েছে তারা। এই সমাজটাকে তাই জ্ঞাননির্ভর মানবিক সমাজ গড়ে তুলতে প্রয়োজন মুক্তমন, খোলা চিন্তা। বিশ্বাসমুক্ত বৈদ্ধিক সমাজ বিনির্মাণে তাই অস্পষ্ট, ধুয়াসা আর সংস্কার জড়ানো পুরোনো গল্পকে বিদায় জানাতেই হবে। মনে রাখতে হবে-
ন স্বর্গো নাপবর্গো বা নৈবাত্মা পারলৌকিক :।
নৈববর্ণাশ্রমাদীনাং ক্রিয়াশ্চ ফলদায়িকা:।
(স্বর্গ নরক, পরলোক তো দূরের কথা এমনকি মানুষে মানুষে যে সৃষ্ট ভেদাভেদ বর্ণাশ্রমধর্ম সকলেই মিথ্যা।)
তথ্য সূত্র
১. অভিজিৎ রায় : নৈতিকতা ও ধর্ম (এই প্রবন্ধটি ড. অজয় রায় সম্পাদিত স্বতন্ত্রভাবনা, মুক্তচিন্তা ও বুদ্ধির মুক্তি গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে) ; চারদিক, ঢাকা, পৃ-৩০৪।
২. শহিদুল ইসলাম : ব্রুনোর আত্মত্যাগ ও যুক্তিবাদ (এই প্রবন্ধটি উপর্যুক্ত গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে) চারিদিক, ঢাকা, পৃ- ১৩১।
৩. হুমায়ুন আজাদ: যতই গভীরে যাই মধু, যতোই ওপরে যাই নীল; আগামী প্রকাশনী, ঢাকা, পৃ-২০।
৪. দেবী প্রসাদ চট্রোপাধ্যায়: লোকায়ত দর্শন; নিউ এজ, কলকাতা, পৃ- ৫০।
৫. 5. B. Russell: Why I am not a Christain, Routledge (এই গ্রন্থের Existence of God অধ্যায়টিই সেই বিতর্ক), London and NY.
৬. ড. অজয় রায় : বিজ্ঞান মনস্কতা ও বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ নির্মাণ (এই প্রবন্ধটি প্রথম আরজ আলী মাতুব্বর স্মারক গ্রন্থে ২০০১ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। পরবর্তীতে কিছুটা পরিবর্তিত আকারে স্বতন্ত্র ভাবনা গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে); চারিদিক, ঢাকা, পৃ-৩৩।
৭. সুকুমার রায় : সমগ্র শিশুসাহিত্য (কবিতা: খিচুড়ি); আনন্দ, কলকাতা, পৃ-১।
* লেখাটি মুক্তান্বেষা (৭ম সংখ্যায়) প্রকাশিত।
লেখাটি পড়ে বেশ ভাল লাগলো। আমার মনে হয়, লেখাটির ভাষার প্রয়োগে কোনো উগ্রতা নেই এবং বেশ যুক্তিপূর্ন সুখপাঠ্যও বটে। যুগ যুগ ধরে আমাদের জিনে অপবিশ্বাসের যে ভাইরাস ঢুকে গেছে তা তো আর একদিনে যাবেনা, হয়তো লম্বা সময় নিবে সেটার বিবর্তনে। তবে এ ধরনের লেখা বা আলোচনা যতো বেশী হবে, মানুষের অপবিশ্বাসের দৃঢ়তা ততো দুর্বল হতে থাকবে। তাদের অপবিশ্বাসের জায়গাটা হয়ত বিজ্ঞানভিত্তিক যুক্তিনির্ভর বিশ্বাসের দখলে চলে যাবে। যেমন ধরুন, একজন ধর্মবিশ্বাসী মানুষ shop-lift করবেনা হয়তো তার আল্লাহ/ঈশ্বর/God এর ভয়ে। কিন্তু বিশ্বাসী অবিশ্বাসী সবাই সেটা করবেনা সার্ভিলেন্স ক্যামেরার ভয়ে। হয়ত একসময় ন্যানো (nano) সার্ভিলেন্স ক্যামেরার ব্যবহার শুরু হবে এবং সেটা আছে কি নেই তা বোঝাই যাবেনা। তখন হয়তো দেখা যাবে কোন দোকানে হয়তো সত্যিই কোনো ক্যামেরা নেয়, কিন্তু কেউ শপ-লিফট করছে না ন্যানো ক্যামেরার বিশ্বাসের কারনে। অর্থাত আস্তে আস্তে বাস্তবভিত্তিক একটা বিশ্বাস মানুষের hypothetical বিশ্বাসের জায়গাটা দখল করে নিবে। বিশ্বাস এমনই একটি বিষয় যে কাউকে যুক্তি দিয়ে মোলায়েমভাবে কাবু না করে বেশী চাপাচাপি করলে তার উগ্রবাদী হয়ে যাওয়ার একটা আশংকা থাকে। আশা করি আমরা ভবিষ্যতে মোলায়েম যুক্তির অপবিশ্বাস তাড়ানো আরো লেখা দেখতে পাবো।
লেখাটি পড়তে গিয়ে বার বার হুমায়ুন আজাদের ‘আমার অবিশ্বাস’ বইটির কথাই মনে পড়ছিল। আরো মনে পড়ছিল অভিজিৎ রায়ের ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ প্রবন্ধটি। এ ধরনের লেখা যতবেশি প্রকাশ হবে ততই আমাদের জন্য মঙ্গল। বিশ্বাস থেকে জন্ম নেয় নানা ধরনের কুসংস্কার। বিশেষ করে ধর্মীয় নানা বিশ্বাস আমাদেরকে এগুতে দেয় না।
বিশ্বাসীদের বিশ্বাস যে ভুল সেটা বৈজ্ঞান দিয়ে প্রমাণ করার কোনো আবশ্যক দেখি না। বিশ্বাসীদের কেতাবগুলোই সবচেয়ে বড় প্রমান যে তাদের বিশ্বাসগুলো ভুলে ভরা, অসামঞ্জস্যপূর্ণ…
বিশ্বাসে বস্তু মিলালে সূর্য এখন পৃথিবীর চারদিকে ঘুরত- এই জায়গাটা মনে ধরল খুব।
@স্বপন মাঝি,
তবে বিশ্বাসগুলো-র উদ্ভবের ক্ষেত্রে কাজ করেছে প্রয়োজন না কৌতূহল, একটু ভেবে দেখা দরকার।
আমারও তাই ধারণা। কৌতূহল এবং স্বার্থের প্রয়োজনে শত্রুর উপর এ বিশ্বাসের মনগড়া প্রয়োগই হতে পারে ইশ্বরের প্রাতিষ্টানিক রূপ।
এ কথাটা আমার খুব ভাল লেগেছে। চমৎকার ! কেন জানি মনে হচ্ছে, এ শব্দটা খুঁজতে খুঁজতেও তো খুঁজে পাচ্ছিলাম না। এখন কিছুটা পরিষ্কার, ধর্ম বা বিশ্বাস প্রয়োজনের পথ আগলে দাঁড়ায় বা আড়াল করে।
বিপ্লব
ওটা (ঈশ্বর বিশ্বাস) না থাকলে মানব সমাজ একত্রিত হ’তে পারতো না, এ রকম ক’রে ভাবাটা কতটা যুক্তিসঙ্গত আমি জানি না। তবে বিশ্বাসগুলো-র উদ্ভবের ক্ষেত্রে কাজ করেছে প্রয়োজন না কৌতূহল, একটু ভেবে দেখা দরকার।
অভিজিৎ
যুদ্ধটা কার বিরুদ্ধে ছিল? কেন আপনার মনে হলো, এসব যুদ্ধ না হ’লে মানব জাতি বিলুপ্ত হ’য়ে যেত?
বিশ্বাস মানুষকে খন্ডিত ক’রে, মানুষকে মানুষের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। এটা বুঝবার জন্য বিশ্বাসজনিত কারণে খুনোখুনি-র অতীত (অনেক পড়াশুনা করতে ক’রে বলতে হয়) না বলে বর্তমানের চালচিত্র দেখলেও অতীতটা আঁচ করা যায়।
প্রশ্নগুলো্কে উস্কে দে’বার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ।
@স্বপন মাঝি,
স্বপন মাঝি আমি আগেই বলেছি, বিশ্বাসের ব্যাপার স্যাপারগুলো আমি বিবর্তনীয় দৃষ্টিকোন থেকে দেখতে আগ্রহী – ‘কি হলে কি হতে পারতো’ তার উপর ভিত্তি করে নয়। আমি কি কোথাও বলেছি যে, যুদ্ধ না হ’লে মানব জাতি বিলুপ্ত হ’য়ে যেত? না, তা কিন্তু বলিনি বরং খুঁজতে চেয়েছি কেন যুদ্ধের মত কিংবা বিশ্বাসের মত ব্যাপারগুলো মানব সমাজে প্রোথিত হয়ে গিয়েছে প্রথম থেকেই। আমার মন্তব্যটা পুনরায় পড়ুন। আমি বলতে চেয়েছি যুদ্ধ কিংবা বিশ্বাসজনিত ব্যাপারগুলো সম্ভবতঃ ‘কালচারাল ইউনিভার্সাল’। এমন কোন জাতির অস্তিত্ব কি আপনি দেখাতে পারবেন, যেখানে যুদ্ধ ছিলো না, কিংবা নেই? এমন কোন সংস্কৃতি কি দেখাতে পারবেন, যেখানে লোকজন কোন কিছুতে বিশ্বাস করে না? না সে ধরনের কোন সংস্কৃতি নেই। কোন কোন সংস্কৃতিতে হয়তো বিশ্বাসের প্রকোপ কম, কোন কোন সংস্কৃতিতে অনেক বেশি। কিন্তু আছেই। এমন কোন সংস্কৃতি দেখানো যাবে না যেখানে বিশ্বাস নেই। কেন নেই? কারন হল, বিশ্বাস ব্যাপারটা একসময় মানবজাতিকে কোন না কোন ‘উপযোগিতা’ দিয়েছিল, সেজন্যই এই ট্রেইটগুলো সার্বজনীনভাবে মানব চরিত্রের বৈশিষ্ট হয়ে গেছে।
শিশুদের কথা চিন্তা করুন। আপনি নিশ্চয়ই দেখেছেন বাচ্চাদের একটা সময় পর্যন্ত বাবা মায়ের কথা চোখ বন্ধ করে শুনতে হয়, বিশ্বাস করতে হয়। কেন হয়? কারণ এ ব্যাপারটা টিকে থাকার জন্য অত্যাবশকীয় নিয়ামক। কোন শিশু চুলায় হাত দিতে গেলো, আর সাথে সাথে তা মা বলে উঠলো – হাত দেয় না ‘গরম’! সাথে সাথে শিশুটি হাত সরিয়ে নিল। না নিলে কি হত? শিশুটি পুড়ে মারা পড়তো। অতীতে নিশ্চয় অনেক শিশু মারা পড়েছিলো মার কথায় অবিশ্বাসের খেসারত হিসেবে। সে সমস্ত শিশু টিকে থাকে নি। এই সিমুলেশনটা আপনি প্রজন্মের পর প্রজন্ম করুন দেখবেন এমন ট্রেইট জন্ম হয়েছে যেখানে শিশুরা মার কথা শোনে, বিশ্বাস করে। টিকে থাকার জন্যই এটা ঘটে। কিন্তু এই চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করে টিকে থাকার ক্ষতিকর দিকও আছে। শিশু মার ভাল উপদেশ আর কুসংস্কারাচ্ছন্ন উপদেশের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না। ‘চুলায় হাত দেয়া না’ কিংবা ‘দেখে শুনে রাস্তা পার হও’ – এগুলো মার ভাল উপদেশ, কিন্তু সেই মাই আবার অনেক কুসংস্কারচ্ছন্ন উপদেশ দিতে পারে – ‘মিস্টি খেয়ে অংক পরীক্ষা দিতে যেও না – গোল্লা পাবে’ জাতীয়। তখন শিশুর পক্ষে বোঝা কঠিন যে মা তাকে হাত সরিয়ে নিয়ে চুলার গরম থেকে বাঁচিয়েছে, সেই আবার মন্দ উপদেশ দিয়ে তার মধ্যে ‘বিশ্বাসের ভাইরাসের’ জন্ম দিতে পারে। এটা বুঝলেই আপনি বুঝতে পারবেন কীভাবে মানব সমাজে বিভিন্ন প্রথানির্ভর বিশ্বাস অনেক সময় ক্ষতিকর ভাইরাসের বীজ বপন করতে পারে। চিন্তা করে দেখুন – সতীদাহ, মুরতাদ হত্যা, বিধর্মী নিধন সহ হাজারটা বিশ্বাস অপবিশ্বাস মানব সমাজে কিভাবে টিকে ছিল বা আছে। এগুলোর সঠিক বিশ্লেষণ জরুরী।
লেখাটি আমার কাছে খুবই ভাল লেগেছে। হয়তো অভিজিৎ এবং বিপ্লব পালের কথাই ঠিক, কিন্তু আমার মতে এ ভয়ংকর ইশ্বর বিশ্বাষ না থাকলে আদি সমাজে দলাদলি ,মারামারি হয়তো কমই হত। তারা গোষ্টিবদ্ধ হত নিজেদের প্রয়োজনের তাগিদেই। ইশ্বর এ যুগের তুলনায় আদিকালে নিশ্চয় কম বদ ছিলনা?
:rose2: :rose2: :rose2: :rose2: :rose2:
“শেষ কথা” হয়তো কারো পক্ষে বলা হয়ে উঠবে না। তবুও কেউ কেউ বলেন, বলে আনন্দ পান। “মহান ঈশ্বরের” আমিত্বের প্রকাশ একজন নাস্তিকের মধ্যেও দৃশ্যমান। শেষ পর্যন্ত ঈশ্বর হয়তো ছায়া হয়ে বেঁচে থাকবেন কোন কোন নাস্তিকের মত-প্রকাশ-ভঙ্গির মধ্যে।
যে কোন মত-পথকে এক ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দে’য়া বা গ্রহণ করার মধ্যে “মহান ঈশ্বরের” অনুগামীদের ছায়া দেখতে পাই, আর তাতেই ভয় হয়।
লেখক ও মন্তব্যকারীদের মন্তব্যের প্রেক্ষিতে এ সংশয়।
তবুও সবাইকে ধন্যবাদ।
আমি প্রবন্ধটির সাথে সহমত না,
প্রথমেই দুটি জিনিস মনে রাখতে হবে
১) পশুদের বিশ্বাস নেই মানুষের আছে
২) সব ধরনের বিশ্বাস টেকে না। অসংখ্য বিশ্বাসের মধ্যে কিছু টেকে। বিশ্বাসের ও প্রাকৃতিক নির্বাচন হয়।
ঈশ্বর এমন একটি বিশ্বাস টিকে গেছে। কেন টিকল? পশুদের বিশ্বাস নেই। কিন্ত আদিম সভ্যতা শু্রু হতে হতেই বিশ্বাসের জন্ম হল।
প্রাচীন গুহাচিত্র গুলো দেখলে যেখা যাবে, বিশ্বাস বা আচরনের স্থলে গোষ্ঠি আচরনের ভূমিকা আছে।
অর্থাৎ গোষ্ঠি জীবনের জন্য এই সব বিশ্বাসের জন্ম হয়েছিল। এবং কিছু কিছু বিশ্বাস যেমন ঈশ্বরে বিশ্বাস সেকালের আদিম সমা্জকে একত্রিত করতে সাহায্য করে। কারন সেকালে মিডিয়া ছিল না। একমাত্র ভাইরাল মিমের জন্যেই গোষ্ঠিবদ্ধতা সম্ভব ছিল।
বিশ্বাস ভাল না খারাপ সেটা বিবর্তনের ধারার ওপর নির্ভর শীল। আমরা প্রযুক্তির যে ধাপে সেখানে বিশ্বাসের দরকার নেই। কিন্ত ঐতিহাসিক সময়ে বিশ্বাসের দরকার ছিল না বললে ভুল হবে।
ভারতে অতীতে ঈশ্বরের বিশ্বাসী গোষ্ঠিরা টিকে গেছে, নিরশ্বরবাদি ( বৌদ্ধ বা জৈনরা) টিকতে পারে নি। কারন বিশ্বাসের ভাইরাসগুলি ঈশ্বরবাদি সমাজের
রিপ্রোডাক্টিভ ফিটনেস উন্নত করেছিল।
তাছার ধর্মই শুধু বিশ্বাস করে না। কমিনিউস্টরাও ঐতিহাসিক বস্তবাদে বিশ্বাস করে। যা বিশ্বাসই।
এই নিয়ে আমা্র একটা প্রবন্ধ আছে
এবং সেই বিশ্বাসের বলি ধর্মের বলির শতগুন।
সুতরাং লেখক কোনটা বিশ্বাস আর কোনটা বিশ্বাস সেটাই বোঝেন নি।
এটি অত্যন্ত আদ্যিকালের বামপন্থী ঘরাণার লেখা, যার বর্তমানে কোন ব্যাবহার দেখি না।
অত্যন্ত চমৎকার সূচনা হয়েছে যখন লিখলেন ,
উপরোক্ত বক্তব্যের সাথে সম্পূর্ন সহমত প্রকাশ না করে উপায় নেই। এখন এই জীবন সম্পর্কে অতি আজগুবি, সরল, কল্পনাবৃত, চিন্তাহীন ও পর্যবেক্ষণবিমূখ আষাঢ়ে গল্পসমূহকে বাতিল করতে হলে আমাদের সামনে কি কোন পথ খোলা আছে এবং থাকলে কি সেই পথ ? এ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট দিক নির্দেশনা আপনার প্রবন্ধে থাকলে পাঠকদের অনেক উপকারে আসতো ।
তবে শেষের দিকে এসে কোপার্নিকাসের সাথে সিগমন্ড ফ্রয়েডের বিরিন্চিবাবাগিরিকে মিলিয়ে দিয়ে সত্যনাশ করে দিলেন। লিখলেন ,
যে কোন তত্তকে বিজ্ঞান বলতে হলে তার মাঝে কয়েকটা বৈশিষ্ট থাকতে হয় :
ক) সংশ্লিষ্ট গবেষণা কি এই গবেষনাপ্রসূত বক্তব্যকে মিথ্যা প্রমানিত বা ফলসিফাই(falsify) করার কোন জানালা খোলা রেখেছে?
খ) সংশ্লিষ্ট গবেষণা কি Null hypothesis কে মানে ? এর মানে কোন বক্তব্যের সমর্থনে পর্যাপ্ত প্রমান না দেখানো পর্যন্ত তা মিথ্যা হিসেবে পরিগণিত হবে।
গ) সংশ্লিষ্ট গবেষণা কি মূখ্য শাখাকে ( যেমন , পদার্থবিদ্যা) প্রয়োজনে পরিবর্তন করার ক্ষমতা রাখে ?
এখন ফ্রয়েডের গবেষনা তথা সাইকোএনালিসিস-কে কি উপরোক্ত শর্ত সাপেক্ষে বিজ্ঞান বলা যায় ? অবশ্যই নয় । শুধু তাই নয় , সম্পূর্ন মনোবিজ্ঞানকে ততটুকুই বিজ্ঞান বলা যায় যতটুকু সমাজবিদ্যাকে কিংবা প্রাচ্যের যে কোন ঈশ্বরহীন ধর্মকে বিজ্ঞান হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। আমরা জানি যে কোপার্নিকাস অন্যদিকে সেক্ষেত্রে উপরের শর্তসমূহ পূরোপুরিই পূরন করেছেন। বিজ্ঞান কোন বিশ্বাস নয় বরং চলমান সংশয় যা সময়ের সাথে নিজেকে সংশোধন করে চলে। এ জগৎ জীবন সম্পর্কে অতি আজগুবি, সরল, কল্পনাবৃত, চিন্তাহীন ও পর্যবেক্ষণবিমূখ আষাঢ়ে গল্প কেবল সত্যিকারের বিজ্ঞানের মাধ্যমেই পরিত্যাগ করতে হবে। অবৈজ্ঞানিক অবিশ্বাস দিয়ে নয় । সুন্দর একটা বিষয়ের অবতারণা করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
লেখাটি ভাল লাগলো। আপনাদের মতো লেখকদের আর বেশি করে মুক্তমনায় লেখা উচিৎ।
একটি জায়গায় কিছুটা অন্যমত আছে আমার। যদিও আমি আপনার লেখার থিমের সাথে একমত, কিন্তু যেভাবে বিশ্বাসকে ‘সবচেয়ে অর্থহীন আবিষ্কার’ বলে প্রথম বাক্যে আপনি মত প্রকাশ করেছেন, ঠিক সেভাবে আমি ব্যাপারটিকে (অন্ততঃ এখন) দেখি না। ব্যাপারগুলোকে আমি বিবর্তনীয় প্রেক্ষাপটেই দেখতে আগ্রহী। আর আমার মতে, বিশ্বাস কিন্তু কারো ‘আবিস্কার’ না, বিশ্বাস অনেক বৈশিষ্ট্যের মতো সম্ভবত জৈববিবর্তনীয় পথেই উদ্ভুত একটি বৈশিষ্ট্য, যা অনেক সময় ক্ষতিকর রূপ নেয়।
আমার কিছু খুব ছোটখাট কাজ আছে এ নিয়ে। এ প্রসঙ্গে ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ সহ কিছু লেখা আমি মুক্তমনাতে আগে দিয়েছে (হয়তো ভবিষ্যতে বই হিসেবে বেরুতেও পারে)। আমি লেখাগুলোয় বলেছেলাম, আমরা যতই নিজেদের যুক্তিবাদি কিংবা অবিশ্বাসী বলে দাবী করি না কেন, এটা তো অস্বীকার করার জো নেই – ‘বিশ্বাসের’ একটা প্রভাব সবসময়ই সমাজে বিদ্যমান ছিলো। এটা মনে করা ভুল হবে না যে, ‘বিশ্বাস’ ব্যাপারটা মানব জাতির বেঁচে থাকার পেছনে হয়তো কোন বাড়তি উপাদান যোগ করেছিল একটা সময়। মানুষ আদিমকাল থেকে বহু সংঘাত, মারামারি এবং রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে গিয়ে আজ এই পর্যায়ে এসে পৌছেছে। একটা সময় সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করাটা ছিল মানব জাতির টিকে থাকার ক্ষেত্রে অনেক বড় নিয়ামক। যে গোত্রে বিশ্বাস ঢুকিয়ে দিতে পারা গিয়েছিল যে যোদ্ধারা সাহসের সাথে যুদ্ধ করে মারা গেলে পরলোকে গিয়ে পাবে অফুরন্ত সুখ, সাচ্ছ্বন্দ্য, হুর পরী উদ্ভিন্নযৌবনা চিরকুমারী অপ্সরা, (আর বেঁচে থাকলে তো আছেই সাহসী যোদ্ধার বিশাল সম্মান আর পুরস্কার) – তারা হয়ত অনেক সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করেছে এবং নিজেদের এই ‘যুদ্ধাংদেহী জিন’ (আক্ষরিক অর্থে নয় অবশ্যই) পরবর্তী প্রজন্মে বিস্তৃত করতে সহায়তা করেছে। আমাদের মুক্তমনা সাইটে রিচার্ড ডকিন্সের একটি চমৎকার প্রবন্ধ রাখা আছে ‘ধর্মের উপযোগিতা’ নামে । প্রবন্ধটিতে অধ্যাপক ডকিন্স একজন বিবর্তনবাদী বিজ্ঞানীর দৃষ্টিভঙ্গী থেকে বিশ্বসের বিভিন্ন দিক নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। সেটি পড়া যেতে পারে।
কিন্তু আমি এও দেখিয়েছি (বিশ্বাসের ভাইরাস দ্রঃ) কিন্তু অসংখ্য মন্দ বিশ্বাস হয়ত অনেক সময় জন্ম দেয় ‘বিশ্বাসের ভাইরাসের’ ’। এগুলো একটা সময় প্রগতিকে থামাতে চায়, সভ্যতাকে ধ্ব্বংস করে। যেমন, ডাইনী পোড়ানো, সতীদাহ, বিধর্মী এবং কাফেরদের প্রতি ঘৃণা, মুরতাদদের হত্যা এগুলোর কথা বলা যায়। আমি নেমাটোমর্ফ হেয়ারওয়ার্ম, ল্যাংসেট ফ্লুক সহ কিছু প্যারাসাইটের উদাহরণ হাজির করেছিলাম তুলনামূলক বিশ্লেষণ করতে। দেখতে পারেন।
বিশ্বাস কিভাবে ছড়ায়, কিভাবে বিশ্বাসের মহামারী তৈরি হয় সেগুলো বুঝতে রিচার্ড ডকিন্স কিংবা ডেনিয়েল ডেনেটের বইগুলো পড়া যেতে পারে। সেই সাথে জীববিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব এবং আধুনিক বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের ব্যাখ্যাগুলো জানাও খুব দরকার।
আবারো, লেখাটির জন্য ধন্যবাদ।
অসম্ভব ভাল লাগলো লেখাটা। :rose2: :yes: