জানালার পর্দা খুলতেই মস্ত পাহাড় এসে দাঁড়ালো সামনে। গ্রীবা তুলে সুপ্রভাত জানালো সহাস্যে। চোখ রগড়ে জিজ্ঞেস করলামঃ আমি কোথায়?

তুমি ব্যান্ফে এসেছ বন্ধু। স্বাগতম।

 

হ্যাঁ তাইতো। মনে পড়ল। ব্যান্ফ্। পাহাড় আর নীল হ্রদেরা যেখানে আলিঙ্গনে আলিঙ্গনে বাঁধা থাকে নিত্য। যেখানে কালো পশমের পোশাক পরা ভালুকের গায়ে সওয়ার হয়ে ভেসে বেড়ায় প্রজাপতিরা। যেখানে সকালবেলার আকাশ থেকে পাহাড় নেমে অভিবাদন জানায় আগন্তুককে।

মনে পড়ল গতকাল সন্ধ্যার পর এসে পৌঁচেছি এখানে। গণিতের অধিবেশন চলবে একটানা চারদিন—সোম থেকে বৃহস্পতি। গণিতের সঙ্গে পর্বতের একটা আত্মার যোগ আছে। তারা উচ্চতা ভালবাসে। তারা মগ্নতার সাধক। গণিতের নগন্য সেবক বই কিছু নই আমি, তবু প্রসিদ্ধ গণিতকূলের সাথে একই শকটে করে বেশ কিছু উঁচু উঁচু গণিতালয়ে যাবার সৌভাগ্য আমার হয়েছে বটে। কিন্তু ব্যান্ফে এই প্রথম। ব্যান্ফের গল্প শুনেছি অনেক। একে ক্যানাডার ভূস্বর্গ বলে অনেকে। ভারতীয় পর্যটকরা কাশ্মিরের সঙ্গে তুলনা করেছেন। ইউরোপিয়ানরা করেছেন সুইজারল্যাণ্ডের সঙ্গে। আমি তুলনা পছন্দ করিনা। সবারই স্বাতন্ত্র্য আছে। প্রকৃতিরও । বৈচিত্র্য নয় শুধু, স্বাতন্ত্র্য। সিসিলির এরিচিতে যে পাহাড় দেখেছিলাম ক্যালগেরি আর ব্যান্ফের রকি পর্বত তার থেকে ভিন্ন। তারা আপন আপন ভাবে ভিন্ন।

কাল সন্ধ্যায় বাসে করে আসার সময় চালক সাহেব হঠাত্ ব্রেক করে ঘোষণা করলেনঃ এই দেখুন সামনে একটা কুগার দাঁড়িয়ে আছে। কুগার আমি ছবিতে দেখেছি অনেক, টেলিভিশনেও কম দেখা হয়নি, কিন্তু একেবারে সামনে থেকে দেখা, এই প্রথম। একটা মৃদু শিহরণ অনুভব করলাম শরীরে। সৌভাগ্য যে বাসের ভেতরে ছিলাম। বাইরে থাকলে শিহরণটি একটু অন্যরকম হত হয়ত। কুগার একটি শ্বাপদ জন্তুর নাম।

মুখহাত ধুয়ে সকালবেলার নাস্তা খেতে বেরুব। পথে একটি হরিণের সাথে দেখা। সম্ভবত আমারই মত প্রাতরাশের জন্যে বেরিয়েছে। আমাকে দেখে তার বিন্দুমাত্র ভাবান্তর হল বলে মনে হয়নি। বুঝলাম অভ্যস্ত হয়ে গেছে। হয়ত জানে গণিতের লোকেরা বন্দুক নিয়ে ঘোরাফেরা করেনা—-তারা হরিণদের চেয়েও নিরীহ। বেশ লাগল। মানুষে-জীবেতে একটা বোঝাপড়া সৃষ্টি হয়ে গেছে। ব্যান্ফ্ তো জীবেদেরই রাজ্য—-মানুষ সেখানে শখের পর্যটক ছাড়া কিছু নয়। সংসারে এখনো ‘জীবের রাজ্য’ বলে কিছু আছে কোথাও, ভাবতেই ভাল লাগে।

গোটা জায়গাটি একটা বড়সড় পুতুলঘরের মত। দশ-বারোটি বাড়ি, মাঝারি সাইজের স্কুলের চেয়ে বড় কোনটাই নয়—লেগোর গুটির মত স্তরে স্তরে সাজানো, পাহাড়ের গায়ে পাথর কেটে বসানো হয়েছে। আঁকাবাঁকা উঁচুনিচু সরু পথ দিয়ে যেতে যেতে মনে হয় প্রতিটি ইঁট শিল্পীর স্বপ্নের রঙ দিয়ে তৈরি। স্থায়ী জনবসতির জায়গা নয় এটা—স্থায়ীভাবে বাস করে কেবল গুটিকয় স্থানীয় কর্মচারী আর বনের জীবজন্তু। জায়গাটির গোড়াপত্তন হয়েছিল গত শতাব্দীর ষাটের দশকে। তখন এর নাম ছিল ব্যন্ফ্ চারুকলা কেন্দ্র—-ব্যান্ফ্ সেন্টার ফর ফাইন আর্টস এণ্ড পারফরমেন্স। সঙ্গীত, শিল্পকলা, মঞ্চনাটক, সৃষ্টিধর্মী লেখালেখি। প্রতি গ্রীষ্মে ক্যানাডার মেধাবি ছাত্রছাত্রীরা এসে জড় হত এখানে দলে দলে, এখনও হয়। দুহাজার সাল পর্যন্ত গোটা জায়গাটিই ছিল ললিতকলার তরুণতরুণীদের চারণক্ষেত্র। এক সালে তার সাথে আরেকটা মাত্রা যোগ হয় ক্যানাডার কেন্দ্রীয় সরকার ও যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের উদ্যোগে—-গণিত ও বিজ্ঞানচর্চা। তাঁরা সিদ্ধান্তে পৌঁছান, সঠিকভাবেই বলব, যে ব্যান্ফের পরিবেশ শুধু শিল্পকলার জন্যেই নয় যেকোন সৃষ্টিধর্মী কাজের জন্যেই আদর্শস্থানীয়। এখানে প্রকৃতির কোমল স্পর্শে প্রাণ আপনাতেই সজীব হয়ে ওঠে, কল্পনা তার সকল আবরণ খুলে শতবর্ণে উদ্ভাসিত হতে উদ্গ্রীব হয়। দুই সরকারের উদার অনুদান দুচারবছরের মাঝে কর্মমুখর করে তোলে সমস্ত পরিবেশটিকে । চারুকলা থেকে জ্ঞানবিজ্ঞানের সকল শাখাই সমান পৃষ্ঠপোষকতার অধিকার অর্জন করে। সাথে সাথে নামটিও সংস্কৃত হয়ে ‘ব্যান্ফ্ গবেষণা কেন্দ্র’তে পরিণত হয়। চারুকলার সীমিত উঠান প্রসারিত হয়ে জ্ঞানসাধনার সকল শাখাকে ঠাঁই করে দেয়।

চারদিনের অধিবেশন, ঠাসা প্রোগ্রাম। সকাল ন’টায় শুরু, সন্ধ্যা ছ’টায় শেষ। মাঝে দু’ঘন্টার লাঞ্চ বিরতি। একটানা লেকচার—-একেকদিন ন’টা কি দশটা। সকালবেলায় দুটি কি একটি ছিল একঘন্টা ব্যাপী টক, বাকিগুলো সব আধঘন্টার। বক্তাদের নিজ নিজ গবেষণার ওপর ভিত্তি করে রচিত পেপার—কেউ একক, কেউ বা এক থেকে একাধিক সহপ্রণেতা সহকারে। প্রতিটি পেপারই মন দিয়ে শুনতে হয়। সবগুলো সবাই বোঝে তা নয়। বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার মত গণিতও শাখায় প্রশাখায় এতটাই বিস্তারলাভ করেছে যে এর এক শাখার লোক আরেক শাখার ভাষাই হয়ত বুঝতে পারবে না, বিষয় বোঝা দূরে থাক। অনেকটা একই কণ্ডোতে পাশাপাশি ফ্ল্যাটে দীর্ঘদিন বাস করা সত্ত্বেও পরস্পরকে না চেনার মত। তবু সম্মেলনের ঘনিষ্ঠ পরিবেশে দূরত্ব কমে যায় খানিকটা, একটা সূক্ষ্ম বন্ধন সৃষ্টি হয় । একটি জ্ঞান থেকে পুষ্টি অর্জন করে আরেকটি। তারপর আছে অন্তহীন আলোচনা। তর্ক, যুক্তি ও ব্যাখ্যার অবকাশ । সম্মেলনের মূল লক্ষ্যটাই তা—আলাপে আলাপে নতুন জ্ঞানসঞ্চারের সম্ভাবনা সৃষ্টি করা। অনেক সময় বড় বড় সমস্যার সমাধান বেরিয়ে যায় আলাপের মধ্য দিয়ে। এ এক অন্য জগত।

একটা বিকেল ফাঁক ছিল প্রমোদভ্রমণের জন্যে। কিম্বা শুধুই কিছু না করে নিজের ইচ্ছার ফানুশ উড়িয়ে গা এলিয়ে বসার জন্যে। অনেকে দল বেঁধে গিয়েছিল ব্যান্ফের নানা দর্শনীয় জায়গায়, —-নামকরা হ্রদ, বনছায়াচ্ছন্ন পাহাড়ি পথ, মন-কেড়ে-নেওয়া পার্বত্য ঝরণা। আমি ওদের সঙ্গে যোগ দিতে সাহস করিনি উঁচুনিচু রাস্তায় হাঁটতে হবে বলে। আমার পায়ে বার্ধক্যের ভার, হাঁটুতে শতাব্দীর জীর্ণতা। শল্যকৃত হৃদপিণ্ড পর্বতারোহণে অনিচ্ছুক। তাই আমার যাওয়া হয়নি। একটা অপূর্ণতা থেকে গেল বইকি।

সেই অতৃপ্তির অনেকখানিই পূরণ হয়ে গেল ফেরার পথে। সকাল দশটায় বাসে করে রওয়ানা দিলাম ক্যালগেরির পথে। পৌনে দু’ঘন্টার রাস্তা—শ’দেড়েক কিলোমিটার দূরত্ব দুই শহরের। আকাশভরা রোদ মাথায় নিয়ে প্রকাণ্ড টুরবাস গবেষণাকেন্দ্রের এলাকা ছেড়ে মূল শহরের পথঘাট অতিক্রম করে হাইওইয়ের স্রোতের মধ্যে মিশে গেল অনায়াসেই। মাত্র দু’জন যাত্রী আমরা । এমন নাকি হয় মাঝে মাঝে। কখনো বসার জায়গা থাকে না, কখনো যাত্রীবিহীন বাসের ভেতর নৈঃশব্দের ভারি নিঃশ্বাসই শোনা যায় কেবল। অক্টোবরের ১৭ তারিখ—শেষ হেমন্তের ছায়া নামতে শুরু করেছে নিসর্গব্যাপী। সুখের পাখিরা কুলায় ফিরতে শুরু করেছে একে একে।

হাইওয়েতে নামবার কিছুক্ষণের মাঝেই চারদিক থেকে পর্বতমালা এসে ঘিরে ধরল আমাদের। হঠাত্ একঝাঁক মেঘ এসে ক্ষণিকের ছোঁয়া দিয়ে উধাও হয়ে গেল। আমি একেবারে সামনের সীটে বসা। গোটা বিশ্বটাই আমার চোখের সামনে। কোনও অদৃশ্য শিল্পী আমাকে ঘিরে বিরাট বিরাট মুরাল এঁকে চলেছেন মুহূর্তে মুহূর্তে। আকাশ পাহাড় পথ অরণ্য সব দুয়ার খুলে দাঁড়ালো আমাকে দেখবার জন্যে—-যৌবনে গ্রামে যাবার পথে যেমন পাড়ার কিশোরীরা বেড়ার আড়ালে এসে দাঁড়াতো আমার পায়ের শব্দ শুনে। আমি কান পেতে থাকলাম প্রকৃতির হৃদস্পন্দন শোনার জন্যে। পাহাড়ের চূড়ায় নগ্ন পাথরের শরীর, সৃষ্টির আদিমুহূর্তটিকেই যেন ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে মৌন আরাধনায়। বিপুল এক ধ্যানমগ্ন মূর্তি। মনে পড়ছিল তখন কৈশোরে-দেখা এক ছায়াছবির কথা—-প্রবোধ কুমার সান্যালের বিখ্যাত বই ‘মহাপ্রস্থানের পথে’। দারুণ দাগ কেটেছিল আমার কিশোর মনে। হিমালয়ের গা বেয়ে ওঠা মেঘের দেশেতে এক পুন্যাশ্রমের পটভূমিতে নায়কনায়িকার সাক্ষাত্। ওরা পরস্পরের প্রেমে পড়ে গিয়েছিল কিনা তত্ক্ষণাত্ মনে নেই, কিন্তু আমি যে পড়ে গিয়েছিলাম নায়িকার সাথে সেটা মনে আছে। কত সহজ ছিল সেসময় প্রেমে পড়ে যাওয়া। সাথে সাথে কত কঠিন ছিল সে প্রেমকে ব্যক্ত করা। চারদিকে চোখ, শাসানি দৃষ্টি, নিষেধের দেয়াল। আজকে শাসন নেই কোথাও, শুধু মনটাই শুকিয়ে গেছে শতবর্ষীয় বৃক্ষের বাকলের মত ।আজকে আমার সামনে শুধু এই বিশাল পর্বত আমার সকল চিন্তা ও চেতনাকে আচ্ছন্ন করে দাঁড়িয়ে আছে। আমার অস্তিত্ব তার নগ্ন মূর্তির কাছে স্তিমিত বাতুলতার পর্যায়ে পৌঁছে গেছে ।

একটি পাহাড় দেখলাম ডানপাশে যার একেবারে শেষ চূড়ায় একটি গাছ—-একটিমাত্র গাছ কালের প্রহরী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অবিশ্বাস্য স্পর্ধায়। সেখানে উদ্ভিদের কোনও অস্তিত্বই থাকার কথা নয়। মেঘের রাজ্য সেটা। সারাবছর বরফ জমে থাকে। গ্রীষ্মের রৌদ্রতাপও তাকে নরম করেনা। তবুও এই গাছ, এই দুরন্ত দুঃসাহসী বৃক্ষ কেমন করে এতকাল ধরে গিরিশৃঙ্গের মুকুট হয়ে ঘোষণা করে চলেছে নিজের অস্তিত্ব জানিনা। মনে হয় সেখানে মন্দির বানিয়েছেন কোনও উন্মাদ সন্ন্যাসী। পাহাড়টি যেভাবে বেঁকে গেছে উপরের দিকে নিচে থেকে তাকালে অনেকটা মন্দিরের মত মনে হয় বইকি । কে জানে গাছটি হয়ত তিনিই লাগিয়েছিলেন। সাধুসন্ন্যাসীরা তো কোনও বাস্তব অবাস্তবের ধার ধারেন না। আমি অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম সেদিকে, চলমান শকট যতক্ষণ না এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ের সামনে নিয়ে গেল আমাকে। দৃশ্যটি ভুলবার নয়। ইংরেজিতে একেই বুঝি বলে সুরিয়েল। এ যেন জীবনেরই এক বিচ্ছিন্ন অবাস্তবের প্রতিচ্ছবি।

কিছুক্ষণ পর পাহাড়গুলোর চূড়ায় চূড়ায় রাশি রাশি মেঘ জমা হয়ে গেল—-যেন কোনও জরুরি বৈঠক বসবে ওদের। ভীষণ তাড়া—-এক্ষুণি একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার । পলক পড়তে না পড়তে মেঘগুলো ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল চতুর্দিকে, যেন শত্রুপক্ষের আক্রমনের জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে। দিকবিদিক আচ্ছন্ন হয়ে গেল সাদা বৃষ্টির মত জলকনার মুহুর্মুহু আঘাতে। মনে হল যেন শত কোটি মেঘের পাখি বিশাল বিশাল ডানা মেলে ছুটতে শুরু করেছে আমাদের বাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কে জানে কোন অজানার পানে। বুঝলাম তুষাড়ঝড় শুরু হয়ে গেছে। অটোয়াতে হলে অবাক হতাম—-নভেম্বরের আগে বরফের সাক্ষাত পাইনা সচরাচর। কিন্তু রকি পর্বতের হৈমন্ত উপত্যকাতে মেঘেদেরই একাধিপত্য। ঝড় দেখে ভাবলাম বাস হয়ত পথের পাশে দাঁড়াবে খানিক, ঝড়ের প্রকোপ কমে যাওয়ার অপেক্ষায়। বাঁদিকে বেশ ক’টা গাড়ি থেমে গেল দেখলাম—-অনর্থক বিপদের সঙ্গে ছিনিমিনি খেলার চেষ্টা কেন। কিন্তু আমাদের বাসটি থামা দূরে থাক, ব্রেকে পা দিয়ে একটুখানি গতি কমানোর চেষ্টাও করলনা। অনুমান করলাম যে দূরপাল্লার বাসচালকদের বড় ভয় ঝড়কে নয়, মুনিবকে, যে মুনিব ঘড়ির কাঁটা ধরে বসে থাকে ঝড়ের বাইরে, এবং ঘড়ির কাঁটার সঙ্গেই যার সকল বোঝাপড়া। সুতরাং যাত্রীবাহী শকট যে চালায় সে মেঘের সঙ্গে হয়ত চুক্তি করে নিয়েছে যে মেঘ করবে মেঘের কাজ,সে করবে তার। কেউ কারো পথ বেঁধে দাঁড়াবে না। সে এক শ্চর্য দৃশ্য। ব্যান্ফের বনেতে যেমন মানুষে-জীবেতে মিতালি, হাইওয়ের ঝড়েতেও যেন একইরকম মিতালি মানুষে-মেঘেতে । ঝড়-তুফান-বাদলা-তুষার যা’ই হোক জীবনের শকট কখনও তার চলা বন্ধ করবে না। বাসের উষ্ণ নিরাপত্তার ভেতরে থেকে আমার নিজের শরীরেও অনুভব করলাম সেই সূক্ষ্ম মিতালির কোমল স্পর্শ।

ক্যালগেরি পর্যন্ত বাকি পথটুকু, প্রায় একশ’ কিলোমিটার, সেই বিপুল ঝড়ের ভেতর দিয়েই চলল শকট। রবিঠাকুরের সেই গানটি “…ঝড়কে পেলাম সাথী…”, বড় প্রিয় গান আমার, তার মর্ম খানিকটা বোঝার সুযোগ হল। আরো বুঝলাম, এ ঝড় শুধু পথের নয়, জীবনেরও।

অবশেষে ক্যালগেরি। কোনদিন আসা হয়নি আগে। পাকা আটচল্লিশ বছর ধরে আছি এদেশে। মনে হয় সবই তো দেখলাম। কিন্তু আসলে কিছুই দেখিনি। দেখার চোখ ছিল না। বাইরের চোখটির কথা বলছিনা, অন্য চোখটি। দুর্ভাগ্যবশত ক্যালগেরি শহরটিকে বাইরের চোখেও দেখা হয়নি। এবার গৌরি সেনের টাকায় আসবার সুযোগ হল বলে এলাম। কথা দিয়েছিলাম কলিনকে, আঁখিকে, যে ওদের বাড়িতে অন্তত একটি রাত কাটাব ব্যান্ফ্ থেকে ফেরার পথে। তাই সরাসরি অটোয়াতে না গিয়ে দুটো দিন ওদের ওখানে থেকে যাওয়া। না থাকলে ওদের মনটা ছোট হয়ে যেত। জীবনের দীর্ঘ চলার পথে অনেক মনই তো ভাঙ্গা হল অজান্তে, পায়ের তলায় মূর্খ অবহেলায় মাড়ানো হল কত সুকোমল পুষ্পকলি, আর কেন অযথা কষ্ট দেওয়া মানুষকে। শিব্বির আর রাতুল দুই ভাই—-শিব্বির ছোট, তার স্ত্রী আঁখি;রাতুলের স্ত্রী কলিন। তিনবছর আগে ওরা মন্ট্রিয়লে ছিল, আরো তিনটি ভাইএর সাথে, প্রায় একই পাড়াতে। সেখান থেকেই পরিচয় ওদের সঙ্গে। পরিবারটিকে আমি পেয়েছি আমার লেখা র মধ্য দিয়ে।

‘দেশে-বিদেশে’তে লিখতাম, ওরা পড়ত খুব আগ্রহ করে। আমার মত সাধারণ লেখকের ভাগ্যে এই অসাধারণ প্রাপ্তি—-এত অফুরন্ত ভালোবাসা এত এত হৃদয়বান মানুষের কাছ থেকে। ক্যানাডা-আমেরিকার যেখানে যাই সেখানেই মানুষ উদারচিত্তে তাদের দুয়ার খুলে দেয় আমার কাছে। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষদের প্রাণভরা এত মনিমানিক্য, এত সুধা সৌরভ, এত আপন করে কাছে-টেনে-নেবার অপার পারগতা, তবুও কেন যে দেশটি এমন নিষ্প্রাণ নিষ্ক্রিয়তার পঙ্কিলতায় আবদ্ধ হয়ে আছে যুগের পর যুগ কিছুতেই বুঝতে পারিনা।

এক রাত আঁখি-শিব্বির আর তাদের দু’টি সন্তানের উষ্ণ আতিথেয়তায়, পরের রাতটি কলিন-রাতুল আর তাদের তিনটি দারুণ আদুরে ছেলেমেয়ের কলকাকলিতে কেটে গেল স্বপ্নের আবির মাখা দিনদু’টি। দারুণ ডিগ্রিধারি মানুষ নয় তারা, বিরাট পয়সাওয়ালা ব্যক্তিত্বও নয়, কিন্তু প্রাণের প্রাচুর্যে তাদের হার মানাতে পারবে এমন বিত্তবান মানুষও আমার চোখে পড়েনি বেশি। আমার সীমিত অভিজ্ঞতায়, বিত্তের অভাবটি যেন প্রতুলভাবেই পুষিয়ে দেবার এক আশ্চর্য ক্ষমতা ধারণ করেন আমাদের সমাজের স্বল্পবিত্ত অংশটি, শুধুমাত্র তাদের প্রাণের ছোঁয়ায়।

শিব্বিরের বাড়িতে থাকাকালে দেখা হল দেশ থেকে আসা এক ব্যতিক্রমী মানুষের সঙ্গে। আলমগির তাঁর নাম—পুরো নামটি মনে করতে পারছিনা। নাম নিয়ে এ এক মহা সমস্যা আমার—- কিছুতেই মনে রাখতে পারিনা। এ ব্যাপারে আমি হলাম যাকে বলে মেন্টালি চ্যালেঞ্জড—বাংলাতে কি বলে একে? মানসিক শ্লথতা? সোজা কথায় গবেট? যাই হোক, এই আলমগির সাহেব মানুষটি দারুণ করিতকর্মা, শুধু নিজের ব্যবসাবাণিজ্যের বিষয়ে নয়, সমাজের কোনও সমস্যার প্রতিই উদাসীন নন তিনি। যখন যা দরকার, যে কোনও বিপদ আপদ, অসুখবিসুখ, ডাকুন আলমগিরভাইকে, সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। লেখাপড়া কতখানি করেছেন জানিনা, জানার দরকারও নেই আমার, তাঁর কাজের পরিচয়ই যথেষ্ট আমার জন্যে। ক্যালগেরি শুধু নয়, গোটা আলবার্টা প্রদেশেরই বেশ কিছু রাজনৈতিক হোমচোমরার সঙ্গে তাঁর ওঠাবসা। খুব ঘনিষ্ঠ না হলেও কাজ আদায় করে নেবার মত পরিচয় যে আছে তার কিছু প্রমান আমি নিজেই দেখে এলাম। সবচেয়ে বড় প্রমান হল একটি ‘বাংলাদেশ কমিউনিটি সেন্টার’—-খুব বড় আকারের কিছু নয়, তবে এর মূল লক্ষ্য হল ক্যালগেরির ক্রমবর্ধমান বাংলাদেশী প্রবীন গোষ্ঠীর জন্যে একটি ‘আরাম করে সময় কাটাবার’ জায়গা। অর্থাত্ একটা ছোটখাট বৃদ্ধাশ্রম—-যা আমার বহুদিনের পুরনো স্বপ্ন। দেশ থেকে খুব শখ করে বাবামাকে নিয়ে আসি আমরা, কিন্তু তাঁদের জীবনের যে দৈনন্দিন শূন্যতাটি, বিশেষ করে জীবনসঙ্গী হারাবার পরবর্তিকালের যে অপরিসীম একাকিত্ব তার বিন্দুমাত্র প্রতীতি আমাদের সদাকর্মব্যস্ত মানুষগুলোর কারু্র আছে কিনা সন্দেহ। সেই অভাবটি প্রবাসের অন্য কোথাও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মোচন করবার লক্ষনীয় প্রচেষ্টা আমি দেখিনি আজ পর্যন্ত। ক্যালগেরিতে এসে তা দেখলাম প্রথমবারের মত। আমার প্রাণ জুড়াল। সেজন্যেই এই লেখার উদ্যোগ। আলমগির ও তাঁর সহকর্মীদের প্রতি রইল আমার শতসহস্র অভিনন্দন।

ক্যালগেরি আলবার্টার রাজধানী নয়, বানিজ্যকেন্দ্র। আলবার্টাকে আমি বলি ক্যানাডার মধ্যপ্রাচ্য। আলবার্টার তেলের খনি দিয়ে কোষাগার ভরে প্রদেশের কেবল নয়, গোটা দেশটারই। তবে মধ্যপ্রাচ্যের তেল যেমন মুসলিম বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশকেই দারুণভাবে তৈলাক্ত করে ফেলতে উদ্যত হয়েছে, আলবার্টার তেল দ্বারা মানুষ ততটা তৈলাক্ত হয়নি, আশা করি হবেও না, শুধু কোষাগারই পুষ্ট হয়েছে। ‘০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দার সময় সারা ক্যানাডাব্যাপী একটা বিশাল ক্যালগেরিমুখি কাফেলা তৈরি হয়েছিল কর্মহারা বেকারবাহিনীর। সেই মানবস্রোতে ভেসে এসেছিল দেশবিদেশের আরো অসংখ্য অভাগা শ্রমিক। চারপাঁচ বছর আগে ক্যালগেরিতে বাংলাদেশীরা সংখ্যায় একহাজারের বেশি ছিল কিনা সন্দেহ, এবার গিয়ে শুনলাম কম করে পাঁচ থেকে ছ’হাজার। ভারতীয়দের তো কথাই নেই। কোন কোন পাড়া আছে যেখানে শ্বেতাঙ্গ বাসিন্দা প্রায় নেই বললেই চলে। উপমহাদেশীয় অভিবাসীরা সংখ্যায় এতই বেড়ে গেছে যে এবছর ক্যালগেরির প্রথম মুসলিম মেয়র নির্বাচিত হলেন কিছুদিন আগে। শিব্বিরদের পাড়াটিতে দেখলাম অনেক দোকানপাটের সাইনবোর্ড হিন্দি বা তামিল ভাষায়। এমনকি গ্যাসের দোকানেও।

এপাড়াতে বেশির ভাগ বাড়িতেই গ্যারাজ নেই, এমনকি গাড়িবারান্দাও না। রাস্তায় গাড়ি রাখতে হয় শীত গ্রীষ্ম বৃষ্টি বাদলা যা’ই হোক। সবচেয়ে অবিশ্বাস্য জিনিস হল সেখানে বরফ পরিষ্কার করা হয়না সরকারিভাবে। কাজে যেতে হলে প্রথমে শাবল হাতে করে রাস্তায় বেরুতে হয়, তারপর কোনরকমে নিজের জায়গাটুকু সাফ করে গাড়ি নিয়ে বেরুবার ব্যবস্থা করতে হয়। অসুখবিসুখ জ্বরবিকার এসবের কোনো দোহাই দিয়ে লাভ হবে না। কেউ আপনার অশ্রুকাহিনীতে বিগলিত হবে না। সেখানে চাচা আপন প্রাণ বাঁচা বচনটি আক্ষরিকভাবেই সত্য। ক্যানাডার মত ঠাণ্ডা দেশে এটা যে আদৌ সম্ভব ক্যালগেরিতে না গেলে সেটা বিশ্বাস করা যেত না। অথচ ক্যালগেরিতেই বরং শীত একটু বেশি, অন্তত কিউবেক-অন্টারিওর তুলনায়। সেখানে অক্টোবর থেকে বরফ শুরু হয়ে যায়। সুতরাং ক্যালগেরিতে মানুষ যায় বটে, কিন্তু তারা আরামে আছে সুখে আছে সেরকম হয়ত ভাবা ঠিক হবে না। তারা হয়ত জীবিকা অর্জন করে সেখানে, কিন্তু জীবনের কতখানি পায় সেটা তারাই বলতে পারবে ভাল। আমি সেখানে থাকতে পারতাম না সেটা হলপ করে বলতে পারি।

শিব্বির তার গাড়ি করে ক্যালগেরির বেশ কিছু জায়গাতে নিয়ে গিয়েছিল আমাকে। দেখলাম অনেককিছু। দু’দিনের দেখাতে অবশ্য কিছুই দেখা হয়না একটা শহরের, শুধু ভাসা ভাসা কিছু ধারণা হয় মাত্র। ক্যালগেরি সম্বন্ধে আমার এই ভাসাভাসা ধারণাগুলো খুব প্রীতিকর নয় । কেমন যেন ছাড়া ছাড়া ভাব শহরটির—-কোনও বিশেষ চরিত্র বা বৈশিষ্ট্যের মধ্যে বাঁধা যায় না তাকে। বিশেষ কোনও রঙ নেই, চেহারা নেই, আলো নেই। পাহাড়ের টিলায় টিলায় কার্ডবোর্ডের বাক্সের মত করে সাজানো সারি সারি বাড়িঘর যার একটি থেকে আরেকটির কোন চারিত্রিক তারতম্য চোখে পড়ে না। যেন তারা একে অন্যের ছকে তৈরি ‘মেড ইন চায়না’ খেলার পুতুল। ক্যালগেরিকে কোনও অপেক্ষাকৃত উঁচু পাহাড় থেকে দেখলে মনে হবে এটা একটি শহর নয়, অনেকগুলো বিচ্ছিন্ন শহরের সমষ্টি। এমনকি শিবির বললেও অত্যুক্তি হবে না। হ্যাঁ শিবির বললেই বরং সঠিক বর্ণনা হয়—-শরণার্থী শিবির না হলেও তৈলকর্মী শিবির বললে নেহাত্ অন্যায় হবে বলে মনে হয়না।

ক্যালগেরির একটি ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য আছে অবশ্য। একে বলা হয় শিনুক—-একপ্রকার উষ্ণ বায়ুপ্রবাহ যা আসে রকি পর্বতের ওপার থেকে , এবং এসেই সমস্ত শহরটির ওপর একটি উষ্ণ প্রলেপ ছড়িয়ে দেয়। সেটা ঘটে শীতকালে, অধিকাংশ সময়। ফলে সেখানে সকালবেলা হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডা হলেও বিকেলবেলা গেঞ্জিগায়ে বেরুবার অবস্থা দাঁড়াতে পারে অনায়াসেই। ওরা বলে, ক্যালগেরিতে একই দিনে তিনটি ঋতুর সাক্ষাত্ পাওয়া সম্ভব—-শীত, বসন্ত, গ্রীষ্ম। সকালে ঠাণ্ডা, দুপুরে বসন্তের মন্দা হাওয়া, বিকেলে নিরক্ষীয় অঞ্চল। অনেকটা সেকারণেই নাকি ক্যালগেরির পৌরসভার রথী মহারথীরা বরফ-হলেই-সাফ করতে- হবে- সাথে- সাথে ওরকম কোনও তত্ব মানেন না। মানবেনই বা কেন। সেখানে তো প্রকৃতিই স্নোট্রাক পাঠিয়ে দেয় দরকার হলে। প্রকৃতির সঙ্গে এমন সুন্দর সৌহার্দপূর্ণ একটি সম্পর্ক আমাদের অটোয়াতে থাকলে মন্দ হতনা। জীবনটিকে আরো উপভোগ করা যেত। কিন্তু তবুও, যে যাই বলুক, আমার জন্যে অটোয়ার চেয়ে ভাল শহর পৃথিবীতে কেবল একটাই—ঢাকা। ঢাকা বাসযোগ্য নয় জেনেই কথাটা বলছি আমি।

নিউ ইয়র্ক,
১৭ই নভেম্বর, ‘১০
মুক্তিসন ৩৯