অধ্যাপক ড. মু. জাফর ইকবালের নাম দেশের প্রায় সকল শ্রেণীর মানুষের মুখেই শোনা যায়। আর বাংলাভাষী এই ব্লগসাইট গুলোতে তো কথাই নাই। এখানে সবচাইতে বেশি আলোচিত দেশি ব্যাক্তিত্ব হয়তো তিনিই। তবে এক্ষেত্রে তার লেখনী বা পেশাদারীত্বের স্থলে তার ব্যাক্তিগত জীবন নিয়েই বেশি নাড়াচাড়া করা হয়। আমি অবশ্য সেটা সমর্থন করি না। তাছাড়া ব্যাক্তিগত ভাবে আমি তাঁকে যথেষ্ট সম্মান করি। একজন শিবির কর্মীর কাছে অবশ্য যদি তার সম্বন্ধে জানতে চাওয়া হয় তখন অন্যকথা শোনা যাবে। কিন্তু আমি আগেই উল্লেখ করেছি, কারও ব্যাক্তিগত জীবন নিয়ে টানা-হ্যাঁচড়া করা কখনোই উচিত নয়। আজ আমি বরং তার এক ‘জনপ্রিয়’ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী ‘অক্টোপাসের চোখ’ নিয়ে আমার অভিমত আপনাদের সাথে শেয়ার করতে চাচ্ছি।
গল্পটি আমি পড়েছি অনুপম প্রকাশনী কর্তৃক ‘অক্টোপাসের চোখ’ শীর্ষক বইটির তৃতীয় মুদ্রণ থেকে। প্রথম প্রকাশ ছিল ফেব্রুয়ারি ২০০৯-এ। সেই হিসেবে আমার এ আলোচনা অনেক পুরনো মনে হতে পারে। বইয়ের ৯ থেকে ১৬ পৃ. পর্যন্ত গল্পটির পরিব্যাপ্তি। গল্পে দেখা যায় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান আকাদেমির মহামান্য পরিচালক কিহি তার বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের শেষ প্রান্তে এসে বিশ্বের সফলতম বিজ্ঞানীদের নিয়ে মানবসভ্যতার উন্নয়নের লক্ষ্যে এক আলোচনায় বসেন। এখানে এক পর্যায়ে তিনি বলেন

“বিশ্বব্রহ্মান্ডের সর্বর্শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষ এই পর্যায়ে এসেছে বিবর্তনের ভেতর দিয়ে……দুইশ হাজার বছর আগের হোমোস্যাপিয়েন, বিবর্তনের ভেতর দিয়ে বর্তমান মানুষের পর্যায়ে এসেছে”।

এখানে বোঝা যায় গল্পের প্রেক্ষাপট এমন এক সময়ের যখন বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন যে, ঠিক দুই লক্ষ বছর আগে homo sapience এর উদয় হয়েছিল । কিন্তু কথা হল মহামান্য কিহি একবার বিবর্তনের কথা বললেন, আবার বললেন ‘বিশ্বব্রহ্মান্ডের সর্বর্শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষ’; দুটি পুরোপুরি পরষ্পরবিরোধী কথা। যা হোক বিজ্ঞানীরা এবার মানবদেহের খুঁতগুলো দূর করে একটি নিখুঁত মডেলের মানবদেহ ডিজাইনের কথা ভাবতে লাগলেন। জীববিজ্ঞানী টুহাস তার পরামর্শে মানুষের চোখের ত্রুটিগুলি তুলে ধরেন। এবং অক্টোপাসের মত চোখ সংযোজনের পরামর্শ দেন। ভালো কথা।
কিন্তু এক তরুন বিজ্ঞানী ফিদা বললেন, নবজাতকের মাথার আকার বড় হওয়ায়, মায়ের সন্তান জন্মদানে অনেক কষ্ট হয়। এজন্য তিনি পরামর্শ দিলেন মানবশিশু তথা মানবজাতির মাথাই ছোট করে ফেলার। এখানে একটি কথা, তিনি কি বিষয়ক বিজ্ঞানী তা লেখক কোথাও উল্লেখ করেননি। জানিনা এর কারণ কি। অন্যান্য বিজ্ঞানীদের ক্ষেত্রে কিন্তু তিনি সেটা উল্লেখ করেছেন। তবে আশ্চর্য বিষয় হল বিজ্ঞানীরা তার পরামর্শকে সাদরে গ্রহণ করে নেয়। প্রজাতির বুদ্ধিমত্তা নির্ভর করে তার শরীরের আকারের সাথে মস্তিষ্কের আকারের অনুপাতের উপর। মাথার আকার যদি বড় না হয় তাহলে তার মস্তিস্কের আকারও বড় হবে না। বাকি শরীরের সাথে মস্তিস্কের আকারের অনুপাতের কারণেই মানুষকে সবচেয়ে উন্নত প্রজাতির জীব বলা হয়। বিবর্তনের কারণে অন্যান্য এপদের যেখানে চোয়াল বড় হয়ে গেছে, সেখানে মানুষের মস্তিষ্কের আকার বৃদ্ধি পেয়েছে। এখানেই মানুষ এবং অন্যান্য জীবের মধ্যকার অন্যতম প্রধান পার্থক্য বিরাজ করে। এরপর আসে আরেক বিজ্ঞানী রিকির কথা। লেখক ৯ম পৃষ্ঠায় তার সম্পর্কে লিখেছেন জীববিজ্ঞানী, কিন্তু দুই পৃষ্ঠা পর তার নামের সামনে লেখা হয়েছে গণিতবিদ। কোনটি সঠিক পরিচয় কিভাবে বুঝবো? তার পরামর্শ দেখে যদি কিছু বুঝতে পারেন তবে দেখুন।

“বিবর্তনের কারণে মানুষ হঠাৎ করে দুই পায়ে দাঁড়িয়ে গেছে কিন্তু হাড়ের সংযোগটা মানুষের ওজন ঠিকভাবে নিতে পারে না। দুটি না হয়ে ৪টি হলে ওজনটা ঠিকভাবে নিতে পারত”।

বাহ, বিজ্ঞানীরা কিনা আমাদের চতুষ্পদ প্রজাতিতে পরিনত করতে চাচ্ছেন। সেই Australopithecus, Ardipithecus এরও আগে মানুষকে নিয়ে যেতে চাচ্ছেন। আর বড় কথা হল বিবর্তনের সুদীর্ঘ প্রক্রিয়ায় হঠাৎ করে মানুষের দুই পায়ে দাঁড়িয়ে যাওয়ার কোন সুযোগ নাই।
প্রযুক্তিবিদ রিভিক অবশ্য ভালো পরামর্শ দেন। তিনি দেহের অন্যতম উটকো ঝামেলা অ্যাপে‍‌ন্ডিক্সের কথা উল্লেখ করেন। কিন্তু আরেক জীববিজ্ঞানী সুহাস (নাকি টুহাস) কম গুরুত্বপূর্ণ বলে একে উড়িয়ে দিয়ে মানুষের জননেন্দ্রিয়ের বিপজ্জনক অবস্থানের কথা তুলে ধরেন। এরপর তারা আরও দীর্ঘ আলোচনা শেষে ‘মানব জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে সর্বকালের সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ সিদ্ধান্তটি’ গ্রহণ করেন। বিজ্ঞান আকাদেমি সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নেয় যে, মানব জাতির জিনোমে আগামি ১০০ বছরে খুব ধীরে ধীরে পরিবর্তন আনা হবে যেন ১০০ বছর পরে মানবদেহে আর কোন সীমাবদ্ধতা না থাকে। বলা বাহুল্য এখানে সীমাবদ্ধতা বলতে উপরের সেই হাস্যকর আলোচনার (মাথা ছোট করে ফেলা, পায়ের সংখ্যা ৪ করে ফেলা ইত্যাদি) বিষয়বস্তুই আসে।
সেই মোতাবেক যদি আবার এই মানবদেহের উপর ইঞ্জিনিয়ারিং চালানো হয়, তবে এই অপরিকল্পিত এবং ত্রুটিপূর্ন মানবদেহের অবস্থা কি দাঁড়াবে তা সহজেই অনুমান করা যায়।
এরপর মহামান্য কিহি নিজ চোখে দেখতে চাইলেন, যে তাদের এই প্রচেষ্টা কতটুকু সফল হয়, মানব জাতির কতটা উপকার সাধন করে। তাই তিনি শীতল ঘরে গিয়ে ১০০ বছরের জন্য ঘুম দিলেন। এরপর ঘুম থেকে উঠে তিনি কি দেখবেন তা জীববিজ্ঞান সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞান থাকা যেকোন মানুষের পক্ষেই অনুমেয়। তবে যেটা অনুমেয় নয় তা হল, মহামান্য কিহি নিজের মনে বললেন,

“আহা এই পৃথিবীটা কি অপূর্ব। সৃষ্টিকর্তা তোমাকে ধন্যবাদ আমাকে মানুষ করে পৃথিবীতে পাঠানোর জন্য”।

…এর আগ পর্যন্ত তো তিনি বিবর্তনবাদী ছিলেন, এখন হঠাৎ… তিনি এমন কি ঘুম দিলেন যে এক ঘুমে একজন বিবর্তনবাদী সৃষ্টিতত্ত্ববাদী হয়ে যেতে পারেন। এরপর তিনি দেখলেন তার মানব জাতির উন্নয়ন। ছোট মস্তিষ্ক তথা কম বুদ্ধিবিশিষ্ট, চতুষ্পদ, কাপড়বিহীন, জম্বি মানুষেরা তাকে আক্রমণ করে তার কণ্ঠনালী কামড়ে ছিড়ে মেরে ফেলে। (গল্প শেষ)
ভাবতে অবাক লাগে, যিনি ‘সুহানের স্বপ্ন’, ‘ফিনিক্স’, ‘পৃ’, ‘সফদর আলীর মহা মহা আবিষ্কার’ এর মত বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী লিখতে পারেন তিনি কিভাবে এ ধরণের গল্প লিখেন। আমার কথা হল দেশের জনপ্রিয়তম সায়েন্স ফিকশন লেখকই যদি লেখায় এমন ভুল করেন, তবে অন্যদের কি দশা তা অনুমানের চেষ্টা না করাই ভাল। স্যারের উদ্দেশ্যে আমি শুধু এটাই জানাতে চাই, উনার প্রতিটি গল্প, প্রতিটি রচনা এদেশের অল্পবয়েষী পাঠকদের মধ্যে অনেক প্রভাব ফেলে। উনার লেখাকে অবশ্যই অপবিজ্ঞানের ভাইরাস থেকে দূরে রাখতে হবে। নইলে দেশের তরুন প্রজন্ম এতে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এদেশে সঠিক বিজ্ঞানচর্চার দৌড় কতটুকু তা আশা করি উনার অজানা নেই।

আমার এক বন্ধু একবার কথা প্রসঙ্গে এই ‘অক্টোপাসের চোখ’ গল্পটির কথা টেনে এনে আমাকে বলেছিল যে, এই গল্পের মাধ্যমে জাফর স্যার স্বীকার করে নিয়েছেন যে, সৃষ্টিকর্তা মানুষকে যেভাবে সৃষ্টি করেছেন সেটাই সবচেয়ে উপযুক্ত। কোন মানুষ এটাকে পরিবর্তনের চেষ্টা করলে তার পরিণাম এমনই হবে। তার কথা শুনেই আমি গল্পটাকে আরও মনোযোগ দিয়ে পড়ার পর এই পোস্ট লেখার সিদ্ধান্ত নেই। সে না বললে এই পোস্ট আমার হয়তো লেখা হত না। একারনে এই লেখাটি আমি তাকেই উৎসর্গ করছি।