১.
বাঙলাদেশের মত একটা রক্ষণশীল দেশে যেখানে সমাজ একজন ব্যক্তির জীবনে খুব গুরূত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, সেখানে একজন নাস্তিকের পক্ষে সমাজের বাকি দশ জনের সাথে মিলিয়ে চলা মাঝে মাঝে বেশ কষ্টকরই হয়ে পড়ে। এখানে ভিন্ন মতের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ তো নেইই, বরং আছে ভিন্ন মতাবলম্বীদের প্রতি অসহনীয় মানসিক নির্যাতন, কখনো কখনো যা আবার শারীরিক পর্যায় পর্যন্ত চলে যায়! নাস্তিকরা এখনো এখানে প্রকাশ্যে তাদের বিশ্বাসের কথা বলতে পারে না (ব্যতিক্রম আছে বইকি), ঈশ্বরে বিশ্বাস না করা সত্ত্বেও তাদেরকে অনেকসময় ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে অংশ নিতে হয়।

এখানেই একটা বড় প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় আমাদেরকে, নাস্তিকদের পক্ষে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত? অথবা, যে নাস্তিক ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে অংশ নেয়, তাকে কি আমরা আদৌ নাস্তিক বলতে পারি?

সংকীর্ণভাবে চিন্তা করতে গেলে, যেহেতু নাস্তিকতা মানে ‘স্রষ্টায় অবিশ্বাস’, সেহেতু কোন ব্যক্তি ধর্মীয় কোন অনুষ্ঠানে অংশ
নিলে তত্ত্বগতভাবেই তাকে ‘নাস্তিক’ বলা ঠিক হবে না। যে ব্যক্তি ‘স্রষ্টা’য় অবিশ্বাস করছে, সে আবার কিভাবে সেই
‘স্রষ্টা’রই আরাধনা করছে? – এই পরস্পরবিরোধীতার কারণেই আমাদের সমাজের গুটিকয়েক নাস্তিকদের এক বিশাল
অংশকেই আর ‘নাস্তিক’ বলা যাবে না।

কিন্তু, বাস্তবতাকে বিবেচনায় নিলে ব্যাপারটা একটু অন্যরকম হয়ে যায়। আমি একটা ব্যক্তিগত উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা
পরিষ্কার করছি।

দুই বছর আগের কথা। তখন আমি পুরোদস্তুর নাস্তিক। আমার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরও ব্যাপারটা জানা
হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তারপরও তারা (বিশেষ করে আমার মা) ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোতে অংশ নিতে পীড়াপীড়ি করত।
আমি স্বভাবতই রাজি হতাম না, কিন্তু রাজি না হওয়ার মানে হচ্ছে একপ্রকার লঙ্কাকান্ড হয়ে যাওয়া (এ প্রসঙ্গে বলে রাখি,
আমার পরিবার বেশ রক্ষণশীল)! তাই কখনো তাদের রোষানল থেকে বাঁচার জন্য, কখনো বা তাদের মনে কষ্ট না দেওয়ার
জন্য, ধর্মীয় অনুষ্ঠানে প্রায়ই অংশ নিতাম। তত্ত্বগতভাবে, তখন আমি নাস্তিক ছিলাম না!

আমি কিন্তু মনে করি তখনও আমি নাস্তিকই ছিলাম। নাস্তিকতা বলতে আমি বিশ্বাসগত ব্যাপারটাকেই (স্রষ্টায় অবিশ্বাস) বুঝি, আচরণগত ব্যাপারটাকে আমার কাছে গৌণই মনে হয়। একজন ব্যক্তিকে, আমার মতে, আমরা তখনই ‘নাস্তিক’ বলব যখন তার মধ্যে ‘স্রষ্টায় বিশ্বাস’ ব্যাপারটা অনুপস্থিত থাকবে; সে যদি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে বা দুবেলা পূজা-আহ্নিক করে তারপরও সে বিশ্বাসী হয়ে যাবে না!

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে একজন বিশ্বাসীর সাথে একজন নাস্তিকের পার্থক্য আর থাকল কোথায়? পার্থক্য আছে ঠিকই,
তবে এই পার্থক্য তাদের আচরণে নয়, পার্থক্য তাদের আচরণের পেছনের কারণে। একজন বিশ্বাসী নামাজ পড়ে কারণ সে
বিশ্বাসকরে নামাজ পড়লে তার জান্নাতপ্রাপ্তির সম্ভাবনা বর্ধিত হবে; অন্যদিকে একজন নাস্তিক কখনোই জান্নাতপ্রাপ্তির সম্ভাবনায়
নামাজ পড়বে না, তার কারণটা হবে সামাজিক।

২.
এখন, একজন নাস্তিকের পক্ষে নামাজ পড়া অথবা পূজা দেওয়া কতটুকু যৌক্তিক- এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য আমাদের আলোচনাকে একটু ভিন্নদিকে সরিয়ে নিতে হবে। এখনও পর্যন্ত অন্তত বাঙলাদেশের নাস্তিকরা সমাজের চাপের কাছে নতি স্বীকার করে আসছে, তাদের বেশির ভাগই নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বে হলেও ধর্মীয় কার্যকলাপে অংশ নিচ্ছে।এটা কিন্তু মোটের উপর নাস্তিকদের অবস্থার উন্নতি করছে না, বরং তাদেরকে আরো দীর্ঘকালের জন্য পর্দার আড়ালে রেখে দিতেই সাহায্য করছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, নাস্তিকদের উচিত ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানগুলো পুরোপুরি বর্জন করা,
সমাজের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে হলেও। যেকোন নতুন ধারণা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে প্রচুর সময় নেয়, কিন্তু সেই নতুন ধারণার ধারকেরাই যদি ‘সামাজিক’ হয়ে ওঠে, তাহলে সেই ধারণা অন্তত নিকট ভবিষ্যতে প্রতিষ্ঠা হওয়ার সম্ভাবনা হারায়। ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলো বর্জন করার পাশাপাশি আমাদের উচিত নিজেদের মধ্যে বন্ধন সুদৃঢ় করা, যাতে আমরা পুরোপুরি ‘অসামাজিক’ না হয়ে উঠি!

তাহলে কি আমরা ঈদ বা পূজার মত সার্ব্বজনীন হয়ে ওঠা উৎসবগুলোকেও পুরোপুরি বর্জন করব? এখানে আবার আমি একটু দ্বিমত পোষণ করি। ঈদ-উল-ফিতর কিংবা শারদীয় দুর্গোৎসবকে আমি শুধু ধর্মীয় নয়, বরং সাংস্কৃতিক উৎসব হিসেবেও দেখি। ছোটবেলা থেকেই এই দুটো উৎসবেই আমি ইচ্ছেমত মজা করে এসেছি, আমি চাইনা আমি আমার আদর্শের জন্য এইসব মজা থেকে বঞ্চিত হই!

আমার বক্তব্যগুলোকে পরস্পরবিরোধী বলে মনে হতে পারে। ব্যাপারটা পরিষ্কার করছি।

আমি ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের (rituals) বিরোধিতা করলেও অসাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ধর্মীয় উৎসবের (festivals) বিপক্ষে নই। পহেলা বৈশাখ একসময় পুরোপুরি ধর্মীয় একটা ব্যাপার ছিল, কিন্তু কালের বিবর্তনে এখন এর সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক ব্যাপারটাই মুখ্য হয়ে উঠেছে। আমরা দুই দিনে সবাইকে অবিশ্বাসী করে ফেলতে পারব না, কিন্তু চেষ্টা করলে যেকোন মানুষ কিছুদিনের মধ্যেই অসাম্প্রদায়িক হয়ে উঠতে পারে। অসাম্প্রদায়িকতা একসময় মানুষকে অবিশ্বাসের দিকেই নিয়ে যাবে, আর আমি মনে করি ঈদ-উল-ফিতর বা শারদীয় দুর্গোৎসবের মত উৎসবগুলো আমাদেরকে জাতিহিসেবে ক্রমশঃ অসাম্প্রদায়িকতার পথেই নিয়ে যাচ্ছে।

পরিশেষঃ
তবে, সব কথার শেষ কথা, নাস্তিকরা স্বাধীন। প্রত্যেক নাস্তিক, আমার বিশ্বাস, স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পারে; তাই
নাস্তিকদেরকে কোন বাঁধা গন্ডির মধ্যে আটকে ফেলা যাবে না। আমরা বড়জোর বলতে পারি, নাস্তিকদের এটা করা
উচিত কিংবা ওটা করা উচিত না; কিন্তু কখনোই ‘তুমি নামাজ পড়, তুমি তো নাস্তিক নও’- এরকম কিছু বলতে পারি
না। নাস্তিক হতে হলে অন্য কোন যোগ্যতাই লাগে না, কেবল ঈশ্বরে অবিশ্বাসী হলেই চলে।

(এই লেখাটার অনুপ্রেরণাটা এসেছে ফেইসবুকে “অ্যাথিয়েস্ট বাঙলাদেশ” গ্রুপে অন্যান্য কিছু নাস্তিকদের সাথে আলোচনার
ফলস্বরূপ।)

(অক্টোবর ষোল, ২০১০)