ক.
জুম্মার আযানের পর ইমাম সাহেব আজ নিজে মাইকে দাঁড়িয়ে সকলকে মসজিদে আসার জন্য বলেছেন। গ্রামের সর্বসাধারণের মঙ্গলের জন্য হুজুর যখন কোন সীদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তখন তিনি এইভাবে সকলকে সমবেত হবার জন্য বলেন। ইমাম সাহেবের কথা ফেলবার সাধ্য কারও নেই। তাই আজ যারা নামায পড়ে না তারাও গেল। যাদের এখন ক্ষেতে পানি দেয়ার কথা ছিল তারাও গেল। যার একটি পা নেই, নাতি ছেলের কাধে ভর করে সেও গেল। আললাহর সাথে যার ভেতরে ভেতরে গভীর দ্বন্দ্ব সেও গেল। গ্রামে যে কয়েকঘর হিন্দু-ডোমদের বাস ছিল, তারাও গেল-মসজিদের গেটে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল, কেননা, আজ যে সীদ্ধান্ত নেয়া হবে তার সাথে এদের স্বার্থও জড়িত।

ইমাম সাহেব শুরু করলেন : ‘মুমিন, ঈমানদার ভাইয়েরা আমার! আপনারা ইতিমধ্যি টের পেয়িছেন, আল্লাহ আমাদের ওপর চরমভাবে নাখোশ। তাঁর অভিশাপ নাযিল হয়িছে এই রহমতগঞ্চের ওপর। মাঠে দাও দাও করি আগুন জ্বলছি। সোনার ফসল পুড়ি ছাঁই হয়ি যাচ্ছি। আল্লাহর আদেশে সূর্য তার শক্তির কেরামতি দেখাচ্ছি। সবাই না খেয়ি মরবি – আল্লাহর সাথে নাফোরমানি! দিলে আল্লাহর ভয়-ডোর আনো মিয়ারা, তোমাদের জন্যি আরো কঠিন দিন অপেক্ষা করছি। কথায় আছে, ‘ঊন বর্ষায় দুনো শীত!’ এইবার খরায় সব পুড়ি যাচ্ছি, পরের বার দেখবা বানের পানিতে বও-বাচ্চা সব ভেসি যাচ্ছি। তাই এখুনো সময় আছে, তুমাদের বাল-বাচ্চাদের বাচানুর।’
‘হুজুর, আমরা গ্রামের ব্যাবাক মানুষই তো নামায পড়ি, তাহলি কেনে এই গজব ?’ – জানতে চাইলেন মুরুবিব গোছের এক কৃষক।
‘শুধু নামায পড়লি হবে মিয়া? এই মসজিদের দিকে একবার নজর দিয়ে দেখ,-গেল পাঁচ বছর ধরি শুধু মেঝেটাতেই ইট পড়িছে। আল্লাহর ঘরকে এত অবহেলা করলি গজব নাজিল হবি না তো এমনি!’
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া গ্রামের একমাত্র ছেলেটি দাঁড়িয়ে গেল, ‘হুজুর, ক্ষমা করবেন, মসজিদ পাকা হওয়া না হওয়ার সাথে খরার কি সস্পর্ক বুঝলাম না? দেশে তো আর পাকা মসজিদের অভাব নেই! খরা তো এখন দেশ জুড়েই। আর তাছাড়া, আমাদের গ্রামের সকলেই চাষী, পুরো গায়ে চেয়ারম্যান সাহেব আর আপনার ঘর ছাড়া পাকা কোন ঘর নেই। সুতরাং এই গায়ের মসজিদ কাচা হলি ক্ষতি কি?’
হুজুর তেলে বেগুনে তেতে উঠলেন-‘কি! আল্লাহর ঘরে বসি আল্লাহর সাথে নাফোরমানি? এই পোলাকে আজই গাঁ ছাড়া করতি হবে। মাদ্রাসায় শিক্ষা নিলে আজ ওর এই গতি হতু না।’

খ.
কয়েকদিনের মধ্যে ইমামের নির্দেশ মোতাবেক মসজিদ পাকা করার কাজ শুরু করা হল। গ্রামের সকলে তাদের সাধ্যমত দান করলো। যার সাধ্য নেই সেও কিছু দিলো। আমবিয়ার বাপ এই দুর্ভিক্ষের মৌসুমে যে অল্প কটি ফসল ঘরে তুলেছিল তার সবটাই প্রায় ইমামের হাতে তুলে দিল। পশ্চিম পাড়ার শকুর তার একমাত্র হালের গরুটা আল্লাহর ঘর তৈরীতে সপে দিল। নারীরাও থেমে থাকে নি-কেউবা হাতের বালা, কেউবা কানের দুল, কেউবা গলার মালা। শিশুরা বাঁশের ফোকরে কিম্বা মাটির ব্যাংকে আসছে মেলা থেকে রঙিন খেলনা কিনবে ভেবে যে দু’ চারআনা পয়সা জমা করেছিল তাও দিয়ে দিলো। গ্রামে খরা কিম্বা বন্যায় শহরের মানুষদের সহযোগিতা না পেলেও মসজিদের জন্য তারা দু’হাত ভরে দিলো।

মসজিদের দেয়াল করা হয়। ছাদ করা হল। রঙ করা হল দেয়ালে। পাশের গ্রাম থেকে বিদ্যুৎ আনা হল। মাইক লাগান হল চতুর্দিক তাক করে। গুনে গুনে দশটি বৈদুতিক বাতি ও ফ্যান সেট করা হল। আরব দেশ থেকে ইমাম আর চেয়ারম্যানের জন্য কাবাঘর আঁকা তুলার জায়নামায আনা হল। চেয়ারম্যান আর ইমাম সাহেব নাকি মসজিদের জন্য বিদেশ থেকে সাহায্য আনানোর ব্যবস্থা করছেন। তাদের ঘরেও রঙ করা হল একেবারে বিলেতি ধাঁচের।
‘বার বার মিস্ত্রি-টিস্ত্রি আনা ঝামেলা, তা কি বলো ইমাম?’
‘আমিও যা ভাবছিলাম’-উত্তরে ইমাম সাহেব বলেছিলেন।
দীর্ঘদিন ধরে বিনা মজুরে কাজ করলো গ্রামের শয়ে শয়ে মানুষ। মসজিদ শেষ হতে না হতেই মহামারী দেখা দিল গ্রাম জুড়ে। না খেতে পেরে মারা গেল শিুশু, বৃদ্ধ, জোয়ানরাও। এতবড় প্রকট একটা মহামারীর মাঝেও টিকে গেল বেশ কিছু মানুষ,-আল্লাহর অশেষ মেহেরবানী বলে কথা!

গ.
মজিদ মিয়া তার ছয় বছরের ছেলে আর নয় বছরের মেয়েকে সকাল সকাল গোসল করিয়ে পরিস্কার কাপড়-চোপড় পরায়। মসজিদ দেখতে যাওয়া ওদের অনেক দিনের বায়না। আশেপাশের গ্রাম জুড়ে এখন মসজিদটা দর্শনীয় জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষ বেশ ঘটা করে মসজিদে আসছে, ঘুরে ফিরে দেখছে চারপাশ। ময়না আর মজনু, মজিদ মিয়ার ছেলে-মেয়ে, আজ বেজায় খুশি। মজিদ মিয়া তার একহাতে মেয়েকে অন্যহাতে ছেলেকে ধরে বেশ আনন্দে পা বাড়ায় মসজিদের দিকে। মসজিদের গেটে এসে মজনু বাবার হাত গলিয়ে ছুটে যায় মসজিদের ভেতরে। ‘অ্যারে অ্যারে একি করলি, পা খান ধুয়ে যা আর একবার!’-মজিদ চেঁচিয়ে বলে। ময়না বেশ যত্ন করে পা দুখানি ধুয়ে মসজিদে প্রবেশ করে। মজিদ মসজিদের ভেতরে প্রবেশ করার আগে বেশ দ্বিধায় পড়ে যায়-এমন ফাটা পায়ে উঠলে আল্লাহর ঘরের চকচকে মেঝেতে যদি দাগ পড়ে যায়! মজিদ মসজিদের এক কোনায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। ‘এটা আমাগো মসজিদ, তাই না বাপজান?’-ময়নার যেন বিশ্বাসই হয় না। মজনু আর ময়না যে যার মত করে মসজিদের ভেতর ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকে। ঘুরন্ত ফ্যানের দিকে তাকিয়ে মজনু অবাক হয়ে যায়। ‘আববা, এইটা কেমনে ঘোরে?’ ‘সবই আল্লাহর কুদরত বাপ।’-উত্তর দেয় মজিদ। ‘ফেরেসতারা ঘুরায়, তাই না বাপজান?’-ও পাশ থেকে বলে ময়না।

মজনুকে ভেতরে দেখে তেড়ে আসে ইমাম-‘এই কার ছোকড়া এটা, হ্যাফপান্ট পরি ঢুকি পড়িছে? বের হ’ বলছি।’
ইমামের কথা শুনে ছুটে যায় মজিদ-‘হুজুর মাফ করবেন, এইডা আমার পুলা। কয়দিন থেকি মসজিদটা দেখতি চাচ্ছিল।’
‘দেখতে চাচ্ছিল ভাল কথা। বাইরে থেকি দেখাবি। এইভাবে হ্যাফপ্যান্ট পরি কেও আল্লাহর ঘরে ঢোকে নাকি রে বেকুব! আর তোর পেছনে ঐ মহিলাডা কে?’
‘আমার মেয়ে হুজুর।’ ভয়ে ভয়ে বলে মজিদ।
‘জানিসনে মেয়ে মানষের বেপর্দা হয়ে মসজিদে আসতে নেই?’
‘হুজুর, হেয় আমার দুধের বাচ্চা। বাচ্চাদের ছেলে আর মেয়ে কি!’
‘দুধের বাচ্চা, কস কি! হেরে দেখিই তো মনে হয় বিয়ের বয়স পার হয়ি যাচ্ছি।’
‘না হুজুর, গেল মাঘে ওর বয়স আট হয়িছে।’
‘এখনই তো বিয়ের উপযুক্ত সময়। নবী কারীম স: আয়েশা রা: কে যখন বিয়ে করে তখন তাঁর বয়স সাত বছর ছেল। শোন, তোর মেয়ি মাশআল্লাহ সুন্দর আছে। বি’ নি তোকে ভাবতি হবে না। বিহানে একবার মক্তবে আসিস কথা আছে।’
মজিদের মনটা কেমন জানি বিষিয়ে ওঠে। একহাতে মেয়ে অন্যহাতে ছেলেকে নিয়ে মজিদ মসজিদ থেকে বের হয়ে আসে।
‘আববা, আমাগো ঐ রকম বাড়ি হইব না? কি সুন্দর দেখতি! মনে হয় খালি দেখি আর দেখি!’
‘ঐরকম ঘর করতি মেলা ট্যাকা লাগে, তাই না বাপজান? অতো ট্যাকা বাপজান কুতায় পাবে!’
‘তালি তো আল্লার মেলা ট্যাকা, তাইনা বু’?’
‘মেলা ট্যাকা মানে! আল্লাহর কাছে বড় বড় টাকার গাছ আছে, তাই না বাপজান?’
‘আল্লায় ওতো বড়লোক তো, আববা আল্লার বাড়ি কাম করতি গেলিই পারে?’
‘হি! হি! হি!,’ খিল খিল করে হেসে ওঠে ময়না, ‘তোর মাথায় ঘেলু নেই। আল্লাহ দুনিয়ায় থাকে নাকি! আল্লাহর ঘর হচ্ছি ঐ আকাশের মেলা ওপরে!’
‘তালি ঐ মসজিদে কিডা থাকে? হুজুর স্যার যে বললু, ঐডা আল্লার ঘর?’
‘তোকে আমি বুঝাতি পারবু না। বাপজান, উকে বুঝাও তো?’
‘এই থামবি তুরা? আল্লাহকে নি এসব কথা বুললি পাপ লাগবি।’

ঘ.
পরের বছর বর্ষা যেন ঝাপিয়ে পড়ে রহমতগঞ্জের ওপরে। গাঙের পানিতে ভেসে যায় মাঠ। নদীর বাঁধ ভেঙ্গে রাতারাতি ডুবে যায় রহমতগঞ্জের অর্ধেকেরও বেশি বাড়ি ঘর। ভেসে যায় গবাদি পশুর সাথে মানুষও। মজিদ মিয়ার মাটির দেয়াল চাপা পড়ে মারা গেছে মজনু। ঘর বাড়ি হারিয়ে মানুষ এখন মসজিদের বারান্দায় আশ্রয় নিয়েছে। মহিলা ও শিশুদের জন্য চেয়ানম্যান সাহেবের বৈঠকখানা ও পরিত্যক্ত গোয়ালঘর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কিছু পরিবার আশ্রয় নিয়েছে আশে-পাশের গ্রামে আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে।

‘আল্লাহর কি কুদরত, এত দুর্যোগেও মসজিদটার কিছু হয়নি! এই মসজিদখান না থাকলি তুমরা কুতায় গি’ দাঁড়াতে? গ্রামের অর্ধেকেরও বেশি বাড়ি-ঘর পানিতে ভেসি গেল অথচ এই মসজিদের একটা ইটও ডুবলু না! সবাই আল্লার কাছে শুকরিয়া আদায় কর।’-হুজুর আজ জুম্মার খুতবায় বেশ কয়েকবার বললেন কথাটা।
‘হুজুর গেল বছর খরা গেল, এ বছর বানে ভেসি গেল গাঁ-আমরা এ কুন পাপের শাস্তি ভোগ করছি?’-বৃদ্ধলোকটা বলতে বলতে কেঁদে ফেললো।
‘‘শাস্তির কথা কেনে বুলছেন? বরং আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেন। আল্লাহ পাক কালামে বলছেন, তিনি যাদেরকে যত বেশি ভালোবাসেন তাদেরকে বিপদ দি’ ততবেশি পরীক্ষা করেন। এই পরীক্ষাতে উত্তীর্ন হলিই তো কাল কেয়ামতের দিন জান্নাত অবধারিত। সুরা নাবা’য় আল্লাহ বলিছেন, ‘সাবধানীদের জন্যি রয়িছে সাফল্য, দ্রাক্ষা, সমবয়স্কা উদ্দিন্নযৌবনা তরুনী এবং পূর্ণ পানপাত্র।’ এসব পাওয়া কি এতই সুজা? দুনিয়ার যত সুখ-শান্তি তো কাফের মুশরিকদের জন্যি। আল্লাহ আমাদের ভালোবাসেন বুলিই না এত পরীক্ষা-সবাই বলেন আলহাম্দুলিল্লাহ।’’
‘আলহামদুলল্লিহা’-সবার সাথে সাথে চোখ মুছতে মুছতে বৃদ্ধও বললেন।

নামায শেষ করে মসজিদের এক পাশে মজিদকে ডেকে নিয়ে যায় হুজুর। ফিসফিস করে বলেন, ‘আমার প্রস্তাবটা ভেবি দেখো মজিদ মিয়া। এই দুর্যোগের মাঝে তুমার পরিবারের একখান গতি হইবে।’
মজিদ কোন কথা বলে না। গোরস্থানের দিকে পা বাড়ায় সে। গেল বছর অনাবৃষ্টিতে মা মরছে, এইবার অতিবৃষ্টিতে ছেলেটা গেল। আশ্রয় আর হালের গরুটা ভেসে গেল গাঙে; এখন মেয়েটার জীবনটাও বোধহয়…! গ্রামে এত বড় ক্ষতি আর কারও হয়নি। মজিদ হাঁটতে হাঁটতে থেমে যায়। পিছন ফিরে তাকায় সে। জলের মাঝখানে জ্বলজ্বল করে জ্বলছে ধবধবে সাদা মসজিদটা। ‘আল্লাহ তুমি আমাকে এত ভালোবাসো?!’ মজিদ আবার হাঁটতে শুরু করে। জলের ভেতর কাঁপতে থাকে মসজিদটা।

বি দ্র গল্পটিতে মেহেরপুরের ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে।