আধুনিক ও উত্তরাধুনিক পর্ব
কাজী নজরুল ইসলামের “বিদ্রোহী” কবিতাই রোমান্টিক যুগের শান্ত সৌম্য স্রোত থেকে বেরিয়ে এসে নতুন বেগবান তরঙ্গ হিল্লোল তোলার প্রথম প্রয়াস। যদিও রোমান্টিক যুগের অধিক ব্যবহৃত মাত্রাবৃত্ত ছন্দেই কবিতাটি নির্মিত, তথাপি এর স্তবক বিন্যাস ও পঙ্ক্তি নির্মাণ মাত্রাবৃত্তে সমিল মুক্ত ছন্দের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। এর ভেতরের দোলা, ভাষার অপূর্ব নাচন বাংলা কবিতা আগে প্রত্যক্ষ করেনি। তবে স্পষ্টত, রোমান্টিকতার বলয় ভাঙার আভাস তৈরী করতে পারলেও নজরুল ছিলেন আপাদমস্তক রোমান্টিক কবি। তিনি শুধু সঞ্চার করেছেন সাহস, দিয়েছেন নতুন পথের সন্ধান।
আলোচনার সুবিধার্থে এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে কিছুটা ভিন্নতা থাকার কারণে আধুনিক কালপর্বকে দু’ভাগে বিভক্ত করা যায়। সেই ক্ষেত্রে জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে ও অমিয় চক্রবর্তী─এই পাঁচ কবি আধুনিক কবিতার প্রথম স্রোতের একত্রিত প্রধান। এঁরা প্রত্যেকেই ছন্দ নিয়ে বিস্তর কাজ করেছেন; অন্ত্যমিলের ধরণ নিয়ে চালিয়েছেন বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা (তেরসা রিমা, স্পেনসরিয়ান রাইম─মূলত জীবনানন্দে); স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও অক্ষরবৃত্ত ছন্দের নানামুখি ব্যবহারে ও দৈনন্দিন শব্দবন্ধের উৎসারণে নির্মাণ করেছেন বিচিত্র ধরনের কবিতা। সমৃদ্ধতর হয়েছে সনেটের অঙ্গন। তিন প্রকার ছন্দেরই মুক্ত রূপের বিকাশ ঘটেছে; যদিও অক্ষরবৃত্তের মুক্ত রূপের ব্যবহার পেয়েছে অধিক গুরুত্ব। ছন্দের প্রতিষ্ঠিত চালেও এ সময় অসংখ্য কবিতা রচিত হয়েছে।
১.
তাদের পদাঙ্ক মুছে গেছে রৌদ্রে, ধারাপাতে ঝড়ে;
যুগান্তরে
তোমার স্মৃতিও, জানি, সেই মতো হারাবে ধূলায়।

তবু চায় প্রাণ মোর তোমারেই চায়।
তবু আজ প্রেতপূর্ণ ঘরে
অদম্য উদ্বেগ মোর অব্যক্তেরে অমর্যাদা করে;
অনন্ত ক্ষতির সংজ্ঞা জপে তব পরাক্রান্ত নাম─
নাম─শুধু নাম─শুধু নাম।
(নাম/সুধীন্দ্রনাথ দত্ত)

সমিল অক্ষরবৃত্তের এই মুক্ত রূপে আট-দশ চালের ঝোক থাকলেও, চার ছয় বারো ইত্যাদি জোড় সংখ্যক মাত্রার পর্ব দেখা যায়।

২.
মানুষের হৃদয়কে না-জাগালে তাকে
ভোর, পাখি, অথবা বসন্তকাল ব’লে
আজ তার মানবকে কি ক’রে চিনাতে পারে কেউ।
চারিদিকে অগণন মেশিন ও মেশিনের দেবতার কাছে
নিজেকে স্বাধীন ব’লে মনে ক’রে নিতে গিয়ে তবু
মানুষ এখনো বিশৃঙ্খল।
(জনান্তিকে/ জীবনানন্দ দাশ)

অমিল অক্ষরবৃত্তের মুক্তরূপের এই চাল যাকে আমরা অন্যত্র নঞ ছন্দ বলে উল্লেখ করেছি, আধুনিকতার দ্বিতীয় পর্যায় পুরোপুরি শাসন করে চলে।

এই পর্যায়ের কবিরা যেমন শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও হুমায়ুন আজাদ প্রত্যেকেই বিপুল ভাবে চর্চা করেছিলেন অমিল অক্ষরবৃত্তের মুক্তরূপের। যদিও স্বরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্তের মূল ধারায়ও চর্চা অব্যহত ছিলো, তথাপি মুক্তছন্দের বিকাশ দিগন্ত স্পর্শ করেছে।

৩.
স্বাধীনতা তুমি
কাজী নজরুল, ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো
মহান পুরুষ, সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কাঁপা─
স্বাধীনতা তুমি
শহীদ মিনারে অমর একুশে ফেব্র“য়ারীর উজ্জ্বল সভা,
স্বাধীনতা তুমি
পতাকা-শোভিত স্লোগান-মুখর ঝাঁঝালো মিছিল,
স্বাধীনতা তুমি
ফসলের মাঠে কৃষকের হাসি।
(স্বাধীনতা তুমি/ শামসুর রাহমান)

মাত্রাবৃত্তে অমিল মুক্তছন্দের ব্যবহারে এখানে ছয় মাত্রার চাল আনা হয়েছে। অথচ কবিতাটি গদ্যের মতো পড়ে যেতেও কোনো অসুবিধা হয় না। তাই কখনো কখনো ছন্দের এই ধরনকে গদ্যছন্দও বলা হয়।

৪.
যেদিকে ইচ্ছে পালাও দু’পায়ে, এইটুকু থাক জানা;
চারিদিকে আমি
কাঁটাতারে ঘিরে সান্ত্রী বসিয়ে পেতে আছি জেলখানা।

কুকুর যেমন সব-ক’টি দাঁতে গেঁথে রাখে প্রিয় মাংস,
গেঁথে রাখি দাঁতে
তোমার শরীর এবং রূপের আধা-আর-উর্ধ্বাংশ।
(প্রেম/হুমায়ুন আজাদ)

মাত্রাবৃত্তে সমিল মুক্তছন্দ। এখানেও ছয় মাত্রার চাল পরিলক্ষিত হয়।

৫.
সামান্য হয়
তাঁর পূজাতে নষ্ট সময়
এবং তিনি
আমার চেয়ে ভালোবাসেন তরঙ্গিণীর
দু-হাত ফাঁকা, রক্তে মাখা ওষ্ঠ, করুণ─
চায় না ক্ষমা তরঙ্গিণী পাপের দরুণ।
(মন্দিরে ওই নীল চূড়া/শক্তি চট্টোপাধ্যায়)

স্বরবৃত্তে সমলি মুক্তছন্দ। রোমান্টিক যুগেও এমন সমিল মুক্তছন্দের প্রয়াস দেখো গেছে নজরুলে “সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে” কবিতায়।
৬.
কারুর দিকে হাত বাড়ালেই হাত সরে যায়
দুঃখভেজা মেঘ-আড়ালে
যখন-তখন
মনের আপন ঘাঁটি ভীষণ প্রকম্পিত।
এখন আমি কারুর কোথাও যাবার কথা
শুনলে হঠাৎ চমকে উঠি।
(এখন আমি/ শামসুর রাহমান)

অমিল স্বরবৃত্তের মুক্তরূপ। এখানে বলে রাখা ভালো যে রোমান্টিক যুগে যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম, আধুনিক পর্বে প্রথম পর্যায়ে যেমন জীবননান্দ দাশ (মূলত অক্ষরবৃত্তে), ঠিক তেমনি আধুনিকতার দ্বিতীয় পর্যায়ে শামসুর রাহমান তিন প্রকার ছন্দেই অসংখ্য কাজ করেছেন; আদিরূপ এবং মুক্তরূপ উভয় শাখায়। আধুনিক কবিতার উৎকর্ষে ছন্দ নিয়ে আর যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন তাঁরা হলেন সঞ্জয় ভট্টাচার্য, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, নিরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সৈয়দ শামসুল হক, শঙ্খ ঘোষ, জয় গোস্বামী, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও আবু হাসান শাহরিয়ার প্রমুখ।

উত্তরাধুনিক কালপর্বেও কবিতার ছন্দ নিয়ে নানা রকম কাটাছেঁড়ার চিহ্ন পাওয়া যায়। প্রতিষ্ঠিত ও বিদ্যমান সবগুলো ছন্দের চর্চাই এ সময়ে হয়েছে। অক্ষরবৃত্তের মুক্ত রূপে কেউ কেউ দৈনন্দিন শব্দের সাথে ক্লাসিক্যাল শব্দের মিশ্রণ ঘটিয়েছেন। সনেটের আঙ্গিক নিয়েও কাজ হয়েছে; এবং সে ক্ষেত্রে নতুন স্তবক বিন্যাস ও অন্ত্যমিলের অভিনবত্ব একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন। তবে এই কালপর্বে অক্ষরবৃত্তের অমিল মুক্তরূপ বা নঞ ছন্দই কবিতা রচনার একটি প্রধান মাধ্যম হিসেবে ধরা দিয়েছে।

চর্যাপদ থেকে উত্তরাধুনিক সময় পর্যন্ত বাংলা কবিতার ছন্দের চর্চা ও উৎকর্ষ নিয়ে বিশদ পর্যালোচনার ভেতর দিয়ে একথা প্রতিয়মান হয় যে বাংলা ভাষার কবিরা সর্বদাই ছন্দ সচেতন ছিলেন এবং এর উদ্ভাবনা ও বিকাশের ক্ষেত্রে রেখেছেন কার্যকরি ভূমিকা। দেখা গেছে যে মধ্যযুগ পার হওয়ার আগেই বাংলা তিন প্রকার ছন্দ সুগঠিত রূপ নিতে সক্ষম হয়েছে। যদিও মাত্রাবৃত্ত ছন্দের ব্যাপক ব্যবহার দেখা যায় রোমান্টিক যুগে তথাপি ক্লাসিক্যাল যুগে এই ছন্দটি যে স্পষ্ট দানা বেধেছে তাঁর প্রমাণ মাইকেল মধুসূদন দত্তের ব্রজঙ্গনা গ্রন্থের “কুসুম” কবিতার কয়েকটি স্তবক। স্মর্তব্য, এর পরেও মাত্রাবৃত্তের শরীরে অক্ষরবৃত্তের যে উপস্থিতি লুকিয়ে ছিলো, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হন তাঁর মানসী কাব্যগ্রন্থের শেষ পাদে এসে। ফলতঃ ধারাবাহিক ভাবে বিশ্লেষণ করে বলা যায় যে স্বরবৃত্ত ছন্দ বিরাজিত ছিলো বাংলা ভাষার উৎপত্তির কাল থেকে গীত, স্বগতোক্তি, ছড়া, শ্লোক ইত্যাদির ভেতর দিয়ে, অক্ষরবৃত্ত ছিলো সর্বদাই আসন গেড়ে, আর মাত্রাবৃত্ত বেরিয়ে এসেছে অক্ষরবৃত্তের শরীর ফুঁড়ে।

চর্যাপদের সময়টি ছিলো স্বরবৃত্ত ও কথ্য ভাষা এবং প্রাচীন মাত্রাবৃত্তের মিশ্রণে নতুন ছন্দ মিশ্রবৃত্ত বা অক্ষরবৃত্তের উৎপত্তির কাল। মধ্যযুগে আট-ছয় পয়ারের চালে অক্ষরবৃত্ত পরিশুদ্ধ হওয়ার সাথে সাথে ওর শরীরের ভেতর দিয়েই দানা বেঁধে ওঠে মাত্রাবৃত্ত ছন্দ। ক্লাসিক্যাল বা মহাকাব্যিক যুগে অমিত্রাক্ষর রীতির উদ্ভাবনের মাধ্যমে বাংলা কবিতা পায় স্বাধীনতার সাধ; এই পর্বে সনেট সংযোজিত হওয়ায় অন্ত্যমিল বিন্যাসের নতুনত্ব দেখা যায়। রোমান্টিক যুগ মাত্রাবৃত্ত ছন্দের সহজ বিকাশের ক্ষেত্র উন্মোচিত করার পাশাপাশি ছন্দে বিপুল গতির সঞ্চার করে মুক্তছন্দের দিকে ধাবিত হয়। আধুনিক কালে এই মুক্তছন্দই “আমি” বা ব্যক্তির সংসর্গে নতুন জোয়ার তুলে ছুটে যায় দিকে দিকে; ছন্দের প্রচ্ছন্ন বুনন রেখেও কবিতা হয়ে ওঠে মানুষের দৈনন্দিনতার প্রতীক, যা কথা বলার ভঙ্গিতে উচ্চারিত হয়ে গদ্যের কাছাকাছি চলে আসে। উত্তরাধুনিক কালেও চলে এর সম্প্রসারণ।

(সমাপ্ত)