রাজাকারদের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী শক্তি হিসেবে উল্লেখ করে একাত্তরে এক মার্কিন গোপন দলিলে বলা হয়, কাউকে বাঁচিয়ে রাখা হবে নাকি মেরে ফেলা হবে, সে সিদ্ধান্ত রাজাকাররা নিজেরাই নিতে সক্ষম। নিরীহ গ্রামবাসীর ওপর ওরা নির্বিঘ্নে অত্যাচার-নির্যাতন চালায়। লুটপাট করে। গ্রামাঞ্চলে ওরা রীতিমতো ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। সেনাবাহিনী ওদের বাধা দেয় না।
পাকিস্তান সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (ইউএসএআইডি) উপপ্রশাসক (ডেপুটি অ্যাডমিনিস্ট্রেটর) ১৯৭১ সালের ৫ নভেম্বর যে রিপোর্ট দেন, তাতে রয়েছে এসব তথ্য। ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরে রিপোর্টটি প্রকাশ (ডিক্লাসিফায়েড) করা হয়।
রিপোর্টে উল্লেখ আছে, পূর্ব পাকিস্তানে রাজাকারদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে গ্রামাঞ্চলের মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহরে কিংবা ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে। সম্প্রতি মুসলমান শরণার্থীদের ভারতে আশ্রয় নেওয়ার হার বেড়েছে। এদের বেশির ভাগই ছোট ভূস্বামী ও কৃষক, যারা সাধারণত রাজনৈতিক অস্থিরতার চেয়ে নিরিবিলি জীবন কাটাতে অভ্যস্ত।
সবারই জানা আছে, একাত্তরে যুক্তরাষ্ট্র ছিল পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠতম মিত্র। বাঙালির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য তখন নিজ দেশের জনমত উপেক্ষা করে মার্কিন সরকার অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম দিয়েছিল পাকিস্তানকে। তা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থা বিশেষ করে ওই সময়কার ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন কনসাল জেনারেলের বিভিন্ন রিপোর্টে বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনা পুরোপুরি এড়িয়ে যাওয়া হয়নি। এ ক্ষেত্রে বরং কমই আড়াল করার চেষ্টা করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত তখনকার মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার কে ব্লাড।
ইউএসএআইডির আলোচ্য রিপোর্টটিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বরতার কিছু তথ্যও আছে। রিপোর্টের একটি উপশিরোনাম হলো_’সেনাবাহিনীর নীতি পরিকল্পিত ত্রাস ও প্রতিশোধ।’ এতে উল্লেখ আছে, মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা বেড়ে যাওয়ার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে জেনারেল ফরমান আলী খান ইউএসএআইডি কর্মকর্তাকে বলেন, এ নিয়ে তাঁদের চিন্তার কিছু নেই। এটা ‘ম্যানেজেবল’ অর্থাৎ মোকাবিলা করা সম্ভব। ফরমান জানান, ঢাকায় পূর্ববর্তী ৩০ দিনে এক হাজার ৪০০ গেরিলা (মুক্তিযোদ্ধা) ঢুকলেও তাঁদের বেশির ভাগই লড়াইয়ে লিপ্ত হতে চান না। প্রকাশ না করার শর্তে (অফ দ্য রেকর্ড) ফরমান বলেন, সেনাবাহিনীর পরিকল্পিত সন্ত্রাস ও প্রতিশোধের নীতির কারণেই নাকি অনেক মুক্তিযোদ্ধা ভয়ে লড়াইয়ে জড়াতে আগ্রহ দেখান না।
রিপোর্টে আরো বলা হয়, পাকিস্তানি সেনা কমান্ডাররা পূর্ব পাকিস্তানের গ্রামগঞ্জে এমনকি বিপুলসংখ্যক বিদেশি নাগরিকের চোখের সামনে খোদ ঢাকায়ও সন্ত্রাসী অভিযান (টেরর রেইডস) চালিয়ে যাচ্ছেন।
রাজাকার বাহিনী সম্পর্কে রিপোর্টে বলা হয়, মুক্তিবাহিনীকে মোকাবিলা করার দায়িত্ব রাজাকারদের ওপরই ছেড়ে দিতে চায় সেনাবাহিনী। জেনারেল ফরমান জানান, ওই সময় পর্যন্ত রাজাকারের সংখ্যা দাঁড়ায় ৬০ হাজারে।
এর আগে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই মার্কিন প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার (ডিফেন্স ইনটেলিজেন্স এজেন্সি) এক রিপোর্টে ২৫ মার্চ রাত থেকে শুরু হওয়া পাকিস্তানি সামরিক অভিযান এবং বাঙালিদের প্রতিরোধ চেষ্টার বিবরণ দেওয়া হয়। ২৬ মার্চের ওই গোয়েন্দা রিপোর্টে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা করার কথা উল্লেখ করে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস, পুলিশ ও সাধারণ বাঙালিরা আনুমানিক ২৩ হাজার সদস্য নিয়ে শক্তিশালী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হামলা প্রতিরোধের চেষ্টা করছে। পাকিস্তানি বাহিনী যে সমুদ্র ও আকাশপথে সৈন্য ও সরঞ্জাম এনে বাংলাদেশে ক্রমাগত তাদের শক্তি বাড়াচ্ছিল, সে কথাও উল্লেখ আছে রিপোর্টে।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসররা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে আজও ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হিসেবে বর্ণনা করার চেষ্টা করছে। গত মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শুনানির সময় অভিযুক্তদের আইনজীবীরাও এমন মন্তব্য করেছেন। অথচ তাদের তখনকার মদদদাতা যুক্তরাষ্ট্রের এই রিপোর্ট ভিন্ন কথা বলে।
১৯৭১ সালে গঠিত ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব জুরিস্টসের (আইসিজে) রিপোর্টেও বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা করার আইনগত দিক পর্যালোচনা করা হয়। আইসিজের বক্তব্য হলো, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী স্বাধীনতা ঘোষণার এখতিয়ার আওয়ামী লীগ নেতার না থাকলেও অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী সামরিক শাসককে প্রতিরোধের চেষ্টা সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনে বিজয়ী দলের নেতা হিসেবে তিনি করতেই পারেন। দেশীয় আইনে এটা যৌক্তিক। এ দৃষ্টিকোণ থেকেই একাত্তরের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) পাকিস্তান সামরিক বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের নৃশংসতা ও আগ্রাসী কর্মকাণ্ডকে যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে গণ্য করে আইসিজে।
মুক্তিযুদ্ধের অজানা অধ্যায় তুলে ধরার জন্য চন্দনদাকে সাধুবাদ জানাই। নিঃসন্দেহে এইসব তথ্য আমাদের দেশের ইতিহাসকেই সমৃদ্ধ করবে।
মুক্তমনায় আরেকটু নিয়মিত লেখার অনুরোধ রইলো। :rose:
:yes: :yes:
:yes:
অপ্রকাশিত একটা তথ্য উপহার দেওয়ার জন্যঅনেক ধন্যবাদ।