আজ সকাল থেকেই দু’জনে লেগেছে। সামান্য একটা ব্যাপার। চায়ে চিনি দেওয়া নিয়ে তুলকালাম কান্ড। হলোই বা একটু চিনি বেশি। তাই বলে এভাবে বলবে?
“বুড়ো হতে চললে, তবু তোমার কান্ডজ্ঞান হলো না। এতো চিনি খেলে আমি আজই মরব”।
ডায়বেটিস টায়বেটিস কিচ্ছু নেই। তবু ঐ এক জুজু- একটু চিনি বেশি হলেই গেল আর কি! এছাড়াও সারাদিন এটা সেটা নিয়ে খিটিমিটি লেগেই আছে। রিটায়ার করার পর থেকেই এমন হচ্ছে। যেদিন সামাদ সাহেব চাকুরিতে অবসর নিয়ে বাসায় এলেন, তার পরদিন থেকেই এ অবস্থা। ‘এই জিনিসটা এখানে রেখেছিলাম নেই কেন?’ ‘জুতো জোড়া ঠিক জায়গায় রাখা হয়নি কেন?’- ঘরে যেন হাজারটা দাসী-বাদী আছে আর কি! কাজের লোক বলতে তো ঐ একরত্তি মেয়েটা।

আগে সকালে উঠে নাকে মুখে কিছু দিয়ে ছুটতো। তারপর সেই কুর্মিটোলার অফিস থেকে এই মগবাজার বাসায় আসতে আসতে বিকেল পাঁচটা। যানজট পড়লে তো আর কথাই নেই। এক একদিন দুশ্চিন্তায় ভয়ে রাফেয়া বেগমের বুক শুকিয়ে যেত। অ্যাক্সিডেন্টের ভয়। আশেপাশে কত দেখলেন। সকালে বাবুটি সেজে অফিসে গেল, দুপুরে লাশ হয়ে ফিরে এলো। না, ভাগ্য ভালো, তেমন কিছু হয়নি। যার জন্য চিন্তা করতে করতে জীবন কেটে ফেল সে-ই কিনা দু’মাস ঘরে থাকতে না থাকতে রাফেয়ার হাড়-মাংস কালি করে দিল। অথচ কত স্বপ্ন ছিল।

বিয়ের পর স্বামীর নতুন চাকরি, ঘরসংসার, শ্বশুর-শাশুড়ি এসবের জন্য একটু কক্সবাজার পর্যন্ত যেতে পারেননি। বিয়ের আগে কত স্বপ্ন ছিল- হানিমুনে যাবেন। কোথায় কী! সংসারের হাঁড়ি ঠেল! একটা সিনেমা দেখতে গেলে শ্বাশুড়ির অনুমতি নিতে হবে। তার উপর আবার গুচ্ছের দেবর-ননদ। দু’জনে মিলে কোথাও যাবার উপায় ছিল না। তারপর একদিন ছেলেপুলে, তাদের দেখ-ভাল, লেখাপড়া, সংসার চালাতে হিমশিম। বাইরে রেখে ঘরেই দম ফেলার ফুরসৎ নেই। তখন মাঝে মাঝে রেগে গেলে সান্ত্বনা দিত- “ওরা বড় হোক। আমি রিটায়ার করলে তোমাকে নিয়ে বেড়াতে বের হবো”’। কোথায় কী! সেসব কথা যদি একটু মনে থাকতো। এখন বাড়ি করার কথা মাথায় ঢুকেছে।

“এই বাড়ির ভূতে তোমাকে খাবে। আমি পারবো না হাঁড়ি ঠেলতে। সব ছেড়ে ছুড়ে চলে যাবো”- রাগে গজগজ করতে করতে আরেক কাপ চা বানালেন রাফেয়া। চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে বেডরুমে ঢুকে বেডসাইড টেবিলের উপর ঠক করে রাখলেন- “তোমার সংসার দেখার লোক জোগাড় কর। আমি আর পারবো না”
“দেখ রাফু, তুমি মিছিমিছি ঝগড়াটা চাগিয়ে তুলবে না”
“কেন তুলব না? একশো’বার তুলব। সারাটা জীবন তুমি আমাকে ভাওতা দাওনি?”
“কি? কী ভাওতা দিয়েছি?”
“আগে বলেছো রিটায়ার করার পর এই করবে, সেই করবে। এখন বাড়ি নিয়ে পাগল হয়েছো। কে থাকবে তোমার বাড়িতে? আমি চলে যাবো”
“যাওনা, কে তোমাকে ধরে রেখেছে? হুঁ! আমি যেন বাড়ি নিজের জন্য করছি আর কি!”
“তোমার জন্যই করছো। স্বার্থপর। কে থাকবে তোমার বাড়িতে? আমার ছেলে তো যে চাকরি নিয়েছে- বাইরে বাইরেই থাকবে। তুমিই থাকো তোমার বাড়িতে। আমি চলে যাবো যেদিকে দু’চোখ যায়”
“যাও যাও। কে তোমাকে ধরে রেখেছে? গেলেই বাঁচি”- খেঁকিয়ে উঠলেন সামাদ সাহেব।
“যাবোই তো”- রাগে অগ্নিমূর্তি হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন রাফেয়া বেগম।

বাইরে এসে কান্না পেয়ে গেল তাঁর। আশ্চর্য! এভাবে বলতে পারলো! “যাও!” যেন এ সংসার তার কিছুই না। তিনি কিছুই করেন নি এর জন্য?

কিছুক্ষণ পর বাইরে যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে বেরিয়ে এলেন সামাদ সাহেব।
“আমি বাইরে যাচ্ছি। দালালের সঙ্গে দেখা করতে হবে। দু’একদিনের মধ্যে বায়না হবে”।
রাফেয়া কোন উত্তর দিলেন না। মনে মনে শুধু বললেন- ‘নিকুচি করি তোমার বাড়ির। তুমিই থাকো’।
কাজের মেয়েটা দরজা বন্ধ করে দিল। রাফেয়ার রাগ একটুও কমেনি। মানুষটার আস্পর্ধা দিন দিন বাড়ছেই। আরো বুড়ো হলে বোধহয় হাত ধরেই বের করে দেবে। কেমন করে লোকটা বললো- “যাও! কে তোমাকে ধরে রেখেছে!” না, আর এক মুহূর্ত নয়। এক্ষুণি চলে যাবেন তিনি। বেডরুমে ঢুকে ভ্যানিটি ব্যাগটা নিলেন। কিছু টাকা-পয়সা, টুকিটাকি, টুথব্রাশ, চিরুণী নিলেন। দু’তিনটে শাড়ি-কাপড়। ব্যাগ নিয়ে বাইরে যাবার সময় কাজের মেয়েকে বললেন, “দরজা বন্ধ করে দে। সাহেব ছাড়া আর কেউ এলে দরজা খুলবি না। আর সাহেব আমার কথা জিজ্ঞেস করলে বলবি- চলে গেছি”।
“কোথায় যাচ্ছেন?” – ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলো কাজের মেয়ে।
“জানি না”
আর কথা বা বাড়িয়ে বেরিয়ে এলেন। একটা রিক্সা নিলেন। এবার মনে হলো কোথায় যাবেন? মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। এই ঢাকা শহরেই থাকে তারা। কিন্তু সেখানে গেলে মেয়েকে ছোট করা হবে। “তোমাকে আমি উচিত শিক্ষা দেব সামাদ চৌধুরি”। দাঁত কিড়মিড় করলেন রাফেয়া। “বুড়ো ভাম। তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে, আর এখন তুমি আমাকে বলো চলে যেতে!”

কিন্তু যাবেন কোথায়? বাবার বাড়িতে অনেকদিন যান না। ভাই-বোনেরা যার যার সংসারে। ঈদে-চাঁদে সবাই আসে, দেখা করে। ওদের কাছে তো হুট করে যাওয়া যায় না। “খোকার কাছেই যাবো”। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলেন। পরমুহূর্তে ভয় করে উঠলো- একাকী সেই চট্টগ্রাম কীভাবে যাবেন? একা তো যান নি কখনো।
“কই যাইবেন?”
তাই তো। রিক্সায় উঠে রিক্সাওয়ালাকে বলা হয়নি কোথায় যাবেন।
“স্টেশনে চলো। কমলাপুর স্টেশন”
স্টেশনে এসেই শুনতে পেলেন ঘোষণা। চট্টগ্রামগামী ট্রেন এক্ষুনি ছাড়বে। কমলাপুর স্টেশনটা বেশ লম্বা। রিক্সাওয়ালার ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি হাঁটতে লাগলেন। শরীর আর আগের মত নেই। পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই করছে। অর্ধশতাব্দী বয়স। চলার সেই ছন্দ কোথায় হারিয়ে গেছে। মানুষ কত তাড়াতাড়ি বুড়িয়ে যায়। রাফেয়া বেগমও বুড়ো হয়ে যাচ্ছেন। আর তাইতো সামাদ সাহেবের এত অবহেলা। অথচ অল্প বয়সে রাফেয়া একটু অভিমান করলেই কতো সাধাসাধি! থাক ঐ চ্যাপ্টার। রাফেয়া ঐ লোকের কথা আর ভাববেন না। শত্রু, শত্রু!

তাড়াহুড়ো করে সামনে যে কম্পার্টমেন্ট পেলেন তাতেই চড়ে বসলেন। এটা একটা সেকেন্ড ক্লাস কামরা। জানালার পাশের একটা সিটে বসে পড়লেন রাফেয়া। সামনের সিটে একটা অল্পবয়সী ছেলে সকালের কাগজ পড়ছে। কব্জিতে বাঁধা ঘড়ির দিকে তাকালেন। আটটা পাঁচ মাত্র। তাহলে কোন।। ভোরবেলা উঠে ঝগড়া শুরু করলেন তাঁরা। নামাজ পড়ে সকালের চা দিতে গিয়েই বিপত্তি। মনে পড়লো গত রাতেও সামাদ সাহেব বলছিলেন আজ সকালে গিয়ে দালালকে নিয়ে বাড়িওয়ালার কাছে যাবেন। যত তাড়াতাড়ি পারেন বায়না করে নিতে চান। জায়গাটা খুব পছন্দ হয়েছে তাঁর। তারপর শুয়ে শুয়ে আনমনেই আউড়েছেন- “ধন নয়, মান নয়, এতটুকু বাসা”
“থাকো তুমি তোমার বাসায়”- আপন মনেই মুখ ঝামটে উঠলেন। ব্যাগটা রেখে স্থির হয়ে বসলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই যাত্রীদের সুন্দর ভ্রমণের শুভ কামনা করে ট্রেন ছাড়লো। অকারণে বুকটা চিন্‌-চিন্‌ করে উঠল। মানুষটা বাইরে থেকে এসে হতভম্ব হয়ে যাবে। জীবনে কোনদিন রাগ করে আলাদা ঘরে ঘুমুতে পর্যন্ত দেয়নি। কত তোয়াজ, কত তোষামোদ করেছে। ভালোই হলো। বেশি বাড়াবাড়ির আগে একটু শিক্ষা দেয়া হলো। “যেতে বলেছে, চলে এসেছি। আমার অভাব কী? আমার ছেলে আছে। আমি এখন থেকে আমার ছেলের কাছে থাকবো। তোমার স্বপ্নপুরীতে তুমিই থাকো” গজগজ করলেন মনে মনে।

ট্রেন ঢাকা শহর ছাড়িয়ে অনেক দূরে চলে এসেছে। গ্রাম শুরু হয়েছে। খোলা মাঠ, সবুজ প্রান্তর, মাঝে মাঝে হলুদ সর্ষে ক্ষেত। আঁকা বাঁকা খাল- এক অদ্ভুত প্রশান্তি এনে দিল মনে। মনে পড়লো বছর খানেক আগে যখন চট্টগ্রামে যাচ্ছিলেন সে সময়ের কথা। ছেলে প্রথম বাসা পেয়েছে, বাবা-মা কে নিয়ে যাচ্ছে। ফার্স্টক্লাস রিজার্ভেশন। কত তত্ত্ব-তালাশ। দু’জনের মনে সে কী আনন্দ!

একমাত্র ছেলে তাদের- সুদীপ্ত। মানুষ হয়েছে, প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পাশ করার পরপরই চাকরি পেয়েছে। বিদেশী বহুজাতিক কোম্পানি। বিদেশে ট্রেনিং নিয়ে এসেছে। সারা রাস্তা মা-বাবা-ছেলে কি হাসি-গল্প। দু’পাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে দেখতে যাওয়া। তখন তারা বলেছিলেন, বছরে অন্তঃত একবার আসবেন। কিন্তু কই! বছর গড়িয়ে দেড় বছর হতে চললো। আজ এটা, কাল এটা করে আর যাওয়া হয়নি। চট্টগ্রামে গিয়ে তো মনটা আরো ভরে গিয়েছিল। পাহাড়ের উপর কী সুন্দর বাংলো। যে ক’দিন ছিলেন রাফেয়া যেন তাঁর হারানো কৈশোর ফিরে পেয়েছিলেন। বাবা-ছেলে দু’জনে মিলে তাঁর যত্ন করেছে। সামাদ সাহেব ছেলেকে বলেছিলেন, “তোর মা’র খুব শখ ছিল বাইরে বেড়াতে যাবার। আমি নিতে পারিনি। তুই তবু একটা শখ পূরণ করলি”।

সেদিন নিজেকে কি যে সুখী মনে হয়েছিলো। আর আজ কত দুঃখী। রিটায়ার করার পর থেকেই সামাদ সাহেবের মেজাজটা কেমন চড়ে গিয়েছে। আগে সারাদিন বাইরে থাকতো। টের পাওয়া যেতো না। এখন ঘরে থেকে কেবলই এটা-ওটা নিয়ে দোষ ধরা। আচ্ছা, চায়ে চিনি একটু বেশি হলো। এটা এমন কী! তোমার ডায়বেটিস নেই। রাফেয়া প্রথম প্রথম একটু সামাল দিয়েছেন। কাজের মেয়েটাকেও বকাঝকা করেন সামান্যতেই। কত বুঝিয়েছেন, “ওটা আমার ডিপার্টমেন্ট। কাজের লোক চলে গেলে তখন আমার কষ্ট হবে। শুধু বাঁধা বুয়া দিয়ে কাজ চলে না। তাছাড়া ওরা এসব কথা ফ্ল্যাটে চালাচালি করে’”। কী বাজে ব্যাপার। অথচ মেজাজ কি তাঁরও কম? বরং চিরদিন তাঁর মেজাজই সহ্য করেছে ছেলে-মেয়ে-বাবা। সংসারের কর্ত্রী যখন থেকে তখন থেকেই তাঁকে ভয় করে সবাই। আর আজ কিনা- রাগে গা রি রি করে উঠলো।
“দেখি আপনার টিকেটটা”
এই রে! তাড়াহুড়ো করে ট্রেনে উঠেছেন। টিকেটের কথা মনেও ছিল না। হতভম্ব হয়ে রইলেন রাফেয়া। লজ্জায় কান-মাথা গরম হয়ে উঠলো। কোন রকমে তোতলাতে তোতলাতে বললেন, “আমি মানে আমি খুব তাড়াতাড়ি উঠেছি তো, টিকেট করা হয়নি”
টিকেট চেকার কী যেন ভাবলেন। সামনের ছেলেটি জিজ্ঞেস করলো- “কোথায় যাবেন খালাম্মা?”
“চট্টগ্রামে। আমার ছেলের কাছে”
ছেলেটি চেকারকে অনুরোধ করলো একটা টিকেট দিতে। টিকেট চেকার ভালো করে একবার দেখলেন। এতক্ষণে নিজের উপর বিশ্বাস ফিরে এসেছে রাফেয়ার। বেশ গড় গড় করে স্বামী-পুত্রের পরিচয় দিলেন। টিকেট যে নিজে কখনো করেন নি তাও কথায় কথায় বুঝিয়ে দিলেন। টিকেট চেকার টাকা নিয়ে টিকেট দিলেন। জরিমানা নিলেন দশ টাকা। আরো বেশি নিলেও কিছু করার ছিল না। এটাও হয়তো চেকারের পকেটেই যাবে। সুযোগ পেলে সরকারের ঘরে ক’জন জমা দেয়। দেশের যা হাল-চাল।

ভৈরব ব্রিজের উপর দিয়ে ট্রেন যাচ্ছে। আকুল হয়ে মুখ বাড়ালেন। এত ভালো লাগে নদী দেখতে। নদীর পাড়ে হলুদ সর্ষেক্ষেত, মনে হয় শাড়ির হলুদ আঁচল। অনেক আগে বিভূতিভূষণের উপন্যাসে পড়েছিলেন বিহারের ফুলকিয়া বইহারের সর্ষে ক্ষেতের বর্ণনা। অপূর্ব লেগেছিল। বইটা আজো তাই সবচেয়ে প্রিয়। আসলে প্রকৃতির মতো সুন্দর পৃথিবীতে আর কিছুই নেই। অথচ একটা জীবন শুধুই হাঁড়ি ঠেললেন। কিছুই দেখলেন না জীবনে। রাগটা আবার চিন্-চিন্‌ করে উঠলো রাফেয়া বেগমের মাথায়।

গাড়ির দুলুনিতে ঘুম এসে গিয়েছিল। হঠাৎ শুনলেন ছেলেটি ডাকছে- “খালাম্মা, চট্টগ্রাম এসে গেছে”। ধড়মড় করে উঠলেন। কাপড়-চোপড় সামলে ব্যাগটা নিলেন। স্টেশনের বাইরে প্রচন্ড ভীড়। প্রাইভেট কার, ট্যাক্সি, রিক্সা। একটা রিক্সায় উঠে বসলেন রাফেয়া বেগম।
“কোথায় যাইবেন?”
তাই তো, কোথায় যাবেন? ঠিকানা তো আনা হয়নি। রিক্সাওয়ালাকে বোঝাতে চাইলেন তিনি- পাহাড়ের উপর খুব সুন্দর বাংলো বাড়ি। তার চারপাশে ছোট ছোট আরো অনেক পাহাড়। রিক্সাওয়ালা বোকার মত কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো- “আমি তো চিনি না”। তারপর আবার বললো- “আপনি তো চেনেন। দেখাই দিবেন”
“ভাড়া?”
“যা হয় ইনসাফ দিবেন”
রিক্সাওয়ালার কথা শুনে ভাল লাগলো। গতবার যেখান দিয়ে গেছেন সেখান দিয়ে নিয়ে গেলে নিশ্চয় চিনতে পারবেন। পাহাড়ের কাছ দিয়ে যাচ্ছে দেখে জিজ্ঞেস করলেন- “এটা কোন্ জায়গা?”
“টাইগার পাস”
“এ না, এই পাহাড় না। তুমি অন্য জায়গায় চলো”
বেলা পড়ে আসছে। প্রায় দেড়-দু’ঘন্টা তাঁকে নিয়ে ঘুরে রিক্সাওয়ালাও বিরক্ত। এবার বুদ্ধিমানের মত প্রস্তাব দিলো রিক্সাওয়ালা- “চলেন আপনারে থানায় লইয়া যাই”।

ভীষণ কান্না পাচ্ছে। রাগের মাথায় কী কেলেংকারী করে বসলেন। এখন কি সত্যি সত্যিই থানায় যাবেন? ছোটভাই এস-পি। এই বয়সে রাগ করে থানায় গেছেন শুনলে কী কান্ডই না হবে। এদিকে সন্ধ্যা প্রায় হয়ে আসছে। কোথায় যাবেন? এছাড়া তো আর উপায় দেখছেন না। শেষ পর্যন্ত রিক্সাওয়ালাকে বললেন- “চলো থানায়”।

থানায় এসে পরিচয় দিলেন ভাইয়ের, এবং ছেলেরও। বাংলাদেশে এটাতে যত কাজ হয়, অন্যকিছুতে ততটা হয় না। তাঁকে বসিয়ে ওরাই ঠিকানা নিয়ে যোগাযোগ করলো। খোকাকে পাওয়া গেল। এক্ষুণি এসে পড়বে। কী ভাববে সুদীপ্ত। হয়তো রাগ করবে। বলবে, “বুড়ো বয়সে তুমি লোক হাসাচ্ছ?” তাহলে কী করবেন? এত বয়স হলো তবু কারো ধমক সহ্য করতে পারেন না। আদর করে হাজারটা কাজ করাও, আপত্তি নেই। কিন্তু ধমকাবে কেন? ঐ মানুষটা সাত সকালে ওভাবে না ধমকালে কি তিনি আসতেন? আবার রাগটা শরীরে চনমন করে উঠলো।
“মা”
চমকে ফিরে তাকাতেই দেখতে পেলেন সুদীপ্ত এগিয়ে আসছে। আর স্থির থাকা যায় না। দু’হাত বাড়িয়ে ছুটে গিয়ে ছোট্ট শিশুটির মত ছেলের বুকে আশ্রয় নিলেন। আর তখনই দু’চোখ ভাসিয়ে কান্না। সারাদিনের জমাট রাগ-অভিমান গলে গলে পানি।
“মা, তুমি কী যে ছেলেমানুষ” ছেলের কন্ঠ স্নেহার্দ্র।
“তোর বাবা অমন করে বললো কেন?”
“কিন্তু বাবার কী দশা জানো? দুপুর পর্যন্ত মনে করেছে তুমি রাগ করে কাছে-পিঠে কোথাও গেছ। দুপুরের পর থেকে সবাইকে ফোন করে অস্থির। এ পর্যন্ত আমাকেই চার-পাঁচবার ফোন করেছে। আমি অনেক বুঝিয়ে ঢাকায় থাকতে বলেছি। তবে আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল তুমি আমার কাছেই আসবে। আচ্ছা মা, এত রাগ করলে চলে? তুমি যদি হারিয়ে যেতে আমাদের কী হতো?”
“খুব ভালো হতো। তোর বাবার শান্তি হতো”
“হ্যাঁ, তোমাকে বলেছে। চলো এবার বাবাকে খবর দিই, এসে যাক। কালই টিকেট করে দেব। তারপর কক্সবাজার থেকে হানিমুনটা সেরে এসো”
“ভালো হবে না, পাজী ছেলে কোথাকার”
সারাদিনের ক্লান্তি মুছে আলোয় ভরে উঠলো রাফেয়া বেগমের মুখ।