ট্রাফিক পুলিশ

 

কালো ফিতায় ঝুলানো লাল বাঁশিটি বাজিয়ে অবিরত কিছু একটা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে যাচ্ছিলো শরীফ।কি-ইবা আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারে সে? সস্তার যানজট।বোকা ট্রাফিক পুলিশ ছাড়া ঢাকা শহরে সেটা এখন আর কেউ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে না,নিয়ন্ত্রণের  চিন্তাও করে না।বাড়ীর পূর্বদিকের জমিটা,যেখান থেকে প্রতি শীতে ফুলকপি আর লালশাকের যোগান আসত,সেটা বিক্রি করে শহরের বড় অফিসারদের পয়সা দিয়ে শরীফের বড়মামা তার জন্য এই বড় চাকুরীর ব্যবস্থা করেছিলো।মামার প্রতি শরীফের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।চৌদ্দপুরুষের মধ্যে একমাত্র এই বড় মামাটাই মন্ত্রীমিনিস্টারদের সাথে উঠাবসা করেন বলেইতো এত সহজে চাকুরীটা হয়ে গেল।

 

আজ  শরীফের বড় আনন্দের দিন।ঢাকা শহরে চাকুরী হবার পর এই প্রথম তার বউ আর আট বছরের ছেলে বাবাকে দেখতে আসছে।পাশের রুমের জাফরকে সে বলে রেখেছে,ঢাকায় এসে বিশ্রাম করে,দুপুরের খাবারের পর,তার বউ আর ছেলেকে যেন জাফর নীলক্ষেতের সিগন্যালের কাছে নিয়ে আসে।আজ তার নীলক্ষেত মোড়ে ডিউটি।ছেলে কাছ থেকে দেখবে,কেমন করে তার বাবা হাতের ইশারায় তামাম রাজ্যের সব গাড়ীগুলোকে একে একে থামিয়ে দিচ্ছে।একবারতো এক পতাকা লাগানো গাড়ী সিগন্যালে পড়ে গেলে,ড্রাইভারের সে-কি রাগ।ওদিকে,শরীফতো ছেড়ে দেয়ার পাত্র নয়।কোনোভাবেই গাড়ী যেতে দেবে না।এই গল্প বউ এর কাছে বলে কতবার যে সে হোহো করে হেসে উঠেছে তার ইয়ত্তা নেই।বড়বড় চোখ করে বউ তার জিজ্ঞেস করতো,কেন,গাড়ীতে বসে থাকা বাবু বুঝি রাগ করলো না?চোখে মুখে পরিতৃপ্তির ভাব এনে শরীফ বলতো,ক্ষমতা,বুঝলা বউ,সব হইলো গিয়া ক্ষমতা অবাক চোখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে দেখে বউ তার উঠে যায় পাশের ঘরে,সযতনে ধুয়ে এনে একগ্লাস পানি দিয়ে বলে,ধর,খাও।

 

শরীফের সাথে নীলক্ষেতের মোড়ে ডিউটিতে আছে আরো দুইজন।বোকা সহকর্মীকে সিগন্যালে দাঁড় করিয়ে মোড়ের পাশের ছোট্ট দোকানটায় গিয়ে তারা পান চিবোতে থাকে আয়েশী ভঙ্গিতে।আরও খানিক পরে মোড়ের কাছে হলুদ কাপড়ে লাল কালিতে লেখা মাত্র দুই টাকায় মোবাইল ফোনএর দোকানে গিয়ে দুই টাকা দামের পুলিশি ক্ষমতা দেখিয়ে, বিনা পয়সায় নাম্বার লাগিয়ে তারা কথা বলতে থাকে পাশের বাড়ির ফরিদের বাপের সাথে।আমি বাড়ী আসলে সবগুলারে জেলের ভাত খাওয়াইয়া ছাড়ুম টাইপ ফাঁপা বুলি আওড়াতে আওড়াতে যখন তারা মেজাজের সর্বশিখরে অবস্থান করে,তখন চারদিকের গাড়ীগুলি যেন একসাথে হুমড়ি খেয়ে পড়ে শরীফের উপর।কোনদিক বন্ধ রেখে কোনদিক থেকে গাড়ী ছাড়বে বুঝবার আগেই মিনিবাসের ভিতর থেকে কোন এক ভদ্রলোক ছেঁচিয়ে উঠেন,এই খান**পোলাগুলার জন্যই দেশটার আইজ এ অবস্থা।

 

গাড়ীর কালো ধোঁয়া আর সূর্যের অসহ্য উত্তাপে কপালের ওপর থেকে ঝরে ঝরে পড়ে ঘাম।শীতাতপ নিয়ন্ত্রীত গাড়ীতে ভদ্রলোকেরা যাওয়ার পথে চোখ কড়মড় করে তাকায়।তাদের সুন্দর মুখ থেকে বেরিয়ে আসা কুৎসিত সব খিস্তিখেউড় শুনবার দূর্ভাগ্যটুকু আর হয়ে উঠেনা শরীফদের,বাইরে আসার আগে সে শব্দ আটকা পড়ে দামী গাড়ির সাউন্ডপ্রুফ গ্লাসে ।বাঁশি ফুঁকতে ফুঁকতে জীবন দিয়ে দিলেও কেউ এখানে থামে না।তাই দৌড়ে গিয়ে গাড়ির সামনে দুহাত তুলে দাঁড়ায় শরীফ।ফিসফিস করে মা-বাপ তুলে গালি দিতে দিতে ড্রাইভারগুলো কোনক্রমে গায়ে ধাক্কা না লাগিয়ে ব্রেকএ পা রাখে অনিচ্ছাতেই।

 

রাস্তার ওপারে জীর্ণশীর্ণ রিক্সাওয়ালার চাকা দুমড়ে-মুচড়ে দিয়ে বেপরোয়াভাবে চলে গেল চারচাকার প্রাইভেট কার।পথচারীরা দৌড়ে এসে আহা আহা বলে আকাশ বাতাস ভারী করে তুললো।তারপর একজন বলে উঠলো,ট্রাফিক ওখানে দাঁড়ায়া কি ** ছিঁড়তেছে?আরেকজন বলে,ওই চো*মারা*রপোলারাতো আছে খালি খাওয়ার ধান্ধায়। আরো একজন বলে,ওরা কি মাইনষের জাত।ওগোরেতো শুয়রে ** দিছে। ততক্ষণে,শরীফের জলপাই রঙয়ের পুলিশি পোশাক ঘামে ভিজে ভারী হয়ে উঠে,চোখমুখ হয়ে আসে অন্ধকার।ক্ষণিকেই,দমকা হাওয়া ঢাকার রাস্তার সব ধূলিবালির সাথে সস্তার আচার মোড়ানোর প্লাস্টিক আর দেয়ালে লাগানো নোংরা পোস্টারের টুকরো দিয়ে মাখামাখি করে দেয় সমস্ত গায়ে।

 

ক্লান্ত শরীর যেন আর সইতে পারে না।প্রতিদিনের রুটিনধরা একই কাজ।তবু ভালো লাগে শরীফের।অনেক ভালোবেসে সে তার কাজ করে যায় সমস্ত দিন ধরে।শরীফের ক্লান্তি টের পেয়েই হয়তো আকাশ কালো হয়ে আসে।একটু পরেই নামবে বৃষ্টি।তাড়াহুড়ো করে রিকশা,বাস,গাড়ী;ছুটোছুটি করে এগিয়ে যেতে চায় একের আগে আরেকজন। শরীফেরও ব্যস্ততা বেড়ে যায়।হাত উঠিয়ে শরীফ একদিকের গাড়ি থামিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই গাড়ির ভিতরে বসে থাকা ভদ্রলোক বলে ওঠেন,কিরে গাড়ি ছাড়িস না কেন? শরীফ চুপ করে থাকে।আবার প্রশ্ন আসে,কিরে কথা কানে যায় না। এবার শরীফের রাগ আসে।জোর গলায় বলে ফেলে,চুপ করে বসে থাকেন গাড়ির ভিতর।সময় হলে ঠিকই ছাড়বো। ছোটলোকের বাচ্চা বলে কি’- গাড়ির দরজা খুলে নেমেন আসেন ভদ্দরনোক।ঠাস্‌ ঠাস্‌ চড় মারতে থাকেন শরীফের গালে।সমস্ত দিনের ক্লান্তি,অবসাদে শরীফের যেন মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার দশা।আত্মগ্লানিতে পীড়িত হয়ে অসহায় শরীফ কোন রকমে সামলে উঠে।চোখ মেলে দেখতে পায় সামনেই রাস্তার ওপারে তার আট বছরের ছেলে।ভয় ভয় মুখে তাকিয়ে আছে বাবার দিকে।অঝর ধারায় বৃষ্টি নামে।বৃষ্টির পানির সাথে মিশে যায় শরীফের চোখের পানি,বৃষ্টির পানির এসে আড়াল করে দেয় সে পানি,যেন তার আট বছরের ছেলে দেখতে না পায়।

 

 

মইনুল রাজু

আগস্ট ৩১,২০১০

[email protected]