গতকাল রাতে স্বপ্নে বেগম রোকেয়াকে দেখেছি। সালাম দিতেই দেখি আমার দিকে ভীষণ রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে। আমার চোখে বিস্ময় দেখে বললেন, “সুলতানার স্বপ্নের কিছুই হল না, তোমরা এখনো কবি বললেই ভাবো ‘পুরুষ’ …”।
এরপর বেশি মনে নেই। মনে আছে, এর পর দেখেছিঃ মহিলা কবি-উলফ-সাপ্পো-বোভোয়ার-যোনি-স্তন-পাছা-শিশ্ন- ইত্যাদি ইত্যাদি, আরো অনেক অনেক অস্পষ্ট শব্দ।
স্বপ্নকাল : জানুয়ারী, ২০০৯
বেগম রোকেয়া বা রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের সঠিক পাঠ খুব বেশি হয় নি বলেই আমার ধারণা।
মুক্তমনাকে অনেক ধন্যবাদ, কারণ তাদের নীড়পাতায় বড় করে এই বিস্ময়কর প্রতিভার উদ্ধৃতি দেয়া আছেঃ
“‘যখনই কোন ভগ্নী মস্তক উত্তোলনের চেষ্টা করিয়াছেন, অমনি ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচনরূপ অস্ত্রাঘাতে তাঁহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে। আমরা প্রথমতঃ যাহা মানি নাই, তাহা পরে ধর্মের আদেশ ভাবিয়া শিরোধার্য করিয়াছি। আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগন ……ঐ ধর্মগ্রন্থগুলিকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রচার করিয়াছেন। এই ধর্মগ্রন্থগুলি পুরুষরচিত বিধি-ব্যবস্থা ভিন্ন আর কিছুই নহে।’”[১]
আমি ঠিক জানি না মুক্তমনাতে বাইরের ব্লগের কোন লিঙ্ক দেয়া যায় কিনা। সচলায়তন ব্লগের একটা লেখা না দিয়ে পারছি না। লেখা নন্দিনীর।
খুব সহজ ভাবেই যে কারো মনে হতেই পারে, কেন বাবা আদমকে হাওয়া বিবির আগে তৈরী করা হলো(হিন্দু শাস্ত্রে শতরূপা-মনু), কেনই বা প্রত্যেকটি শামীয় ধর্মগ্রন্থ পুরুষ নবীদের উদ্দেশ্যে রচিত? এই প্রশ্নগুলি প্রায় ১০০ বছর আগেই রোকেয়ার মনেও উদ্রেক হয়েছিল সন্দেহ নেই।
ক্ষেত্রবিশেষে আমি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে পাইঃ আজকের যুগের অনেক তথাকথিত শিক্ষিত নারী/পুরুষ রোকেয়ার এই উদ্ধৃতিতে আঁতকে উঠেন। কেন? এ কারনে যে তারা ধর্মগ্রন্থগুলি বা রোকেয়া কোনটিই সঠিক ভাবে পাঠ করেন নি।
রোকেয়ার লেখা আমাদের পাঠ্য পুস্তকে রাখা হয় | কারা রাখে ? পুরুষ | এবং বাংলাদেশের পুরুষ | এমন ভাবেই কাট ছাঁট করে পাঠ্য পুস্তকে তুলে দেয়া হয় যাতে করে পুরুষ নারীকে যতটুকু শিক্ষিত করে তুলতে চায়, রোকেয়া থেকে এর বেশি কিছু যাতে সে না পায় | রোকেয়ার বিপ্লবের বাণী পাঠ করে নারী বিপথে(!) যাক এটা পুরুষ চায় না | আবার এই পুরুষের শিক্ষিত ঘরণী প্রয়োজন, নয়ত সে পিছিয়ে পড়ে তার সমসাময়িক অন্য জাতের পুরুষের থেকে |
কলেজে এবং স্কুলগুলিতে যখন কোন পুরুষ বা নারী শিক্ষক “অর্ধাঙ্গী”/”জাগো গো ভগিনী” পড়াতেন তখন তাদের কথাগুলি শুনেই টের পাওয়া যেত, তাদের রোকেয়ার প্রতি মনোভঙ্গি | রোকেয়াকে নিয়ে বেশির ভাগের স্মৃতি ঐ দুই প্রবন্ধ পাঠই | ফলে ঐ শিক্ষক/শিক্ষিকার ছাত্র/ ছাত্রীরা রোকেয়ার যে অবয়বটি তাদের মনোজগতে স্থাপণ করে রেখেছে আর রোকেয়া নারীকে এবং নিজেকে যে অবস্থানে দেখতে চেয়েছেন এই দুটো কোনকালেই এক হয় না | রোকেয়া তার সময়ে বিপ্লবী, আমাদের সময়ে এবং সামনেও শুধু “নারীবাদীদের” নয় সকল প্রকার বিপ্লবীর জন্য অনুপ্রেরণা জোগাবেন | তার উদ্দেশ্য আর যাই হোক ভারতীয় মুসলমানের জন্য “শিক্ষিতা বউ” তৈরী করা ছিল না|
শিক্ষক/শিক্ষিকাদের আপদ ও বিপদের কারণ হলো, তাদের সমাজ, ধর্ম, তাদের ঘরে তাদের কন্যা/পুত্রবধু, তারা নিজেরাই।
রোকেয়ার সমসাময়িক লেখক/লেখিকাদের রচনা পাঠ করলে রোকেয়ার মহত্ত্ব আরো অনুধাবন করা যেতে পারে | একে বারে সমসাময়িক হলেন ভার্জিনিয়া উলফ | তিনিও কিঞ্চিত নারীবাদী ছিলেন | উলফ পাঠ করলে এবং তার পাওয়া শিক্ষা ও তার পারিপার্শ্বিকের সাথে তুলনা করলে রোকেয়া…কে অনেক খানি বোঝা যেতে পারে | “ধর্মের সাথে নারীবাদের সংঘাত” – এটা একেবারে ভিন্ন/অপ্রাসঙ্গিক ইস্যু নয় | রোকেয়া নিজেও এ বিষয়ে অবগত ছিলেন | যে পরিমাণ পর্দার ব্যবস্থা করে এবং অভিভাবকদের বুঝিয়ে সুজিয়ে মেয়েদের স্কুলে নিয়ে আসতেন তার অভিজ্ঞতার বর্ণনা পড়ে দেখেতে পারেন সবাই | মেয়েগুলি ঐ গুমোট কালো পর্দা দেয়া গাড়ির ভিতর চলতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ত, বমি করত |
যারা রোকেয়াকে ধন্যবাদ দেয় এজন্য যে মেয়েদের সাথে প্রেমটি করার সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে / বউয়ের সাথে ২ টা কথা বলে শান্তি পাই / আমাদের মেয়েরাও পিছিয়ে নেই / … সেই সব পুরুষের / সেই রকম প্রেমিকা/বউ/মেয়ে যারা হয়ে উঠতে চায় এই যুগে তাদেরকে রোকেয়ার মর্ম কোনকালেই বোঝানো সম্ভব না, তাদের সেই প্রয়োজনও নেই | রোকেয়াকে চাইলেই শুধু সেই ভদ্র বিধবা মহিলা যিনি স্কুল করে স্বামীর শোক উদযাপন ও আমাদের মেয়েদের একটু ঘষেমেজে তৈরী করার চেষ্টা করেন, এরকমটা ভাবা যায়, তাতে আমাদের বিবেকের অনেক বাঁধা দূর হয়ে যায় |
এই জাতীয় নারী ও পুরুষের প্রিয় লেখিকা হবেন Jane Austen, যিনি তার উপন্যাসের শুরুতেই বলে দেন, “It is a truth universally acknowledged, that a single man in possession of a good fortune, must be in want of a wife.”[২]
সমস্যা তথাকথিত নারীবাদীদের নিয়েও আছে। তারাও আজকাল বিজ্ঞাপণে/পর্নোগ্রাফিতে “নারীর আসন/বসন কেমন হবে” তা নিয়ে ব্যস্ত। মার্ক্সবাদ/অস্তিত্ববাদ/উত্তরআধুনিকতাবাদ/… মিলিয়ে নারীবাদ বিষম হয়ে উঠেছে।
রোকেয়ার পুনঃপাঠ একান্ত আবশ্যক।
১. প্রজেক্ট বর্ণমালা – রোকেয়া রচনাবলী
২. জেন অস্টেন – প্রাইড এন্ড প্রেজুডিস
অশ্লীলতা/তথ্যসূত্রহীনতা জাতীয় ত্রুটি মার্জনার অনুরোধ থাকলো, এটি কোন মৌলিক রচনা নয়, শুধু কিছু মন্তব্য ও ধারণার উপর লিখিত
রোকেয়া রচনাবলীর লিংক কাজ করছে না।
সবাইকে কমেন্ট করার জন্য ধন্যবাদ,
ফরিদ আহমেদ কে ধন্যবাদ তার লেখার জন্য।
🙂
নির্মোহ লেখার জন্য ধন্যবাদ!
কিপিটাপ। :yes:
চিন্তা-জাগানিয়া এই প্রবন্ধটির জন্য ধন্যবাদ।
আপনার এখানে মন্তব্য করার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু মন্তব্যের আকার বিশালরূপ নেওয়াতে আলাদা পোস্ট হিসেবে দিয়েছি। আশা করি মনে কিছু করবেন না।
http://blog.mukto-mona.com/?p=9973
অফ টপিকঃ আপনার আগের লেখাটা পড়বার আগেই দেখলাম মুছে দিয়েছেন মুক্তমনার নীতিমালার সাথে সাংঘর্ষিক বলে। জানি না লেখায় কী ছিল যে আপনার সেরকম মনে হলো। তবে, এইটুকু শুধু বলবো যদি কোন দ্বিধা থাকে, তবে আগেই মডারেটরদের কাছে এক কপি পাঠিয়ে দিয়ে মতামত নিতে পারেন। অথবা পোস্ট করার পরে তাঁদের সিদ্ধান্তের উপর ভরসা করতে পারেন। নীতিমালার সাথে খাপ না খেলে হয় তাঁরা আপনাকে অনুরোধ করবেন লেখাটা নামিয়ে নিতে বা শুধুমাত্র আপনার ব্লগে প্রকাশ করতে কিংবা তাঁরাই নামিয়ে দেবেন মুক্তমনা থেকে।
লেখাটা পড়ে যতটানা আনন্দ পেয়েছি মিঠুন ভাইয়ের মন্তব্য পড়ে বেদনাহত হলাম তার চেয়ে বেশি। অবশ্য যারা রোকেয়াকে পাঠ্য বইয়ের মাধ্যমে চেনে তাদের থেকে আর কিই বা আশা করা যেতে পারে।
স্বাক্ষর,
এই লেখাটা মুক্তমনাতেও অনেক আগেই প্রকাশিত হয়েছিল।
সুন্দর একটি লেখার জন্য ধন্যবাদ। আরও লিখুন।
@সাইফুল ইসলাম, নন্দিনী আপুর লেখাটা আমি আনেক আগে পড়েছি। উনার লেখাটা খুবই ভাল লেগেছিল।
আসলেই আমাদের সিলেবাসের মাঝে থেকে বেগম রোকেয়াকে পুরোপুরি উপলব্ধি করা অসম্ভব। আমি তার লেখা যেটুকু পড়েছি তাতেই মুগ্ধ হয়েছি তাকে আরো জানতে চেয়েছি। যদিও এখনো রোকেয়ার বেশি লেখা পড়িনি তবে তার যে উক্তিগুলো বিভিন্ন লেখকের বইয়ে বিশেষত হূমায়ুন আজাদের “নারী” বইতে পড়েছি তাতে বুঝেছি তিনি তার সময়ে কতটা অন্য সময়ের আর অন্য ভাবনার মানুষ ছিলেন। ধন্যবাদ লিঙ্ক দুটো দেবার জন্য। বেগম রোকেয়ার এই বইগুলো ডাউনলোড করা যাবেনা? জানাবেন প্লিজ। আমি অবশ্য তার রচনাসমগ্র কিনব ভাবছি অনেকদিন ধরেই।
আসলেই দুঃখজনক ব্যাপার।
“আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগন ……ঐ ধর্মগ্রন্থগুলিকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রচার করিয়াছেন। এই ধর্মগ্রন্থগুলি পুরুষরচিত বিধি-ব্যবস্থা ভিন্ন আর কিছুই নহে।”
স্বাক্ষর ফেস বুকে বেগম রোকেয়ার এই বানী স্ট্যাটাস হিসেবে আপলোড করার সাথে সাথেই কমেন্ট পড়ল-
“Ei kotha begum Rokea bolchen ?? do u have reference ? unar last line literally nile … ” acccording to islam religion and belief ” … ” as i understand ” … she has committed a very great sin by uttering these words. She was against th…e religious scriptures ? particularly Quran ?”
আরেকটা কমেন্ট পড়ল-
shit,ei kotha rokeya bolse???vaia um also looking forward to the ref
আমি ভাবি, রোকেয়া কে এতদিন যারা পরম শ্রদ্ধা করত, তার মুখের এই বানী শোনার সাথে সাথে সব শ্রদ্ধা ধুলায় মিশে গেল। অথচ কেউ বানীটার মর্মার্থই উপলব্ধি করার চেষ্টা করল না।
খুব হতাশ লাগে মাঝ মাঝে।