ইভ টিজিং এর বাংলা প্রতিশব্দ যৌন হয়রানি বা যৌন পীড়ন । শব্দটি নিয়ে এবং এর বাংলা প্রতিশব্দ নিয়েও অনেকের আপত্তি। কেউ এর ঘৃণ্যভাব বুঝাতে বাংলা শব্দটি ব্যবহার করতে চায়, আবার অনেকে ইভ টিজিং এর বাংলা প্রতিশব্দটি উচ্চারণ করতে অস্বস্তিবোধ করেন বলে ইংরেজী শব্দটি উচ্চারণেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। অথবা একটু মোলায়েম করে ছাত্রীদের উত্যক্ত করা বুঝাতে চান। দুয়েকজন মনে করেন ইভ টিজিং শব্দটি বললে সাধারণ মানুষ বিষয়টি বুঝতে পারে না।
ইভ টিজিং নিয়ে কথা হচ্ছিল এক মফস্বঃল শহরে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সাথে ঘরোয়া পরিবেশে। সে অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় জেলা পর্যায়ের সরকারী কর্মকর্তা, জাতীয় দৈনিকের জেলা প্রতিনিধি, চিকিৎসক ও কলেজের শিক্ষক ছিলেন। ইভ টিজিং নিয়ে ব্যক্তিগত অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে বিভিন্ন জনের সাথে কথা বলার উদ্যোগের অংশ ছিল এটি। এ থেকেই উপরোক্ত ধারণা পেয়েছি।
মানসিকভাবে পরিপক্ক, সামাজিকভাবে পদস্থ, আর্থিকবভাবে শক্তিশালী মানুষদের মধ্যেও যৌন হয়রানি বা যৌন পীড়ন শব্দ ব্যবহার নিয়ে যেখানে এত দ্যোদুল্যমানতা রয়েছে, সেখানে মানসিকভাবে অপরিপক্ক একজন কিশোরীর পক্ষে এর শিকার হওয়ার পর সুস্থির থাকা যে কী যন্ত্রণাময় তা সহজেই অনুমেয়।
উক্ত আলোচনায় একজন বললেন — আমাদের সময়েও আমরা মেয়েদের সঙ্গে একটু আধটু মশকরা করতাম। নিজেদের ভাললাগা— ভালবাসার কথা জানাতাম। কিন্তু এমন ভৌতিক পরিবেশ সৃষ্টি করার কথা তো চিন্তাও করতে পারিনি।
আমি নিজেও মনে করতে পারলাম না আমার কিশোর বেলায় এমন ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি বলে। আমি একটু দজ্জাল ছিলাম, তবে আশেপাশে কিছু মেয়েদেরকে উত্যক্ত করার নমুনা দেখেছি যা আজকের সাথে কোনভাবেই তুলনীয় নয়।
আজকাল সাংস্কৃতিক প্রবাহও ইভ টিজিংকে প্রভাবিত করছে বলে আমার মতামত জানাই। যেমন, বাংলা বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র মানেই ইভ টিজিং দিয়ে শুরু এবং পরিণামে নায়কের সাথে নায়িকার প্রেম। এমন কাহিনী বা ঘটনাও বখাটেদেরকে উদ্ধুদ্ধ করে থাকে বলে আমার ধারণা।
ইভ টিজিং নামে আখ্যায়িত করা যাবে না তবে মেয়েদের উত্যক্ত করার অস্তিত্বের প্রসঙ্গটি আলোচনার ধারাবাহিকতা পাই নরসিংদী থেকে সংগৃহীত লোক ছড়ায়ও।
এই ছেঁড়ীরে ধর
হেই ছেঁড়ীরে ধর
চোংগার ভিতরে ভর
চোংগা গেছে ভাইঙ্গা
ছেঁড়ী দিছে কাইন্দা।
অথবা
আয়শা গো খইয়ের টুরী
খই ভাজে আড়াই টুরী
একটা খই পোকরা
আয়শারে ধইরা ঠোকরা।

তাই বলে মেয়েরা কিন্তু পিছিয়ে থাকত না। তাৎক্ষণিক উত্তর। তৈরিই থাকত—-
ছুরুত আলী বুরুত আলী মোড়া গোডা খায়
বাপের লগে কাইজ্যা কইরা ফাঁস লইতো যায়।
কিংবা
আয়েত আলীর বিয়া
পুঁতি গোডা দিয়া

ছেলেটি মেয়েটির এ স্পর্ধা সহ্য করতে না পেরে বলত —-
‘আমিনা জামিনা ধুতরা গোডা খায়
হাইঁয়ের লগে কাইজ্যা কইরা বাপের বাড়ীত যায়’।

আজকের কিশোরীরা পাল্টা উত্তর দেওয়ার সাহস থেকে বঞ্চিত। কারণ উত্যক্ত করার সাথে যুক্ত অস্ত্র, এসিড, মাদক ও সর্বোপরি দলীয় রাজনীতি।

এবার যৌন পীড়ন নিয়ে আইনের সাথে বর্তমান প্রেক্ষাপট মিলিয়ে দেখা যাক।
একটু নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ( সংশোধন) আইন ২০০৩ এর ধারা- ১০ঃ যৌন পীড়ন, ইত্যাদির দন্ডঃ
‘যদি কোন ব্যক্তি অবৈধভাবে তাহার যৌন কামনা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে তাহার শরীরের যে কোন অঙ্গ বা কোন বস্তু দ্বারা কোন নারী বা শিশুর যৌন অঙ্গ বা অন্য কোন অঙ্গ স্পর্শ করেন বা কোন নারীর শ্লীলতাহানী করেন তাহা হইলে তাহার এই কাজ হইবে যৌন পীড়ন এবং তজ্জন্য উক্ত ব্যক্তি অনধিক দশ বৎসর কিন্তু অন্যূন তিন বৎসর সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদন্ডেও দন্ডনীয় হইবেন।‘
এখানে নারী বা শিশুর অঙ্গ স্পর্শ করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু স্পর্শ না করেও যে নৃশংস আচরণ করা যায় তা ভূক্তভোগীরাই জানেন।
আমার ব্যক্তিগত এক অভিজ্ঞতা হয়েছিল কাওরান বাজারের মাছ বাজারের গিয়ে। মধ্যবয়সী এক নারী হয়েও আর ঐ বাজারে যাইনি।

স্বামীর সাথে প্রাতঃভ্রমণে যাই মাঝে মাঝে। ফাঁকে মাছ বাজারে বা সবজি কেনা কাটাও সারি সময় সুযোগ বুঝে। বেশি মাছ কেনার প্রয়োজন হলে বা এমনিতেও মাসে এক আধবার মাছ কিনতে কাওরান বাজারে যেতাম। মাছ বাজারটি এফ ডি সির পেছনে থেকে কাওরান বাজারের কাঠের মিলের পেছনে রেল লাইনের পাশ ধরে অবস্থিত। আমি রেল লাইনের একপাশে দাঁড়িয়ে থাকতাম আর আমার স্বামী মাছ কিনতে বাজারের ভেতরে ঢুকত। মাঝখানে এসে বিভিন্ন মাছ ও এর দাম জানিয়ে কোনটা আমার পছন্দ তা জেনে নিত। একদিন ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশ বছর বয়সী এক লোক জিহ্বা ও বৃদ্ধাঙ্গুল নেড়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে এমন কুরুচিপূর্ণ ইঙ্গিত করছিল যে ঐ রকম স্থানে আমার পক্ষে অপমান সহ্য করা ছাড়া আর কোন উপায় খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ঘৃণায় গা রি রি করছিল। এমন জিহ্বা চাটার দৃশ্য কোন চলচ্চিত্রেও লম্পট চরিত্রে অভিনয় শিল্পীদেরও করতে দেখিনি। আমার স্বামী যথারীতি মাছ না কিনে আমার পছন্দ জানতে আসতেই তাৎক্ষণিকভাবে তাকে নিয়ে চলে আসি। সে প্রথমে আমার আচরণে হতবম্ভ। পরে আমার স্বামীকে আমি বুঝাতে পেরেছিলাম আমার চলে আসার কারণ। তার সাথে ২৮ বছর দাম্পত্য সম্পর্ক অতিবাহিত করেছি বলেই বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে পেরেছিলাম। আমাদের কিশোরীরা যে পারিবারিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠে যা হজম করা তাদের পক্ষে যেমন কঠিন ততোধিক কঠিন তার পরিস্থিতি কারো সাথে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে বলা।
সেদিন ইভটিজিং শিকার হওয়ার অভিজ্ঞতা ও কেন কিশোরীরা আত্মহনন করে সে উপলব্ধির ষোলকলা পূর্ণ হয়েছে।

ইভটিজিং এর জন্য কিশোরীরা কেন আত্মহননের পথ বেছে নেয়?
এর উত্তর অনেক। কিশোরীদের মানসিক দৌর্বল্য ছাড়াও আরো অনেক কিছুই দায়ী। কিন্তু আমার মত মধ্য বয়সী নারী যেখানে স্পর্শবিহীন পীড়ন সহ্য করতে পারলাম না সেখানে কৈশোর বয়সে তো অসম্ভবই।
তবে ঢাকা মহানগরী পুলিশ অধ্যাদেশ, ১৯৭উ ঃ মহিলাদিগকে উত্যক্ত করিবার শাস্তি নামে এর ধারা- ৭৬ এ স্পষ্ট করে বলা হয়েছে —-
‘যদি কেহ কোন রাস্তায় বা সাধারণের ব্যবহার্য স্থানে বা সেখান হইতে দৃষ্টিগোচরে স্বেচ্ছায় এবং অশালীনভাবে নিজ দেহ এমনভাবে প্রদর্শন করে যাহা কোন গৃহ বা দালানের ভিতর হইতে হউক বা না হউক, কোন মহিলা দেখিতে পায়, অথবা স্বেচ্ছায় কোন রাস্তায় বা সাধারণের ব্যবহার্য স্থানে অশালীন ভাষা ব্যবহার করিয়া অশীল আওয়াজ, অঙ্গভঙ্গি বা মন্তব্য করিয়া কোন মহিলাকে অপমান বা বিরক্ত করে, তবে সেই ব্যক্তি এক বৎসর পর্যন্ত মেয়াদের কারাদন্ড অথবা দুই হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানাদন্ড অথবা উভয় প্রকার দন্ডে দন্ডনীয় হইবেন।‘
সমস্যা হল এ বিষয়টি নিশ্চিত করবে কে? কে বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে?
ইভ টিজিং বা যৌন পীড়ন বা যৌন হয়রানি মিলে মিশে একাকার রাজনীতি, চাঁদাবাজি, মাস্তানি আর টেন্ডারের সাথে। কার সাথে কে মিলেছে?
চাঁদাবাজির সাথে — রাজনীতির সাথে মিলেছে নারীকে যৌন পীড়ন। একটা আরেকটাকে কলুষিত করছে।
ঢাকা মহানগরী পুলিশ অধ্যাদেশ, ১৯৭৬ঃ মহিলাদিগকে উত্যক্ত করিবার শাস্তি মুখ থুবরে পড়ে থাকে মাস্তানদের পায়ের নীচে পুলিশসহ। গত ১৮ আগষ্ট ২০১০ তারিখে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরটিই এর জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ।

‘গত রাতে স্কুলছাত্রী সাকিরা ইসলাম মিতু মোবাইল ফোনে টাকা রিচার্জ করতে নিকুঞ্জ এলাকার ১৮ নম্বর রোডের বাসার অদূরে একটি দোকানে যায়। এ সময় সেখানে অবস্থানকারী স্থানীয় সন্ত্রাসী রাজন, একাব্বরসহ তার সহযোগী বখাটেরা তাকে উত্ত্যক্ত করে। এ ঘটনা জেনে মিতুর মামা ১৭ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগ নেতা ফরিদ সেখানে গেলে বখাটেরা তাঁকে মারধর করে। খবর পেয়ে খিলক্ষেত থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে সন্ত্রাসী রাজনকে আটক করে। এ সময় অন্য সন্ত্রাসীরা পালিয়ে ১৯ নম্বর রোডের একটি ছয়তলা ভবনে আশ্রয় নেয়। এ অবস্থায় রাজন পুলিশের কাছ থেকে পালিয়ে ওই ভবনে ঢুকে পড়ে। সেখানে গ্রেপ্তার অভিযান চালাতে গিয়েই পুলিশের দল হামলার শিকার হয়। বখাটেরা এসআইসহ চার পুলিশ সদস্যকে বেদম মারধর করে জখম করে পুলিশের একটি পিস্তল ও দুটি ওয়াকিটকি ছিনিয়ে নিয়ে গেছে।

মধ্যরাতে পুলিশ হামলাকারীদের গ্রেপ্তার ও অস্ত্র উদ্ধারের জন্য বিশেষ অভিযানে নামে। নিকুঞ্জ এলাকার বাঁধ ও বস্তিতে অভিযান চালিয়ে পুলিশ রাত ২টা পর্যন্ত হামলাকারী রাজনসহ ১২ জনকে আটক করলেও খোয়া যাওয়া অস্ত্রটি উদ্ধার হয়নি।’
মহানগরী পুলিশ অধ্যাদেশ, ১৯৭৬ ঃ মহিলাদিগকে উত্যক্ত করিবার শাস্তি এর অসারতার দলিল এ খবরটি পড়লে সহজেই অনুমেয় যে ইভ টিজিং বা যৌন পীড়নের সাথে যুক্ত হয়েছে অনেকগুলো ক্ষেত্র। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ঘটনা, যেমন, বসনিয়ার মত এখানেও ঘটনার শিকার নারী। অন্য আরও ঘটনার মতই একটি কিশোরী স্কুলছাত্রী ঘটনার কেন্দ্রবিন্দু, রাজনীতি করা ছাত্রলীগ নেতা মামা, চাঁদাবাজি, দুর্বল পুলিশ যাদের হাত থেকে আসামী রাজন পালিয়ে গিয়ে সহযোগী সহযোগে তাদেরকে জখমসহ অস্ত্র পর্যন্ত নিয়ে যায় আর সবার উপরে বখাটেরা শক্ত তার উপরে নাই। সব মিলিয়ে নারীর ভোগান্তিকে বহুমাত্রিক ট্র্যাজেডিতে পরিণত করেছে।
মহিলাদিগকে উত্যক্ত করিবার শাস্তি অধ্যাদেশ থাকা অবস্থায় মহানগরীতে যৌন হয়রানিতে অতিষ্ট হয়ে আত্মহত্যা করেছে ইলোরা, সিমি ও মহিমারা। প্রত্যেকটি ঘটনায়ই পুলিশের যে দুর্বলতা প্রকাশিত হয়েছে তা হতাশাব্যঞ্জক এবং পুলিশ নৈতিকভাবে দুর্বল বলেই প্রশাসনিকভাবে নাস্তানাবুদ হয়েছে বলে মনে হয়। কাজেই নতুন আইন করে অপরাধ বন্ধ করার সমাধান খোঁজা যুক্তিযুক্ত নয় বলেই আমার ধারণা।
আইন সংশোধন করতে গিয়েও সরকার কারিশমা দেখায়। উপরে নারী ও শিশু নিরযাতন দমন (সংশোধন) আইন ২০০৩ এর ধারা- ১০ ঃ যৌন পীড়ন, ইত্যাদির দন্ডঃ এর কথা বলেছি। এতে বলা হয়েছে —
‘যদি কোন ব্যক্তি অবৈধভাবে তাহার যৌন কামনা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে তাহার শরীরের যে কোন অঙ্গ বা কোন বস্তু দ্বারা কোন নারী বা শিশুর যৌন অঙ্গ বা অন্য কোন অঙ্গ স্পর্শ করেন বা কোন নারীর শ্লীলতাহানী করেন তাহা হইলে তাহার এই কাজ হইবে যৌন পীড়ন’।
অথচ নারী ও শিশু নিরযাতন দমন আইন ২০০০ এর ধারা- ১০ ঃ যৌন পীড়ন, ইত্যাদির দন্ডঃ (২) এ ছিল —–
কোন পুরুষ অবৈধভাবে তাহার যৌন কামনা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে কোন নারীর শ্লীলতাহানি করিলে বা অশোভন অঙ্গভঙ্গি করিলে তাহার এই কাজ হইবে যৌন হয়রানি এবং তজ্জন্য উক্ত পুরুষ অনধিক সাত বৎসর কিন্তু অন্যূন দুই বৎসুর সশ্রম কারাদন্ডে এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদন্ডেও দন্ডনীয় হইবেন।‘
নারী ও শিশু নিরযাতন দমন ( সংশোধন) আইন ২০০৩ এর ধারা- ১০ ঃ যৌন পীড়ন, ইত্যাদির দন্ডঃ এ ২ নং অণুধারাটি বাতিল করা হয়েছে আইনটির অপব্যবহার রোধের জন্য —- মিথ্যা মামলা রোধ করার জন্য। এখানে পুরুষের পরিবর্তে ব্যক্তি দিলেই তো আর প্রশ্ন থাকত না। কারণ কোন নারীও নারীকে যৌন হয়রানি করতেই পারে। অথচ অশোভন অঙ্গভঙ্গি বিষয়টি মুছে দিয়েছে।
যে সমাজে যৌন হয়রানির শিকার নারীর তথাকথিত মানহানি হয়, সেখানে শতকরা কত জন নারী মিথ্যা মামলা করে নিজেদের চরিত্রেও তথা কথিত আঁচড় লাগাবার সাহস পাবে? আর মিথ্যা মামলা যে দিবে তার পক্ষে স্পর্শের কথা বলা নিশ্চয়ই কঠিন নয়।
তাছাড়া ১৮৬০ সালের দন্ডবিধি ৫০৯ ধারায় কোন নারীর শালীনতার অমর্যাদার অভিপ্রায়ে কোন মন্তব্য, অঙ্গভঙ্গি বা কোন কাজ নিয়ে শাস্তির বিধান থাকলেও আজ পর্যন্ত এ দেড়শ’ বছরে কয়টি মিথ্যা মামলা হয়েছে? আর এ আইন বলবৎ থাকা সত্ত্বেও তো শত শত নারীর প্রতি শালীনতার অমর্যাদার অভিপ্রায়ে মন্তব্য, অঙ্গভঙ্গি বন্ধ হয়নি।
কাজেই নারী নির্যাতন বিরোধী আইন সংশোধন ও প্রবর্তনের সময় নারীর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থানের দিকটি বিবেচনা ও বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।
প্রায় প্রতিদিনই প্রচার মাধ্যমে বিভিন্ন আঙ্গিকে ঈভ টিজিং আলোড়িত ও আলোচিত খবর, এর প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে। সিনথিয়ার আত্মহনন এর খবর এর একটি।
মুন্সীগঞ্জের বাড়ৈখালী উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্রী হাসনা রহমান সিনথিয়া (১৫) বখাটের উৎপাত সহ্য করতে না পেরে ১১ আগষ্ট ২০১০ আত্মহনন করে। তার বাড়ি শ্রীনগর উপজেলার বাড়ৈখালী গ্রামে। নিজবাড়ির বসতঘরে গলায় নিজের পরিহিত ওড়না গলায় জড়িয়ে ফাঁস দেয় সে।
জানা যায়, প্রায় এক বছর ধরে বাড়ৈখালী উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী সিনথিয়াকে উত্যক্ত করে আসছিল গ্রামের বখাটে যুবক জাহাঙ্গীর শেখ। এ নিয়ে একাধিকবার স্থানীয়ভাবে সালিশি বৈঠক হয়েছে। পুলিশের উপস্থিতিতে স্থানীয় গণ্যমান্য নিয়ে অনুষ্ঠিত সালিশি বৈঠকে জাহাঙ্গীরকে গ্রেফতারের সিদ্ধান্তও হয়। পরে ওই সব বৈঠকেই বার বার তাকে শোধরানোর সুযোগ দেওয়া হয়। শোধরায়নি জাহাঙ্গীর। জীবনের মায়াকে শোধ করতে হয়েছে সিনথিয়াকেই। তাকে বাঁচাতে পারেনি অভিভাবক, স্কুলের শিক্ষক, পুলিশ ও স্থানীয় গণ্যমান্যরাও। সে এক বছর ধরে সহ্য করেছে উৎপীড়ন। অনেক লম্বা সময়। অথচ সিনথিয়ার আত্মহননের এক ঘণ্টার ব্যবধানে মাদকাসক্ত বখাটে জাহাঙ্গীরকে বিক্ষুব্ধ গ্রামবাসী গণপিটুনি দিয়ে পুলিশের কাছে সোপর্দ করেছে।
কাজটি কি আটকে ছিল চরমতম পরিণতির জন্য! অথচ অপরাধটি প্রতিরোধ উপযোগী ছিল। সম্মিলিত সামাজিক প্রতিরোধ কিশোরীদের বাঁচাতে ও বিকাশে অবদান রাখতে পারে।
এ উচ্ছ্বল কিশোরী আত্মহত্যার মাত্র এক মাস আগে এক মিছিলের সামনের সারিতে ব্যানার হাতে প্রতিবাদ করেছিল। ব্যানারে লেখা স্লোগান: ‘বখাটে সন্ত্রাসীদের প্রতিহত করুন’ ও ‘ছাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন’
তাহলে ১৩ জুন সারাদেশব্যপী ইভ টিজিং প্রতিরোধ দিবসে বিভিন্ন কর্মসূচি যেমন, শোভাযাত্রা, ইভ টিজিং বিরোধী শপথবাক্য পাঠ ও আলোচনা সভা সিনথিয়াদের মনোজগতকে সবল করতে পারেনি। বখাটেদের নিয়ন্ত্রণ বা জনসচেতনতা তো যোজন যোজন দূর।
মুন্সীগঞ্জের মেয়ে সিনথিয়ার আত্মহত্যা প্রমাণ করে যে এখন যেসব সচেতনতামূলক কর্মসূচি নেওয়া হচ্ছে তা কোন ফলপ্রসূ পদক্ষেপ নয়।
আইন নয়, অভিভাবক নয়, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি নয়, তবে কে? কে রক্ষা করবে সিমি, ইলোরা, রুমি ও সিনথিয়া নামক কিশোরীদের! এ কিশোরীরা তো শহীদ কাদরীর কবিতার গোলাপ ও পাখির মত ঝড়ের আগেই ঝরে পড়ে ——-
‘একটি গোলাপ তুলে নিয়ে হাতে,
ঘন্টাখানেকের মধ্যে হাতের তালুতে — হ্যাঁ তোমার
হাতের তালুতে
বেচারা গোলাপ
মরা একটা পাখির মতো কুঁকড়ে এ্যাত্তোটুকুন হ’য়ে গেল
তোমার ত্বকের তাপ
সহ্য ক’রতে পারে নি ঐ নিটোল পুষ্পখণ্ড
———–
আমি একবার খাঁচাসুদ্ধ একটি সবুজ টিয়ে কিনে এনেছিলাম,
সেটা বারান্দায় — হ্যাঁ, এই বারান্দায় থেকে ঝুলতো
বাতাসে দুলতো
একটু একটু পোষ মানছিল, গানও গাইছিল
অনেক ছোলা সে খেয়েছে আমার হাতে
অনেক অনেক ঘট পানি
অসংখ্য, অঢেল বুলি তাকে শিখিয়েছি আমি নিজে
————-
এক প্রবল বৃষ্টির রাত্রে তাকে ঘরে তুলে আনতে পারি নি,
মনেই পড়ে নি,
সামান্য একতু ভুল
সহ্য ক’রতে পারে নি ঐ নিটোল একফোঁটা ডানা-অলা প্রাণী!’

কাজেই আমাদেরকে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করে কিশোরীদের মনোজগতকে নিরাপত্তার বলয় দিয়ে গড়তে হবে। তবে এ বলয় গড়তে সহায়তা দেবে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র। যৌন হয়রানি নামক জুজুর ভয়ও তার জীবনে এর অবস্থান তাকে পরিস্কারভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে যাতে এ বিষয়ে তাকে নাজুক অবস্থায় পড়তে না হয়।