একটি বুড়ো আমগাছ অথবা অমৃত ফল বিষয়ক যাদুবাস্তব গল্পের খসড়া
………………………………………………………………………………..
অনেকগুলো উঠোন। আর ঘর। তার পেছনে বেতঝাড়। উঁচু উঁচু শিরিষ গাছ। এ বাড়ির পুকুর পাড়ে বরই, আমড়া আর জাম গাছ। এর মাঝে একঘর বাউল। একতারা বাজায়। আর নেচে নেচে গান গায়-
এক কালা দতের কালি যা দ্যা কলম লেখি,
আর এক কালা চক্ষের মণি, যা দ্যা দৈনা দেখি,
-ও কালা, ঘরে বইতে দিলি না আমার।
বাউলের ঘরের পাশেই বেতবন। দুটো বেতফল দিয়ে বলল, খাও। কষা আর মিষ্টি। বাউল একটি শিরিষ গাছের নিচে ঘুমিয়ে পড়েছে। কয়েকটি মশা তার নাকে ও গালে বসেছে। কয়েকটি ভন ভন করে উড়ছে। একটি শিয়াল উঁকি দিল। আর কী একটা সাপ বেতবনের ভেতরে ধীরে ধীরে চলে গেল।
হীরাবাড়ির এই ঝোপঝাড়, দীর্ঘ গাছের নম্র ছায়া থেকে একটু হাঁটলেই কালিঘর। তার পেছনে আরেকটি বাড়ি। বাড়িটির পরেই একটি পোড়ো বাড়ি। কোনো ঘরদোর নেই। একটি ভিটি মাত্র। খুটিঁগুলো পোড়া। আর মজা পুকুর। পানাভর্তি। আর আছে একটি বুড়ো আমগাছ। কোনো কোনো ডালে পরগাছা। দুএকটা ফুল ফুটে আছে। অনেক পাখির বাস। এখানে কেউ থাকে না। কোনোদিন কেউ কি ছিল?
চোখ মেলে দেখি, বাউল আমার পাশে বসে আছে। এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে বুড়ো আমগাছটির দিকে। দুহাকে বুকের কাছে ধরা একতারাটি। বিড় বিড় করে বলছে, হে মহাবৃক্ষ। তোমার ফল অমৃত। তোমার ছায়ার আশ্রয়ে থেকে এখানে জন্ম হয়েছে একজন অমৃতের পুত্রের। তার কারণেই আমরা গাইতে পারছি অমৃতের গান-
জয় বাংলার জয়
হবে হবে হবে, হবে নিশ্চয়
কোটি প্রাণ একসাথে
জেগেছে অন্ধরাতে
নতুন সূর্য ওঠার এইতো সময়।
এই আমগাছটিই আমার বন্ধু। মাঝে মাঝে এর নিচে একা বসে থাকি। গরু ঘাস খায়। ঘুমিয়ে পড়ি। কখনো কখনো বুঝতে পারি, কয়েকজন লোক কথা বলছেন। ভারী ভারী কথা। সমাজতন্ত্র। শোষণহীনতা। অসাম্প্রদায়িকতা। আবহমান বাংলা ও বাঙালীর ইতিহাস। সকলের মঙ্গলের কথা। শুনতে পাই, একজন লোক ঘোড়া ছুটিয়ে আসছেন। একটু থেমে যাচ্ছেন। উচ্চস্বরে ঠাট্টা করছেন, কি হে সিঙ্গি বিপ্লবী শওকত চৌধুরী। সমাজতন্ত্র তোমাগো কাম না। আমরাই আনুম।
তারপর হো হো করে হাসতে হাসতে ফিরে যাচ্ছেন। তার নাম ঘোড়া জামাল। রাস্তা ছোটো। নইলে গাড়িই কিনতেন। গাড়ি ছাড়া তাকে মানায় না।
অদূরে একটি দেওয়ালে লেখা-তিন বলদের এক শিং-মুজিব মোজাফ্ফর মণি সিং।
– আমাদের লক্ষ্য বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র। আর কি সব।
একদিন ঠাকুরদা রওনা হলেন ঢাকায়। অনেক বয়েস হয়েছে। এটাই তার শেষ তীর্থ যাত্রা। ধূতি পাঞ্জাবী ধোপা বাড়ি থেকে ধুইয়ে আনা হল। সঙ্গে গেল বাউল। তার বাউলা ড্রেস। বলে, আমি আউলা মানুষ। নামাজও পড়ি। আবার গানও গাই। আমারতো কোনো জাত ফাত নেই। বিনোদ সাহ যেতে পারলেন না। দিন দুনিয়ায় তাঁর কেউ নেই। যাঁরা ছিল তাঁরা একাত্তুরে শহীদ। এখন কেবল একটি রামছাগল তার সঙ্গী। তিনি ঢাকায় গেলে রামছাগলকে কে দেখবে? ছোখের জল ফেলতে ফেলতে বিনোদ সাহ বললেন, শেখরে কৈয়েন ছোটোবাবু, তোমার জন্য বুকটান কৈরা হাঁটতে পারছি। তোমার মুখের দিকেই চাইয়া বাঁইচা আছি। তোমারে সালাম।
আর গেলেন কাশেম কবিরাজ। কবিতা লেখেন। আর তশবী টেপেন। এক সময় নাটকও করতেন। জলিরপাড় থেকে উঠবেন টমাস তিমথি সরকার।
বাবার মন খুব খুশি। এবার আমাদের কপাল ফিরতে পারে। মা দুদিন পায়েস রান্না করে ঠাকুরের ভোগ দিলেন।
ঠাকুরদা ফিরলেন দিন চারেক পরে। খুব সুখি। বাবাকে বললেন, কিছু কি চাইতে গেছি নিকিরে! তিনিতো মানুষ নন। তিনি আমাগো চোখের জল মুছায় দিছেন। নিজের মাটিকে নিজের করে দিয়েছেন। নিজের ঘরকে নিজের করে দিয়েছেন। তার কাছে কি আর কিছু চাওয়ার থাকেরে পাগলা! তিনি বুকে টেনে নিয়েছেন। বলেছেন, কোনো ভয় নেই। আমি আছি। আমার প্রাণ ভরে গেছে।
এর কিছুদিন পরে ঠাকুরদা মারা গেলেন। তাঁর কোনো দুঃখ ছিল না। তিনি গেলেন পূর্ণতার লাবণ্য নিয়ে।
একদির ভোরবেলায় বাবা কাজে গেলেন না। বাবা পুরনো রেডিওটাকে চড় থাপ্পড় দিচ্ছেন। কড় কড় শব্দ করে একদম থেমে গেল।বাবা ধাই ধাই করে ছুটে গেলেন হারুন চাচার বাড়িতে। হারুনচাচা রেডিও শুনছিলেন। চোখে জল। রেডিও বন্ধ করে দিলেন। বললেন, বাড়ি ফিরে যাও। দ্যাখো বাঁচতে পারো কিনা। বাংলাদেশে আবার দোজখ নেমে আসছে।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে দেখলাম, আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবুমিয়া আর ছোটকা দাস ধানি মাঠের মধ্যে নেমে যাচ্ছেন। কমরেড শওকত চৌধুরী তাদের পথ আগলে দাঁড়ালেন। বললেন, পালিয়ে যাচ্ছেন কেন? আসেন রুখে দাঁড়াই।
সাবুমিয়া ফ্যাস ফ্যাস করে জবাব দিলেন, সম্ভব নয়। অস্ত্রপাতি নাই। জমা দিয়া ফেলাইছি।
–জনগণকে নিয়ে নেমে পড়ি। অস্ত্রের কি দরকার?
-ওদের হাতে অনেক অস্ত্র, অনেক টাকা পয়সা আর। এরপর কি বললেন বোঝা গেল না। ঘোড়া জামাল কমরেড শওকত চৌধুরীকে ধাক্কা মেরে ছুটে বেরিয়ে গেলেন অনেক দূরে। তার ঘোড়াটি হা করে তাকিয়ে রইল। তার পিঠে কোনো সওয়ার নেই। যে কেউই উঠে পড়তে পারে এখন।
অনেকদিন পরে এদিন পনু মিয়াকে দেখলাম। সঙ্গে জি রহমান। আগের চেয়ে গায়ের রং আরও উজ্জ্বল হয়েছে। স্বাস্থ্যে ভরপুর। সম্প্রতি আরেকটি বিয়েও করেছেন। আমাদের বাসায় এলেন। যে ঘরটিতে ঠাকুর্দা থাকতেন তার দরোজা লাথি মেরে খুলে ফেললেন। বাবাকে ঠাণ্ডা গলায় বললেন, এটা খালি করে দাও।
এ ঘরটি সাড়ে তিন বছর আগে তার দখলে ছিল। অফিস ছিল রাজাকার কমিটির। আজ আবার ঘরটি তাদের দখলে চলে গেল।
সুরুদ্দিন মাস্টার অনেকদির পক্ষাঘাতগ্রস্থ হয়ে বিছানায় পড়েছিলেন। তার চোখে আজ সুরমা টানা। পরনে আচকান। পায়ে মোকাসিন। মাথায় জিন্নাহ টুপি। জি রহমানের সঙ্গে বুক মেলালেন। তার অসুখ সেরে গেছে। তার বড়ো মেয়েটি শেখা আপা দীর্ঘদিন পরে অন্দরে ঢুকলেন নিরিবিলি ঘুমাতে। আর সে ঘর থেকে শুকনো মুখে কিছু খোঁচা খোঁচা দাড়ি, বাবরি চুলের যুবক বাইরে এসে দাঁড়াল। তারা এখন কি করবে বুঝতে পারছে না। পনু মিয়াকে দেখে বড়ো করে সালাম ঠুকল। পনু মিয়া তাদের মাথা থেকে লাল ফেট্টি খুলে দিলেন। পিঠ চাপড়ে বললেন, গুড জব। তোমরা অনেক করেছো।
ওরা সবাই ছিল ক্ষুধার্ত। বিনোদ সা’র রাম ছাগলটিকে প্রকাশ্য রাস্তায় জবেহ করল। বিনোদ সা নদীর দিকে ছুটে গেলেন। তারপর শুরু হল রান্না। অনেকগুলো লোক সেদিনই অন্ধকার থেকে বাইরে বেরিয়ে এসেছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে, মাঝে মাঝে হেলিকপ্টার চক্কর দিচ্ছে। উড়ে যাচ্ছে দক্ষিণে। অই গ্রামটির নাম টুঙ্গিপাড়া।
অনেকদিন পরে এইসব লোকজনের চমৎকার একটি ভোজ হল। চারিদিকে পাকিস্তানী মশলা আর বাংলার ঝলসানো গোস্তের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে- একটি রাস্তা থেকে অনেকগুলো রাস্তায়। বাড়িঘরে। অফিস আর স্কুলে। পুলিশ ব্যারাকে। ধর্মশালায়। আদালতে। নদীতে। ধানক্ষেতে। গাছে গাছে। আকাশে। কবরে। মগজে।
সমস্যা হয়ে গেল বুড়ো অমৃত মুচির। একজোড়া পুরনো জুতো মেরামত করছিলেন। অসাবধানে ধারালো ছেনিতে তার বুড়ো আঙ্গুলটা খসে গেল। ষাট বছরের জীবনে এ ধরনের ঘটনা এই প্রথম। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুলো। ধুলোর মধ্যে কাটা মানুষের মতো তার আঙুলটা ছটফট করছে। লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে। এ রকম রক্ত কি আবার দেশটার ভেতরে বের হবে? অমৃত মুচি থর থর করে কাঁপতে লাগল।
আর ভোজে তৃপ্ত পনু মিয়া, জি রহমান, সুরুদ্দিন মাস্টার, হঠাৎ অন্ধকার থেকে বের হওয়া স্বাস্থ্যবান যুবকেরা হীরাবাড়ি থেকে ধরে আনল বাউল হীরামনকে। বয়েসী আমগাছটার নিচে দাঁড় করাল। বলল, গতকাল ছিল পাক পাকিস্তানের আজাদি দিবস। আজ ১৫ আগস্ট। এই আমগাছটো যে লোকটিকে ছায়া দিয়ে মানুষ করেছিল- সেই লোকটাই পাকিস্তান ভেঙেছে। তাকে আমরা শেষ করেছি। তুই আজ এই নাজাতের দিনে গান ধর-
পাক সার জামিন সাদ বাদ-
হীরামন বাউল ওদের দিকে ফিরে তাকাল। চোখে আগুন। একতারাটি বুকের ভেতর থেকে বের করল। আঙুল ছোঁয়াল। গুণগুণাগুণ সুর তুলল। খুব মৃদু স্বরে। কি গাইছে বোঝা গেল না। এগিয়ে গেল সামনের দিকে। অমৃত ফলদানকারী বুড়ো আমগাছটির দিকে। গাছটির বাকলের কাছে। বাকল ফুড়ে একটি দরোজা বের হলো। বাউল সে দরোজার মধ্যে দিয়ে গাছটির ভেতরে ঢুকে পড়ল। আবার দরোজাটি বন্ধ হয়ে গেল।
পরদিন দেখা গেল, আমগাছটির চারটি ডাল ভাঙা। ঝড়ে ভেঙেছে, না কে বা কাহারা কুঁপিয়ে ভেঙেছে জানা গেল না।
বাতাসে যখন আমগাছটির পাতাগুলো নড়ে, কচি কচি ডালগুলো দোলে, নতুন ফুল ফোঁটে, ফল ধরে, খোলস পাল্টায়, নতুন হয়ে হয়ে ওঠে- তখন শোনা যায় কেউ গান গাইছে। উদ্দাত্ত সে সুর। মাটি, আকাশ, বাতাস ছাপিয়ে যায়। মগজের মধ্যে ধাক্কা মারে। হীরামন বাউলের গান-
জয় বাংলার জয়
হবে হবে হবে, হবে নিশ্চয়
কোটি প্রাণ একসাথে
জেগেছে অন্ধরাতে
নতুন সূর্য ওঠার এইতো সময়।
আপনার লেখায় যখন সত্যের নদী অন্তসলীলা হয়ে বয়ে যায় আপন গতিতে মনে আমার এক মিশ্র ভাবের উদদ্রেগ হয়।আমি যেন এক অব্যক্ত বেদনায় ভুগি।
নিজের লোক, নিজের এলাকা সম্বন্ধে বলার মত আমার আর তেমন কেউ বেঁচে নাই। অথচ দেখুন সময়ের কি নির্মম পরিহাস। বাবা যখন বেঁচে ছিলেন ওনার কাছ থেকে অনেক কিছু জানতে পারতাম কিন্তু জানার তেমন কোন আগ্রহ দেখাইনি। দেখালে উনি খুশিই হতেন। উনি মাঝে মাঝে একটা কথা বলতেন এখানকার (পঃ বাংলা) থেকে দেশে(গোপালগংজে) অনেক ভাল ছিলাম। বাবার এই কথাকে বোঝবার মত সময় ছিল না আমার। এখন বুঝি। এমন সময় বুঝলাম যখন উনি নেই।
আমার নিজের এই আনুভূতিকে আর বাড়াবো না কারন পাঠকদের ভাল নাও লাগতে পারে। আপনার কাছে অনুরোধ আরও লিখুন।
আপনার লেখাকে প্রথম ও প্রধান সোরস মনে করি আমার ছটো বেলার তপব্ন কে যানতে। তাঁকে অবনত মাথায় শ্রদ্ধা নিবেদন করতে।
হীরামন নামটাও ও যেন শোনা শোনা। স্মৃতির অতলে যেন নামগুলি আস্তে আস্তে তলিয়ে যাচ্ছে।
ভাল লাগলো।
@সেন্টু টিকাদার, ঘটনা তো সত্যি। হীরামন পাগল।
@কুলদা রায়,
দাদা, কেন এত মন খারাপ করে দেন? :deadrose:
আমার শহর গোপালগঞ্জ : পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের দিনটি
শুধু গোপালগঞ্জ নয় ; বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকেই পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট থেকে শ্বাপদদের পুনঃযাত্রা। মাঝে মাঝে যাত্রা বিরতি দিয়ে আবার শুরু করে দ্বিগুন শক্তি নিয়ে।
ধন্যবাদ লেখাটির জন্য।
হৃদয় ছোঁয়া লেখা।
পুরো দেশের সামগ্রিক চিত্র একটি গ্রাম থেকেই ফুটে বেরিয়েছে।
চমৎকার এই পোস্টটির জন্য ধন্যবাদ।
দাদা,
কেন বারবার বুলবুলিতে ধান খেয়ে যায় বলতে পারেন? প্রতিটা শব্দ হৃদয় নিংড়ে নিয়েছে।
দারূণ ভাল লাগল। হৃদয় খুলে প্রতিটি শব্দ বসিয়েছ, কুলদা।
বড় করুণ সুড়ে বেজে উঠেছে তোমার সারেংগীখানা।
@নৃপেন্দ্র সরকার, গল্পটি সত্যি। লোকগুলোর নাম একটু পাল্টে দেওয়া হয়েছে।
গাছটি এখন আর নেই।
@কুলদা রায়, দাদা, নাম গুলি বিন্যাস করলে সব বুঝতে পারি। অরা সবাই আম্র চেনা। কিন্তু সত্য ঘটনাকে আপনি বীর দর্পে নাম প্রকাশ করলে আরো তত্ত্যনির্ভর হত নয় কি? নাকি নাকি সখ্যালঘু ভীতসম্প্রদায়ের কাতারে আপনিও দাঁড়িয়ে গেলেন! একথা স্বিকার করি অরা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আমাদেরই জয়দ্ধ্বনিতে। কিন্তু এখন সময় এসেছে এদের নুখোশ খুলে দেওয়ার। আমি সেই কুলোদা নন্দকে খুজে ফিরছি যার কলমের ফলাতে ফালি ফালি হবে সমাজের এই কীট পতুংগ।