গণিত ও মহাপ্লাবন

(রৌরব স্মরণে উৎসর্গিত)

[পোষ্টম্যানের কথা: ‘গণিত ও মহাপ্লাবন’ লেখাটি বুঝতে গণিতের গভীর জ্ঞানের প্রয়োজন নেই। গণিত সম্পর্কে একটু নিয়মকানুন আর জ্যামিতি সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা থাকলেই চলে। গণিতে যাদের এলার্জি রয়েছে তারাও নি:সংকোচে পড়তে পারেন। মজা পেলে পেতেও পারেন]

মহাপ্লাবন:
বাইবেলের গল্পে আমরা পড়েছি-কিভাবে সমস্ত পৃথিবীটা একবার বন্যায় প্লাবিত হয়ে গিয়েছিল, সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ের চূড়াকেও সেই জলস্তর ছাড়িয়ে গিয়েছিল। গল্পটিতে বলা হয়েছে “পৃথিবীতে মানুষ সৃষ্টি করেছিলেন বলে ঈশ্বরের মনে অনুশোচনা জেগেছিল।”

ঈশ্বর বললেন, “আমি যাকে সৃষ্টি করেছি, সেই মানুষকে আমি পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেব- মানুষ আর জন্তু উভয়ই, এবং গাছ-গাছালি আর আকাশচারী পাখি, সবই।”

একমাত্র যে-মানুষটিকে ঈশ্বর রেহাই দিতে মনস্থ করেন, তিনি হলেন ন্যায়পরায়ণ নোয়া। ঈশ্বর তাঁকে আসন্ন ধ্বংসকান্ড সম্বন্ধে সাবধান করে দিয়ে বললেন ৩০০ হাত লম্বা, ৫০ হাত চওড়া আর ৩০ হাত উঁচু একটা বিশাল নৌকা বানাতে। তিনতলা উঁচু একটা বিশাল নৌকা বানাতে। তিনতলা উচু এই নৌকাটা শুধু যে নোয়াকে, তাঁর পরিবারকে আর তাঁর প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানদের পরিবারের লোককে রক্ষা করতে, তাই নয়; পৃথিবীতে সমস্ত প্রাণিকুলের প্রজাতিকেও রক্ষা করবে। ওই নৌকাটায় দীর্ঘকালের জন্যে যথেষ্ট পরিমাণে খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহ করে, ওইসব পশু পাখি-কীট-পতঙ্গের সমস্ত বর্গের প্রত্যেকটিকে একজোড়া করে আশ্রয় দেবার জন্যে ঈশ্বর তাকে নির্দেশ দিলেন। পৃথিবী থেকে সমস্ত মানুষ আর প্রাণিকুলকে ধ্বংস করবে। তারপর নোয়া এবং তিনি যেসব প্রাণীকে বাঁচাবেন তারা নতুন করে বংশবৃদ্ধি ঘটিয়ে এক নতুন মানবজাতি আর নতুন প্রাণীজগৎ সৃষ্টি করবে।

বাইবেলে বলা হয়েছে, “এবং সাত দিন বাদে দেখা গেল, বন্যার জল পৃথিবীকে ঢেকে ফেলতে শুরু করেছে… চল্লিশ দিন আর চল্লিশ রাত ধরে পৃথিবীর বুকে বৃষ্টি ঝরে পড়ল…জল বেড়েই চলল আর নৌকাটাকে ভাসিয়ে তুলে ধরল ওপরের দিকে… বিপুল পরিমাণ জল জমে উঠল পৃথিবীর ওপরে; এবং সমস্ত আকাশের নিচে যতো উঁচু পাহাড় আছে, সবই জলে ঢাকা পড়ল। পনেরো হাত উঁচু জল জমে উঠল…এবং পৃথিবীর বুকের যতো প্রাণী ছিল সকলেই মারা গেল…একমাত্র নোয়া আর নৌকাটায় যারা তার সঙ্গে ছিল তারাই বেঁচে রইল।” বাইবেলের কাহিনী অনুযায়ী, আরও ১১০ দিন পৃথিবী জলে ডুবে ছিল। তারপর সেই জল নেমে গেল এবং যেসব প্রাণীকে নোয়া রক্ষা করেছেন তাদের সবাইকে নিয়ে নৌকা থেকে বেরিয়ে এলেন পৃথিবীকে ফের প্রাণিকুল সমৃদ্ধ করে তোলার জন্যে।

মহাপ্লাবনের এই কাহিনী থেকে দুটি প্রশ্ন উঠছে:
১) সবচেয়ে উঁচু পাহাড়-পর্বতের চেয়েও উঁচু হয়ে জলস্তর জমে উঠে পুরো পৃথিবীকে ঢেকে ফেলার মতো বৃষ্টিপাত হতে পারে কি?
২) পৃথিবীতে যতো বর্গের প্রাণী আছে, নোয়ার নৌকায় তাদের প্রত্যেকটির একজোড়ার স্থান সংকুলান হতে পারে কি?

এই মহাপ্লাবন কি সম্ভব ছিল?: উপরের দুটি প্রশ্নেরই গাণিতিক সমাধান করা যেতে পারে।

মহাপ্লাবনের ওই জল এসেছিল কোথা থেকে। স্বভাবতই, আবহমন্ডল থেকে। তারপরে সেটা গেল কোথায়? গোটা পৃথিবীব্যাপী একটা জলসমুদ্রকে মাটি শুষে নিতে পারে না, অন্য কোনো ভাবেও সেটা অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে না। একমাত্র আবহমন্ডলেই ওই মহাপ্লাবনের সমস্ত জলটার এখন আবহমন্ডলেই থাকা উচিত। সুতরাং, আবহমন্ডলের সমস্ত বাষ্প যদি জলবিন্দুতে ঘনীভূত হয়ে পৃথিবীর উপরে ঝরে পড়ত, তাহলে সবচেয়ে উঁচু পাহাড়গুলিকে ঢেকে দিয়ে আরেকটি মহাপ্লাবন হতে পারত। তা হতে পারে কি না দেখা যাক।

আবহবিজ্ঞানের বই থেকে আমরা জেনে নিতে পারি আবহমন্ডলের আর্দ্রতা রয়েছে কতোখানি; ওই বইগুলিতে বলছে, প্রতি বর্গমিটারের উপরে বায়ুর যে স্তম্ভ রয়েছে, সেটা বায়ুস্তম্ভের মধ্যে গড়ে ১৬ কিলোগ্রাম বাষ্প রয়েছে, এবং কোনো ক্ষেত্রেই সেটা ২০ কিলোগ্রামের বেশি কখনোই নয়। এই সমস্ত বাষ্প যদি ঘনীভূত হয়ে পৃথিবীর উপরে এসে পড়ত, তাহলে ওই বৃষ্টির জলের গভীরতা কতোটা হত, তা হিসেব করে দেখা যাক। ২৫ কিলোগ্রাম, অর্থাৎ, ২৫,০০০ গ্রাম জল ঘন মানের দিক থেকে ২৫,০০০ ঘন সেন্টিমিটার জলের সমান। এটাই দাঁড়াত এক বর্গ-মিটার, অর্থাৎ ১০০X১০০= ১০,০০০ বর্গ-সেন্টিমিটার, ক্ষেত্রফলের ওপরে জমে ওঠা জলস্তম্ভের ঘনমান। এই ঘনমানকে ভূমির ক্ষেত্রফল দিয়ে ভাগ করে আমরা জলস্তরের ঘনমান। এই ঘনমানকে ভূমির ক্ষেত্রফল দিয়ে ভাগ করে আমরা জলস্তরটির গভীরতা পাচ্ছি:
২৫,০০০:১০,০০০=২.৫ সি.মি
বন্যার জল ২.৫ সেন্টিমিটারের বেশি উঁচুতে উঠতে পারত না। কারণ, আবহমন্ডলে এর চেয়ে বেশি জল নেই।* এমন কি, এই উচ্চতাও সম্ভব হত যদি মাটি একটুও জল শোষণ না করত।

আমাদের হিসেব থেকে দেখা যাচ্ছে যে, মহাপ্লাবন যদি হয়েও থাকত, তাহলেও বন্যার জল ২.৫ সেন্টিমিটারের বেশি উঁচুতে উঠতে পারত না। আর, ৯ কিলোমিটার উঁচু এভারেস্ট পর্বতশৃঙ্গে পৌছানো তো বহু দূরের কথা। বন্যার জলস্তরের উচ্চতাটাকে বাড়িয়ে তুলেছে মাত্র… ৩,৬০,০০০ গুণ।

এবং, যদি কোনো বৃষ্টি- “প্লাবন”ও হত তাহলেও সেটা বাস্তবে সম্ভব হতে পারত না, সেটা হত শুধু ঝিরঝির বৃষ্টি। কারণ, ৪০ দিন ধরে একটানা বৃষ্টির ফলে অধ:ক্ষেপণ হত মাত্র ২৫ মিলিমিটার- দিনে ০.৫ মিলিমিটারেরও কম। শরৎকালের ঝির ঝির বৃষ্টি যদি সারাদিন ধরেও চলে, তাহলে তার ফলে এর ২০ গুণ বারিপাত হয়।

এমন একটা বিশাল নৌকা হতে পারে কি: এবার দ্বিতীয় প্রশ্নটার আলোচনায় আসা যাক। যেসব প্রাণীকে নোয়ার রক্ষা করার কথা, তাঁর নৌকোয় তাদের সকলেরই সংকুলান হতে পারত কি?

নৌকোটায় কতখানি স্থান ছিল দেখা যাক। বাইবেলের গল্প অনুয়ায়ী, নৌকোটা ছিল তিনতলা উঁচু। প্রত্যেক তলা ৩০০ হাত লম্বা, ৫০ হাত চওড়া। পশ্চিম এশিয়ায় প্রাচীন জাতিগুলির কাছে এক হাত লম্বা মাফটা ছিল ৪৫ সেন্টিমিটার বা ০.৪৫ মিটারের খুব কাছাকাছি। মেট্রিক পদ্ধতিতে পরিবর্তিত করে নিলে এর অর্থ দাঁড়ায়, প্রত্যেকটি তলা ছিল:
৩০০X০.৪৫=১৩৫ মিটার লম্বা এবং ৫০ X০.৪৫=২২.৫ মিটার চওড়া।

সুতরাং প্রত্যেকটি তলার ক্ষেত্রফল ছিল: ১৩৫ X২২.৫=৩,০৪০ বর্গ-মিটার (পূর্ণ সংখ্যায়)।

এবং এই তিনটি তলার সবগুলিতে মোট “বাসযোগ্য” ছিল:
৩,০৪০ X ৩=৯১২০ বর্গমিটার।

ধরা যাক, শুধু স্তন্যপায়ী জন্তুদের পক্ষেই কি এই জায়গাটুকু যথেষ্ট? প্রায় ৩,৫০০ রকমের বিভিন্ন স্তন্যপায়ী জন্তু আছে, এবং নোয়াকে শুধু ১৫০ দিন চালাবার মতো যথেষ্ট পরিমাণে খাদ্যের সংস্থানও করতে হয়েছে। তাছাড়া, একথাও ভুললে চলবে যে শিকার ধরে খায় যেসব জন্তু, তাদের শুধু নিজেদের জন্যেই নয়, তাদের ঔসব শিকারযোগ্য জন্তুদের থাকার জায়গা দরকার, এবং সেই সংঙ্গে শিকারযোগ্য জন্তুদের জন্যে খাদ্য সংগ্রহ করে রাখার মতো জায়গাও দরকার। ওই নৌকোয় একজোড়া করে প্রত্যেকটি স্তন্যপায়ী জন্তুর জন্যে ৯,১২০: ৩,৫০০= ২.৬ বর্গমিটার জায়গা ছিল।

এটা নিশ্চিত যথেষ্ঠ নয়, বিশেষ করে এই তথ্যটি যদি আমরা বিবেচনার মধ্যে ধরি যে, নোয়া আর তাঁর বিরাট পরিবারের জন্যেও কিছুটা বাসযোগ্য স্থান প্রয়োজন ছিল এবং খাঁচাগুলোর মধ্যে কিছুটা ফাঁক রাখারও দরকার ছিল।

স্তন্যপায়ী জন্তু ছাড়াও, নোয়াকে অন্যান্য বহু প্রাণীকে নিতে হয়েছে। এরা হয়তো স্তন্যপায়ীদের মতো অতো বড়ো নয় কিন্তু তাদের বৈচিত্র্য বিভিন্নতা ঢের বেশি। এদের সংখ্যা এই রকম:

পাখি ……………….. ১৩,০০০
সরীসৃপ …………….. ৩,৫০০
উভচর ……………… ১,৪০০
মাকড়সা …………… ১৬,০০০
পতঙ্গ ………………. ৩,৬০,০০০

শুধু স্তন্যপায়ী জন্তুদেরই যদি স্থানাভাব ঘটে থাকে, তাহলে অন্য প্রাণীদের জন্যে তো বিন্দুমাত্র জায়গা ছিল না। পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীকুলের একজোড়া করে প্রতিনিধিকে স্থান দেবার জন্যে, নৌকোটা বাস্তবিকপক্ষে বাইবেলের বর্ণনা অনুযায়ী, নৌকোটা ছিল একটি বিশাল ভাসমান আধার- জাহাজীদের পরিভাষায় বলতে গেলে, সেটা ভাসমান অবস্থায় ২০,০০০ টন জলকে স্থানচ্যুত করেছিল। সেই প্রাচীনকালে যখন জাহাজ তৈরীর কৃৎকৌশল ছিল নিতান্তই শৈশাবস্থায়, তখন এহেন বিরাট আকারের জলযান তৈরীর কায়দাকানুন লোকের জানা ছিল- এটা খুবই অবিশ্বাস্য। কিন্তু মস্ত বড়ো হলেও, বাইবেল-নির্দিষ্ট কর্তব্য পালন করার মতো এমন একটা বিশালকায় জাহাজ সেটা ছিল না। প্রশ্নটা হল পাঁচ মাসের মতো যথেষ্ট খাদ্যদ্রব্য সমেত রীতিমত একটা চিড়িয়াখানার ব্যবস্থা করা!

সংক্ষেপে বলতে গেলে, বাইবেলের মহাপ্লাবনের কাহিনীটি গণিতের দ্বারা সত্য নয় বলেই প্রমাণিত হচ্ছে। বাস্তবিকপক্ষে, এরকম কিছু ঘটার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। আর, যদিই বা ঘটে থাকে, তাহলে সেটা সম্ভবত কোনো স্থানীয় বন্যার ঘটনা- বাদবাকিটা প্রাচ্যদেশীয় উর্বর কল্পনাপ্রসূত।

================
*অনেক জায়গাতেই কখনও কখনও বৃষ্টিপাত ২.৫ সে. মি. ছাড়িয়ে যায়; কিন্তু সেই সব ক্ষেত্রে সেটা শুধু নির্দিষ্ট এলাকাটির উপরের আবহমন্ডল থেকেই সরাসরি আসে না, আশপাশের জায়গার আবহমন্ডল থেকেও বায়ুস্রোতের দ্বারা বাহিত হয়ে আছে। বাইবেলের বর্ণনা অনুযায়ী, মহাপ্লাবন পৃথিবীর সমগ্র উপরিতলকে যুগপৎ প্লাবিত করে দিয়েছিল এবং সেইজন্যেই একটা কোনো জায়গা অন্য জায়গা থেকে আর্দ্রতা “ধার করে” আনতে পারে না।

————
[বাংলায় একটা প্রবাদ আছে- চুরি বিদ্যা মহাবিদ্যা যদি ধরা না পড়ো। ধরা পড়ার আগেই স্বীকার করছি- লেখাটি Mathematics Can Be Fun বই থেকে সংগৃহীত, বইটি সোভিয়েত ইউনিয়নে মু্দ্রিত।]