১.
সমুদ্র নেকড়ে এক সময় আমাকে হরণ করেছিল। তখন তো আমার কৈশোর। স্কুল থেকে তখন সোজা চলে যাই নজরুল পাবলিক লাইব্রেরীতে। সাদা একতলা ভবনটি। শালগাছ লম্বা হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আর আমাদের মধুমতি নদীটিও এর মধ্যে বুড়ো হয়ে যাচ্ছে। দূর থেকে দেখা যায় কয়েকজন জেলপুলিশ শিকে মাথা রেখে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। চরে ফুট-তরমুজ হচ্ছে। দলদস্যুগুলো অন্যকোথাও পাড়ি দিচ্ছে।
গ্রন্থাগারিক ময়েন স্যার ছিলেন আমার স্কুলের বায়োলজির শিক্ষক। কিন্তু লাইব্রেরীতে গেলে তিনি আমাকে চিনতেন না। শুধু কানে আসত–বালকদের জন্য অই আলমারী। উহু, এদিকে নয়। এখন সময় শেষ। সন্ধ্য নামার সঙ্গে সঙ্গে দরোজা বন্ধ। এইসব কথার মধ্যে আমি শালপাতা কুড়োতে কুড়োতে বাড়ি ফিরে যাই। দেবসাহিত্য কুটির আমার তখন আর ভাল লাগে না।
প্রতিদিন ময়েন স্যারের সঙ্গে লাইব্রেরীতে যাই। তিনি সাদা পাঞ্জাবী। তিনি সাদা পাজামা। তিনি গৌরবর্ণ হে। ময়েন স্যার দরোজা খুলে দেন। আর আমি হেঁটে হেঁটে আলমারী পেরিয়ে বাগানের সিঁড়িতে বসে থাকি। কোথাও যাওয়ার নেই। সামনে স্টেডিয়াম। দেখতে পাই ফুটবল দেয়াল টপকে আকাশ সমান হয়ে যাচ্ছে। দেখতে পাই এর মধ্যে ক্যালেণ্ডুলা নীরবে ফুটেছে। হালকা লাল। অথবা হলুদ। আমি ঝরনা দিয়ে জল দেই। ঘুরে ঘুরে বাতাস আসে। এরকম একদিন ফুল ফোঁটা শেষ হলে ময়েন স্যার আমার পাশে একটি বই রেখে যান। ভুল করে? দি সী উলফ। লেখক জ্যাক লন্ডন।
বইটি পড়তে শুরু করি সিঁড়িতে বসেই। পড়তে পড়তে শালপাতা ঘন হয়ে আসে। অন্ধকার জমে আসে। লোকজন দেখতে পায় কে এক কিশোর মগ্ন হয়ে আছে দূরের কোন সমুদ্রের ভিতর–তার পিছনে দীর্ঘ মানুষের মতন তাকিয়ে আছেন সফেদ গ্রন্থাগারিক। আর জ্যাক লন্ডন।
২.
হামফ্রিকে গভীর সমুদ্র থেকে যখন উদ্ধার করা হল তখন হামফ্রি অবাক হয়ে দেখল—জাহাজটার নাম ঘোস্ট। শিল শিকারে চলেছে। অদ্ভুত দর্শন তার কাপ্তান। তার নবনীত কোমলাঙ্গ দেখে বলে উঠছে–তোমার এখনো পা গজায় নি। সুতরাং মার খাও। ঝাড়ি খাও। খেতে খেতে মরো। অথবা বাচোঁ।
এই কঠিন লোকটির নাম প্রকৃত নাম নেই। নাম উলফ লারসেন। ডেনিস বংশোদ্ভুত–জন্ম নরওয়ে। বারো বছর বয়স থেকেই সমুদ্রে। কেবিন বয়–শিপবয়-সীম্যান এবং সতের বছরে সমুদ্র মানুষ। এর মধ্যে কখন যে সে হয়ে গেছে ঘোস্ট জাহাজের কাপ্তান–কখন কাকে মেরে সমুদ্রে ভাসিয়ে দিয়ে দখল নিয়েছে মৃত্যদূত ঘোস্ট—হয়ে উঠেছে জলদস্যু, সমুদ্র নেকড়ে গ্রন্থে মুদ্রিত নেই। মুদ্রিত আছে তার আপন ভাইয়ের নাম ডেথ লারসেন। জানি দুশমন।
উলফ লারসেন জানে নিজের পায়ে হাঁটা চাই। নিজের পায়ে হাঁটতে হলে অন্যদের করতে হবে হুকুমের দাস। যারা অস্বীকার করবে তাদের জন্য কোনো মায়া মমতা কিম্বা নীতি-ধর্ম বলে কোন ব্যাকরণ থাকতে নেই। যে উপরে উঠবে সে হবে একক ঈশ্বর। কাউকে দরকার নেই।
হামফ্রি, একদা যে ছিল দার্শনিক গ্রন্থে আকুল, এভাবে ধীরে ধীরে বোধ করে তার নবনীত কোমলাতা তাকে ছেড়ে চলে গেছে। পেশীগুলো ফুলে উঠেছে। ঘাড় ফেরালে রক্তচক্ষু দেখে হিংস্র জাহাজীরাও ভয় পায়। তার অধীত বিদ্যা হেরে গেছে লারসেনের স্বোপার্জিত গণিত, সাহিত্য, প্রযুক্তি জ্ঞানের যুক্তিজালে। সেও ছুরি হাতে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিতে যে কারো বুক। আর তখুনি উলফ লারসেন হাততালি দিয়ে বলে উঠে, হামফ্রি, তোমার পা গজাতে শুরু করেছে।
এ সময় তাদের জাহাজ তুলে আনে কয়েকজন সমুদ্র-পীড়িত মানুষকে। তাদের মধ্যে একজন কবি মিস ব্রিউস্টার। এই প্রথম টের পায় লারসেন সে কিছুটা ভালবাসা বোধ করেছে এই নারীটির প্রতি। কিন্তু হামফ্রি ক্ষুধার্ত জাহাজী ক্রু, লারসেন আর সমুদ্র ঝড়ের হাত থেকে বাঁচিয়ে চলে নারটিকে।
একদিন নৌকা চুরি করে একটি নির্জন দ্বীপে পালিয়ে যায় হামফ্রি আর কবি নারী। তারা সেখানে নির্মাণ করে ঘর, শিকার করে শিল আর জ্বালায় আগুন। এভাবে তারা টিকে থাকে নিজেদেরে পায়ের উপরে ভর করে। এ-পাটি অর্জন করেছে লারসেনের কাছ থেকে–ঘোস্ট জাহাজ থেকে।
এ সময় ডেথ লারসেন ঘোস্টকে আক্রমণ করে তার ক্রুদের ভাগিয়ে নিয়ে যায়। ছিন্নভিন্ন করে দেয় জাহাজের পাল। উলফ লারসেন একা ভেসে চলে তার পরিত্যাক্ত জাহাজে। আর এভাবে সেই নির্জন দ্বীপে দেখা হয় আবার হামফ্রি আর মিস ব্রিউস্টারের সঙ্গে। তখন শক্তিহীন লারসেন। হামফ্রি দখল নেয় তার আগ্নেয় অস্ত্রগুলি। তারা সিদ্ধান্ত নেয় পালগুলিকে মেরামত করবে। তখন লারসেন তাদের বলে, সে দ্বীপে মারা যেতে চায়। তাকে যেন তারা নামিয়ে নেয়। আর এভাবে কৌশলে নষ্ট করে দেয় পাল মেরামতের সকল উদ্যোগ।
এ সময় লারসেনের চোখ হয়ে যায় অন্ধ। দেহ নিশ্চল। বধির। যতক্ষণ তার দেহে প্রাণ ছিল–ততক্ষণ প্রাণপণে চেষ্টা করেছে এই দুটি প্রাণবন্ত মানুষকে মেরে ফেলতে। ব্যর্থ করতে চেয়েছে মানবিক বোধকে।
আর এর মধ্যে দিয়ে এই দুটো মানুষ নতুন করে ভাঙা জাহাজটিকে সারিয়ে তোলে। পাল ঠিক করে। আবার ভাসে সমুদ্রে–মানুষের পৃথিবীতে ফিরে যেতে। আর তখন মারা যায় উলফ লারসেন। কারণ সে জানে কারো করুণায় তার বেঁচে থাকার অর্থহীন। বাঁচতে হবে একা। নিজের পায়ে। নিজের করে। তাই সে ডুবে যায় গভীর সমুদ্রে।
৩.
এই নেকড়ের গল্পগাঁথা পড়তে পড়তে বুঝতে পারি সন্ধ্যা হয়ে গেছে–আর শালগাছের পাতা থেকে ঝরে পড়ে কয়েকটি শিশির। দূরে বাদুড় উড়ে যায়। কোথায়? কে জানে! শুধু জানে এই প্রবীন গ্রন্থগারিক একা হেঁটে চলেছেন। তাঁর ছায়ার হাত ধরে সেই ব্যাকুল কিশোর।
……………………………………………………………………………………………….
দি সী উলফ
জ্যাক লন্ডন
সমুদ্রের স্বাদ
বাংলা অনুবাদ : কবীর চৌধুরী
প্রকাশক : বাংলা একাডেমী
রিভিয়ুটি খুব ভাল লেগেছে ।
পৃথিবীটা দুভাগে বিভক্ত– শিকারী ও শিকার। হয় তুমি শিকারী হবে, না হয় শিকার। এমনই সব নির্মম উপলব্ধীর মুখোমুখি দাঁড় করান জ্যাক লন্ডন।
আমার দুঃসময়ের প্রেরণা দাতা এই লেখককে নিয়ে লেখার জন্য কৃতজ্ঞতা। লেখাটি চমৎকার। :yes:
পুনশ্চ:
জ্যাক লন্ডনের বিখ্যাত উপন্যাস ‘হোয়াইট ফ্যাঙ’ এর চলচ্চিত্র রূপের খন্ডাংশ এখানে। পুরো ছবিটি ইউটিউটে কয়েক খন্ডে পাওয়া যাবে। এর অ্যানিমেশন ভার্সনও আছে। …
[img]httpv://www.youtube.com/watch?v=aXslm_WFFPo&feature=related[/img]
বিভুতিভুষনের অপরাজিত উপন্যাসে লেখক অপুর কিছু চিত্রায়ন করেছেন। অপু দেওয়ানপুর গবর্ণমেন্ট মডেল ইনস্টিটিউশনে স্কলারশিপ পেয়ে পড়তে গিয়েছিল। সে লাইব্রেরী থেকে বই নিয়ে স্কুল আঙ্গিনার কোন এক কোনে বসে নিবিস্ট মনে পড়ত। ভুলে যেতো জগতের জাগতিক সব কিছু। বিকেলের আলো ফুরিয়ে অন্ধকার ঘনিয়ে সাঁঝ নামত। অপুর খেয়ালই থাকতনা। এ লেখাটিতে অপুর ছায়াগন্ধ লেগেছে। ভালো লেগেছে।
@মাহমুদা নাসরিণ কাজল,
আমার মনে হয় তোমার কবিতা লেখার হাত আছে। কিছু ছাড় এখানে।
@মাহমুদা নাসরিণ কাজল,
‘বিভুতিভুষনের অপরাজিত উপন্যাসে লেখক অপুর কিছু চিত্রায়ন করেছেন। অপু দেওয়ানপুর গবর্ণমেন্ট মডেল ইনস্টিটিউশনে স্কলারশিপ পেয়ে পড়তে গিয়েছিল। সে লাইব্রেরী থেকে বই নিয়ে স্কুল আঙ্গিনার কোন এক কোনে বসে নিবিস্ট মনে পড়ত। ভুলে যেতো জগতের জাগতিক সব কিছু। বিকেলের আলো ফুরিয়ে অন্ধকার ঘনিয়ে সাঁঝ নামত। অপুর খেয়ালই থাকতনা। এ লেখাটিতে অপুর ছায়াগন্ধ লেগেছে। ভালো লেগেছে।’
এই কটি বাক্য লক্ষ কর। কমপ্লিট বাক্য। প্রথম ৬টি বাক্যে তুমি কিছু ইনফরমেশন দিচ্ছ। তারপরই তোমার মন্তব্য–দুটি ছোট বাক্যে। এবং একটি শব্দ ‘ছায়াগন্ধ’–এরকম শব্দ তো আমি খুব লেখকের কলমেই দেখতে পাই। আসলেই তো বিভূতির লেখা ছায়াগন্ধী। একটি শব্দেই বিভূতির মহিমা বলে দিয়েছ। এরকম শব্দের ভেতরে লুকিয়ে থাকা অপার রূপের জগৎ বের করা কি সহজ?
সবাই পারে না। তুমি পেরেছ।
জ্যাক লন্ডনের মূল বই প্রথমবার স্কুলে থাকার সময় পড়ার চেষ্টা করে ব্যার্থ হই। অতিমাত্রায় বোরিং লেগেছিল অনুবাদ, সাথে হয়ত আমার কচি বয়স?
এরপর সেবা প্রকাশনীর ঝরঝরে অনুবাদ পড়ি। তাও বিশেষ ভাল লাগেনি।
এর চেয়ে কুলদার লেখাই অনেক ভাল লেগেছে 🙂 ।
@আদিল মাহমুদ,
কস্কী মমিন? 😉
@বিপ্লব রহমান,
যাহা বলিব সত্য বলিব
সত্য বই মিথ্যা বলিব না;
কুলদা বিপ্লবের মনে
ব্যাথাও দিব না
উহারা অজান্তে ব্যাথা পাইয়া গেলে
দায়ীও থাকিব না।
@আদিল মাহমুদ, :laugh:
ছোট বেলায় জ্যাক লন্ডনের এই বইটি আর “দ্য কল অব দা ওয়াইল্ড” বইটি ক্ল্যাসিক্স্ ইলাস্ট্রেটেড সংস্করণ পড়েছিলাম। এই বইগুলিতে সুন্দর ছবি থাকাতে কাহিনী আরও জীবন্ত হয়ে উঠত। যারা সী উলফের ক্ল্যাসিক্স্ ইলাস্ট্রেটেড সংস্করণ (ইংরেজীতে অবশ্য) পড়তে চান নীচের লিঙ্ক থেকে কমিক বুক ফর্মে তা ডাউনলোড করতে পারেন।
http://www.megaupload.com/?d=TPZYMXMA
কমিক বুক পড়ার জন্য সবচেয়ে ভাল সফটয়ার হল মাঙ্গামিয়া (Mangameeya)। এটা ডাউনলোড করতে পারেন নীচের সাইট থেকেঃ
http://www.mydailymanga.com/2009/01/14/mangameeya-update/
ভাল লাগল!
ভালো লাগলো। বইটি পড়ার আগ্রহ তৈরী হল।
খুব ভালো লাগলো উলফ লারসেনের গল্প।
আতীতে নরওয়েজিয়ান রা ছিল ভাইকিংস। জলদস্যু। জলদস্যুতা নরওয়েজিয়ানদের কাছে ছিলো একটা গরবের পেশা।
আপনার ১ নং ও ৩ নং বর্ননা এত জীবন্ত লাগলো যেন কিছু ক্ষনের জন্যে আপনার ছেলেবেলার শরিক হয়ে গেলাম।একটা সুন্দর অনুভুতির পরস পেলাম।
@সেণ্টূ টিকাদার, ধন্যবাদ।