আমার মামু গওহর আলী মসতো বড়ো কবিয়াল। জাকড়া চুল। বাউলা ডেরেস।
একদিন গঞ্জ থিক্যা ফিরা মামুরে আর খুইজা পাওয়া গেল না। মূলাদি আর আমতলীর বায়নাওয়ালারা চইলা গেল। তাগো মুক ভার। কেডা আর তাগো আসর জমাইবো। এই চিন্তায় তাগো মাতা আউলা।
মামীর কিন্তু কুনো চিন্তা নাই। খুপ কুশি। আগে গান পসনদো করতো না। কৈতো গানই হ্যার সতীন। আর এহুন রান্না করে আর নিজি নিজি গুনগুনাই গান গায়- নিশিতে যাইও পুল বনে। চউক্ষে কাজল। বুজলাম, বেপার সুবিদার না। কৈলাম, মামু কৈ?
মামী হাইস্যা কুডি কুডি। কয়, দ্যাহো খাডের তলায়।
খাডের তলায়ই মামুরে পাওয়া গেল। মাতার হেই লোম্বা চুল আর নাই। টাক। নয়া চুল গজাইতেছে। কদম পুলির লাহান। আর বোজা যায়- কিছুডা আলকাতরার দাগ চান্দিতে এহনো আচে।
-কী হৈচে মামু?
– আয়ুব খানের আম্রি চুল কাইডা দিচ্ছে। কৈছে নয়া জামানায় এইসব চলবে না।
মামু মাতায় গামছা বাইনদা গঞ্জে গেল। ফিরা আইল দুইদিন পর। মাতায় কিস্তি টুপি। লগে দুইডা ছাগোল। ব্যা ব্যা কৈরা ডাকতেআছে।
-ছাগোল দিয়া কি হরবা মামু?
– ঘোড়া দৌড়ানিতে নামামু।
– ঘোড়া দৌড়ে ছাগোল? বুজবার পারতাছি না।
-সুইজা কাম নাই। এইডা তুমার বাপের ছাগোল না- আয়ুব খানের ছাগোল। মুন্সী সাব দিছেন।
হেইদিন হৈতে মামুর লগে লগে ছাগোল দুইডা। ছাগোল দুইডার লগে লগে মামু। হারাদিন গেরামের ব্যাবাক কাডোল পাতা খাইয়া শ্যাষ। হ্যারপর অন্য গেরামের পাতাও শ্যাষ। আয়ুব খানের ছাগোলের তাগোদই আলেদা। পরের কাডোল পাতা খাইয়া পাঞ্জাবী ঘোড়ার মতো নাদুস নুদুস হৈয়া উডল। হডাৎ কৈরা দেকলে হ্যাগো ছাগোল না- হাছা ঘোড়ার লাহানই লাগে। আর দ্যাশ গেরামের ছাগোল গুলান খাইদ্য না পাইয়া শুটকো ইনদুর হৈয়া গেল।
অবোস্তা আরও জুটিল হৈল- যহন মামু ছাগোলের লগেই গুমান শুরু করলো। মামী রাগে গজ গজ কৈরতে লাগল। আগে আছিল গানের পাগোল। এহুন হৈছে ছাগোলের পাগোল।
মামু কয়, একদুম চুপ। এডি ছাগোল নয়রে। এডি আয়ুব খানের ঘোড়া। সমসসা হৈলে মহাবেপদ।
কাউয়ার চরে সাতদিন দৈরা প্যানডেল বানান হৈল। লেহা হৈল শালু কাপুড়ে- ঐতিহাসিক ঘোড়ার দউড়। আর আইল মাইক। দিন রাইতে বাজতে লাগল- লাল দুপাট্টা মল মল মল।
যেইদিন ঘোড়ার দউড় হেইদিন সহালে দুইজুন কসাই আইসা ছাগোল দুইডারে জবাই কইরা ফেললো। অন্য কুনো কতা নাই। কয়জন বাবুর্চি আইসা রাননা বাননা শুরু করল বড়ো ডেকচিতে। মামু আতকা কৈলো- এইডা কি করলেন? মোর ঘোড়ার দউড় হৈবে ক্যামনে?
লুকগুলান কতা কয় না। গুইরা গুইরা নাচে। আর রাননা করে। আর গান গায়- লাল দুপাট্টা মল মল মল।
মামী শরমে ঘরে গিয়া খিল দিল। খাডের নীচে ডুকলো।
মুন্সী সাবের লঞ্চ কাউয়ার চরে আইসা বিড়ল। মাতায় জিননাহ টুপি। চউক্ষে সুরমা টানা। লোম্ব শেরওয়ানী। কালো মুকাসিন পায়ে। মচোর মচোর শব্দ অয়। চোস পাজামা। আতরেরর গইন্দে নাকের মইদ্যে ছ্যাত কৈরা ওডে। খানা পিনা সারলেন লঞ্চেই। লোম্ব ডেইক ছাইড়া কৈলেন, আইচ্চা বি খানা হ্যায়। দিল তক বি ঠান্ডি হো জায়গা।
মামু বিড় বিড় কৈরা এর মইদ্যে একবার কৈলেন, মোর ঘোড়া দউড়োনির কি অইবে?
মুন্সী সাব দাঁত খিলাইতে খিলাইতে কৈলেন, এইডা তুমার চিন্তা না। গান বানাইচো?
-না।
-সে কি? তুমার এহুন কাম নয়া নয়া গান বানদা। আর নাপসোন্দ গানের কতা পাল্ডাও। আরও কত কি কৈলেন মুন্সী সাব। মেলা হিস্টিরি। হ্যাষে কৈলেন, তাইলে একহান গান হোনাও তো দেহি। হুনি।
গওহর মামু কি আর করেন। গান দরলেন-
প্রাণ সখিগো
অই শোন কদম্বডালে বংশী বাজায় কে?
মুন্সী সাবের নয়া বিবি একবার কেবিন থিকা বাহিরে আইলেন। কিচুক্ষণ চাইয়া রইলেন চরের দিক। আবার কেবিনের মইদ্যে ডুইকা গেলেন। তার বয়স ১৬-১৭ বচোর। মুন্সী সাব হাত দিয়া মামুরে থামাইয়া দেলেন। কৈলেন, তুমার এই প্রাণ সুখিডো কেডা?
-রাদা।
-কদম্ব মানে কি?
– কদম পুল।
– বংশী?
– বাশিঁ।
– আর বাঁশিডা বাজায়- হেইডা কেডায়?
– কিসনো।
– কোন কিসনো? মাইয়াগো লগে দিললাগি করতো যেই কালা বেডা- হেই নিকি তুমার কিসনো?
মামু কুনো কতা কৈল না। মুন্সী সাব ঠান্ডা গলায় হুকুম দেলেন, এই ছাগোলডারে বান অই খাজুরগাছের লগে। আর অর কান দুইডা কাইডা ফ্যালা। হালায়, মালাউনগো গান গায়!
মুন্সী সাব ঘোড়া দউড়ানির মাডের দিক হাডা দিলেন।
হেইদিন কাউয়ার চরে লুকে লুকারণ্য। কুনো জাগা ফাকা নাই। ইস্টেজে মুন্সী সাব নাক ডাকতেআছেন। খানাপিনা আচ্ছা হৈচে তো। আর বয়সডাও তো কম না। মাইকে বাজতেআছে- আর কিচুক্ষণের মইদ্যে শুরু হৈবে । অইতিআসিক ঘোড়ার দউড়। এডি যে কুনো ঘোড়া লয়গো। এইডি পিল্ড মার্শাল আয়ুব খানের ঘোড়া।
মুন্সী সাবের গুম বাঙতে বাঙতে রাইত নাইমা আইল। চর জুইড়া গুডগুডা আনদার। দুএকডা জুনাকি পিরিক পিরিক কৈরা জ্বলে। এর মইদ্যে কুন সুমায় ঘোড়ার দউড় শুরু হৈল বুজবার পারলাম না। আবসা আলোতে দেকলাম, কয়ডা শুডকি ইনদুর দউড়াইতাছে জিমাইতে জিমাইতে। আর হ্যাগো পিচে একডা মানুষ মেলা কষটে দউড়ানোর বঙ্গি করতাচে। লুকডা ঠিকমতো খাড়াইতেই পারে না। দউড়াবে কি! পইড়া পইড়া যায়। আর দুইডা দইত্য হ্যার ঘাড় দইরা তক্ষুণি উডাইয়া দ্যায়। হাইকা কয়, দৌড়া- ঘোড়া দৌড়া।
মেলাদিন পরে গঞ্জে গেছি। লঞ্জ গাডে দেহি ছুডো খাডো বিড়। বিড়ির মইদ্যে একডা লুক কিমরির বড়ি বেচতেআছে।
মাতায় জিননা টুপি। কানের জাগায় কান নাই। হেইহানে ছাগোলের দুইডা কান দড়ি দিয়া বানদা।
কৈলাম, মামু, অ মামু!
কেডা কার মামু? লুকডা বেঞ্জু বাজায় আর গান গায়-
পিয়ারা দোসতো গো
অই শোন খাজুর তলায় শিঙ্গা ফুকায় কে?
এই পরথম ল্যাহাডা পড়লাম। জুট্টিল হৈছে। চলুক। :yes:
বেশ উপভোগ করেছি। চমৎকার লেখা।
আমার জন্য নতুন লেখা। খুব ভাল লেগেছে। আমার সচলায়তনেই কেবল মাঝে মাঝে ঢু মারা হয়, আর কোথাও যাওয়া হয়না।
ভালো লেগেছে। লেখককে অভিনন্দন। :yes:
আমি এর আগে পড়িনি।
চমৎকৃত হলাম!
@ কুলদা রায়,
দাদা,
চমৎকার। সচল, নতুন দেশ, সামু ব্লগ, হৃদকলম, আমার ব্লগ এসব জাগাতেই এই চমৎকার লেখাটি আছে। মুক্তমনা অবশ্য অন্যস্থানে প্রকাশ করা লেখাকে মুক্তমনায় পোষ্ট করতে উৎসাহ দেয় না।
দেখা যাক কী হয়?
@মাহফুজ,
সচল, নতুন দেশ, সামু ব্লগ, হৃদকলম, আমার ব্লগ তারপরে মুক্তমনা। বাহ্ এতগুলো জায়গায় বিচরন দেখে আপনার তারিফ না করে পারলামনা। আরও হয়তো অনেক আছে যেগুলো জ্ঞাত নই। প্রশংসা করতে আপনার প্রতি রইলো :rose2:
@ব্রাইট স্মাইল্,
যেগুলো জ্ঞাত নন, সেগুলো কি জানতে ইচ্ছে করে? তাহলে সংক্ষেপে বলি-
মুক্তমনায় যারা লেখা পোষ্ট করেন, তারা প্রায়ই অন্য ব্লগের লিংক দিয়ে দেন, বিষয়টি আরো বিস্তারিত জানার জন্য। আমি ঐ সমস্ত লিংক অনুসরণ করে করে অনেক জায়গায় গেছি। তবে কিছু কিছু ব্লগ আমার কাছে ভালো লাগে, তার মধ্যে সচল একটি। সবচেয়ে বাজে লাগে সদালাপ। এছাড়া নাস্তিকতার ধর্মকথাও ভালো লাগে। তবে যাই বলুন আমার কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ হচ্ছে মুক্তমনা।
ইংরেজী ওয়েবে বেশি ঢুকি না, মোল্লার দৌড় যেমন মসজিদ পর্যন্ত, ইংরেজীর ব্যাপারেও আমার তদ্রুপ। তবে ইদানিং একটু একটু পড়া শিখছি। কয়েকদিন আগে আকাশ মালিক ভাই একটা লিংক দিলেন, সেটা ছিল ইংরেজী। এভাবেই আমি বিচরণ করেছি ওয়েবের বিভিন্ন সাইটে। এছাড়া পেপার পড়ি, কালের কণ্ঠ, প্রথম আলো।
নাপাক কতগুলো জায়গায় কিভাবে যেন চলে গেছি, সেটা আর উল্লেখ করতে চাই না।
দুইদিন আরবান ডিকশনারীতে ঢুকেছি। আর হুমায়ুন আজাদ এ প্রায়ই বিচরণ করি।
এই হলো আমার সংক্ষিপ্ত আন্তর্জালিক বিচরণ।
@মাহফুজ,
ভালো লাগলো আপনার বিভিন্ন ক্ষেত্রে আন্তর্জালিক বিচরণে দেখে। আশা করছি আপনার বিচরনের ক্ষেত্র আরও বৃদ্ধি পেতে থাকবে এবং আপনি আরও জ্ঞান- গুনে সমৃদ্ধ হতে থাকবেন।
@মাহফুজ,
অন্য ব্লগগুলোর কথা জানি না, কিন্তু সচলায়তনে তো এই লেখা কখনও ছাপা হয় নি!
@স্নিগ্ধা,
জ্বী সচলে নাই। মনে হয় স্লিপ অব কী বোর্ড। অন্যগুলোতে আছে এবং পড়েছি। উনার আঞ্চলিক ভাষার ডায়ালগগুলি খুবই চমৎকার লাগে। আমি দারুন উপভোগ করি।
@মাহফুজ, এটার দুটো উত্তর আছে আমার কাছে। একটা উত্তর দিচ্ছি। এখানে অনেক লেখাই দেখছি–যা অন্যত্র প্রকাশিত হয়েছে। বিষয়ের গুরুত্বঅনুসারে এখানে পূনঃপ্রকাশ করা যায় বলেই মনে হয়েছে। তবে ভবিষ্যতে আপনার সতর্কবার্তা মনে থাকবে। ধন্যবাদ।
@কুলদা রায়,
অন্য ব্লগে যদি প্রকাশ হয়ে থাকে তাহলে এখানে উল্লেখ করলে ভালো হয়। তানাহলে কে কখন কোন্ কথায় আপনাকে আহত করে বসবে তার তো ঠিক নেই। আমার অনুভূতিতে আঘাত করলে আমি হয়ত মুক্তমনা ছেড়ে যাব না। কিন্তু সবাই তো আর আমার মত না। একটুতেই মন খারাপ করে ব্লগ ছেড়ে চলে যায়। আর কোনদিন আসবো না, মুক্তমনা ছাড়া কি আর কোন ব্লগ নাই ইত্যাদি ইত্যাদি কথা বলে।
যাহোক, আপনার এই লেখাটাই বরিশাল এলাকার ভাষা ছাড়াও কি অন্য এলাকার ভাষা রয়েছে?