স্মৃতির পাতা থেকে

আকাশ মালিক

(উৎসর্গ- আদিল মাহমুদ)

১৯৭০ সালে কওমী মাদ্রাসার ছাফেলা চারমে (মাদ্রাসার হিসেবে নবম শ্রেণী) বৃত্তি পরীক্ষা দিয়ে অবসর দিন কাটাচ্ছিলাম। কওমী মাদ্রাসায় ছাফেলা দুওম (সপ্তম), ছাফেলা ছুওম (অষ্টম), ও ছাফেলা চারম (নবম) তিনটি শ্রেণীকে ঐ সকল শ্রেণীতে পাঠ্য, প্রধান কিতাবের নামানুসারে ডাকা হয়- ‘সফর’, ‘নহমীর’ ও ‘হেদায়াতুন নুহ’। উল্লেখ্য আমি মাদ্রাসা শুরু করেছিলাম তৃতীয় জামাত থেকে। ছাফেলা চারমে এসে সহপাঠী শওকত আলীর সাথে আমার গভীর বন্ধুত্ব গড়ে উঠলো। তার চাচা, পাঠশালা হেডমাষ্টার মোখলেস আলী ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ভক্ত একজন আওয়ামী লীগ সমর্থক। শওকতের সুত্রে আমিও মাষ্টার সাহেবকে চাচা ডাকতাম। তিনি আমাদেরকে নিজের সন্তানের মত দেখতেন। মাদ্রাসা ছুটির পর প্রায়ই তাদের বাড়ি যেতাম, মাষ্টার সাহেব না খেয়ে আসতে দিতেন না। দু একদিন না দেখলে তিনি আমার খোঁজ নিতেন। মাষ্টার সাহেব আমাদেরকে দেশ বিদেশের বিচিত্র গল্প শুনাতেন। ভুগোল, রাজনীতি, বিশ্ব ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করতেন, আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। তার টেবিলে পড়ে থাকা বাংলা পত্রিকা মাঝে মাঝে পড়তাম। মাদ্রাসায় বাংলা পত্রিকা সপ্নেও দেখি নাই। চাচার ঘরে একটা রেডিও ছিল। তিনি আমাদেরকে সাথে নিয়ে সংবাদ শুনতেন। তিনি চলে গেলে ভলিয়্যুম কমিয়ে দিয়ে আমরা রেডিওতে গান শুনতাম। একজন মাদ্রাসা ছাত্র হিসেবে ঐ একটি ঘর ছাড়া আমার জন্যে নির্ভয়ে নিরাপদে গান শুনার জায়গা পৃথিবীতে আর কোথাও ছিলনা। মাঝে মাঝে ভাবতাম মাষ্টার সাহেব এত অমায়িক বন্ধুসুলভ ব্যবহার করেন আর আমাদের হুজুররা কেন এত খিটখিটে মনের। হুজুরগন আর আমাদের মধ্যে যেন মুরগীর বাচ্চা আর চিলের সম্পর্ক। একদিন চাচা আমাদেরকে শেখ মুজিবুর রহমানের কাহিনি শুনালেন, সাথে ছয় দফা কী, কেন, তাও ব্যাখ্যা করলেন। তখন রাজনীতির কিছুই বুঝতাম না। মাদ্রাসায় সমাজ বিজ্ঞান, রাস্ট্র বিজ্ঞান, পৌরনীতি পড়ানো হয়না। তবে চাচার কাছ থেকে এতটুকু বুঝেছিলাম যে, সিলেটের ছাতকে তৈরী সিমেন্ট পাকিস্তানে সস্তায় পাওয়া যায়, আমাদের দেশে তৈ্রী কাগজ বিক্রীর অনুমোদন পেতে হলে পাকিস্তান থেকে সীল মোহর লাগাতে হয়। শেখ মুজিব পাকিস্তানের এই বৈষম্যমূলক আচরণের বিরোধিতা করেন। তখন আমি এও জানতাম যে আমাদের হুজুরগন ‘জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম’ নামক একটি দলের সমর্থক, খেজুর গাছ ইসলামের বা ইসলামী দলের এবং নৌকা আওয়ামী লীগের প্রতীক। শওকত প্রকাশ্যেই বলতো যে, সে শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের সমর্থক।

বৃত্তি পরীক্ষা শেষে কোথায় যাব কি করবো জানিনা, একদম ভবঘুরে অবস্থা। ছয়মাস গোয়ালে বন্দী, বর্ষার শেষে কার্তিক অগ্রহায়ন মাসে শুকনো মাটি পেয়ে গরুদের যে অবস্থা হয়, আমার অবস্থাও ঠিক তেমনি। লুকিয়ে লুকিয়ে হাইস্কুলের ছাত্রদের সাথে মেলামেশা, গান, নাটক, যাত্রাদল, দূর্গাপুজা, কালীপূজা সব জায়গায় আনাগোনা। পাঞ্জাবী টুপি ছেড়ে শার্ট পরার পর নিজেকে আয়নার সামনে পুরো শিক্ষিত বাবুর মত দেখে মনেমনে হাসলাম। ইতিমধ্যে মুন্ডানো মাথায় চিরুণী বসানোর মত চুলও গজায়েছে। শওকত আলী দূরে কোথাও অন্য একটি মাদ্রাসায় চলে গেল, আমি আর চাচার বাড়িতে যাইনা। আমার পরিবর্তন দেখে বড় ভাই চিন্তিত হলেন। একদিন জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখন কী করা, এভাবে তো সময় নষ্ট করা যায়না’। আমি বললাম- ‘আমি স্কুলে পড়বো’। প্রায় ২ বৎসর পর ১৯৭৩ সালে একদিন আমাকে আমাদের গ্রাম থেকে পাঁচ মাইল দূরে একটি গ্রামের হাইস্কুলে নিয়ে যাওয়া হলো। মা-বাবার ঘর ছেড়ে জীবনে এই প্রথমবারের মত পরের ঘরে বাস করার পথে পা বাড়ালাম। জায়গীর বাড়ির ভাত মুখে তুলবো, ভাবতেই ভয় লাগে। পরের বাড়ি, পরের ঘর, পরের বিছানায় শুইতে যাবো, গৃহ কর্ত্রীকে মা, না খালা, না চাচী ডাকতে হবে? এ সমস্ত ভেবে মনটা ভারী হয়ে উঠলো।

স্কুলের কাছাকাছি এসে মনে হলো, এ যেন স্কুল নয় কোন সৌখিন শিল্পীর তুলিতে আঁকা একটি ছবি। স্কুলের পূর্ব ও পশ্চিম দিকে দুটো করে ভিটের দুই প্রান্থে কৃষ্ণচুড়ার গাছ। পাতা নেই শুধু ফুল আর ফুল। দূর থেকে মনে হয় যেন গাছ দূটোর গুড়িতে সবুজ ঘাসের উপর চকচকে লাল রঙ্গের কার্পেট বিছানো। আমি বুঝিনা এই গাছটার নাম কৃষ্ণচুড়া কেন হলো? স্কুলের ঠিক মাঝখানে রক্তজবা ফুলের ঝাড়। এর সামনে মসৃন মাঝারি ধরণের উঁচু মোড়ালি বাঁশের আগায় পতপত করে উড়ছে লাল সবুজের পতাকা। ইউনিফর্ম পড়া ছাত্র ছাত্রীরা, ছেলেরা ছেলেদের সাথে, মেয়েরা মেয়েদের সাথে দল বেঁধে স্কুলে আসছে, ক্লাসে ঢুকছে, এমন দৃশ্য এত নিকট থেকে আগে কোন দিন দেখিনি। মাদ্রাসার বন্ধু শওকত আর আবুলের কথা মনে পড়ে গেলো। খুব ভাল হতো তারাও যদি আজ আমার সাথে এই স্কুলে ভর্তি হতো। নিজেকে বড় একা, অসহায় মনে হলো।

স্কুলের চৌকিদার সুব্রত হাওলাদার আমাদেরকে, প্রধান শিক্ষক সুভাস চন্দ্র দেব এর খাস কামরায় নিয়ে গেলেন। স্যার আমাদেরকে দেখে হাত তুলে বললেন- ‘আদাব’। শব্দটি আগেও শুনেছি তবে নিজে কোনদিন কারো প্রতি ব্যবহার করিনি। ভেতরে দুষ্ট হাসি চেপে রেখে মনে মনে বললাম, এখানে ছাত্ররা হিন্দু মুসলমান চিনে আদাব-সালাম বলে কীভাবে? আমি যদি না চিনে ভুলে হিন্দু স্যারকে সালাম আর মুসলমান স্যারকে আদাব বলি তা হলে কী হবে? স্যার টুকটাক আমার মৌখিক পরীক্ষা নিচ্ছেন, এমন সময় বাহিরে শুনা গেল জাতীয় সঙ্গীত। স্যার উঠে দাঁড়ালেন আমরাও দাঁড়ালাম। ভয় বিষ্ময়ের মিশ্র মৃদু ঝড় বুকের ভেতর বয়ে যাচ্ছে। জাতীয় সঙ্গীত শুনলে এভাবে দাঁড়াতে হয়? রুমের দরজা বন্ধ, আমরা তিনজন মানুষকে কেউ দেখছেনা তবুও দাঁড়াতে হবে? নামাজের আজান শুনে পেছনের জীবনে কত হাজারবার আজানের দোয়া পড়লাম, কিন্তু এমন অনুভুতি তো কোনদিন টের পেলাম না, জাতীয় সঙ্গীত শুনে দাঁড়ানোর মধ্যে যা পেলাম। স্কুলের শিক্ষক ছাত্র-ছাত্রীরা এ দেশকে এত ভালবাসেন, এই পতাকাকে তারা এত শ্রদ্ধা করেন? কওমী মাদ্রাসাগুলো কি বাংলাদেশকে ঘৃণা করে? কেন সেখানে পতাকা নেই, জাতীয় সঙ্গীত নেই? আগামীকাল আমিও সকলের সাথে লাইনে দাঁড়িয়ে জীবনে প্রথমবারের মত জাতীয় সঙ্গীত গাইবো। সেদিনের অভুতপূর্ব অনুভুতি ভাষায় ব্যক্ত করা যায়না। জাতীয় সঙ্গীত শেষে স্যার আমাকে তার শেষ প্রশ্নটি করলেন- ‘স্কুলের পাশে একটি ফুলের বাগান আছে, বাক্যটির ইংরেজি কী হবে’? আমি উত্তর দিলাম- ‘Flower garden near school’. স্যার মুচকি হেসে বললেন- ‘কিছুটা ভুল হয়েছে, অসুবিধে নেই, বীজ গণিত আর ইংরেজীতে তোমার একটু অসুবিধে হবে, আমি সব ঠিক করে দেবো’। উল্ল্যেখ্য, কওমী মাদ্রাসায় পাটি গণিত পড়ানো হয়, বীজ গণিত পড়ানো হয়না। স্যার টেবিলের উপর রাখা পিতলের ছোট ঘণ্টার মাথায় দুটো চাপ দিলেন। ক্রিং ক্রিং করে শব্দ হলো, অমনি চৌকিদার সুব্রত হাওলাদার উপস্থিত হয়ে বললেন- ‘আজ্ঞে স্যার’। স্যার বললেন- অস্টম শ্রেনীতে গিয়ে কামালকে বলো এখানে আসতে। কামাল রুমে ঢুকে বললো ‘আদাব’ স্যার। স্যার কামালকে আদেশ করলেন, সে যেন আমাকে স্কুল ছুটির পর তাদের বাড়ি নিয়ে যায়। কামাল ‘আজ্ঞে স্যার’ বলে মাথা নীচু করে চলে গেল। বুঝা গেল জায়গীরের ব্যবস্থা নিয়ে কামাল বা তার অভিভাবকের সাথে আগেই হেড স্যারের আলোচনা হয়েছে। আগামিকাল থেকে আমিও ‘ইয়েস স্যার’ ‘নো স্যার’ ‘আজ্ঞে স্যার’ আদাব, নমষ্কার বলবো, ভেবে কিছুটা চিন্তিত হলাম। কোনদিন যা বলি নাই, নাটকীয়ভাবে এ সব বলতে গিয়ে ঠোঁটে যদি হাসির উদয় হয় তখন কী হবে? স্যার আমাকে সোজা নবম শ্রেণীতে ভর্তি করে দিলেন। জীবনে ওস্তাদ, হুজু্র‌ মাষ্টার, শিক্ষক নামের অনেক লোক দেখেছি, সুভাস চন্দ্র দেব এর মত শিক্ষক দ্বিতীয় আরেকজন দেখিনি। স্যার তাঁর নিজের লেখা একটি ইংরেজী ব্যাকরণের বই হাতে দিয়ে বললেন- ‘এক সপ্তাহের জন্যে আসরের নামাজের পর থেকে মাগরিবের নামাজের পূর্ব পর্যন্ত সময়টুকু আমি তোমাকে পড়াবো, তুমি আমার ঘরে আসবে তোমাকে এলজ্যাব্রা আর ইংরেজি ব্যাকরণ বুঝায়ে দিব’। সেখানে গিয়ে দেখি ঐ নির্দিষ্ট সময়ে দশম শ্রেণীর কিছু ছাত্রও স্যারের কাছে আসে। স্যারের কথার মধ্যে যাদু ছিল। যে কোন কঠিন বিষয়কে ভেঙ্গে ভেঙ্গে, এত সুন্দর, সহ্‌জ ধীর-শান্ত ভাষায়, উপমা, উদাহরণ দিয়ে কী ভাবে বুঝাতেন তা না দেখলে অনুমান করা মুশকিল। সকলকে অবাক করে ষান্মাসিক পরীক্ষায় ক্লাসে ৩৫জন ছাত্রের মধ্যে তৃতীয়, ও বাৎসরিক পরীক্ষায় প্রথম স্থান পেয়ে গেলাম। স্পষ্ট মনে আছে, দীনিয়াত বা ধর্ম শিক্ষার মৌলুভী সাহেব কানেকানে কৌতুক করে বলেছিলেন- এবারে ৯৯ দিলাম, পরবর্তিতে তোমার ধর্ম শিক্ষার কাগজে তুমি নিজেই মার্ক করে দিও।

বাৎসরিক পরীক্ষার পর একদিন একটি গ্রামের হাইস্কুল থেকে তাদের স্কুল কর্তৃক আয়োজিত ভলিবল প্রতিযোগীতায় অংশ গ্রহন করার জন্যে নিমন্ত্রন আসলো। মোহসিন স্যারের নেতৃত্বে আমরা প্রতিযোগীতায় অংশ গ্রহন করলাম। পুরুষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে একজন বক্তা ঐ গ্রামের নাম বললেন- ‘শহীদ নগর’। অথচ আমরা জানতাম যে, গ্রামের নাম ‘শ্রী রাম শ্রী’, বা শ্রীরামিশী। গ্রামটির নাম শহীদ নগর কেন, কীভাবে হলো, সংক্ষিপ্তভাবে বক্তা তাও ব্যক্ত করলেন। সেদিন গ্রামের মানুষের কাছ থেকে শুনেছিলাম এক লোমহর্ষক কাহিনি আর আমাদেরকে দেখানো হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সাক্ষী গ্রামের কিছু জায়গা। স্মৃতির পাতা বেয়ে বেয়ে আজ সেই কাহিনিটি শুনানোর জন্যে, আপনাদেরকে মাদ্রাসা থেকে স্কুল হয়ে এই গ্রাম পর্যন্ত এতদূর কেন নিয়ে আসলাম, তার কারণটা বলে দেয়া ভাল। সেদিন স্কুলে আসার কারণে কাহিনির ঘটনাস্থল দেখার সুযোগ হয়েছিল, আর এই ঘটনার ভিল্যেন নায়কদেরকে আমি মাদ্রাসায় পড়াকালীন সময়ে বহুবার কাছে থেকে দেখেছি।

দিনটি ছিল ১৯৭১ সালের ৩১শে আগষ্ট মঙ্গলবার, সকাল ৯টা। পূবাকাশে বর্ষাকালের অথৈ জল ভেদ করে সবেমাত্র রঙ্গীন ভোরের সূর্য উঠেছে। সিলেট জেলার, জগন্নাথপুর থানার অন্তর্গত শ্রী রাম শ্রী (শ্রীরামিশি) গ্রামের শিশু কিশোরেরা প্রস্তুতি নিচ্ছে স্কুলে যাওয়ার, কৃষকেরা গরু নিয়ে গোয়ালায় ব্যস্ত, ধীরে ধীরে নতুন সুন্দর একটি দিনকে বরণ করে নিতে জেগে উঠেছে গ্রাম। এমনি সময় গ্রামবাসী জানতে পারলেন তাদের শ্রীরামিশি বাজার পাকিস্তানী আর্মী ঘেরাও করেছে। ৯টি নৌকায় ৩০জন পাকিস্তানী আর্মী, সাথে পথপ্রদর্শক কয়েকজন রাজাকার। প্রথম নৌকা থেকে বেরিয়ে আসলেন, পথপ্রদর্শক রাজাকার-প্রধান দুই ব্যক্তি, তাদের একজন হলেন হজরত মৌলানা নূরুদ্দীন সাহেব- মুহাদ্দীসে গহরপূরী, অন্যজন জগন্নাথপুর থানার হবিবপুর গ্রামের আহেমদ আলী খান। সিলেট জেলার সকল গ্রামের কওমী মাদ্রাসার সাথে মুহাদ্দীসে গহরপূরীর গভীর সম্পর্ক। তারা গ্রামবাসীকে বাজার সংলগ্ন শ্রীরামিশি হাইস্কুল মাঠ প্রাংগনে সমেবত্ হওয়ার ডাক দিলেন। ধর্মবিশ্বাসী, গ্রামের সহজ সরল মানুষ তাদের ডাকে সাড়া দিলেন। সেদিন নারী ও শিশু ব্যতিত গ্রামের সকল পুরুষ স্কুলের মাঠে এসে জড়ো হয়েছিলেন। তাদের ধারণা ছিল অন্তত গহরপূরী মুহাদ্দীস সাহেবের উপস্থিতিতে আল্লাহর গজব নাজিল হবেনা। কিন্তু কে জানতো তিনি নিজেই যে এ গ্রামের নিরস্ত্র নিরপরাধ মানুষের জন্যে গজব হয়ে হাজির হয়েছেন। রাজাকার দলের নেতাগণ গ্রামবাসীকে বললেন যে, তারা দেশ ও গ্রামের শান্তি রক্ষার্থে একটি শান্তি কমিটি গঠন করে চলে যাবেন। ইতিমধ্যে বিশ্বাস ঘাতক আহেমদ আলী খান স্থানীয় কিছু দালালদের সহযোগীতায় আওয়ামী লীগ সমর্থক ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বেশ কিছু মানুষের নাম সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়। রাজাকারগন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, এই গ্রামে স্বাধীনতার পক্ষের কোন মানুষকে জীবিত রাখবেনা। শান্তি কমিটি গঠন করার ঘোষণা ছিল একটি মিথ্যে ধোকা, প্রতারণা। তারা তাদের প্রভু পাকিস্তানী কমান্ডারকে প্রস্তুত হতে ইংগিত করলো। ১০০ জন মানুষকে আলাদা করে স্কুল ও বাজারের মধ্যবর্তি ছোট্ট খাল পাড়ে নিয়ে দাঁড় করানো হলো। এ খালটি বিশ্বনাথ ও জগন্নাথপুর থানার সীমানা দিয়ে প্রবাহিত। পেছন দিক থেকে হাত বেঁধে দিয়ে সকলকে কলেমা পড়ার আদেশ দেয়া হলো। ভীত সন্ত্রস্ত অসহায় মানুষগুলোর অনেকেই সাক্ষাৎ মৃত্যুর সম্মুখে দাঁড়িয়ে, আপন মাতা পিতা, ভাই বোন, স্ত্রী সন্তানদের স্মরণ করে কাঁপা কণ্ঠে অস্ফুটস্বরে কিছু কথা বলেছিল, আর অনেকেই কলেমা সম্পূর্ণ পড়তে পারেনি। ততক্ষনাৎ তাদের বক্ষ লক্ষ্যভেদ করে স্টেইনগান দিয়ে ব্রাসফায়ার করা হয়। গগণবিদারী স্টেইনগানের বিকট শব্দে টিনের চালে বসা কবুতরেরা, বৃক্ষের শাখার পাখিরা উড়ে যেতে পেরেছিল। মানুষ পালিয়ে যাওয়ার পথটুকুও রাজাকারেরা বন্ধ করে দিয়েছিল। প্রায় সকলের মৃতদেহ খালের জলে অর্ধ ডুবন্ত অবস্তায় তিন দিন ভাসমান ছিল। এই নৃশংস হত্যার সংবাদ যখন ঘরে পৌছিল, তখন গ্রামের বধু তার স্বামী, মা তার সন্তানের লাশ তুলে নেয়ার আর সময় নেই। নিজ প্রাণটুকু হাতে নিয়ে যে যেদিকে পারেন পালিয়ে যান। অল্প সময়ের মধ্যেই জনবহুল শ্রীরামিশি গ্রাম জনশুন্য হয়ে যায়। সেদিন শ্রীরামিশি গ্রামের কমপক্ষে ১৩০ জন নিরপরাধ মানুষকে পাকিস্তানী আর্মীরা তাদের সহযোগী রাজাকারদের পরামর্শে হত্যা করেছিল। বাজারের প্রায় সবগুলো দোকানে কেরোসিন ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে ধ্বংস করে দেয়া হয়। বেশ কয়েকটি বাড়িও আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়। যে সকল রাজাকার এই গণহত্যা ঘটিয়ে ছিল, তারাই এক সপ্তাহ পরে জগন্নাথপুর থানার রানীগঞ্জ বাজারে অনুরূপ আরেকটি হত্যাকান্ড ঘটায়। সেখানে তারা ২৫জন মানুষকে খুন করে সম্পূর্ণ বাজার আগুনে পুড়িয়ে ধ্বংস করে দিয়েছিল।

৭০/৭১ সালে আমাদের সিলেট এলাকার গ্রামাঞ্চলে মৌলানা মওদুদী বা ‘জামাতে ইসলাম’ এর নাম অনেকেই জানতেন না। সিলেটের যে সমস্ত এলাকায় শান্তি কমিটি ও রাজাকারবাহিনী গঠন করা হয়েছিল, প্রায় সবই হয়েছিল দেওবন্দী সিলসিলার বা নিখিল ভারত জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের উত্তসুরী ‘পূর্ব পাকিস্তান জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম’ নামক দলটির উদ্যোগে। এ দলটির পশ্চিম পাকিস্তান শাখার নেতৃত্বে ছিলেন মুফতী মাহমুদ ও পূর্ব পাকিস্তান শাখার নেতৃত্বে মৌলানা মহীউদ্দীন।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ৩৮ বছর পেরিয়ে গেল, আজও একটি প্রশ্নের সঠিক উত্তর আমি পাইনি। অনেক আওয়ামী লীগ সমর্থক নেতা পর্যায়ের লোককেও প্রশ্নটি শুনে বিব্রতবোধ করতে দেখেছি। শতশত কওমী মাদ্রাসার ছাত্র, উস্তাদ এবং দেওবন্দী আলেম নামে পরিচিত রাজাকারদের নাম সিলেট জেলার রাজাকারের তালিকায় নেই কেন?, যারা শ্রীরামিশি গ্রামে ও রাণীগঞ্জ বাজারে হত্যাকান্ড ঘটিয়েছিল তারা কি যুদ্ধাপরাধী নয়? তারা আজও বহাল তবিয়তে আছে, আছে তাদের মাদ্রাসাও। যে আদর্শকে সামনে রেখে তারা সেদিন অস্ত্র হাতে নিয়েছিল, সেই আদর্শ বাস্তবায়নে ঐ সকল কওমী মাদ্রাসা থেকেই ভিন্ন ভিন্ন ইসলামী দলের নামে আজও অস্ত্রহাতে বেরিয়ে আসে আত্মঘাতী জেহাদী জংগীবাদী ইসলামী সন্ত্রাসী। আমরা কি তাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছি?

আরো কিছু তথ্য-

এখানে

এখানে