গল্প শুনে একটা বাচ্চা যতটা অভিভূত হয় একজন বয়স্ক মানুষ ততটা হতে চায় না। এর একটা বড় কারণ বাচ্চাটা সেই গল্প বিশ্বাস করে ফেলে। গল্পের ভিজুয়ালাইজেশনের জন্য এই বিশ্বাস ফ্যাক্টরটা অনেক জরুরি। সে যখন পঙ্খীরাজ ঘোড়ার কথা শোনে, তখনো হয়তো সে একটা সাধারণ ঘোড়াই দেখেনি। সে জানতে চায় ঘোড়া দেখতে কেমন। ঘোড়ার ছবি দেখানো হলে সে তার সাথে দুটো ডানা কল্পনা করে নেয়। বাইরের দেশের ছেলে-মেয়েরা ইউনিকর্নের গল্প শোনে। তার ডানার বদলে আছে শিং। কিন্তু তার পরেও সে উড়তে পারে! এবং সেটা কল্পনা করে নিতেও তাদের আসলেই কোনো কষ্ট হয় না। ওদিকে আমরা যারা আস্তে আস্তে বড় হয়ে যেতে থাকি তারা কেমন যেন বেরসিক হয়ে যাই। আমাদের গল্পে ডালিম কুমারের বদলে চলে আসে গফুর। আর পঙ্খীরাজ ঘোড়ার বদলে এসে যায় মহেষ নামের সেই রুগ্ন অনাহারী গরুটি। কারণ ততদিনে ‘বাস্তবতা’ নিয়ে আমাদের একটা খুব খুঁতখুঁতে ভাব এসে গেছে। আমাদের মধ্যে যারা আরো বাস্তববাদী তারা তো এমনকি ‘মহেষ-গফুরের’ কাল্পনিক গল্পও পড়তে চায় না। সে কারণেই আমাদের দেশে (আসলে সারা পৃথিবীতেই) গল্পের বইয়ের পাঠকের চেয়ে খবরের কাগজের পাঠক সংখ্যা বহু গুণে বেশি।

কিন্তু আসলেই কি মানুষ গল্প শুনতে চায় না? খুব চায়। মনের কোনো গহীন কোণে রবীন্দ্রনাথের সেই বালকটা, জন্মের পরেই যে বলেছিলো ‘গল্প বলো’, সে কিন্তু ঠিকই বেঁচে থাকে। ছদ্ম বাস্তবতার বেড়াজালে আটকা পড়ে তার অবস্থা অবশ্য তখন ফটিকের চেয়েও খারাপ। কিন্তু তখনও সে শুনতে চায় ডালিম কুমারের গল্প। সোনারকাঠি-রূপারকাঠির মায়াবী জগতের গল্প। বিশ্বাস করতে চায় ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর নাঁকি-নাঁকি কথা। এবং মজার ব্যাপার হলো, করেও। বহু জাতি-ধর্ম ভেদে পৌরাণিক কাহিনিগুলোর আবেদন তাই আর কমেই না। কিন্তু হায় তারা তো আর শিশুটি নেই! বাচ্চারা একটা গল্প প্রাণপণে বিশ্বাস করলেও পরক্ষণেই সব ভুলে মেতে উঠতে পারে পুতুল-পুতুল খেলায়। কিন্তু বোকা বুড়োরা আর সেই গল্পের জগত থেকে বের হতেই পারে না। সংসারের পুতুল খেলায় সে সব মিলিয়ে এক উদ্ভট খিচুড়ি পাকিয়ে ফেলে।

আচ্ছা, এসব দেখে-শুনে এই বোকা বুড়োদের উপর বেশ বিরক্তি এসে যায়, তাই না? আমারো আসে মাঝে মাঝে। তবে এক সময় বিরক্তি কেটে গেলে এক ধরণের মায়া ভর করে। দুঃখ এসে যায়। ওদের কী দোষ? ওদের ভিতরে সেই গল্প শুনতে চাওয়া শিশুটাতো মরেনি। আর না হয় বুড়ো হয়ে তারা বাচ্চাদের চেয়ে অনেক বেশি বোকাই হয়ে গেছে। গল্পকে বাস্তবতায় গুলিয়ে ফেলাই তাই নিয়তি। কিন্তু আমি বোকা বুড়োদের করুণা করার কে! আমি নিজেই কি একজন বোকা বুড়ো নই? উমম, এখানেই এসে যায় বিজ্ঞান প্রসঙ্গ। সেই গল্প শুরু করি…

কোথায় দেখেছি বা পড়েছি মনে নেই। বিজ্ঞানের প্রথম ক্লাস। বিজ্ঞান শিক্ষক কোনো কথা না বলে ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে চলে গেলেন বাইরে। কোনো বিজ্ঞান জাদুঘরেই হয়তো। সেখানে বিশাল হল ঘরে মাঝে উচু ছাদ থেকে ঝোলানো আছে একটা এলাহি সরল দোলোক। বাস্কেট বলের চেয়ে বড় একটা পিতলের বব, শক্তিশালী দড়িতে ঝোলানো (ঢাকার বিজ্ঞান জাদুঘরে এমন আছে)। হল ঘরের কিনারায় সবাইকে দাঁড় করিয়ে শিক্ষক গট গট করে হেটে চলে গেলেন সেই ববটার কাছে। তারপর সেটা টানতে টানতে নিয়ে এলেন হল ঘরের কিনারায়। এই সরে আসার কারণে ববটা তখন শিক্ষকের নাক বরাবর উচু হয়ে গেছে। শিক্ষক কোনটা বব, কোনটা কী, এসব বলতে বলতে ঠিক নাকের এক-ইঞ্চি দূরত্ব থেকে ববটাকে ছেড়ে দিলেন। কয়েক মনি গোলোকটা শাই করে ঝুলে চলে গেলো ঘরের অন্য পাশে। তার পরেই আবার প্রচন্ড জোরে ছুটে আসতে লাগলো এদিকে। ছেলেমেয়েরা একটু কুঁকড়ে গেল। কিন্তু শিক্ষক অবিচল। দেখা গেল সেই ভয়ঙ্কর ভারী ববটা এসে আবারো শিক্ষকের নাকের সেই এক ইঞ্চি দূরত্বেই থেমে ফিরে গেল। কিন্তু এমনকি চোখের পলকও পড়েনি তার। শিক্ষকের সাহস দেখে স্টুডেন্টরা তখন রীতিমত অভিভূত। এরকম কুল একজন স্যার কার না ভালো লাগে?

এর পর পিছন ফিরে শিক্ষক বললেন, ‘আমি যেই বিজ্ঞান তোমাদের শেখাবো তার উপর আমার এরকম আস্থা আছে বলেই আমি এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে ভয় পাইনি।’ আসলেই তো, শক্তির সংরক্ষণশীলতার নীতির কারণেই ঐ ববএর সেই উচ্চতার বেশি ওঠার ক্ষমতা নেই। এটা গাণিতিক ভাবেই প্রমাণিত।

তো যে কারণে এই গল্পের অবতারণা। সেটা হলো বিজ্ঞানের গল্পগুলো ঠিক এই রকমই। চমৎকারিত্বে পৌরাণিক কাহিনির চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়(যদিও এই সরল দোলকের গল্পটা একটু সাদামাটা)। আবার যতটা নির্ভরতা আমার দাবি করি তার চেয়েও অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য। তাই আমরা বুড়োরা যারা এসব গল্প শুনে বুকের মাঝে সেই গল্পশোনা শিশুটাকে জিইয়ে রেখেছি। এবং বুড়ো হওয়ার কারণেই আমাদের গল্প গুলো বাস্তব না হলে শুনতেই চাই না। তারাও পৌরাণিক গল্প আর বাস্তবতা মিলিয়ে সেই উদ্ভট খিচুড়ি পাকানোর হাত থেকে বেঁচে যাই।

এবার আসি আরেক মেরুর বুড়োদের গল্পে। এইসব বুড়োদের মধ্যেও কিছু অদ্ভুত বুড়ো আছে (আমি নিজেও মনে হয় ছিলাম সেই দলে)। যারা আবার বাস্তব গল্পে ঠিক ভরসা পায় না। এ কারণেই কোনো মুভির শুরুতে যদি বলা থাকে ‘বেসড অন আ ট্রু স্টোরি’। অমনি কেমন কেমন যেন লাগে। সত্য গল্পের চমৎকারিত্ব আর কতটাই বা হবে? আবার অনেকে আছে বিজ্ঞানের গল্প মানেই ‘ইট-কাঠ-লোহা-কল-কারখানার’ গল্প। তাতে নাকি কেমন যেন ‘রস’ নেই। ‘কাব্য’ নেই। কিন্তু আসলেতো বিজ্ঞানের গল্পে চমৎকারিত্বের কোনো অভাবই নেই। ক্লাসিক্যাল ফিজিক্সের জগতে যেমন ডালিম কুমারের পঙ্খীরাজ ঘোড়া আছে। তার উড়তে ডানা লাগে। তেমনি কোয়ান্টাম মেকানিক্সের জগতে আছে ইউনিকর্ণ যার ডানার বদলে শিং থাকলেও উড়তে কোনো সমস্যাই হয় না। ওর গাণিতিক সূত্র গুলো, প্রকৃতির নিয়মগুলো আপনার কল্পনার ডানাকে বাঁধে না, বরং আকাশ ছাড়িয়ে মহাকাশে ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ করে দেয়।

তবে বিজ্ঞানের গল্পের একটা দাবি আছে। চর্চার দাবি। ওর গল্পগুলো অনেক কাব্যকথার চেয়েও সুন্দর হলেও সে গল্প উদঘাটনের পিছনে আছে বেশ কঠিন আর দীর্ঘ্য চর্চার ইতিহাস। যে সব গাণিতিক নিয়ম বাস্তবতার সাথে গল্পের অলঙ্ঘনীয় যোগসূত্র তৈরি করে তাদের আয়ত্ব করতে চাই জোর সাধনা। অবশ্য শুরুতে এসব সাধনা-টাধনা বেশ খটমটে ব্যাপার মনে হলেও। এর মধ্যেও গল্পের শেষ নেই। তাই আমরা পড়ি একটা দ্বৈত অবস্থায়। আমি যদি ভিতরের গণিত না জেনে শুধু বিজ্ঞানের গল্পই শুনতে থাকি। তাহলে সেই গল্পে আমার বিশ্বাসের জোর ওই পৌরাণিক কাহিনি বিশ্বাসীদের মতই হয়ে যায়। তাই শুধুই ‘বিজ্ঞানের গল্প শোনা’ কোনো কাজের কথা নয়। আবার আমি হয়তো একজন জীব বিজ্ঞানী, তাই বলে কি কোয়েজার নিয়ে, সুপারনোভা নিয়ে, পদার্থের পঞ্চম অবস্থা- বোস-আইন্সটাইন কন্ডেন্সস্টেট নিয়ে মজার কথা আমি শুনবো না? হ্যা শুনবোই তো! গাণিতিক খুটিনাটিকে বাদ দিলেও বলার মত অসংখ্য গল্প আছে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সব শাখাতেই। সে গল্প প্রায়ই অতি সরলীকরণের দোষে দুষ্ট হলেও, ওগুলো বলা হয় বলেই কোনো কিশোর তার উচ্চতর গণিত বইটা নিয়ে বসে। যে সমীকরণটা কিছুতেই আয়ত্ব করতে পারছিলো না। সেটাকে নিয়ে পড়ে থাকে। কারণ এই দরজা পেরোলেইতো ডানা মেলার অবারিত আকাশ! আর সেই গল্প শুনতে চাওয়া শিশুটা, তাকেও কি ভুললে চলে?

তো বুঝলাম যে গল্প না শুনে আমাদের উপায় নেই। আর এসব গল্পের মধ্যে এমনকি সব চেয়ে আজব গল্পটাও আমাদের বলতে পারে বিজ্ঞান। কিন্তু সেই গল্প আমরা বলব কেন? না হয়, গল্প শোনা সবার প্রাণের দাবী। কিন্তু গল্প বলার কী দরকার? যারা বলে তার কেন বলে? এ বিষয়ে কোনো গবেষণা তো করিনি। তবে আমার ধারণাটা আমি বলতে পারি। আমার মতে যারা গল্প বলে। তাদের দুইটা বৈশিষ্ট্য। প্রথমত, এরা গল্প শুনতে ভালো বাসে খুব। এমনকি বেশিরভাগ সময়ই অন্য আর দশজন গল্প শ্রোতার চেয়েও বেশি। কিন্তু আশে পাশেই তো এমন অনেককেই দেখি। সব সময় নতুন কিছু পড়ছে-শুনছে, উপভোগও করছে অনেক। কিন্তু লিখতে বা বলতে বললে তারা বলবে, ‘নাহ আমার গল্প শুনতেই ভালো লাগে বেশি।’ না, এ আচরণকে ঠিক ‘শুনে শুনে মজা লুটছে শুধু’ এমন স্বার্থপরতা ভাবার কারণ নেই। এটাকে বলা যেতে পারে মিরর নিউরনের দুর্বলতা। আর এখানেই আসে গল্প বলিয়ের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য। যে গল্প বলে সে জানে গল্প শুনতে তার নিজের কত ভালো লাগে। আর তার বলা গল্প যখন আরো দশজন শোনে। তখন বলিয়ের মিরর নিউরন তাকে শ্রোতার সাথে একাত্ব করে ফেলে। যাকে বলে এম্প্যাথি। আর তখনই সে ঐ দশজনের ভালো লাগাটা অনুভব করে নিজের মনে। তাই গল্প বলাটাও আসলে তার গল্প শোনার আনন্দকে কয়েক গুণে বাড়িয়ে নেওয়ারই একটা উপায়। তাই মিরর নিউরনের অ্যাকটিভিটর মাত্রা অনুযায়ী কেউ কেউ হয়ে ওঠে স্বভাব গল্প বলিয়ে। আর কেউ শ্রোতা।

যাই হোক, ভেবেছিলাম মজার কিছু গল্প বলব। কিন্তু শুরু করার আগে মনে হলো ‘গল্প কেন বলব’ আর ‘কেন শুনবো’ তাই নিয়েই যা মনে আসে লিখতে থাকি। তাই ‘গল্প-গল্প’ করে মাথা খারাপ করে দেওয়া, এই লেখাটাকে মূল গল্প শুরুর আগে শুধুই একটা বিরক্তিকর ‘দোহাই’।