জুন জুলাই মাসে বৃষ্টি হবার কথা।কিন্তু বেশ অনেকদিন বৃষ্টির নামগন্ধ নেই।সন্ধা হলে ঘরেঘরে হারিকেন জ্বলে।তবে সলতেটা খুব কমানো থাকে। বিশাল বিশাল কাঁচের জানালায় কাগজ আঠা দিয়ে সেঁটে দেওয়া। দরজার উপরে যথারীতি “লাই ইলাহা ইল্লা আন্তা” সুরা লিখে টাঙ্গানো।
আজ আকাশ জুড়ে মেঘ করেছে।কয়েকদিন অসহ্য গুমোটের পর মনে হয় বৃষ্টি নামবে।চারদিকে তার ঘনঘটা।বৃষ্টি আমার সব সময়ই প্রিয়। দমকা বাতাস দিলো।মা, আমরা সবাই ছোটাছুটি করে জানালার কাঁচ বন্ধ করে দিলাম।
রাত নামলেই আমাদের একমাত্র রেডিও যে রেডিওটা বড়ভাই বুয়েটের হল থেকে পালাবার সময় এনেছিল ওটা খুলে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসি সবাই। প্রধান আকর্ষণ “চরম পত্র” শোনা। এরপরে নব ঘোরানো শুরু,রাত দশটায় বিবিসির ভালো খবর পাওয়া গেলো। এদিক ওদিক রেডিওর নানান শব্দ নানা আওয়াজ আসতে থাকে।
কখনো পিকিং রেডিও ‘চ্যাং প্যাং’ শব্দ। ঐ দিন কিছুক্ষণ পর আর রেডিও শোনা গেলোনা। কারণ ট্রাঞ্জিস্টারটা ব্যাটারি চালিত। ব্যাটারি শেষ হয়ে গিয়েছিল। সবার মন খারাপ হয়ে গেলো।রাতে সবাই খেয়ে তাড়াতাড়ি বিছানায় চলে গেলাম।
বাবার মুখে,বা অনেকের মুখেই শোনা যায়,লোকজন বাক্স প্যাটরা নিয়ে কোথায় যাচ্ছে। কে যে কোথায় যাচ্ছে তার ঠিক ঠিকানা নেই।যে শহরে আছে,সে গ্রামে যাচ্ছে, শহরে অনেকে এ জায়গা থেকে সে জায়গা বদল করছে।
অনেক পরিবারে বড় মেয়ে থাকলে তড়িঘড়ি বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে বাবা,মায়েরা।এর কারণ আজো অজানা।মা,বাবার রক্ষনাবেক্ষণে থাকলেই ঐ মেয়েটির বিপদ,আর স্বামী থাকলেই বিপদ হবেনা এইটাই কী যুক্তি?
যদি তাই হয় কেমন যেনো মনে হল খোড়া যুক্তি।হয়তো এমন হতে পারে মেয়েদের বোঝা মনে হচ্ছিল।আর কুমারী মেয়ে ধর্ষণ মানে বাবা,মায়ের মান ইজ্জতের ব্যাপারটাও উড়িয়ে দেওয়া যায়না।
কারফিউ শিথিলের পর রেডিওর ব্যাটারি কিনে আনলো মেজভাই। দিনগুলো এভাবেই চলে যাচ্ছে। কত খবর কানে আসে।হিন্দুদের ওপর পাকসেনাদের অত্যাচার চরম আকার ধারণ করছে।রাস্তা ঘাটে কাপড় খুলে দেখে কে মুসলমান কে হিন্দু,যদি একটু সন্দেহ হয়। ২৫ মার্চ রাত্রেই তারা অধ্যাপক জি,সি দেব সহ আরো অনেক বুদ্ধিজীবি কে হত্যা করে। পুরান ঢাকার লক্ষী বাজার,তাঁতী বাজার শ্বশানে পরিণত হয়েছে।
পর্ব[৭]
আমার মেজ ভাই সেই সময় মাওসেতুং ভক্ত ছিল। বেচারা সব বইগুলো বাড়ি বদলের সময় পুকুরে ফেলে দিয়েছিল। কী জানি কী হয়। শুনেছি পাশের বাড়িতে ২৬ মার্চের ঐ ভয়াল দিনে মিলিটারি নাকি ঢুকে দেখে শেখ মুজিবের ছবি।ওমনি তারা ফটো পায়ে দুমড়ে বলে “ শালা এইয়ে তুমহারা বাপ হ্যায়?”
আবার কোথাও শান্ত সৌম্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাড়িওয়ালা ছবি দেখে খুশি হয়ে যায়। “ঠিক হ্যায় ইয়ে লোগ সাচ্চা মুসলমান হ্যায়”। তা মেজভাই হয়তো বই হারানোর দুঃখে মাঝে মাঝে ফোঁস-ফাঁস করে। এমন নানা কথা নানান উড়ো খবর শোনা, স্নান করা,খাওয়া আর এক ধরণের উৎকন্ঠায় দিনগুলো ক্রমশঃই অসহনীয় হয়ে গেলো।
বড়বোনের মেয়ে আধো আধো কথা বলে তখন।আমার ছোট বোন তার থেকে বছর খানেকের বড়।দুজনার খুনসুটি দেখি।
শুরু হলো আমার আর এক ফুফুর আনাগোনা। তিনি এলে আমরা সবাই ভয়ে সিঁটিয়ে থাকতাম। ঘোর ইসলামপন্থী এবং পাকিস্তানিদের সমর্থক ছিলেন।
আসলে জুন মাস থেকে রাজাকারবাহিনী ভালোমতোই তাদের সংগঠন তৈরি করে। তখন কে যে রাজাকার, কে তাদের গুপ্তচর বুঝা মুশকিল।তাই কারো পাকিস্তানি সমর্থন দেখলেই ভয় লাগে। ফুফু নানা সুরা কালাম মাকে শিখিয়ে দেন।মা মন দিয়ে তা শুনে।ফুফু বলে,
–দেখো আখেরাতে এই সব কাজের হিসাব দিতে হবে।
–হ্যাঁ বুবু আমি সব শিখে নিচ্ছি।মা আখেরাতের ভয়ে নাকি ফুফুর ভয়ে বিড়বিড় করতেন সুরা।
তো তিনি আমাদের বাড়ির খুব নিকটে থাকায় তাঁর আনাগোনা আমাদের পরিবারে ভীতিকর হয়ে গেলো।
কারফিউ তখন শিথিল করে সন্ধার পর শুরু হয় আবার। তাই সন্ধার আগেই সবাই যারযার বাইরের কাজ তাড়াহুড়ার মাঝে শেষ করে।
সকাল বেলা মা বোনেরা মিলে নাস্তা বানায়। একই খাবার রোজ খাই। কড়াই ভর্তি আলু ভাজি আর রুটি।
শুকনো রুটি মাঝে মধ্যে গলা দিয়ে নামতোনা।
রেডিওর ব্যাটারি কেনার পর আবার আমরা যথারীতি খবর শুনতে লাগলাম।আমি কখনো শুনি আবার কখনো
শুনিনা। এ গাছ থেকে সে গাছ কী কী ফল ধরেছে খুঁজে বেড়াই।পাশের বাড়ির একটা মেয়ে মাঝে মধ্যে আমাদের বাড়ি আসে।আমি কাপড়ের পুঁটুলি খুলে পুতুল বানাই। একটা বাক্স ছিল আমার পুতুলের।সেই বাক্স খুলে রোজ মিছিমিছি রান্না বান্না খেলি।
একদিন বাবা অফিস থেকে এসে জানালেন দেশের অবস্থা ক্রমশঃই খারাপের দিকে যাচ্ছে।বাবা সরকারি চাকরি করেন,হানাদার বাহিনীর আক্রমন শুরুর বেশ ক’দিন বাদেই আবার অফিস করা শুরু করলেন।
বাবা ভেসপা নিয়ে নারায়নগঞ্জ অফিস করতে যেতেন।বাবা বলেন—“রাস্তায় মাঝে মধ্যে কতো যে লাশ দেখি
সব মনে হয় বেওয়ারিশ।চিন্তার ছায়া তাঁর চোখে মুখে।কাপড় ছেড়ে হাত মুখ ধুয়ে রেডিও শুনতে লাগলেন।মা বাবার চিন্তিত চেহারা দেখে জিজ্ঞেস করলেন “—কী হয়েছে?রাস্তায় কী কোন ঝামেলা?
–নাহ ইয়ে ঝামেলা হয়েছিল,বলেন তিনি,
–আমি যাচ্ছি ভেসপা নিয়ে।একজন ট্রাফিকের ইশারায় ব্রেক করি, একটা জীপ বাঁশি বাজাতে বাজাতে যাচ্ছিল। হঠাৎ থেমে আমাদের ক’জনকে চেক করা শুরু করে।গাড়িতে ছিলো মিলিটারি সহ রাজাকারের দল।
আমি ঘামতে শুরু করেছি। এ আবার কোন বিপদে পড়লাম।
সবাইকে চেক করলো, আমার আইডেন্টি কার্ড দেখে ছেড়ে দিল।আমার আমার চোখের সামনে ক’জনকে চোখ বেঁধে পিছমোড়া করে হাত বেঁধে নিয়ে গেলো”বাবা থামলেন।
–পানি দাও তো ।
মা দেখে বাবার কপালে চিকন ঘাম।
–থাক,কাল থেকে অফিস যাবার দরকার নেই।
–অফিসে না গেলে তো আরো বিপদ।তারা মনে করবে আমি পালিয়ে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছি, তাছাড়া টাকা?টাকা তো লাগবে।
তাইতো, এতো বড়ো সংসার।বাবার কাঁধে সবার বোঝা।সবাইকে অন্ততঃদুই বেলা খাবারের জোগান তো দিতে হবে।
মলিন হয়ে গেল সবার মুখ।তাইতো,আমাদের তো অফুরন্ত রাজভান্ডার নেই।অন্ন,বস্ত্র বেঁচে থাকার জন্য যা দরকার কে দিবে? এখানেতো আমাদের গ্রামের বাড়িও নেই।যে দেশে গিয়ে নিশ্চিন্তে বসে খাবে সবাই।মা লক্ষ্য করল বাবার কাপড়ে লাল লাল ছোপ। জিজ্ঞেস করতেই বাবা বলেন,
–এক মিলিশিয়া আর্মি থু করে পানের পিক ফেলে গাড়ি থেকে বাবার কাপড়ে,সেই দাগ লেগে আছে।
বিবর্ণ ব্যথায় মায়ের মুখ সাদা হয়ে গেল।পরম যত্ন নিয়ে বাবার শার্ট প্যাণ্ট ধুয়ে তারে সুখাতে দিলেন।কিছুপরেই কারফিউ শুরু হবে। সন্ধ্যা হয় হয় তখন।
পুরনো কাপড় দিয়ে তৈরি পর্দা ভালোমত ঢেকেঢুকে ঠিকঠাক করতে লাগল,বড় বোন আর মেজ বোন। বাইরে যেনো আলো না যায়। একগামলা মুড়ি এলো সর্ষের তেল,কাঁচা মরিচ,পেঁয়াজ দিয়ে মাখানো। আমরা ক্ষুধার্থের মত গোগ্রাসে গিলতে লাগলাম মুড়ি। অমৃতের মত লাগলো খেতে।
রেডিওতে বলা হচ্ছে দেশের অবস্থা এখন সম্পুর্ণ স্বাভাবিক। কয়জনের সাক্ষাতকার দিলো।এর মধ্যে দিনমজুর, রিকশাওয়ালা,অফিস যাত্রি সবাই ছিল।জানা গিয়েছিল পরে, সবাইকে ধরে এনে বন্দুকের মুখে যে ভাবে শিখিয়ে দেওয়া হয়েছে,তাই তারা ভয়েভয়ে তোতাপাখির মত বলে গিয়েছে।
লালরঙের ট্রাঞ্জিস্টারের দিকে সবাই তাকিয়ে আমরা।মনে হচ্ছে কে যেনো এখনই কথা বলে উঠবে। পাওয়া গেলো স্বাধীন বাংলা বেতার।সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ল ট্রাঞ্জিস্টারের উপর। আমি যাই বুঝি না কেনো,সব চাইতে ভালো লাগতো”চরম পত্র”।কি দারুণ উত্তেজনা নিয়ে সবাই শুনতে লাগলো।
একটু পরে পেছনের বারান্দায় দাঁড়ালাম। বাতাসে আমার ছাপা ফ্রক উড়তে লাগলো।
পর্ব[৮]
নানীর বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছিলাম ঠিকই,কিন্তু থেকে থেকেই নানীর জন্য মন কেমন করতো।ওখানে থাকা অবস্থায় এতো বিপদের মধ্যেও একধরণের শান্তি-শান্তি ভাব মনে হয়েছিলো।
নানীকে জিজ্ঞেস করতাম,
–নানাভাই কবে আসবেন? তিনি চোখের জল মুছতেন আর বলতেন,
—দোয়া করো বু’জান তোমার নানাভাই যেখানেই থাকুন যেনো ভালো থাকুন।
এখানে বলে রাখা দরকার। আমার নানাভাই ছিলেন বুদ্ধিজীবিদের মধ্যে অন্যতম শীর্ষস্থানীয় একজন। আর আমার মায়ের বড় মামা ছিলেন নানাভাই। আমার মা ছোট বেলা থেকেই কোলকাতায় এই নানীর বাড়িতেই মানুষ হয়েছিলেন।
মা’কে অল্প বয়সে যখন আমার নানা (মায়ের বাবা) নিয়ে এসে বিয়ে দিয়ে দিলেন,তখন এই নানী তার ঘোর বিরোধিতা করেছিলেন।মা কোলকাতায় সেই আমলে পর্দা ঢাকা গাড়িতে চড়ে স্কুল যাতায়াত করতেন।
নানাভাই (মায়ের বড়মামা) ঐ সময় কোলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রিন্সিপ্যাল ছিলেন।
সম্ভবতঃ আমার নানাভাই’ই প্রথম মুসলিম প্রিন্সিপ্যাল প্রেসিডেন্সি কলেজের এবং শেষ প্রিন্সিপ্যাল।
১৯৪৭ এর পরে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গার সময় ভারত সরকার তাঁকে (নানাভাইকে)পূর্ণ নিরাপত্তা সহকারে পাকিস্তান পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর জীবনের নিরাপত্তার জন্য। পরবর্তিকালে পূর্বপাকিস্তান(তৎকালীন) এসে আবার তাঁর বিজ্ঞান গবেষনায় নিয়োজিত হয়ে পড়েন।
নানীর এক বিশ্বস্ত কাজের লোক ছিলো আল্লারাখা। সে ছিলো নানীর প্রধান সংবাদ সরবরাহকারী।প্রতিদিন এসে নানীর কাছে হাজির হত।আর নানী তার কাছ থেকে যে সংবাদ পেতেন তাতে তাঁর মেজাজ আরো সপ্তমে চড়ে যেতো। বড় ভাই আল্লারাখা এলেই বলতো,–“এই এলো নানীর বিবিসি”। আমরা তাই নিয়ে হাঁসা-হাঁসি করতাম।
আল্লারাখার সংবাদ মানেই নানীর কাছে মূল্যবান সংবাদ। আল্লারাখা দুনিয়ার খবর সত্য মিথ্যে যা মনে আসতো আর নানীর মন পাওয়া যেতো তাই’ই নানা রঙ্গে রাঙ্গিয়ে পরিবেশন করতো। শুকনা হাড্ডিসার, উস্ক খুস্ক চুল আল্লারাখার। নিচের পাটির দাঁত কামড়ে কথা বলতো। আর সব কথায় জানাতো নিজে চোখে দেখে এসেছে। নানী অবাক বিস্ময়ে শুনতেন। নানী সন্দেহ করলে অবলীলায় কিরে কসম কাটতো।
তবুও আল্লারাখার সংবাদ মানেই নানীর কাছে মূল্যবান সংবাদ।
নানী এর পরে শুরু করতেন বড় ভাইকে,মেজ ভাইকে দিয়ে বাগানের বিভিন্ন কাজ দেওয়া।যেনো ভাইরা কেউ ঘরের বাইরে কোনো অজুহাতে যাবার সুযোগ না পায়।
এমন ভয়াবহ অবস্থায় যখন নানী্র বাড়িতে উৎকন্ঠায় আমরা এক’একটা দিন পার করছি,তখন পাশের বাড়িতে পর্দার ফাঁক দিয়ে দেখতাম কি আনন্দ উৎসব চলছে। সন্ধ্যা বেলায় প্রতিদিন গাড়ির ভিঁড় লেগে যেতো।গান,বাজনার শব্দ নানা হাঁসিতে মুখরিত বাড়িটার কী রহস্য ছিলো আজো কেও জানেনা। কেউ ভয়ে জানবার চেষ্টাও করেনি। এমন অনেক কারণই জানতে পারা যায়না কোনোদিন ।
বিকেল বেলা ভীষণ খিধে পেতো।তখন আমার মামাতো বোন নতূন এক খাবার আবিষ্কার করে।
আলুসেদ্ধ করে টুকরা-টুকরা করতো ছোটো করে,তাতে জিরে গুঁড়ো আর তেঁতুলের পানি দিয়ে বলত
–খাই চলো আলু চটপটি- ।আমরা মেয়েরা সবাই মিলে আগ্রহে খেতাম।
নানীকে দেখেছি দোতালার বারান্দায় চিক (একরকম পর্দা,বাঁশের তৈ্রি ছোটছোট চিকন ফ্রেমে) ফেলে লাঠি হাতে বসে থাকতেন। হয়তো আগামীকাল আল্লারাখা কোনো লাশের খবর আনবে বা মিলিটারি গতিবিধির খবর আনবে সেই আশায় থাকতেন। নানীর কাছে বিবিসি,অস্ট্রেলিয়ার খবর হার মেনে যেতো আল্লারাখার খবরের কাছে। খবর পরিবেশন করে আল্লারাখা একপ্লেট নাস্তা বা ভাত খেতো ভরপেট। চলে যেতো পরের দিন আসবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে।
সেই নানাভাই, ও নেই,নানী ও নেই।কালের অমোঘ নির্দেশে আজ তাঁরা পৃথিবীর ধরাছোঁয়ার বাইরে।
নানীর মৃত্যু খবরে আমার মা যতো ভেঙ্গে পড়েছিলেন,ততোটা নিজ মায়ের ক্ষেত্রে দেখিনি। বাবা যে কোনো পরামর্শ নানাভাই ছাড়া নিতেন না । বড় ভাইয়ের বুয়েটে পড়ার সিদ্ধান্ত নানাভাইয়েরই দেওয়া ছিল।
পর্ব[৯]
বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলাম কতক্ষণ খেয়াল নেই। নানীর কথা মনে হতে চোখে অশ্রু নামলো।জানিনা নানী একা-একা কী করছেন।
দেশ ক্রমশঃই খারাপের দিকে যাচ্ছে। রাস্তা ঘাট অনেক খালি হয়ে যাচ্ছে। মনে হয় কোথাও উৎসব লেগে গিয়েছে,আর সব ঢাকাবাসী সেই উৎসবে যোগ দিতে দৌড়াচ্ছে। এমনই পরিস্থিতি কালকে কী হবে কেউ জানে না। রোজ বাবা অফিসে যায়, মায়ের মুখ শুকিয়ে আমসি হয়ে থাকে। বারেবারে বোনকে,ভাইকে জিজ্ঞেস করে,
–এই দেখো তো কয়টা বাজে? উৎকন্ঠা চেপে রাখে কণ্ঠে,কিন্তু চেহারায় বুঝা যায় স্পষ্ট।
কতক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। হঠাৎ, চোখে ভেসে উঠল
আগুনের ফুলকি। আমরা শবে-বরাতে হাউই উড়ানো দেখেছি, ঐ রকমই হাউই উড়ছে আকাশে। চারদিক আলোয় আলোময়। ঘড়-ঘড় করে ও কী চলছে? বারান্দায় ঝুঁকে আমরা মহাখালির বাড়িতে দাঁড়িয়ে আছি।
কে যেনো বলে উঠলো—ঐ যে– ঐ গুলো ট্যাঙ্ক। ট্যাঙ্ক? সে আবার কী? যুদ্ধের সময় ট্যাঙ্ক বের করে সেনাবাহিনী যুদ্ধ করে। তবে এখন আবার কোন দেশে যুদ্ধ লাগলো?
শোঁ-শোঁ শব্দ কোথা থেকে যেনো আসছে,তার সাথে লোকজনের আর্ত চিৎকার। আলোর ঝলকানিতে সবার চোখ ঝলসিয়ে গেলো,মাগো এই সব কী?
ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসলাম।পাশে মেজ আপা, আমি ভয়ে হাঁপাচ্ছি। মেজ আপা বলে,
–কী হয়েছে?স্বপ্ন দেখেছো?
– পানি—পানি খাবো,হাত বাড়ালাম পানির জন্য। ৭১ এর ২৫ মার্চের ভয়াল স্বপ্ন আজো দেখি,আজো ভয়ে ঘুম ভেঙ্গে যায়। বোনকে জিজ্ঞেস করি,
–দেশ কী স্বাধীন হবে আপা?
–কী জানি হয়তো হবে,অন্যমনষ্ক জবাব দেয় আপা।
বড় আপার মেয়ে আধো-আধো কথা বলতে শিখেছে। আমার ছোট বোন আর আপার মেয়ে দু’জনা সারাদিন ধূলোবালি নিয়ে খেলা ধূলা করে।ক’দিন আগেই মিটিং মিছিল হতো।রাস্তায় মানুষের মুখে শ্লোগান-
“ইয়াহিয়ার চামড়া
তুলে নেবো আমরা “
অথবা,
“তোমার আমার ঠিকানা
পদ্মা মেঘনা যমুনা”
ঐদিন খেলতে খেলতে বড়াপার মেয়ে আধো মুখে বলে ওঠে,
“জয় আংগা’(জয় বাংলা)। বড় আপা মুখ চেপে ধরে।বাচ্চা কী বলছে? কেউ শুনে ফেলে যদি নির্ঘাত বিপদে পড়বে সবাই।
রোজ ফুফু ময়লা কাপে চা খায় চুক-চুক করে আর সন্দেহের চোখে তাকায় সবার দিকে।
নিরাশা আর হতাশা ক্রমশঃ অন্ধকারের মতো সবাইকে গ্রাস করে।উৎকন্ঠায় মাঝে মাঝে বমি পায়।
বুকের ভেতরে পুরোনো মর্চে ধরা দরজা,ভাঙ্গা জানালার ভেঙ্গে পড়ার মড়মড় শব্দ শুনি।
[চলবে]
নানা কারণে আজকাল মুক্তমনা নি্য়মিত দেখা হয় না। তবে আফরোজার ফানুসটা আমি মিস করতে চাই না।
কারণ হচ্ছে, আমি যেন সময় ভ্রমণে চলে যাই। সেই সব ১৯৭১-এর দিনগুলি আফরোজা যেন আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাক দেয়।
আসলে কোন ্বাঙালী ্সেইসব দিনরাত্রি ভূলতে পারবেনা। আফরোজার লেখাটা মনে হচ্ছে যেন উপন্যাসের দিকে মোড় নিচ্ছে–এটা খুবই ভাল কথা।
@আবুল কাশেম,
আসলে সময়ের ঘড়ির গাড়িতে চেপে আমিও যেনো কোথায় চলে যাই। তখন মনে হয় এইতো সে দিনের কথা, নিজের বয়স যে বেড়ে যাচ্ছে খেয়ালই থাকেনা। কী আশ্চর্য!
@আবুল কাশেম,
আমারও তা’ই মনে হয়।
আফরোজাকে – :rose2: :yes:
@আকাশ মালিক,
দেখা যাক,কোথায় যায় শেষ পর্যন্ত।
ভাল লাগছে, লিখতে থাকুন। শুধু একটা প্রশ্ন, এই পর্বটা আপনি আত্মজীবনীর মত লিখছেন, প্রথম পর্বটাও কি তাই ধরতে হবে?
@দীপেন ভট্টাচার্য,
আপনার ভালোলাগার জন্যে ধন্যবাদ। আপনার প্রশ্নের জবাব “হ্যাঁ,ধরে নিতে পারেন”
মুগ্ধ হয়ে পড়ে গেলাম, কেবল মনে হচ্ছে পুরো ৭১ পর্ব যদি একসাথে পাওয়া যেত।
চিন্তা করে দেখুন না?
@আদিল মাহমুদ,
আপনি বলছেন,
“ মুগ্ধ হয়ে পড়ে গেলাম, কেবল মনে হচ্ছে পুরো ৭১ পর্ব যদি একসাথে পাওয়া যেত।
চিন্তা করে দেখুন না? ”
আমি খুশি হতাম এক সাথে পোষ্ট করতে পারলে। কিন্তু,তা অনেক দীর্ঘ হয়ে যাবে। মুক্ত-মনায় মনে হয় এক মাত্র ই-বই ছাড়া সম্ভব না। জানিনা আমার ধারণা ভুল কীনা।কেননা,”ফানুস” ১ খণ্ড ২ খন্ড এক সাথে করলে ধীরে ধীরে উপন্যাসে আকার নিচ্ছে। ইচ্ছে থাকলেও পারছিনা যে।
আসলে কোথায় গিয়ে শেষ হবে দেখা যাক।
আফরোজা আলম,
ধন্যবাদ বদলে দেওয়ার জন্যে। জন মানুষ আর সচেতন লেখিকা তো এক নয়।
আফরোজা আলম,
আমার এ গন্ডগোল শব্দটায় একটু আপত্তি। যদিও আমার নরসিংদি এলাকায় ১৯৭১ সালকে ইতিবাচকভাবেই গন্ডগোল বলে থাকে। বৃহত্তর জনগোষ্ঠির মুখে , লোকমুখে ,গন্ডগোল শব্দটি শুনে কোন রকম নেতিবাচক লাগে না।
এখানে গন্ডগোল শব্দটি আমার কাছে ভাল লাগছে না।
লিখুন। ১৯৭১ কে যারা দেখেছি প্রত্যেকেরই উচিত নিজের অভিজ্ঞতা লেখার।
@গীতা দাস,
আপনি বলেছেন,
“এখানে গন্ডগোল শব্দটি আমার কাছে ভাল লাগছে না।”
কাউকে বা কোন ব্যপারকে ছোট করে দেখানোর কারণে আমার এই লেখা কি মনে হচ্ছে?
নরসিংদিতে ,
“ বৃহত্তর জনগোষ্ঠির মুখে , লোকমুখে ,গন্ডগোল শব্দটি শুনে কোন রকম নেতিবাচক লাগে না।”
খুব অবাক হবার হলাম। আর আমার একটা মাত্র শব্দে আপনার আপত্তি। বদলে দিলাম। দেখুন ঠিক আছে কীনা।
সুপ্রিয় পাঠক,
৭১ দিনলিপি কেবল ঐ সময় যা যা দেখেছি, শুনেছি বা যতোটুকু স্মরণে আছে,(ছোট বেলাকার স্মরণ শক্তির তীব্রতা পরিক্ষা দিচ্ছি), বাকী মা বোন কে দিনক্ষণ জিজ্ঞেস করে লিখে যাচ্ছি।নাই এতে কোন তত্ত্ব পরিবেশন, নাই ধর্ষিত বাঙ্গালি নারীদের পরিসংখ্যন।যেটা পাবেন,আনুমানিক হিসেব, আর সেই সময়ের ভিত্তিতে ঢাকা শহরের যারা অবরুদ্ধ ছিলেন তাঁদের একএক জনের দিন কেমন গিয়েছে। তবু চেষ্টা চালিয়ে যাব আরো কিছু তত্ত্ব সংগ্রহের। আমার এই লেখা একান্তই সদামাটা একএক দিনের বা সপ্তাহের বর্ণনা পাবেন। হয়তো পাবেন না কোনো রাজনীতির ছোঁয়া বাকি আপনাদের সু-চিন্তিত মতামত।
@আফরোজা আলম, ভালো লাগছে আপনার এই ৭১ এর দিনলিপি পড়তে। ছোট বেলার স্মরণ শক্তি যে আপনার তীব্র এতে কোন সন্দেহ নাই।
@ব্রাইট স্মাইল্,
আপনি যথার্থ বলেছেন, আমি যখন বোনদের কে কিছু জিজ্ঞেস করছি, ওরাও অবাক হয়ে বলছে-
কি করে আমার এতো খুঁটিনাটি মনে আছে। আমার বড় ভাই বলছে কি করে মনে আছে।
অথচ দেখুন কালকের কথা অনেক সময় ভুলে যাই।স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসি তখন ছায়া-ছবির মত ভাসতে থাকে,তবে সময় গুলো জিজ্ঞেস করতে হচ্ছে।যখনই লিখি,ফোন করে মনে না পড়লে জিজ্ঞেস করি। আসলে যা থাকে মনের কোনে,তা কি জীবনে ভুলা যায়? যা জীবনের পটপরিবর্তন করে দেয়।তা কোনদিন ভোলা সম্ভব না । কারো না।