[জ্বলি ন’ উধিম কিত্তেই!/ যিয়ান পরানে কয় সিনে গরিবে/ বযত্তান বানেবে বিরানভূমি/ ঝারান বানেবে মরুভূমি/ গাভুর বেলরে সাঝ/ সরয মিলেরে ভাচ।…ভাবানুবাদ: রুখে দাঁড়াবো না কেন!/ যা ইচ্ছা তাই করবে/ বসত বিরানভূমি/ নিবিড় অরণ্য মরুভূমি,/ সকালকে সন্ধ্যা/ ফলবতীকে বন্ধ্যা।…কবিতা চাকমা।]
যতবারই দূর পাহাড়ে যাই, ততবারই মনে পড়ে হারিয়ে যাওয়া পাহাড়ি মেয়ে কল্পনা চাকমার কথা। আজ থেকে ঠিক ১৪ বছর আগে, ১৯৯৬ সালের ১২ জুন রাঙামাটির দুর্গম বাঘাইছড়ির নিউ লাইল্যাঘোনা গ্রামের নিজ বাড়ি থেকে অপিত হন তিনি। কল্পনা চাকমা ছিলেন হিল ইউমেন্স ফেডারেশনের সাংগঠনিক সম্পাদিকা। …
জুমঘর, ন্যাটজিও ম্যাগাজিন, ১৯৭২।
আমি তখন দৈনিক আজকের কাগজের খুদে রিপোর্টার। এক সন্ধ্যায় পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) নেতা সঞ্চয় চাকমা (পরে শান্তিচুক্তি বিরোধী ইউনাইটেড পিপলস ডেমেক্রেটিক ফ্রন্ট–ইউপিডিএফ’র দলছুট নেতা, এখন প্রবাসী) আমাকে টেলিফোনে খবর দেন, বিপ্লব, আমাদের একটি মেয়ে রাঙামাটি থেকে হারিয়ে গেছে। আমি বিষয়টি পরিস্কার করে জানতে চাই, হারিয়ে গেছে মানে? সঞ্চয় বলেন, সেনা বাহিনী অস্ত্রের মুখে তাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গেছে। …
সঙ্গত কারণেই আমি ঘটনাটি তাকে বিস্তারিত টেলিফোনে না বলার অনুরোধ করি। ওই রাতেই হাজির হই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্সের ছাত্র সঞ্চয় চাকমার জগন্নাথ হলের দণি বাড়ির ৩২৪ নম্বর কক্ষে। ওই কক্ষটি চারজন ছাত্রের জন্য বরাদ্দ হলেও গোটা দশেক পাহাড়ি ছাত্র সেখানে বাস করতেন। আমি, সঞ্চয় ও পিসিপির আরো কয়েকজন মিলে কল্পনা চাকমা অপহরণের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করি। আমি পিসিপি নেতাদের জানাই, খবরটি পত্রিকায় ব্যাপকভাবে প্রকাশ করা দরকার। কারণ এই একটি অপহরণ সংবাদের মধ্যদিয়েই সে সময়ের অশান্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের বহু গণহত্যা, গণধর্ষণ, গুমখুন, অপহরণসহ নানা মানবাধিকার লংঘনের খবর ফাঁস করা সম্ভব।
সঞ্চয় আমাকে জানান, পিসিপির প থেকে শিগগিরই একটি দল ঘটনাস্থলে যাচ্ছে। এই দলটি সরেজমিনে খোঁজ-খবর নিয়ে জানবে, কল্পনা চাকমা এখন কোথায়? আমি তাকে অনুরোধ করি, এই দলে আমাকে অন্তর্ভূক্ত করার জন্য। তিনি রাজী হন। ওই আলাপে তিনি আরো জানান, সরেজমিনে এই অপহরণ সংবাদ সংগ্রহ করার জন্য আমি যেনো তৈরি থাকি। শিগগিরই আমাকে খবর দেওয়া হবে।
এই ফাঁকে জানিয়ে রাখি, পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের (২ ডিসেম্বর, ১৯৯৭) আগে সে সময় পাহাড়ের এই সব মারাত্নক মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা প্রায়ই গণমাধ্যমে প্রকাশ হতো না। সেনা বাহিনী রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান– পার্বত্যাঞ্চলের এই তিনটি জেলার সাংবাদিকতা তো বটেই, প্রশাসন, আইন-শৃঙ্কলা, উন্নয়ন, জন-জীবনও নিয়ন্ত্রণ করতো। তাই স্থানীয়দের পে এসব তথ্য-সংবাদ প্রকাশ করা প্রায়ই সম্ভব হতো না।
তখন পাহাড়ের সঙ্গে সমতলের যোগাযোগ ব্যবস্থাও ছিল খুব নাজুক। একে পাহাড়ের পথ-ঘাট দুর্গম, তার উপর অ্যানালগ টেলিফোনের যুগ চলছে। উপজেলা পর্যায়ে এ সব ফোন মাসের পর মাস বিকল থাকে। মোবাইল ফোনের সুবিধা পাওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। এছাড়া যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করা সত্ত্বেও প্রায় পাহাড়ের এখানে সেখানে সেনা বাহিনীর সঙ্গে সাবেক গেরিলা গ্রুপ শান্তিবাহিনীর চলছে সশস্ত্র লড়াই। সব মিলিয়ে পাহাড়-যাত্রা ছিল ব্যাপক ঝুঁকিপূর্ণ।
গেরিলা নেতা সন্তু লারমার হাইড-আউটে, ৫ মে, ১৯৯৪, লেখক।
এর পরেও পিসিপি ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সংবাদ বিজ্ঞপ্তির বরাত দিয়ে জাতীয় দৈনিকগুলোতে কল্পনা চাকমা ‘নিখোঁজ’ হওয়া সংক্রান্ত কিছু টুকরো খবর প্রকাশ হয়েছিল।
এরই মধ্যে ঘটে যায় আরেক দুঃখজনক ঘটনা। কল্পনাকে উদ্ধারের দাবিতে ২৭ জুন পিসিপি তিন পার্বত্য জেলায় হরতালের ডাক দেয়। হরতাল চলার সময় বাঘাইছড়িতে পিসিপির মিছিলে নিরাপত্তা বাহিনী গুলি চালালে নিহত হন পিসিপির রূপম, সুকেশ, মনতোষসহ চারজন ছাত্রকর্মী। সংবাদপত্রে এই খবরটিও ছোট আকারে প্রকাশ হয়।
জুলাইয়ের প্রথমার্ধে সঞ্চয় চাকমা আমাকে খবর দেন, আমার যাত্রার দিনণ ঠিক করা হয়েছে। ঢাবির জগন্নাথ হলে সাাতের পর আমার গাইড ঠিক করা হয় দীলিপ কুমার চাকমা নামে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অনার্সের ছাত্রকে। দীলিপও পিসিপি কর্মী, তার গ্রামের বাড়ি বাঘাইছড়ির কাচালং নদীর পাড়ে, কল্পনাদের বাড়ির কাছেই। এ কারণে সে ওই এলাকার পথ-ঘাট খুব ভালো জানে।
এক ভোরে দীলিপসহ আরো কয়েকজন পিসিপি কর্মীর সঙ্গে আমি যাত্রা শুরু করি। তখন ঢাকার সঙ্গে তিন পার্বত্য জেলার একমাত্র সরাসরি যাত্রীবাহি যোগাযোগের মাধ্যম ছিল লক্কড়-ঝক্কড় ‘ডলফিন পরিবহন’। কিন্তু আমরা পাহাড়ের উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে নিরাপত্তার স্বার্থে ডলফিন পরিবহন এড়িয়ে চলি। গুলিস্থান থেকে মিনিবাস ধরে ফেনি পর্যন্ত পৌঁছাই। এরপর আবারো ‘পার্বতী পরিবহন’ এর মিনিবাস ধরে খাগড়াছড়ি। সেখানে থেকে চাঁদের গাড়ি (ওভারলোডেড ভাড়ার জীপ) ধরে দীঘিনালা হয়ে বাঘাইছড়ি বাজার।
এরপর দীর্ঘ পথ হেঁটে হেঁটে আমরা পৌঁছাই স্থানীয় একটি কিয়াং ঘরে (বৌদ্ধ মন্দির)। দুপুর গড়াতে শুরু করেছে ততণে। কিয়াং-এর কয়েকজন ভান্তে আমাদের কল্পনাদের এলাকা সর্ম্পকে খোঁজ-খবর দেন। পিসিপিকর্মীরা তাদের কাছে বারবার জানতে চাইছিলেন, সেখানে যাওয়াটা কতটুকু নিরাপদ? কারণ তাদের সবটুকু উদ্বিগ্নতা ঘিরে রাখে ঢাকা থেকে আসা সাংবাদিকটিকে ঘিরেই।
ভান্তেরা আমাদের আশস্ত করেন, ২৭ জুনের সংঘাতের পর কল্পনাদের এলাকা এখন শান্ত। তবে নিরাপত্তার স্বার্থে কল্পনাদের গ্রামে বেশীণ থাকা ঠিক হবে না। প্রয়োজনীয় খোঁজ-খবর নিতে বড়জোর দু-এক ঘন্টা কাটানো যেতে পারে।
এ সময় সেখানে এসে হাজির হন এক অতি বৃদ্ধা সন্যাসী। সকলে তাকে ‘সাধু মা’ বলে ডাকেন। তাঁর উচ্চারণে ফুঁটে ওঠে আদি চাকমা ভাষার বোল। তিনি ভেবেছিলেন, আমরা বোধহয় কল্পনা চাকমার উদ্ধারকারী দল। করজোড়ে কপালে প্রনাম ঠেকিয়ে তিনি বলেন, তোমরাই বুঝি ভগবান!
ওই কিয়াং ঘরেই মাদুর পেতে আমরা চাকমা ব্যাঞ্জনে সেরে নেই দুপুরের খাবার। খানিকটা বিশ্রাম নিয়েই আমরা আবার হাঁটতে শুরু করি। শেষ বিকেলের রোদে আমরা পৌঁছাই রূপকারী গ্রামে। সেখানে রূপালি প্রাথমিক বিদ্যালযের মাঠের এক কোনে মঞ্চ নির্মাণ করে পিসিপি শোকসভার আয়োজন করেছে। মঞ্চের পেছনে সদ্য নির্মিত চারটি কালো রঙের স্মৃতিস্তম্ভ মনে করিয়ে দেয় কল্পনা চাকমাকে উদ্ধারের দাবিতে চারজন তরুণের জীবনদানের কথা।
কল্পনা চাকমা, সংগৃহিত।
শোকসভাকে ঘিরে কয়েকটি গ্রামের আদিবাসী নারী-পুরুষ-শিশু ভীড় জমান। পুরো স্কুল মাঠ যখন কানায় কানায় পূর্ণ, তখন মঞ্চে উঠে কল্পনা চাকমাকে নিয়ে লেখা গান ধরেন স্কুল শিক ব্রহ্মকুমার (লালফা) চাকমা। এবার সমবেশে ওঠে শব্দহীন কান্নার রোল। মঞ্চে পিসিপির ছেলেমেয়েরা বক্তৃতা দিতে গিয়ে বার বার খেই হারিয়ে ফেলেন, কান্নায় তাদের গলা বুজে আসতে চায়।
তথ্য-সাংবাদিকতার পেশাগত কাজে অনেক আগেই প্রত্যদর্শন হয়েছে লোগাং (১০ এপ্রিল ১৯৯২) ও নান্যাচর গণহত্যা (১৭ নভেম্বর ১৯৯৩) বা ত্রিপুরার একাধীক শরণার্থী শিবির (১৯৯৬)। এ সব নিজস্ব অভিজ্ঞতায় এমন বোবা কান্না দেখা হয়েছে বারংবার। এরপরেও ওই শোকার্ত জনতার কান্নাটুকু আমায় ঘিরে রাখে, ঝাঁপসা হয়ে আসতে চায় চশমার কাঁচ। ….
স্মৃতির মিনারে পুষ্পার্ঘ দেওয়ার পর আবার আমরা হাঁটতে থাকি ফ্যাঁকাশে সন্ধায়। একজন পাহাড়ির বাড়িতে সামান্য কিছু ভাত-তরকারি খেয়ে শুরু হয় ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ভেতরেই টর্চের আলোয় পথ চলা। লম্বা সুরু সারিতে আমরা পাহাড়, জলকাদা ভেঙে চলি। আমার সামনে পাহাড়ি ছাত্র-ছাত্রীদের একটি অংশ। পেছনে হেঁটে আসে তাদেরই আরেক অংশ। একবার শুধু একটি বিষাধর পাহাড়ি সাপ পথ আগলে দাঁড়ায়। টর্চের আলোতে সাপটিকে দেখে সবাই দ্রুত সতর্ক হয়ে ওঠেন। আমি বিস্ময়ের সঙ্গে দেখি স্কুল-কলেজের ছোট-ছোট ছেলেমেয়েরা কি অসীম সাহসের সঙ্গে পা থেকে স্যান্ডেল খুলে নিয়ে সাপটিকে তাড়ায়। সাপটিকে মেরে ফেলা না ফেলা নিয়েও তাদের মধ্যে সামান্য মত-বিরোধ হয়। পরে আবারো মাইলের পর মাইল পাহাড় ভেঙে বৃষ্টিতে ভিজে পিচ্ছিল দুর্গম পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে আছাড় খেতে খেতে এক সময় আমরা পৌঁছাই কল্পনাদের বাড়ি।
এক চিলতে উঠোন ঘিরে ছোট একটি কুঁড়ে ঘর, অভাবের চিহ্ন সর্বত্র প্রকট। ঘুটঘুটে অন্ধকারে হ্যারিকেন আর টর্চ হাতে পুরো গ্রাম ভেঙে পরে আগত বাহিনীকে দেখতে। কথা হয় কল্পনার জুম (পাহাড়ে ঢালে বিশেষ ধরণের চাষাবাদ) চাষী দুই ভাইয়ের সঙ্গে। তখনো পুরো পরিবারটির আতংক কাটেনি। নিরাপত্তার জন্য বৃদ্ধ মা বাঁধুনী চাকমাসহ তাদের রাত কাটছে অন্যের বাড়িতে।
তারা দুজন অর্নগল চাকমায় বর্ণনা করেন কিভাবে জাতীয় নির্বাচনের ভোটের রাতে লাইল্যাঘোনা সেনা ক্যাম্পের লেফটেনেন্ট ফেরদৌস তার দলবল নিয়ে অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে যায় তাদের আদরের ছোটবোন কল্পনাকে। এক ভাই বেশ কিছুদূর সন্ত্রাসীদের অনুসরণ করলে তাকে মেরে ফেলার জন্য ব্রাশ ফায়ারও করে ওরা। প্রাণ বাঁচাতে কাচালং নদীতে ঝাঁপিয়ে পরে জীবন রা হয় তার। কিন্তু এরপর আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি তাদের বোনের। থানায় এ সংক্রান্ত অপহরণের মামলা দিতে গেলেও পুলিশ মামলা নেয়নি।
কল্পনাদের বাড়ি উঠানেই কথা হয় নানান বয়সী গ্রামের মানুষের সঙ্গে; এমন কি সাদা পোষাকের একজন শান্তিবাহিনীর গেরিলা ক্যাডারের সঙ্গেও। তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, কল্পনা চাকমা অপহরণ সংক্রান্ত খবরের মূল্যায়ন। তিনি তখন অস্পষ্ট অন্ধকারের ভেতর স্পষ্ট চোখে চোখে রেখে আমাকে বলেছিলেন, আমরা আমাদের নিজস্ব অনুসন্ধান চালাচ্ছি। পাহাড়ে বরাবরই নির্যাতন-নিপীড়ন চলছে। কল্পনা চাকমা অপহরণ সেই ঘৃণ্য রাজনীতিরই একটি অংশ।…
সেদিন কল্পনার মা বাঁধুনী চাকমার দেখা মেলেনি। তবে আরো কিছুদিন পরে বৃদ্ধা মা চোখ মুছতে মুছতে বলেছিলেন, তার একমাত্র মেয়ে অপহরণের পর এই অপহরণকে নিয়ে হেলিকপ্টার-রাজনীতির কথা। তিনি বলেছিলেন, ঢাকা থেকে সেনা হেলিকপ্টারে করে কিভাবে কথিত মানবাধিকার সংস্থার নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সর্ম্পক বিভাগের অধ্যাপক, জানিপপ নামে একটি এনজিও প্রধান) সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাদের গ্রামে আসেন। তারা তাকে বার বার চাপ দিচ্ছিলেন, কল্পনা চাকমাকে শান্তিবাহিনী অপহরণ করেছে, কিন্তু এখন শান্তিবাহিনীই এই অপহরণের দায় চাপিয়ে দিচ্ছে সেনা বাহিনীর ওপর — এমন একটি স্বীকারোক্তি দেওয়ার জন্য। কিন্তু নিজের মেয়েকে নিয়ে এমন মিথ্যে রাজনৈতিক প্রচারে তিনি কিছুতেই রাজী হননি। এ নিয়ে তাকে নানা হুমকি-ধামকি দেওয়া হচ্ছে। …
অপেক্ষার প্রহর আর ফুরায় না, ২০০৯, লেখক।
পরে বাঘাইছড়ির ভারপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা, রাঙামাটি পুলিশ সুপার, সেনা কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসকের ভাষ্যসহ দৈনিক আজকের কাগজে কল্পনা চাকমা অপহরণের ওপরে যে কয়েকটি প্রতিবেদন লিখেছিলাম, এর একটির সূচনা কথা ছিল: রক্তের ধারা পেছনে যায় না!…
আজ এতোদিন পরে যখনই কল্পনা চাকমা অপহরণ, সেনাবাহিনীর (২৪ ডিভিশন, পদাতিক) প থেকে কল্পনার সন্ধান দাতাকে ৫০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা, তাকে নিয়ে করা দেশি-বিদেশী অসংখ্য সংবাদ, কলাম ও ব্লগ, মিছিল, মিটিং, মানববন্ধন, নারী সংগঠনগুলো আন্দোলন ও পরে তাদের দীর্ঘ বিস্মৃতি, বিচারপতি আব্দুল জলিলের নেতৃত্বাধীন সরকারি তদন্ত কমিটি ও হীমাগারে বন্দী তার তদন্ত রিপোর্টের কথা ভাবি –তখন বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করি, গত ১৪ বছর ধরে ধরে কল্পনা অপহরণের মতো এতো বড় মানবাধিকার লংঘনের দায় বাংলাদেশ নামক কথিত একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বহন করে চলছে! তার পাহাড়ি বন্ধুরা সহকর্মী হারানোর বেদনা বহন করে চলেছেন ওই ১৪ টি বছর ধরেই।…
অন্যদিকে প্রশ্ন জাগে, আমরা যারা নিজেদের শুভ বুদ্ধির মানুষ বলে দাবি করি, সেই সব সংখ্যাগুরু বাঙালিদের মনের গহিনে কী দেড় যুগের পুরনো এই কাঁটাটি কোনই রক্তরণ করে না? কোথায় আজ কল্পনা চাকমা?
[পুনর্লিখিত]
—
পড়ুন: ১। পাহাড়ে কেন এতো সহিংসতা?
২। পার্বত্য চট্টগ্রাম এখনো বিদ্রোহ অধ্যুষিত অঞ্চল।
৩। ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তি।
৪। লেখকের ই-বুক, ‘রিপোর্টারের ডায়েরি: পাহাড়ের পথে পথে’।
তথাকথিত কল্পনা চাকমার’র অপ হরন দিবসে একটা ঘটনার কথা না বললেই নয়।
সুত্র :
রাজাকার চিরকালের জন রাজাকার
প্রাতিষ্ঠানিক আগ্রাসন বলবেন না। বলেন সহায়তা।
চাকমা তস্কররা এমনিতেই সারেন্ডার করেনি।
“গেরিলা নেতা সন্তু লারমার হাইড-আউটে, ৫ মে, ১৯৯৪, লেখক”-এটা হল আপনার একটা ছবির ক্যাপশন।
জনাব সন্তু লারমারে প্রশ্ন করছিলেন কেন, কার সহযোগিতায় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিয়েছেন? কেন এত প্রানহানী ?
আর কল্পনা চাকমার গল্প ফাদবেন না। এনাফ।
১৪ বছরে বিভিন্ন সরকার এলো, এতগুলো সংস্থা তদন্ত করলো কিন্তু কোন কিছু পেলো না- সব ওই লেফটেনান্ট ফেরদৌস কে বাচানোর জন্য এরকম গল্প সাইদিকে চাদে দেখার মত.
বাংলাদেশ আমাদের সবার
আপডেট:
আপেডট:
@ধন্যবাদ বিপ্লব খবরটি পোষ্ট করার জন্য। ২-৩ দিন আগেই কল্পনা চাকমার ডায়েরিটা নেড়েচেড়ে দেখতে দেখতে ভাবছিলাম দেশ কত কিছুরই তো বিচার হয়, বিচারের নামে কত নাটকও হয়, অথচ এ ব্যাপারে কেউ কোন কথা বলে না। এত বছর পরে এই অর্থহীন প্রতিবেদন দিয়ে কল্পনাকে আবার নতুন করে অপমান করার কি দরকার ছিল!
@বন্যা দি,
আপনি আমার মনের কথাই বলেছেন। তবে আমার মনে হয়, পুলিশী অভিযোগ থেকে লে. ফেরদৌসের নাম বাদ দেয়ার ফলে এখন তার ইউএন শান্তি মিশনসহ আরো বড় হর্তাকর্তা হতে বাধা নেই। 🙁
@বিপ্লব রহমান,
🙁
@রৌরব,
দীর্ঘশ্বাস! 🙁
@বিপ্লব রহমান,
অভিযুক্ত হল জলপাই বাহিনীর লোক, আর ক্ষতিগ্রস্থ হল সংখ্যালঘু যার কোন রাজনৈতিক ব্যাক আপ নেই।
যা হবার তাই হয়েছে। তাও তো তদন্ত হয়েছে; সংবিধান সংশোধন করে যে ফেরদৌস সাহেবকে ইন্ডেমনিটি দেওয়া হয়নি এটাই তো যথেষ্ট। গনতন্ত্রের জয়।
@আদিল মাহমুদ,
সেনারা জানে না, একটি হিংসা আরো অনেক হিংসার জন্ম দেয়! 🙁
@বিপ্লব রহমান,
সেই হিংসে অন্তত আমাদের মত দেশে মনে হয় না তাদের জন্য কোন চিন্তার কারন। এসব ইস্যূ নিয়ে বেশী হাউকাউ করলে আমজনতা আপনাকেই দেশদ্রোহী লেবেল পরাবে।
জলপাই বাহিনী হল সকল ভুল ত্রুটির ঊর্ধ্বে, তারাই দেশের শেষ ভরসা। এনাদের অন্ধ বন্দনা শিক্ষিত জন মানূষের থেকেও যেভাবে দেখি তাতে তেমনই মনে হয়।
@আদিল মাহমুদ,
এ ক ম ত। আমার কাছে বিস্ময় লাগে, গত দেড় দশকেও কোনো মানবাধিকার সংস্থা/ নারী সংগঠন/ আদিবাসী দল ও সংগঠন কেনো কল্পনা অপহরণের মামলাটিকে এগিয়ে নিলো না? তাহলে পাহাড়ের এই সব অচলায়তন ভাঙবে কী করে?? 😕
@বিপ্লব রহমান,
হতাশাবাদী মতামত, তবে আমি সহসা কোন আশা দেখি না।
ইউনিফর্মের উপর থেকে অন্ধভক্তি যতদিনে না যাবে ততদিন কিছু হবে না।
আরো হতাশা ও দূঃখের ব্যাপার হল ইউনিফর্মের যারা আসল বিকল্প তাদের উপর গণমানুষের হতাশা আরো প্রবল, তাই ইউনিফর্মের আছর থেকে সহজে উত্তরনের পথ নেই।
@আদিল মাহমুদ,
সমাধান একটাই—
[img]http://media.somewhereinblog.net/images/biplob_33blog_1188320816_1-1.jpg[/img]
@বিপ্লব রহমান,
“গেরিলা নেতা সন্তু লারমার হাইড-আউটে, ৫ মে, ১৯৯৪, লেখক”-এটা হল আপনার একটা ছবির ক্যাপশন। তখন জনাব সন্তু লারমারে জিগাইছিলেন কেন দেশের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিয়েছেন? কেন এত প্রানহানী ?
আর উপরের ছবিতে ইউনিফরম পড়া মানুষটা আপনারই একজন ভাই(যদি আপনি বাংলাদেশের কেউ হন)।
পেটের তাগিদে অন্য কোথাও চাকরী না পেয়ে এই ইউনিফরম পড়েছেন।তার বেতনের টাকায় স্ত্রী সন্তান বেচে থাকে, মা-বাবার চিকিতসা হয়, ভাই-বোনের পড়াশুনার খরচ জুটে।দেশের জন্য প্রান দেবার ঘটনাও কিন্তু বিরল নয়।বিনিময়ে আপনার ভাই কে লাথি উপহার দিলেন?
তো সবকিছুর সমাধান কি এভাবেই ??????
@ধুম্রজাল,
দুঃখিত, আপনার মন্তব্যটি অনেক দেরীতে চোখে পড়লো। তবু বলছি, আপনি আহত হলেও কিছুই করার নেই। এটিই হচ্ছে পার্বত্য সমস্যার মূল। তাই পাহাড়ে পাকিপনা বন্ধ না করলে কোনদিন পার্বত্য সমস্যার সমাধান হবে না। পার্বত্য সমস্যার সমাধান, তথা পাহাড়ে সত্যিকার অর্থে শান্তি-উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে অবিলম্বে সেখান থেকে সামরিক জান্তা+সেটেলার প্রত্যাহার করতে হবে।
নিছক উর্দির দোহাই দিয়ে ছেঁদো কথায় কাজ হবে না। দয়া করে অনুধাবন করার চেষ্টা করুন, এখানে একটি প্রাতিষ্ঠানিক আগ্রাসন থেকে মুক্তির কথা বলা হচ্ছে, যে আগ্রাসনটি পাহাড়ে জেঁকে বসেছে প্রায় চারযুগ ধরে।
আপনাকে ধন্যবাদ।
এই ব্যাপারটা কেন যেন সহ্য করতে পারছিনা।
কিছুই কি করনীয় নেই?
@রৌরব, 🙁
পাকিস্তানী খান সেনারা ঝাপিয়ে পড়েছিল বাংগালী মহিলাদের ওপর আর বাংগালী সেনারা ঝাপিয়ে পড়ে পাহাড়ী মহিলাদের ওপর। তফাত টা কোথায়?
@সেন্টু টীকাদার, নাহ আসলে কোন পার্থক্য নেই, জাতীয়তাবাদের ঘৃণ্য দিকটা সব জাতি বা দেশের ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রযোজ্য। বিপ্লব রহমানের লেখাগুলো আমাদেরকে বারবার সেটাই মনে করিয়ে দেয়।
@বন্যা আহমেদ, :yes:
@সেন্টু টীকাদার,
নির্যাতনের ধরণে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। অন্যদিকে, শান্তিবাহিনীর প্রতিরোধ যুদ্ধ তথা রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এবং দীর্ঘ অবহেলিত পার্বত্য শান্তিচুক্তিটি এখনো একটি অমিমাংসিত অধ্যায় হিসেবেই রয়ে গেছে।
অনেক ধন্যবাদ। :rose:
আমাদের কোন কিছুতেই শেষ পর্যন্ত কিছু এসে যায় না। বাইরের বিশ্বের মানবাধিকার নিয়ে আমরা এত ব্যস্ত ঘরের মানবাধিকারের খোঁজ কে করে? আমরা বাড়িতে দশখানা চাকর রাখি, তাদের আমাদের সাথে বসার অধিকার দিই না, ভাল থাকার বন্দোবস্ত করি না, তারপর বাইরের পৃথিবীতে এসে “র্যাসিজিম” বলে গলা ফাটিয়ে দিই। আপনার লেখা পড়ে দুঃখ পেলাম, কিন্তু আমাদের মানুষ করে রাখতে এই লেখাগুলির নিয়মিত পুনঃপ্রকাশ দরকার যাতে আমরা ভুলে না যাই। ধন্যবাদ।
@দীপেন ভট্টাচার্য,
এ ক ম ত। ধন্যবাদ।
এই লেঃ ফেরদৌসের নামে এত বড় অভিযোগ এত বছর ধরে থাকলেও সরকার কি আজ পর্যন্ত এ ব্যাপারে কিছু জানিয়েছে? অন্তত কোন তদন্ত করে তাকে দায়মুক্তি দিয়েছে?
সে এখন কোথায়?
@আদিল মাহমুদ,
সুহৃদ, লেফটেনেন্ট ফেরদৌস এখন কোথায়? — এই প্রশ্নটির জবাব পেতে এই লেখাটিই বোধহয় যথেষ্ট, তা-ই না? কারণ গত ১৪ বছরেও কল্পনা অপহরণের বিচার হয়নি। সরকারের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনও আলোর মুখ দেখেনি।
তাই ধরেই নেওয়া যায়, লে. ফেরদৌস এখন পদোন্নতি পেয়ে সেনাবাহিনীর কোনো চৌকশ দলে রয়েছেন। এমন করে পদোন্নতি পেতে পেতে তিনি একদিন হয়তো মেজর-কর্নেল হবেন; তারপর আরো বড় হয়ে হয়তো সেনা প্রধানও হবেন। সব অসম্ভের এই দেশে সব-ই সম্ভব!
আপনাকে অনেক ধন্যাদ।।
বিপ্লব রহমান,
আপনার লেখাটি অবশ্য গতকাল ৯ জুন, দৈনিক “কালের কণ্ঠ”এর ম্যাগাজিন রাজকূট এ পড়েছি।
যাহোক, বৃহত্তর ও প্রবাসী পাঠকের জন্যে ভাল হল। তবে লিংক দিতে বা তা উল্লেখ করতে পারতেন।
১৯৯৬ সালে ঢাকার কিছু পাহাড়ি ছাত্রছাত্রী প্রেস ক্লাব থেকে মিছিল করে জাতীয় সংসদ ভবনে গিয়ে স্পীকারকে স্মারক লিপি দিয়েছিল। এতে নারীপক্ষ থেকে অন্য অনেকের সাথে আমিও ছিলাম।
তখনকার সময়ে ওসমানী মিলনায়তনেই একটা কর্মসূচি ছিল ( কর্মসূচির নাম এ মূহুর্তে মনে করতে পারছি না) নাসরীন হকের নেতৃত্বে নারীপক্ষ ব্যানার নিয়ে প্রতিবাদ করেছিল। মিলনায়তনের ভেতরে যাবার লক্ষ্য ছিল। বাধা পেয়ে ফটকে দাঁড়িয়েছিলাম। তবে পরে নাসরীন ভেতরে গিয়েই কল্পনা চাকমার খোঁজ জানতে চেয়েছিল।
ধন্যবাদ সে সব স্মৃতি জাগিয়ে দেওয়ার জন্যে, তবে পাহাড়ের শান্তি যে কবে আসবে!
@গীতা দাস,
আপনার নিবিড় পাঠের জন্য ধন্যবাদ। :rose:
তবে ঠিক একই লেখা দৈনিক কালের কণ্ঠের রাজনৈতিক সাপ্তাহিক ‘রাজকূট’ এ প্রকাশিত হয়নি। [লিংক] এখানে যে লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে, তাতে গুরুরত কিছু পরিবর্তন রয়েছে। আসলে মূল লেখাটি ওই একই শিরোনামে অনেক আগে মুক্তমনা ডটকম-এই প্রকাশিত হয়েছে। এখন আমি এই দিনপঞ্জিটি পুনর্লিত করেছি মাত্র। [লিংক]
কল্পনা চাকমা অপহরণকে কেন্দ্র করে প্রতিবাদী কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছিলেন, এটি সত্যিই খুব ভাল কথা। কিন্তু দুঃখজনক এই যে, দেশের এতো-শত বেসরকারি সংস্থা, মানবাধিকার সংগঠন, নারী সংগঠন– কেউই গত ১৪ বছরে ওই অপহরণ মামলাটিকে আর চালায়নি। আর এখন সবাই তো ভুলতেই বসছে কল্পনা চাকমার কথা। …. :deadrose: