বাংলাদেশের বাণিজ্যমন্ত্রক বাংলাদেশের সিনেমাহল গুলিকে বাঁচাতে ভারতীয় সিনেমার আমদানি বৈধ করেছিলেন। এতে বাংলাদেশের সিনেমা হলগুলি বাঁচত। তার সাথে সাথে বাংলাদেশের সিনেমা শিল্প ভারতের সাথে যুক্ত হওয়ার সুযোগ তৈরী হয়েছিল। কিন্ত সেসব আশা অঙ্কুরেই বিলুপ্তি। ঢাকার চলচ্চিত্রশিল্পী সংগঠনগুলির যৌথ আন্দোলনে শেখ হাসিনা সেই নিষেধাজ্ঞা আবার ফিরিয়ে এনেছেন। আমি মনে করি বাংলাদেশের শিল্পীরা আগেপিছু না ভেবে, ক্ষণস্থায়ী লাভের কথা ভেবে নিজেদের কবর নিজেরা খুঁড়লেন।

বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্ভভৌম রাষ্ট্র-তারা তাদের জনগনের কথা শুনে আইন প্রণয়ন করবেন-সেটাই কাম্য। তাছারা এক্ষেত্রে সরকার নিষেধাজ্ঞা তুলেই দিয়েছিলেন। শিল্পী সংগঠনগুলির চাপে শেখ হাসিনা পিছু হটলেন। সুতরাং আমার অভিযোগটা বাংলাদেশ সরকারের দিকে নয়। একটা গণতান্ত্রিক সরকারকে জনগণের কথা শুনতেই হয়। শেখ হাসিনা সেই অর্থে ঠিকই করেছেন-জনমতকে মর্যদা দিয়েছেন। কিন্ত আমার এই লেখার উদ্দেশ্য সেই শিল্পীদের উদ্দেশ্যে যারা না বুঝে নিজেদের ভবিষ্যতকে এবং তার সাথে সাথে বাংলা সিনেমার ভবিষ্যতকে বেশ চাপে ফেললেন।

বিবর্তনই জগতের নিয়ম। আমাদের সমাজ, শিল্প, প্রযুক্তি-মার্কেট-লোকজনের চাহিদা সব কিছু পরিবর্তনশীল। সেই পরিবর্তনের সাথে অভিযোজন না হলে মৃত্যু অনিবার্য্য। দুবছর আগে বাংলাদেশের বিখ্যাত পরিচালক তনভীর মোকাম্মেলের সাথে ইন্টারভিউ সুত্রে জেনেছিলাম বাংলাদেশের ৯০০ টা সিনেমা হলের মধ্যে ৬০০ টাই বন্ধ। কোন ভদ্রলোকে সিনেমা দেখে না। গোটা ইন্ডাস্ট্রি চলে কালোটাকায়-মাফিয়ারাজ। ভালশিল্পীরা টিভি নাটক আর সিরিয়াল করে পেট চালাচ্ছে। ভাল সিনেমা করার পরিবেশটাই নেই।

অথচ ভারতীয় সিনেমাকে আটকে কি সেটা ভাল হবে? না বাংলাদেশের সিনেমার বাজারকে ভারতে প্রসারিত করলে বাংলাদেশী সিনেমা বেঁচে যেত ? ভারতে উন্নত বাংলা সিনেমা অবাঙালীরাও দেখেন। সত্যজিত রায়ের প্রায় প্রতিটি সিনেমা আমি দেখেছি আমার জানা প্রতিটি ভারতীয় দেখেছে। শুধু তাই না। এখন বলিউডে হুর হুর করে হলিউডের টাকা ঢুকছে। বলিউডের পরিচালকরা টাকাতে না পেরে আঞ্চলিক সিনেমাতে টাকা ঢালতে আসছেন এবং এই ব্যাপারে বাংলা সিনেমা তাদের প্রথম পছন্দ। এর কারন অনেক। প্রথম কারন অবশ্যই এই যে বলিউডে প্রচুর বিখ্যাত বাঙালী নায়ক নায়িকা আছেন এবং বাংলাতে প্রচুর ভাল পরিচালক আছে। ফলে বাংলা সিনেমা ভারতীয় মার্কেটে চলবে ভাল। আছে সমৃদ্ধ সাহিত্য, সংস্কৃতি। রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র ত শুধু বাঙালীর নন। ভারতে সব থেকে বেশী হিন্দি সিরিয়াল হয়েছে শরৎ সাহিত্য দিয়ে। অন্য কেও ধারে কাছেও নেই। এই দক্ষিন এশিয়াতে হিন্দির পরেই বাংলাভাষী বেশী আছে। এসব কারনেই বাংলা সিনেমা শিল্পে আস্তে আস্তে টাকা আসা শুরু হচ্ছে। এই প্রক্রিয়াতেই বাংলাদেশের সিনেমাও যুক্ত হতে পারত। হলিউড আজ বলিউডে এসে সিনেমা বানাচ্ছে কারন, ভারত হলিউডের সিনেমা এবং শিল্পকে স্বাগত করেছে। লোকে হলিউড বলিউড দুটো সিনেমাই দেখে। কারন টেস্ট আলাদা। মাংস খেলে মাছ খেতে হবে না এমন নিয়ম আছে না কি? আর বাংলা সিনেমার টেস্ট এদের থেকেও আলাদা।

সুতরাং ভারতের থেকে বিযুক্ত হয়ে বাংলাদেশের সিনেমা শিল্পের কি লাভ হবে? খোদ বাংলা সিনেমাকেই, আমেরিকার ডেটাবাজার মিডিয়া ভেঞ্চার ( ডেটাবাজার গ্রুপের মিডিয়া) বিশ্বের বাজারে বিনপন করছে। নেটফ্লিক্স, ব্লকবাস্টার, আই টিউনস সহ সব আমেরিকান রিটেল চ্যানেলেই বাংলা সিনেমা এই বছর থেকেই পাওয়া যাচ্ছে। ঠিক ঠাক এগোলে এই আন্তর্জাতিক বাজার বিশাল। মনে রাখবেন ঋত্বিক ঘটকের মেঘেঢাকা তারা এবং সত্যজিতের পথের পাঁচালী পৃথিবীর সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ২০০ টি সিনেমার মধ্যে স্থান পেয়েছে এবং আজও এর অনেক ডিভিডি বিক্রি হয় গোটা বিশ্বেই। আর বলিউডের অনেক সিনেমাই আজকাল শুধু আন্তর্জাতিক মার্কেটের কথা ভেবেই তৈরী হচ্ছে-যেমন ফক্সের মাই নেম ইজ খান।
শুধু তাই না। আমার সাথে জার্মান এবং স্প্যানিশ প্রযোজকদের ও যোগাযোগ আছে। তারাও আজকাল গোটা বিশ্বের কথাই ভাবছেন। কারন জার্মান বা ইটালিয়ানরা শুধু হলিউডের সিনেমাই দেখছেন। এর সমাধান হলিউডকে জার্মানি বা ইটালিতে আটকানো না। এর বিকল্প হিসাবে জার্মান বা ইটালিয়ান পরিচালকরা গোটা বিশ্বের মার্কেটের কথা ভেবে স্ক্রিপ্ট লিখছেন। চে গুয়েভেরার মোটর সাইকেল ডাইরী স্প্যানিশের থেকে দশগুন টাকা তুলেছে ইংরেজিতে। লাভ ইন দি টাইম অব কলেরা-নোবেল জয়ী সাহিত্যিক মার্কোয়েজের এই স্প্যানিশ উপন্যাসটির ইংরেজি সিনেমাই সব থেকে বেশী লাভ করেছে!

গোটা সিনেমা শিল্পে যখন বিশ্বায়নের পরিবেশ, তখন সেই বিশ্বায়নের সুযোগ নিয়ে নিজেদের আরো উন্নত করাই লক্ষ্য হওয়া উচিত। এতে বাণিজ্যিক লাভ ও বেশী। তখন ঘরের দরজা বন্ধ করে সিনেমা শিল্পকে টিকিয়ে রাখা যাবে কি? সব থেকে বড় কথা সব ভারতীয় সিনেমার পাইরেটেড ডিভিডিই বাংলাদেশে ঢালাও বিক্রি হয়।

অথচ বাংলাদেশে প্রতিভার কোন অভাব নেই। হুমায়ুন আহমেদের গল্পের ওপর করা নাটকগুলি বেশ আন্তর্জাতিক মানের। গোটা উপমহাদেশে গড়পরতাই বাংলাদেশীরাই সব থেকে বেশী সংস্কৃতি প্রবণ এবং তারা সাংস্কৃতিক পরিবেশেই বড় হন। অথচ বাংলাদেশী প্রতিভার বিশ্বায়ন নিয়ে না ভেবে, কিভাবে ভারতীয় ছবি আটকানো যায় সেটা নিয়ে ভাবলে কার লাভ? হলিউডের ছবি মেক্সিকো আটকায় কি? মোটেও না। বরং মেক্সিকোর অনেক পরিচালকই হলিউডে সিনেমা বানাতে আসেন-স্প্যানিশ ও ইংরেজিতে একই সাথে সিনেমা হয়। যেমন এখন অনেক সিনেমাই বাংলা এবং হিন্দিতে হচ্ছে। বড় মার্কেট ছাড়া বাজেট আসবে কি করে? তনভীর মোকাম্মেলের লালন দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি-সিনেমাটা গোটা বিশ্বে বিরাট মার্কেট পেত। অথচ পশ্চিম বঙ্গের বাঙালীরাই জানেন না, লালন বলে একটি অসাধারন সিনেমার অস্তিত্ব আছে! মাটির ময়না সিনেমাটা বেশ কিছু আমেরিকান দেখে থাকলেও দেখতে পারেন-কিন্ত কোন ভারতীয় বাঙালী দেখেছে বলে আজ পর্যন্ত শুনি নি। এটা ত কাম্য না। মাটির ময়নার মতন দুর্দান্ত সিনেমার সব থেকে বড় বাজারত ভারতেই ছিল। যেকোন বলিউড হাউস ওই সিনেমাটা নিতে চাইত।

বাংলাদেশ এবং ভারতীয় বাঙালীকে একত্রিত করে বাংলা সিনেমার মার্কেট না বানালে, বাংলাদেশী পরিচালকেদের পেছনে বেশী টাকা কে লগ্নী দেবে? আর টাকা ছাড়া আজকের দিনে ভাল সিনেমা বানানো কি সম্ভব?

ভারতীয় বাংলা সিনেমার জন্যে বাংলাদেশের শিল্পীরা ক্ষতিগ্রস্থ হবে এটা অমূলক ধারনা। এটা কেন তারা ভাবছেন না, বাংলাদেশে অনেক বেশী বাঙালী থাকে। এবং সেই মার্কেট ধরতে কলকাতার সিনেমা শিল্পে অনেক বাংলাদেশী নায়ক নায়িকা নিতে হবে। যা কিছুদিন হল যৌথ পরিচালনার সিনেমাগুলোতে চালু ছিল।

দেশ ভাগে বাংলা সংস্কৃতির মার্কেট ভাগ হওয়ায় সমগ্র বাঙালী জাতির সর্বনাশ হয়েছে। এবং এই ভাগটা রাখলে ক্ষতি বাড়বে । কমবে না। বাংলাদেশের শিল্পীরা নিজেদের এবং বাংলা সিনেমা শিল্পের বিশাল ক্ষতি করলেন। আমি অনুরোধ করব-আপনারা আরো বিতর্কের মধ্যে দিয়ে একটা সঠিক সমাধান খুঁজুন।