অভিজিৎ
-মোকছেদ আলী*

ঈশ্বরদী থেকে আল্লাহর দর্গা যাওয়ার নতুন রেল লাইন হয়েছে। এজন্য বেলা ১০ টার সময় আল্লাহর দর্গা ষ্টেশনে এলাম। ঈশ্বরদী যাওয়ার আপ ট্রেনটি প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে। আমি টিকিট কাটার জন্য বুকিং অফিসের দিকে যাচ্ছি। গার্ড সাহেব চীৎকার করে যাত্রীদের ডেকে বলছেন, “ঈশ্বরদীগামী প্যাসেঞ্জারদের কোন টিকিট লাগবে না, বিনা ভাড়ায় যেতে পারবেন। তাড়াতাড়ি এসে গাড়ীতে উঠে বসেন।”
প্রায় ৩০/৪০ জন যাত্রী গার্ডের কাছে গিয়ে হাজির হল। দেখাদেখি আমিও গার্ড সাহেবের কাছে গেলাম। গার্ডসাহেব বললেন, বিনা ভাড়ায় যাবেন, তবে একটা শর্ত আছে। শর্তটা হল, বুকে হাত দিয়ে সত্য করে বলতে হবে, আপনি বেগোনাহগার মানে নিস্পাপ। অর্থাৎ সব পাপের মা মিছা কথা আপনি বলেন না। কারো নিন্দা করেন না। কারো প্রতি হিংসা করেন না। ব্যভিচার করেন না। লোভ লালসা করেন না। ঐ যে কুটি মনসুর পল্লী গীতি গান করে- ‘হিংসা আর নিন্দা ছাড়ো, দীলটা করো পরিষ্কার।’ দেখুন আপনার দীলটা পরিষ্কার আছে কিনা? যদি পরিষ্কার থাকে, তাহলে গাড়ীতে উঠে বসেন।
গভীরভাবে চিন্তা করে দেখলাম। আমি গেঞ্জি, লুঙ্গি, গামছা, শাড়ী কাপড়ের ব্যবসা করি। খদ্দেরের কাছে ১০০ টাকা দামের শাড়ীর দাম ৪০০ টাকা চাই। খদ্দের আমার মাথায় টুপী, মুখে গালপাট্টা চাপ দাড়ী, গায়ে লম্বা জুব্বা দেখে আমাকে সত্যবাদী বলে বিশ্বাস করেন। তবুও খদ্দের বলেন-‘ ৪০০ টাকা, দামটা একটু বেশি মনে হচ্ছে।’ আমি ছরাছর মিছা কথাই বলি- “৩৮৫ টাকায় কেনা পোড়াদহের হাটে। হাটের খাজনা শতকরা ২ টাকা। হাটে সন্ত্রাসীদের চাঁদা, আর তাদের গড ফাদারদের চাঁদা শাড়ী প্রতি ৫ টাকা।
দোকানের কর্মচারীকে হুকুম দেই, জগলু, সামছুলের দোকান থেকে ১ কাপ দুধ-চা আর হাকিমপুরী জর্দা দিয়ে একটা পান নিয়ে আয়। খদ্দের খুশি হয় মনে মনে। চা পান শেষে ৪০০, টাকা দেয়। খাতির দেখায়ে ৫ টাকা ফেরত দেই। খুব বিনয়ের সঙ্গে বলি, আপনি আমার পুরাতন বাধা খদ্দের। ১ টা শাড়ীতে ৫/৭ টাকা লাভ নাইবা করলাম। ইনশাল্লাহ ভবিষ্যতে কত লেনদেন হবে। ছাপানো কভারে শাড়ী পুরে ষ্ট্যাপলার দিয়ে পিন আপ করে দেই। চট করে প্রসঙ্গ ঘুরে ফেলি। বলি- ভাইজান, আপনার বড় ছেলে কি মাষ্টারস্ পাশ করেছে? ভাইজান আমার কথায় খুশি হয়ে একটু খুশ খুশ করে কেশে বলেন- ফাইন্যাল দিয়েছে, দোয়া করবেন। রেজাল্ট এখনও বের হয়নি।
ভাইজানের মুখের উপর দোয়া করি- হে আল্লাহ মাবুদ, আমার ভাইজানের বড় পোলাটা যেন ফাষ্ট ক্লাস ফাষ্ট হয়। আপনার বান্দার প্রতি মেহেরবানী কইরেন। আমিন, ছুম্মা আমিন।
সুতরাং আমার দিল যে কিরূপ পরিষ্কার তাতো আমি নিজেই বুঝতে পারছি।
আকতার মেকারের ছেলে জাপান থাকে। লাখ লাখ টাকা পাঠায়, বড় রাস্তার ধারে আলট্রা মডার্ন ৪ তলা বাড়ি করেছে। নাম দিয়েছে মেরিডিয়ান ভিলা। অট্টালিকার দিকে তাকিয়ে হিংসায় আমার অন্তর জ্বলে যায়। কাজেই বিনা টিকিটে গাড়ীতে ওঠা হল না।
পাশেই ছিল জগদীশ বাবু। ঘড়ির মেকার, আবার নতুন ঘড়িও বেচা বিক্রি করে। শুধালো, মোসকেত ভাই, গাড়ীতে উঠলা না? দাঁত কেলায়ে বললাম, বিনা ভাড়ায় গাড়িতে উঠা যাবে না, অন্তর দিল পরিষ্কার নাই। তুমি উঠলা না, শুধালাম। জগদিস দাঁত বের করে হেসে বলল, গার্ড সাহেব বলেছেন, দিলটা পরিষ্কার থাকলেই গাড়ীতে উঠে বসেন। সত্যি কথা বলতে তো তোর কাছে বাধা নাই। তুই আমার বুজম ফ্রেন্ড, অন্তরঙ্গ বন্ধু।
তাইলে ঘটনাটা কই শোন্, আমাদের পাড়ার নগেনদার বড় জামাই একটা ঘড়ি নিয়ে এলো। বলল, “কাকাবাবু, ঘড়িটা বন্ধ হয়ে গেছে। একটু দেখে দেন তো।” বললাম, “বাবাজী বসো।”
একটা ঘড়ি মেরামত করছিলাম। সেটা রেখে জামাইয়ের ঘড়িটা খুললাম। দেখি একটা স্ক্রুপ সামান্য লুজ হয়ে আছে। টাইট দিলেই আবার চলবে।
এখন কথাটা হল, ওর সামনে যদি টাইট দেই- তাহলে তো পয়সা নেয়া যাবে না। তাই খুব পাম দিতে লাগলাম। বললাম, “এটা খুবই ভালো ঘড়ি, অনেক দামী ঘড়ি। কত দিয়ে কিনেছ বাবাজী?” হেসে বলল, “কিনি নাই। বড় মামা জার্মানীর বার্লিনে থাকেন। ৫/৬ মাস হলো, বাড়ি এসেছিলেন, এই ঘড়িটা আমাকে উপহার দিয়ে গেছে।”
বললাম, “বাবাজী এই ঘড়িটি খুবই দামী ঘড়ি, তা ৬/৭ হাজার টাকা হবে। সুইজারল্যান্ডের রিকো। এতে যে পাওয়ারের ব্যাটারী দেয়া আছে তা অনায়াসে ২০ বৎসর চলবে।”
বুঝছিস, মোসকেত ভাই- ঘড়ি তো প্রায় লোকেই হাত থেকে খুলে টেবিলের উপর রাখে। তাই শুধালাম, বাবাজী, ঘড়িটা কি খুলে টেবিলের উপর রাখতে? জবাব দিল, “আজ্ঞে, চান করার সময় হাত থেকে খুলে টেবিলের উপরেই রাখি।” আমি বললাম, “ও বুঝেছি, যেভাবেই হোক ঘড়ি মাটিতে পড়ে গিয়েছিল।”
চালাকি করে বললাম, বাবাজীর বাজারে কোন কাজ আছে? যদি থাকে, সেরে আসো। না হয় কাল সকালে এসে নিয়ে যেও। আমার কর্মচারী রিপনকে বললাম, রিপন, কালামের দোকান থেকে ভাল দুইটা সবরী কলা আন্ আর রামের চায়ের ষ্টল থেকে ১ কাপ সর সমেত দুধ নিয়ে আয়।
বাবাজী নাহু নাহু করে বলল, কাকা আমি কিছু খাব না। বড় বাজারে এক লোকের সঙ্গে দেখা করতে যাব। বলেই উঠে চলে গেল। আমি খুশি হয়ে একটু খুশ খুশ করে কাশলাম।
পরদিন বেলা দশটার সময় জামাই বাবাজী এলো। চা, পান, কলা খাওয়ালাম। ৫/৬ টাকা খরচ হল। ঘড়ি দিলাম। শুধালো, চার্জ করত? বললাম, তুমি আমার নগেদনদার জামাই। সুতরাং তুমি আমারও জামাই। তোমার কাছে কি চার্জ নেয়া যায়? তুমি কি পর? ছড়াছড় মিছা কথা বললাম- “একটা পার্টস লেগেছে, অন্য লোক হলে ৩০০ টাকা চার্জ নিতাম। তোমাকে কি আর বলব, যা ভালো মনে কর দিও।” জামাই বেটা মানি ব্যাগ খুলে ৫০০ টাকার কড়কড়ে নোট একটা দিল। আমিও ড্রয়ার খুলে কড়কড়ে ২৫০ টাকা ফেরত দিলাম। বেটা খুশি হয়ে চলে গেল।
নতুন ঘড়ি বেচার বেলায় খদ্দেরের পোশাক দেখেই বুঝতে পারি বেটা পয়সাওয়ালা। ২০০ টাকার ঘড়ি দিয়ে ১২ শত দাম হাঁকি। বেটা কত কমাবি কমা। শেষে ১২ শত টাকাই দেয়।
চিন্তা করে দেখলাম, আমার দিল একটুও পরিষ্কার নাই। কাজেই বুঝতে পারছ- বিনা ভাড়ায় আমারও ঈশ্বরদী যাওয়া হলো না। একে একে সবাই মাথা নিচু করে চলে গেল।
জগদীশ বলল, মোসকেত ভাই- ঐ যে রবি মাথা নিচু করে চলে গেল। হল বাজারে ওর ভ্যারাইটি ষ্টোর আছে। কসমেটিকের দোকান। সৌন্দর্য বর্ধনের দোকান। মেয়েরাই বেশি আসে। মওকা বুঝে ৫ টাকার মাল ৫০ টাকা দাম হাঁকে। সকাল আটটা থেকে রাত ১০ টা পর্যন্ত দোকান খোলা থাকে। সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে। দিল তো পরিষ্কার হয় নাই। সেদিন কুটি মনসুরের গান শুনলাম রেডিওতে- “নিন্দা আর হিংসা ছাড়ো, দিলটা করো পরিষ্কার।” কি চমৎকার কথা। এই যুগে অন্তর দিল পরিষ্কার রাখা বড়ই কঠিন। ঠিক কিনা মোসকেত ভাই?
জগদিস দা গার্ড সাহেবের কাছে চলে গেল। বলল, স্যার আপনি গাড়িতে উঠছেন না কেন?
গার্ড সাহেব হাস্য করে বললেন- আরে বাপু আমার দিলটাও পরিষ্কার নয়। ঘুষ খাই। ড্রাইভারের সঙ্গে আঁতাত করে ডিজেল বিক্রি কোরে আধাআধি ভাগাভাগি করি। আমার দিলটাও পরিষ্কার নাই। কাজেই আমিও গাড়ীতে উঠতে পারছি না।
এমন সময় জগদীশদার নাতী অভিজিৎ এসে বলল- দাদু চল গাড়ীতে উঠে বসি। জগদীশ বাবু খুব দুঃখ করে বলল- অভিজিৎ, আমি গাড়িতে উঠতে পারব না। আমার অন্তর দিলটা পরিষ্কার নয়। দিল পরিষ্কার না থাকলে গাড়ীতে ওঠা যাবে না। এমন সময় আমার মেজ মেয়ের ছোট ছেলে ফরিদ এলো। ফরিদ আর অভিজিৎ গাড়ীর পা দানীর উপর উঠল। ভেতর থেকে টিটি এসে ওদের দুজনকে হাত ধরে তুলে ভেতরে নিয়ে গেল।
একি! আশ্চর্য ব্যাপার তো, রেলগাড়ী, জেট বিমানের মত আকাশে উড়াল দিল। আমি ভীত হয়ে চীৎকার করে ডাকলাম- অভিজিৎ, অভিজিৎ, ফরিদ, ফরিদ। কিন্তু গলার স্বর বের হচ্ছে না। কে যেন পেছন থেকে আমার পিঠে হাত দিয়ে ধাক্কা দিল। ঘুম ভেঙ্গে গেল। গিন্নি বলল- ফরিদ ফরিদ করে চিল্লাচ্ছো ক্যা? ফরিদ তো ঐ রুমে ওর মায়ের কোলে ঘুমিয়ে আছে। বললাম, কি একটা স্বপ্ন দেখলাম!

অনুলেখক: মাহফুজ
*মোকছেদ আলী (১৯২২-২০০৯)। স্বশিক্ষিত।