নিষ্ঠূর ও অমানবিক অনার কিলিং প্রথা সম্পর্কে নন্দিনী ও শাফায়েত সম্প্রতি দুটি চমতকার নিবন্ধ লিখেছে। এ লেখা বলা যায় সেই লেখাগুলির ধারাবাহিকতার পথে এক ধাপ সংযোজন। ঐ লেখা দুটির মন্তব্য বিভাগে লক্ষ্য করেছিলাম যে অনার কিলিং এর জন্য আসলে ধর্ম দায়ী কিনা বা দায়ী হলে কতটুকু সেটা নিয়ে বেশ প্রানবন্ত তর্ক জমে উঠেছিল। এই লেখাটিতে আমি মূলতঃ চেষ্টা করব অনার কিলিং এর পেছনের কার্যকারন, ধর্মের কতটুকু ভূমিকা বা আদৌ কোন ভূমিকা আছে কিনা, আইন আদালতের ভূমিকা এসব বিষয়ের একটু ভেতরে যেতে।

অনার কিলিং কি তা আমরা সবাই নিশ্চয়ই জানি। খুব সংক্ষেপে; পরিবারের কোন সদস্যের কারনে পরিবারের সম্মানহানি হলে পরিবারেরই অপর কোন সদস্যের হাতে সেই কথিত ‘অপরাধী’র হত্যাকান্ডকে অনার কিলিং বলে। এর কারন হতে পারে বহুবিধ, তবে মূল শিকার বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই মহিলা। কথিত সম্মানহানির কারন হতে পারে ধর্মীয় ড্রেসকোড না মানা, ধর্ষিতা হওয়া, নিজের ইচ্ছায় স্বামী পছন্দ করা, অন্য জাত বা গোত্রে বিবাহ করা, স্বামীর অত্যাচারে ডিভোর্স চাওয়া, এক্ষেত্রে এমনকি বাপের বাড়িতে ফিরে গেলে তারাও নিজের মেয়ে বা বোনকে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করতে পারে। মেয়ে পরপুরুষের সাথে শুধু কথা বললে সেটাও হত্যার যোগ্য অপরাধ বলে ধরা যেতে পারে যেমনটা সম্প্রতি ঘটেছে সৌদী আরবে। এক কিশোরী মেয়ে ফেসবুকে কোন ছেলের সাথে চ্যাট করার অপরাধে বাবার হাতে খুন হয়েছে। স্থানীয় এক শীর্ষ মুফতী এ ঘটনায় হত্যাকান্ডের কোন নিন্দা করেননি, তবে ফেসবুকের নিন্দা করেছেন [১]।

অনার কিলিং প্রথা অনেক প্রাচীন। ঠিক কবে বা কোন যায়গায় এই প্রথার উৎপত্তি তা সঠিকভাবে জানা না গেলেও প্রাচীনকাল থেকেই বিশ্বের অনেক অঞ্চলেই এই প্রথা ব্যাপক পরিমানে প্রচলিত ছিল। তবে বর্তমানে নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলে প্রধানত সীমাবদ্ধ। উল্লেখযোগ্য দেশগুলির মধ্যে আফগানিস্তান, ভারত , পাকিস্তান, লেবানন, মিশর, সিরিয়া, ইয়েমেন, মরক্কো, তুরষ্ক, ইসরাইল, প্যালেষ্টাইন; বস্তুত মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার সব দেশ। তবে সম্প্রতি জার্মানী, ফ্রান্স, ও ইংল্যান্ডের ইমিগ্র্যান্ট কমিউনিটিতেও আশংকাজনক হারে এই কুপ্রথা বাড়ছে। এই তালিকায় সুইডেন ও ইটালীর নামও আছে। অনেকে বাংলাদেশ ভারতের যৌতূক প্রথার বলিদেরও অনার কিলিং এর পর্যায়ভুক্ত করেন। এ ছাড়াও ল্যাটীন আমেরিকার ব্রাজিল ও কলাম্বিয়াতেও আইনী শিথিলতার কারনে স্ত্রী হত্যার হার খুব বেশী (আমাদের দেশের মতই, তবে এদের ঠিক অনার কিলিং বলা যায় না)। তবে ভারতের সতী নারীর আত্মহনন প্রথার মত কালচারের জন্য অনার সুইসাইড নামে আরেকটি আলাদা পরিভাষা ব্যাবহার করা হয়। ইরাকে সম্পতি ৮০ জন ধর্ষিতা মহিলার অনার সুইসাইড স্কোয়াডের ঘটনা ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিল। পরে বের হয়েছিল যে এসব মহিলাকে সুইসাইড বোম্বার বানাবার জন্য পরিকল্পিতভাবেই ধর্ষন করা হয়েছিল, যাতে তারা নিজেদের সম্মানহানির কারনে সুইসাইডে বাধ্য হয়। ধর্ষিতা হওয়াও যে সেই কালচারে মহা অপরাধ। অনার কিলিং এর এমন নগ্ন রাজনৈতিক ব্যাবহার মনে হয় নজির বিহীন। আরো বিস্ময়কর যে একজন স্বদেশী মহিলাই এর মূল হোতা [২]।

অনার কিলিং প্রবন এই দেশগুলির একটা উল্লেখযোগ্য অংশ সনাতন ইসলামী রষ্ট্র বলে বিবেচিত। যেহেতু সনাতনী ইসলাম দেশগুলিতে সামাজিক সংস্কৃতি, প্রচলিত আইন কানুন বেশীরভাগই ইসলামী বিধিবিধান অনুযায়ী পরিচালিত হয় তাই মনে হওয়া খুব স্বাভাবিক যে অনার কিলিং এবং ইসলামী বিধি ব্যাবস্থার মাঝে হয়ত কোন সম্পর্ক আছে। পশ্চীমা দেশগুলিতে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু অনার কিলিং এর ঘটনা বিশেষ করে মুসলমান কমিউনিটিতে ঘটার পর অনেকে সরাসরি ইসলাম ধর্মকে দায়ী করছেন, অসংখ্য অয়েব সাইটও আছে এ প্রচারনার পক্ষে। এ বিষয়টাও কিঞ্চিত অনুসন্ধানের চেষ্টা চালিয়েছি, যদিও সিদ্ধান্ত নেওয়াটা বেশ জটিল।

এতে সন্দেহের কোনই অবকাশ নেই যে প্রকট ভাবে পুরুষ শাসিত সমাজেই এই বর্বর প্রথা প্রচলিত। নারীকে মানুষ হিসেবে ন্যূনতম মর্যাদা না দিয়ে পণ্য হিসেবে গন্য করাই এই সমস্যার আদিমূল। সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে মানবাধিকারেরও উন্নতি ঘটছে। ধর্ম এ ক্ষেত্রে কখনো কখনো সংস্কারকের ভূমিকা রাখলেও অনেক সময় আবার প্রাচীনপন্থী অমানবিক কালাকানুনকে বৈধতা দিয়েছে। ধর্মের ব্যাপ্তি যেহেতু সেই ধর্মের নাজিল হবার সময়কালে সীমাবদ্ধ, তার সমাজ সংস্কারকের ভূমিকাও সেই সময়কালেই অনেকটা সীমাবদ্ধ। এখানেই বাধে গোল। ধর্মীয় সংস্কারের বাইরে সমাজ সংস্কারমূলক অনেক কাজের পথেই ধর্মেকে বাধা হিসেবে দাঁড় করানো হয়। যারা বর্তমানে প্রাচীন কালের ধর্মীয় বা চরম পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধ থেকে মুক্ত হতে পারছে না সেসব সমাজে ধর্ম মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নের সহায়ক না হয়ে বেশ কিছু ক্ষেত্রে বিপরীত ভূমিকাই রাখছে। এরই প্রকৃষ্ট উদাহরন পাকিস্তান সহ মধ্যপ্রাচ্যীয় দেশগুলি ও ভারত। তবে বিশ্বের যাবতীয় অমানবিক কাজ কারবারই যে ধর্মের কারনে ঘটছে সেটাও সত্য নয়। অনার কিলিং এর বলি যে শুধু মহিলারা হয় সেটাও ঠিক নয়। পুরুষেরাও সম্মান হানির কারন বলে চিহ্নিত মহিলার ক্রাইম পার্টনার হিসেবে সাজা পেতে পারে। যদিও তাদের সাজা বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই কম, তারা পালিয়ে গিয়ে বা অর্থের বিনিময়ে প্রান রক্ষা করতে পারে যে বন্দোবস্ত মহিলাদের বেলায় নেই। তাদের মৃত্যুই একমাত্র শাস্তি।

আগেই বলেছি যে অনার কিলিং এর মাত্রা সাধারনভাবে মুসলাম প্রধান দেশগুলি, বিশেষ করে যে সব দেশের আইন ও সামাজিক মূল্যবোধ কট্টর ইসলামী ধ্যান ধারনার ভিত্তিতে গঠিত সেসব দেশে খুব প্রকট, যদিও ইসলাম ধর্মে অনার কিলিং এর কোন অপশন তত্ত্বীয়ভাবে নেই। সে হিসেবে তুরষ্ককে ব্যাতিক্রম বলা যায়। ইউরোপীয় সেক্যুলার ছাঁচের হলেও বিস্ময়করভাবে তুরষ্কে অনার কিলিং এর মাত্রা খুবই ভয়াবহ। সবচেয়ে দূঃখজনক যেটা লেগেছে তা হল যে এ সব দেশের একটা বড় সংখ্যক জনসাধারন যেকোন কারনেই হোক এই বর্বর প্রথার সরব সমর্থক। তাদের কেউ কেউ ধর্ম রক্ষার কারনে এই প্রথার সমর্থক, কেউ আবার ধর্মের কথা সরাসরি না বলে সমাজ ও পারিবারিক মূল্যবোধ রক্ষার করার জন্য এটা দরকার বলে দাবী করে। কোন দেশের আইন আদালত তো নিয়ন্ত্রিত হয় সে দেশেরই মানুষদের দিয়ে। তাই অনেক ক্ষেত্রে পশ্চীমা দেশগুলির বা মানবাধিকার সংস্থাগুলির চাপে আইন কানুন বদলালেও বাস্তবতার তেমন পরিবর্তন হয় না। যেমন, এমনেষ্টির মতে পাকিস্তানে এসব নানান রকমের নারী নির্যাতনের সহায়ক আইন কানুন সরকার যতটা না বদলায় সে তূলনায় অপরাধের মাত্রা আরো অনেক বেশী বৃদ্ধি পায়।

আমরা এখন অনার কিলিং এর একটি অন্যতম চারন ভূমি পাকিস্তানের অবস্থা কিছুটা দেখার চেষ্টা করব। পাকিস্তানে সরকারী হিসেবে বছরে ১,২০০ মত অনার কিলিং এর ঘটনা ঘটে। এর স্থানীয় নাম কারো-কারি। কারি হল মহিলা ভিক্টিম, কারো হল পুরুষ। যদিও কোন কোন বেসরকারী গবেষনা মতে এই সংখ্যা আসলে ১০ হাজারেরও উপরে হতে পারে। এর একটা বড় অংশ অশিক্ষিত উপজাতীয় অধ্যূষিত এলাকায় হলেও শহরের শিক্ষিত সমাজের মাঝেও এই প্রথা ব্যাপক মাত্রায়ই আছে। অনার কিলিং এর সঠিক উপাত্ত কোন সময়ই পাওয়া যায় না তার একটা বড় কারন এটা অনেক সময় অপরাধ হিসেবেই কেউ রিপোর্ট করে না। নিহতের দেহ বেমালুম গায়েব করে ফেলা হয়। নিজ পরিবারের সম্মতিতে পরিবারের সদস্যরাই হত্যাকান্ডে অংশ নিলে কে আর ঘাটাবে? যেখানে থানা পুলিশ, সমাজ, এমনকি আদালতও সমর্থন দেয়? অনেক সময় আইনের আশ্রয় নেবার পরেও পুলিশ ঘটনা ধামা চাপা দিয়ে দেয়। তারাও তো সেই সমাজেরই লোক। খোদ পুলিশই কখনো কখনো ভিক্টিমকে স্থানীয় পঞ্চায়েত বা অত্যাচারী পরিবারের কাছে তুলে দেয় অনার কিলিং এর জন্য। যেমন, ৯৯ সালে উত্তর পশ্চীম সীমান্তের লাল জামিলা নামের এক ১৬ বছরের এক বালিকা এক সরকারী অফিস কর্মচারি দ্বারা ধর্ষিতা হলে তার চাচা থানায় মামলা করে। এরপর পুলিশ তাকে নিরাপত্তা হেফাজতে নেবার নাম করে স্থানীয় পঞ্চায়েত বা জিরগার কাছে তাকে হস্তান্তর করে। সেই জিরগার সিদ্ধান্তে তাকে ধর্ষিতা হয়ে উক্ত গোত্রের সম্মানহানি হবার কারনে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয় [৩]।

ইসলামের সাথে অনার কিলিং এর সরাসরি কোন যোগ না থকলেও কঠোর ধর্মীয় অনুশাসনের উপজাত হিসেবে একটি বড় সংখ্যাক ধর্মগুরু/ মোল্লারা এই প্রথার সমর্থনে সবসময়েই প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়ে আসছে। যে দেশে এই ধর্গুরুদের হাঁকডাক যত বেশী, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যত প্রভাব সে দেশেই ধর্মের নামে এসব কালো কালাকানুন বেশী। সেজন্যই মুসলিম প্রধান মধ্যপ্রাচ্য বা পাকিস্তানে অনার কিলিং এর স্বপক্ষে মোল্লা জোট সরব, ফলে অনার কিলিং চলে ব্যাপক মাত্রায়। আবার মুসলিম প্রধান বাংলাদেশ বা মালয়েশিয়ায় এসবের কথা তেমন শোনা যায় না (যৌতুকের জন্য হত্যা এ জাতীয় ঘটনাকে এক্ষেত্রে বিবেচনা করছি না)।

জিয়াউল হকের জমানায় ‘৭৯ সালে করে যাওয়া তথাকথিত ইসলামী আইনের নামে হুদুদ, কিয়াস, দিয়াত এ জাতীয় আইন যেগুলিতে নারী অধিকার চরম ভাবে ক্ষুন্ন হয়েছে সেগুলিও অনার কিলিং এর হার বৃদ্ধির কারন। শুধু যে মোল্লা সমাজই সমর্থন দিচ্ছে তা নয়। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে সমর্থন এমনকি তাদের শিক্ষিত পার্লামেন্টের সদস্যরাও ব্যাপক পরিমানে দেয়। কার্যকারন একটাই, সমাজ রক্ষা। এ প্রসংগে ৯৯ সালের আরেকটি সাড়া জাগানো ঘটনার উল্লেখ করতেই হয়। এ ঘটনা কয়েকটি কারনে উল্লেখযোগ্য। তার একটি কারন, সাধারনভাবে ধরা হয় বা সরকার দাবী করে যে অনার কিলিং শুধু উপজাতীয় অশিক্ষিত গোত্রগুলির মাঝেই হয়, এ ঘটনা সে ধারনাকে সরাসরি নাকচ করে। দ্বিতীয়ত, অনার কিলিং যে কিরকম বেপরোয়া হতে পারে, আর প্রচ্ছন্ন আইনী সহায়তা পেতে পারে সেটাও এ ঘটনায় কিছুটা বোঝা যায়।

৯৯ সালে সামিয়া সারওয়ার নামের উত্তর পশ্চীম সীমান্ত প্রদেশের এক মহিলা স্বামীর অত্যাচার দাম্পত্য জীবনের ১০ বছর সহ্য করার পর আর একজন লোকের প্রেমে পড়ে। এরপর একদিন মহিলা প্রসূতি অবস্থায় তার স্বামী তাকে লাথি দিয়ে সিড়ি থেকে নীচে ফেলে দেয়। এই ঘটনার পর সামিয়া ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নেয় ও পালিয়ে লাহোরে দাস্তক নামের একটি মানবাধিকার সংস্থায় আশ্রয় নেয়। এই সংস্থার সাথে যুক্ত এডভোকেট হিনা জিলানী ও আসমা জাহাংগীর দুই বোন সুপরিচিত মানবাধিকার কর্মী, তারা জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিনিধি। সামিয়ার বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা তার নিজের পরিবারই সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। তাদের মতে এতে তাদের পরিবারের সম্মানহানি হয়েছে। সামিয়ায় মা যিনি পেশায় একজন ডাক্তার; একদিন সামিয়াকে দেখার ছূতায় দাস্তকের লাহোর কেন্দ্রে যান। তিনি অসূস্থ হবার ভান করে সাথে ড্রাইভারকেও আনেন। এরপর সামিয়াকে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে আনা হলে সেই ড্রাইভার উপস্থিত এডভোকেট হিনা জিলানীর সামনেই সামিয়ার মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে তাকে গুলি করে। তার মৃত্যু হয় ততক্ষনাত। এরপর সেই হত্যাকারী হিনা জিলানীর দিকে আর একটি গুলি ছোঁড়ে, যা ভাগ্যক্রমে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় । এরপর হত্যাকারী গ্রুপ যেন কিছুই হয়নি এমনভাবে বেরিয়ে যায়। হিনা জিলানী পরে বলেছেন যে সামিয়ার মা মাটিতে লুটিয়ে পড়া মেয়ের রক্তাক্ত মৃতদেহ একবার দেখার দরকারও মনে করেননি। এই ঘটনা পাকিস্তানেও ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দেয়। নারী অধিকার সংস্থাগুলি প্রতিবাদে ফেটে পড়ে [৩] [৪]।

উপস্থিত আইনজীবিরা সামিয়ার মা, চাচা, ও সেই ড্রাইভারের নামে থানায় সুষ্পষ্টভাবে অভিযোগ দায়ের করলেও পুলিশ তাদের গ্রেফতার করেনি। উত্তর পশ্চীম সীমান্তের সাধারন মানুষ এ ঘটনায় প্রকাশ্যে উল্লাস প্রকাশ করেছে। বিস্ময়করভাবে সামিয়ায় বাবা, যিনি পেশোওয়ার চেম্বার অফ কমার্সের ততকালীন সভাপতি, তিনি ও স্থানীয় মোল্লা গ্রুপ উলটো হিনা জিলানী ও আসমা জাহাঙ্গীরের ইসলামী আইনে মহিলাদের কুমন্ত্রনা দেওয়ার ও বহিঃবিশ্বে দেশের সম্মানহানির দায়ে গ্রেফতারের দাবী জানান। এই দুজন মহিলা আইনজীবিকে হত্যার ফতোয়া জারি করা হয় এবং মাথার দাম ঘোষনা করা হয়। আসমা জাহাংগীর এর বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় চেয়ে, ও ৯৮ সালের আরো ৩০০ অনার কিলিং ঘটনার সুষ্ঠূ তদন্তের দাবী চাইলেও সরকার কোন ভূমিকাই নেয়নি। এরপর সামিয়ার বাবা পেশোয়ারে এই দুই মানবাধিকার আইনজ়ীবির বিরুদ্ধে সামিয়াকে গুম ও খুনের অভিযোগে মিথ্যা মামলা দায়ের করে বসেন। যদিও সে মামলা পরে হাইকোর্টে খারিজ হয়ে যায়।

এই ঘটনা ৯৯ সালের আগষ্টে পাকিস্তানী পার্লামেন্টের আপার হাউজে উঠলে ৮৭ জন সদস্যের মধ্যে মাত্র ৪ জন এই ঘটনার নিন্দা জানান ও এমন ঘটনার বিরুদ্ধে কঠিন আইন প্রয়োগের দাবী জানান। বাকিরা সরাসরি এই দাবীর বিরোধীতা করেন [৪]। আজমল খটক নামের এক সাংসদ মত দেন; যেখানে সম্মানের প্রশ্ন জড়িত সেখানে এমনকি কোনরকম আলোচনারও অবকাশ নেই। একই মত দিয়ে এই বিল এমনকি উত্থাপনেরও অযোগ্য ঘোষনা করেন স্পীকার ওয়াসীম সাজ্জাদ। বিরোধীতাকারিরা তাদের পক্ষে বলেন যে অনার কিলিং অবাধ যৌনতার বিরুদ্ধে সমাজ রক্ষার হাতিয়ার। হিনা জিলানী এ দিনটিকে তার জীবনের কালো দিবস হিসেবে অভিহিত করেন। দেশের একজন শীর্ষস্থানীয় ইসলামিক স্কলার ডঃ মাহমুদ আহমেদ গাজী বিবিসির কাছে এক সাক্ষাতকারে হত্যাকান্ড সরাসরি সমর্থন না করলেও মত দেন যে অনেকের কাছে অবৈধ যৌনাচার হত্যাকান্ডের চেয়ে বড় অপরাধ। কারন তার মতে ইসলাম নৈতিকতার অধপতনের জন্য স্ত্রীকে প্রহার করার অধিকার দেয় [৪]।

এ সময় পারভেজ মোশারফ তার মিত্র পশ্চীমাদের চাপে কিছু সংস্কারমূলক কাজে বাধ্য হন। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৪ সালের ডিসেম্বরে অবশেষে অনার কিলিং কে সাধারন হত্যা হিসেবে বিচারের আইন করা হয়, যদিও সর্বোচ্চ শাস্তি রাখা হয় মাত্র ৭ বছর, কেবল চরম ক্ষেত্র বিশেষে মৃত্যুদন্ড। যদিও অনার কিলিং উতসাহিত করার জন্য দায়ী হুদুদ আইনের একটি ধারা; হত্যাকারীকে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবার ছাড় দিলে সে বেকসুর মুক্তি পেয়ে যাবে এই ধারাটি বহাল রয়ে যায়।

হুদুদ আইনের এই অমানবিক ধারা রোধ করার জন্য একটি বিল ২০০৫ সালে আবারো পার্লামেন্টে উঠলে সেটাকে সংখাগরিষ্ঠের ভোটে ‘ইসলাম বিরোধী’ বলে বাতিল করে দেওয়া হয়। এই বিলটিতে অনার কিলিং কে সরাসরি চ্যালেনজ় করে ততকালীন সরকারী দল মুসলিম লীগের একজন মহিলা সদস্যা কাশমালা তারিক উত্থাপন করেছিলেন। আইনমন্ত্রী ওয়াসী জাফর ‘৭৯ সালের প্রবর্তিত হুদুদ আইনের আর কোনরকম সংশোধন সরাসরি বাতিল করে দেন। অনার কিলিং এর বিরুদ্ধে সরাসরি কোন আইন প্রনয়ন করা হলে তাদের দেশীয় ও সামাজিক ঐতিহ্য ক্ষুন্ন হবে বলে বক্তব্য দেন জেকোবাবাদ থেকে নির্বাচিত সাংসদ সর্দার সেলিম জান মাজারি [৫] [৬]।

অবশেষে ২০০৬ সালে পশ্চীমা মিত্রদের চাপে পারভেজ মোশারফ হুদুদ আইন সংশোধন করে নারী অধিকার রক্ষার বিল প্রস্তাব করেন (Women Protection Bill), কট্টর ইসলামপন্থী দলগুলির তীব্র বাধার মুখেও এ বিল পাশ হয়। পাকিস্তানের ইতিহাসে এ বিল নারী অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে বলা যায় এক ম্যাগনা কার্টা। এই সংশোধনীর আওতায় ধর্ষন অপরাধ কে হুদুদ আইনের কব্জা থেকে মুক্ত করে সাধারন আইনের আওতায় আনা হয়। এ আইনের ফলে আর হুদুদ আইনের আওতায় মেয়েদের জিনার অভিযোগ এনে পুলিশে দেওয়া যাবে না। ধর্ষনের মামলা প্রমানের জন্য ৪ জন চাক্ষুস স্বাক্ষী হাজির করার প্রাচীন আইন ও তাতে ব্যার্থ হলে উলটা অভিযোগকারিনীকেই জিনার দায়ে প্রকাশ্যে পাথর ছুড়ে মৃত্যুদন্ড বা বেত্রাঘাতের উদ্ভট অমানবিক আইন বাতিল হয়। এ আইনের সুফল কতটা হয় তা জানতে আরো কিছু সময় লাগবে। তবে মানবাধিকার সংস্থাগুলির মতে এই আইন আসলে হুদুদ আইনকে গ্রহনযোগ্য করবার আরেকটি প্রহসন বলে বর্ননা করেছে। বিখ্যাত ক্রিকেটার ও বর্তমানে একটি রাজনৈতিক দলের নেতা ইমরান খান ও অনুরুপ ধারনাই প্রকাশ করেন [৭]।

অনার কিলিং পাকিস্তানসহ যেসব দেশে রাষ্ট্রীয় মদদে চলে সেসব দেশে দূর্বল আইন ও তার ততোধিক দূর্বল প্রয়োগ এই প্রথার জনপ্রিয়তার একটি বড় কারন। এসব দেশের প্রচলিত আইনের কিছু ফাঁককে নারী বিদ্বেষী আদালতগুলি নিদারুনভাবে অনার কিলিং এর আসামীদের পক্ষে ব্যাবহার করে। অনার কিলিং কে পাকিস্তান, জর্ডানসহ আরো কিছু দেশের আদালত কায়দা করে পূর্বপরিকল্পিত হত্যাকান্ড হিসেবে বিবেচনা করে না। এসব হত্যাকান্ডকে তারা সাময়িক উত্তেজনার বশত হত্যা (পাশ্চাত্য দেশগুলিতে যা ম্যান স্লটার বলে বিবেচিত) বলে চালিয়ে দিয়ে অপরাধীকে লঘু শাস্তি দিয়ে ছেড়ে দেয় (পাকিস্তানের পেনাল কোডের ৩০০-১ ধারা)। হুদুদ আইনে আবার এসব অপরাধী ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারকে ক্ষতিপূরনের টাকা দিলে বা অপরপক্ষ মামলা তুলে নিলে এই লঘু শাস্তিও আর পেতে হয় না। মানুষ খুন করে সম্পূর্ন আইনী উপায়েই দায়মুক্তির চমৎকার ব্যাবস্থা ছিল আগের হুদুদ আইনের ছত্রছায়ায়।

পাকিস্তানের আদালতগুলি, বিশেষ করে নিম্ন আদালতগুলি অনেক ক্ষেত্রেই নারী বিদ্বেষী হয়। আদালতগুলি মহিলাদের কি চোখে দেখতে পারে তার বোঝা যাবে এখান থেকে। পাকিস্তানের মেয়েরা সাবালক অবস্থাতেও নিজের পছন্দমত স্বামী বেছে নিলে বা কারো সাথে পালিয়ে গেলে মেয়ের বাবা মেয়েকে অপহরন করা হয়েছে বলে মামলা দিতে পারে। এক স্বামীর ঘর থেকে ডিভোর্স করে আরেক স্বামী বেছে নিলে আগের স্বামী জিনার দায়ে মামলা করতে পারে। সেক্ষেত্রে আদালত সেসব মেয়েদের মামলা নিষ্পত্তি হওয়া পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় হেফাজতে নেয়। আদালতের ভাষায় এসব মেয়ের সরকারী নাম “ক্রাইম প্রোপার্টি”[৩]। মানুষকে সম্পত্তি হিসেবে এ যুগে আর কোন দেশের আদালত অভিহিত করে বলে আমার জানা নেই।

মোহাম্মদ ইউনুস নামের এক ব্যাক্তি তার স্ত্রীকে অবৈধ যৌনাচারের দায়ে হত্যা করে। যদিও মেডিক্যাল রিপোর্ট, পারিপার্শ্বিক অবস্থা তার দাবীকে সরাসরি নাকচ করে দেয়, কিন্তু মাননীয় আদালত তার রায়ে বলেন; “অভিযুক্ত ব্যাক্তি নিহত মহিলার দুই সন্তানের জনক, যখন এই লোক তার স্ত্রীকে দেহের বিভিন্ন স্থানে উপুর্যুপুরি ছুরি মেরে হত্যা করেছে তখন বুঝতে হবে যে সেই মহিলা নিশ্চয়ই এমন গুরুতর কোন অন্যায় করেছে যা এই ব্যাক্তিকে ক্রোধান্বিত করেছে” [৩]।

’৯৪ সালে লাহোর হাইকোর্টে আরেকটি অনার কিলিং ঘটনায় লিয়াকত আলী নামের এক লোকের বিচার হচ্ছিল। সে তার নিজ বোনকে ছুরি মেরে গুরুতর আহত করে ও বোনের প্রেমিক বলে কথিত এক লোককে মেরেই ফেলে। তার উকিল আদালতে যুক্তি দেয়, “ইসলামী সমাজে জিনাকারী ধরা পড়লে তাকে প্রকাশ্যে তৎ ক্ষনাত হত্যা করার বিধান আছে, এসব হত্যা মূলত অপরাধ বলেই বিবেচনা করা উচিত নয়, এগুলি ধর্মীয় দায়িত্ব”। বিজ্ঞ জজ সাহেব এই যুক্তির পক্ষে ঐক্যমত প্রকাশ করেন [৩]।

মানবাধিকার সংস্থাগুলির মতে পাকিস্তানের সংঘটিত অনার কিলিং ঘটনাগুলি সবচেয়ে বেশী ঘটে নিজের পছন্দের স্বামী বেছে নেওয়ার কারনে। প্রাপ্ত বয়ষ্ক মেয়েরা নিজের পছন্দের লোকের সাথে বিয়ে করলে সেটাকেও জিনা হিসেবে বিবেচনা করা হতে পারে। এরপর মেয়ের বাবা বা ভাই সে মেয়ে এবং তার স্বামী উভয়কেই হত্যা করতে পারে। এসব মামলা আদালতে উঠলে জজ সাহেবরা অনেক ক্ষেত্রেই অপরাধীকে ঝোকের মাথায় হত্যা করেছে বিবেচনা করে লঘু দণ্ড দিয়ে ছেড়ে দেয়। পাঞ্জাবের মোহাম্মদ রিয়াজ এবং মোহাম্মদ ফিরোজ নামের দুই ভাইকে নিম্ন আদালত তাদের বোনকে হত্যা করার অপরাধে যাবদজীবন কারাদন্ড দেয়। বোনের অপরাধ ছিল নিজের পছন্দের লোককে বিয়ে করা। আসামী পক্ষ লাহোর হাইকোর্টে আপীল করলে আদালত দারুন বিবচেনা ও মহত্ব দেখিয়ে সাজার পরিমান ১৮ মাসে নামিয়ে দেয় (বিচারের প্রক্রিয়ায় যা তাদের ইতোমধ্যে অতিবাহিত হয়েই গেছে)। আদালত তার রায়ে বলেন, “আমাদের সমাজে অনুমতির বাইরে মেয়ে বা বোন নিজের ইচ্ছানুযায়ী স্বামী বেছে নিলে তাদের কেউই ক্ষমা করতে পারে না” [৩]।

অনার কিলিং এর প্রতি রাষ্ট্রীয় মদদের আরেকটি উদাহরন হিসেবে জর্ডানের কথা উল্লেখ করা যায়। নারী অধিকার বিবেচনায় জর্ডান দেশটির সামগ্রিক ইমেজ মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলির তূলনায় অনেক উন্নত। তবে সেখানেও অনার কিলিং এর প্রতি রাষ্ট্রীয় আইনের পরিষ্কার স্বীকৃতি আছে। “According to Article 340 of the criminal code, “A husband or a close blood relative who kills a woman caught in a situation highly suspicious of adultery will be totally exempt from sentence [৮].” কি দারুন আইন। তবে আর্টিকেল ৯৮ আবার কিছুটা উদারতার পরিচয় দিয়ে অনার কিলিং এর জন্য যথাকিঞ্চিত শাস্তির ব্যাবস্থা করেছে। “Article 98, meanwhile, guarantees a lighter sentence for male killers of female relatives who have committed an “act which is illicit in the eyes of the perpetrator [৮].” তবে এই লঘুতর শাস্তির মাত্রা হল সাধারনত ৩ থেকে সর্বোচ্চ ১ বছরের কারাদন্ড। তবে এই লঘু শাস্তি লঘুতর করারও মোক্ষম কায়দা আছে। খুনী যদি ১৮ বছরের নীচে হয় তবে আর নো চিন্তা, মাত্র দু’তিন মাস পরেই মুক্তি বা কিশোর সংশধোন কেন্দ্রে পাঠানো হয় যেখান থেকে তারা ক্লীন রেকর্ড নিয়ে বেরিয়ে আসতে পারে। রানিয়া আরাফাত নামের ২১ বছরের এক মেয়েকে তার দুই খালা বেড়াতে নিয়ে যায় আম্মান শহরের নির্জন প্রান্তে। সেখানে তার ১৭ বছরের ভাই পরিকল্পিত ভাবে বেরিয়ে এসে বোনকে গুলি করে মারে। বোনের অপরাধ ছিল সে পারিবারিক পছন্দের বিয়েতে সায় দিতে পারেনি [৮]। মধ্যপ্রাচ্যে এভাবে অনেক সময়ই কায়দা করে জল্লাদের ভূমিকায় পরিবারের কনিষ্ঠতম সদস্যকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।

’৯৯ সালে বাদশাহ আব্দুল্লাহ ক্ষমতা নেবার পর অবশ্য বেশ চেষ্টা করেন এই বর্রর প্রথার বিরুদ্ধে কঠিন ব্যাবস্থা নেবার। কিছু কাজও হয়। যথারীতি মোল্লা চক্র চরম ভাবে বাধ সাধে। ২০০০ সালে তাদের পার্লামেন্টে উপরে উল্লেখিত আর্টিকেল ৩৪০ বাতিল করার উদ্দেশ্যে উত্থাপিত একটি বিল মাত্র ৩ মিনিটের মাথায় খারিজ হয়ে যায়। দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল ইসলামিক একশন ফ্রন্ট এ বিলকে অভিহিত করে; “এ আইন আমাদের ইসলামী, সামাজিক, ও পারিবারিক মূল্যবোধ ধ্বংস করবে, এ আইনের দ্বারা স্বামীদের ক্রোধান্বিত হবার মানবাধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে তাদের স্ত্রীদের অবৈধ যৌনাচারের কারনে স্বামীদের ক্রোধান্বিত হবার মানবাধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে”। এর মাত্র দশ দিন পর অভূতপূর্ব ভাবে ৫০০০ লোক বাদশাহর ভাই এ নেতৃত্বে রাস্তায় এই আইনের বিপক্ষে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে [৮]।

তবে তাতে লাভের লাভ তেমন কিছু হয়নি। বাদশাহ আবদুল্লাহ ২০০১ সালে নিজে উদ্যোগী হয়ে নিজের ক্ষমতায় একটি সাময়িক কঠোর আইন করেন, যা ২০০৩ সালে পার্লামেন্ট বাতিল করে দেয়। ২০০৩ সালে আবারো অনার কিলিং এর বিরুদ্ধে শক্ত আইন প্রনয়নের আরেকটি বিল কট্টরপন্থীদের কারনে বাতিল হয়ে যায়। এই বিল বাতিলের মাত্র একদিন পর এক পরিবারের তিন ভাই তাদের স্বেচ্ছায় স্বামী বেছে নেওয়া দুই বোনকে মধ্যযুগীয় কায়দায় কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে মারে [৯]।

এখানে দুটি কথা বলে নেওয়া ভাল। কেউ কেউ হয়ত মনে করতে পারেন যে পরিবারের কোন মহিলার অনৈতিক বা অবৈধ যৌনাচারের কারনে হত্যা করাটা মাত্রাতিরিক্ত, তবে মহিলাও তো অপরাধী একথা মানতে হবে। তাদের জন্য খবর; কাগজে কলমে বা আদালতে অবৈধ যৌনাচার বা জিনা বলতে কি বোঝায় তা পরিষ্কার নয়। যেমন, পাকিস্তান বা মধ্যপ্রাচ্যে কোন প্রাপ্ত বয়ষ্ক মহিলাও নিজের ইচ্ছায় কোন ব্যাক্তিকে বিয়ে করলে সেটাকেও জিনা হিসেবে বিচার করা হতে পারে। পাকিস্তানের আদালতের উদাহরন আগে দিয়েছি। আদালতের কাছে অনেক সময়ই খুন হয়ে যাওয়া মহিলা জিনা করেছে এই অভিযোগই যথেষ্ট। স্ত্রীর সাথে কথা কাটাকাটি হয়েছে বা স্ত্রী তার পরিবারে বেড়াতে যেতে চেয়েছে এমন ঘটনাও স্বামী জিনার সমতূল্য অপরাধ ধরে নিয়েছে। এমন ঘটনাও আছে যে কোন লোকে রাতে স্বপ্ন দেখেছে যে তার স্ত্রী অন্য কোন লোকের সাথে সম্পর্কে করেছে তার কারনেও সে স্ত্রীকে মেরে ফেলেছে।

জর্ডানের মতই আরো বেশ কটি মধ্যপ্রাচ্যীয় ও উত্তর আফ্রিকার দেশ যেমন সিরিয়া, মরক্কো, তুরষ্কে অনার কিলিং এর পক্ষে এ ধরনের নমনীয় আইন আছে। তবে তুরষ্ক সম্প্রতি এ আইন কিছুটা বদল করেছে। মুসলমান প্রধান দেশগুলির বাইরেও ব্রাজিল, কলম্বিয়া, হাইতিতে একই ধরনের আইন আছে, ফলাফলও অন্যরূপ [১০]। বিস্ময়কর হলেও সত্য যে পশ্চীমের দেশগুলির মাঝে ইটালীতেও এরকম আইন এই মাত্র সেদিন ‘৮১ সাল পর্যন্ত ছিল। কারন মনে হয় রাষ্ট্রের উপর চার্চের প্রভাব। তার একটি উদাহরন কিছুদিন আগেই সেখানে ঘটেছে। এক লোক তার স্ত্রীকে পিটিয়ে মৃত ভেবে ট্র্যাশ বীনে ফেলে দেয়। মহিলার অপরাধ ছিল সে স্বামীর পরগামিতায় বিরক্ত হয়ে ডিভোর্স চেয়েছিল। মহিলা কোনভাবে ভাগ্যক্রমে বেচে যায়। এই মামলা আদালতে উঠলে স্থানীয় চার্চের যাজক একে ভালবাসার কারনে হামলা বলে দাবী করেন ও তারা উলটা মহিলার বিরুদ্ধে স্বামীকে গ্রহন না করার অপরাধে মামলা ঠুকে বসেন [১১]।

ভারতেও অনার কিলিং এর বেশ কিছু ঘটনা প্রতি বছর ঘটে। এর অধিকাংশই মূলত ঘটে পাঞ্জাব, হরিয়ানা, ও উত্তর প্রদেশের গ্রাম্য এলাকায়। এ ছাড়া বিহার রাজস্থান উল্লেখযোগ্য। সতী নারীর আত্মহনন (কিছু ক্ষেত্রে বলপূর্বক) যা দুয়েকটা ঘটে তার সবই রাজস্থানে। ভারতে অনার কিলিং ঘটে থাকে মূলত সনাতন হিন্দু ধর্মীয় জাত প্রথার কারনে। জাতপাতের কঠোর প্রথা ভংগ করে অন্য জাতে কেউ বিয়ে করলে অনেক ক্ষেত্রে ধরে নেওয়া হয় যে পরিবারের সম্মানহানি হয়েছে, তখন পারিবারিক সিদ্ধান্তে ঘটানো হয় অনার কিলিং। সাধারনত কোন দেশে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে গেলে এসব গোড়ামী কমে। তবে আশংকার কারন হচ্ছে কিছু মানবাধিকার সংগঠন রিপোর্ট করছে যে বর্তমানে ভারতের বিপুল অর্থনৈতিক উন্নতির ফলে অনার কিলিং বেড়ে যাচ্ছে। কারন তাদের মতে এর ফলে মানুষ বহির্মূখী হচ্ছে বেশী, ভিন্ন জাতের লোকের সাথে মেলামেশা বাড়ছে।

তবে আশার কথা হল, মধ্যপ্রাচ্যীয় বা পাকিস্তানের মত ভারতে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এই বর্বর প্রথাকে উৎসাহিত করা হয় না। ভারতের আদালতে ওসব দেশের মত অনার কিলিং এর জন্য কোন আলাদা নমনীয় ব্যাবস্থা নেই, সাধারন হত্যা হিসেবেই বিচার করা হয়। স্থানীয় পর্যায়ে ধর্মীয় পঞ্চায়েত এসবে উৎসাহ দিলেও জাতীয় পর্যায়ে উগ্র ধর্মীয় নেতারা এসব প্রথার বিরুদ্ধে আইন আদালতকে হুমকি দেয় না। ‘৮৭ সালের বহুল প্রচারিত রুপকানওয়ারের চিতার আগুনে মৃত্যুর ঘটনার পর রাজ্য সরকার এর বিরুদ্ধে কঠোর আইন করে, কেন্দ্রীয় সরকারও সতী প্রতিরোধ আইন নামে নুতন আইন প্রনয়ন করে, ধর্মীয় কোন সংগঠন এসবে আপত্তি জানায়নি। সরকারের ভূমিকাও কঠোর। তাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চিদাম্বরন গত বছরই অনার কিলিংকে এই শতকের কলংক হিসেবে বর্ননা করেছেন। তিনি কঠোর ভাষায় স্থানীয় ধর্মীয় পঞ্চায়েতগুলির ভূমিকারও নিন্দা করেন [১২]।

উপরের আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে অনার কিলিং কোন নির্দিষ্ট ধর্ম বা দেশের মাঝে সীমাবদ্ধ নয়। এর মূল ধর্মে নয়, তবে নি:সন্দেহে ধর্মের নামে বেশ ধর্মীয় নেতা মোল্লা পুরুত এসব কাজ সরবে সমর্থন করেন। সাধারন মানুষও ধর্মের নামে অন্ধ হয়, পুরুষতন্ত্রকে জিইয়ে রাখার জন্য নিজের বিচার বিবেকে হারিয়ে এমনকি ধর্মে আসলেই কি আছে তাও জানতে চায় না। যেমন, ইসলাম ধর্মে স্বেচ্ছায় স্বামী বেছে নেবার কারনে হত্যার কোন বিধান নেই। কিন্তু মুসলিম বিশ্বের অনার কিলিং এর একটি বড় কারন হল এটি, যার পেছনে স্থানীয় মোল্লা গ্রুপের সক্রিয় সমর্থন আছে, সমাজ ও রাষ্ট্রেরও রয়েছে এ ধরনের হত্যার পেছনে প্রচ্ছন্ন সমর্থন। আজকের বিশ্বে অনার কিলিং এর সবচেয়ে বড় শিকার মুসলিম সমাজেই। এমনকি পাশ্চাত্য দেশে এর আমদানীও মূলত ঘটছে মধ্যপ্রাচ্য ও পাকিস্তানী অভিবাসীদের দ্বারা। যদিও আজকাল মুসলিমদের মাঝেই অনেকে এর বিরুদ্ধে সরব হচ্ছেন, ধর্মের চোখেই দেখাতে চেষ্টা করেছেন যে এই প্রথা কত বর্বর। ধর্মে এসব মোটেও বলা নেই, মাত্র গুটি কয়েক গ্রাম্য অশিক্ষিত মোল্লার কারনে ধর্মের নিন্দা করা অন্যায় এ জাতীয় দায় এড়ানো কথায় ক্ষতি হয় নিজেদেরই। মাত্র গুটি কয়েক লোকের কারনে বদনাম হলে তাদের সমর্থন না দিয়ে বর্জন করাটাই যুক্তিযুক্ত। তা না করে উলটা এসব বর্বর প্রথার সমালোচনাকারীদের গণহারে ধর্ম বিদ্বেষী এ ধরনের কথা বলা খারাপ ছাড়া ভাল ফল আনবে না। নিরপক্ষ মানুষ কোরান, হাদীস, বেদ, গীতা ঘেটে গবেষনা করতে যাবে না ধর্মে আসলেই কি বলা আছে তা দেখতে। সে ধর্মকে সেই ধর্মের কড়া অনুসারী বলে দাবীদারদের আচরন দিয়েই বিচার করবে। পাশ্চাত্য বিশ্বে সেটাই ঘটছে।

প্রশ্ন উঠতে পারে যে এই সমস্যার সমাধান কি? সমাধান বলা খুব সহজ, তবে কাজে পরিনত করা মোটেও সহজ নয়। কঠোর আিন প্রনয়ন অবশ্যই অতি অবশ্যই দরকার। তবে সাধারন অনার কিলিং প্রবন দেশগুলির সাধারন মানূষের মন থেকে মহিলাদের সনাতনী ধ্যান ধারনায় পণ্য হিসেবে গণ্য করার মারাত্মক সংস্কৃতি থেকে মুক্ত হতে না পারলে কাগুজে আইন কানুন ও তেমন কিছু করতে পারবে না। এটা একটি সামাজিক বিপ্লবের সমতূল্য।

রেফারেন্সঃ
[১] http://www.telegraph.co.uk/news/worldnews/1583420/Saudi-woman-killed-for-chatting-on-Facebook.html
[২] http://www.timesonline.co.uk/tol/news/world/iraq/article5661466.ece
[৩] http://www.amnesty.org/en/library/info/ASA33/018/1999
[৪] http://news.bbc.co.uk/2/hi/programmes/correspondent/909948.stm
[৫] http://news.bbc.co.uk/2/hi/south_asia/4311055.stm
[৬] http://www.taipeitimes.com/News/world/archives/2004/07/24/2003180222
[৭] http://en.wikipedia.org/wiki/Hudood_Ordinance
[৮] http://www.gendercide.org/case_honour.htm
[৯] http://news.bbc.co.uk/2/hi/middle_east/3094736.stm
[১০] http://www.legalserviceindia.com/article/l243-Violence-against-woman—Issue-Of-Honor-killing.html
[১১] http://www.stophonourkillings.com/?q=node/4267
[১২]http://www.thaindian.com/newsportal/uncategorized/honour-killings-a-shame-on-india-chidambaram_100224214.html