২৩ শে ফেব্রয়ারী।….আজকে শহরের রাস্তা দেখে মনে হচ্ছে যেন কোন একটা মায়াপুরি – নিরব, নিস্তব্ধ। সকলেই চলছে, কিন্তু মুখে কোন কথা নেই। বিষাদ আর বেদনার ঘনছায়া তাদের চোখে মুখে। আশ্চর্য! সংবাদপত্রগুলোর অধিকাংশই এমন নিরেট মিথ্যা লিখেছে যে বলবারই নয়। ইনসাফ আর আজাদ কতকটা সত্য লিখতে চেষ্টা করেছে। আজাদের জন্য দূঃখ হয়। গতকাল সত্য তথ্য উদঘাটনের অপরাধে বিশেষ সংখ্যাটি বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবার পর বেচারা আজ বড় সোজা হয়ে গেছে। গভর্ণমেন্ট পরিবেশিত সংবাদের বাইরে বড় একটা সে ঘেঁসেনি। আশ্চর্যের কথা হচ্ছে – মর্ণিং নিউজ প্রেস ভস্মীভূত হয়ে যাবার পরও – বড় জড়সড় ভাবে মোটে এক পৃষ্ঠা হয়ে সেটা বেরিয়েছে আর তাতে দৃঢ় ভাবেই বলা হয়েছে যে Voice of Nation Cannot die and will not die. হয়তবা এ আস্ফালন সত্যি, কারন যা শক্ত তার প্রাণ, বাপস! দুষ্ট লোকেরা বলাবলি করছে যে মর্ণিং নিউজের বিরহ সহ্য না করতে পেরে সরকার গর্ভণমেন্ট প্রেস হতে তা মুদ্রনের ব্যাবস্থা করে দিয়েছেন।
সংবাদপত্রের খবরে প্রকাশ – গতকাল পরিষদে একটি বিল নাকি পাশ হয়েছে যাতে বলা হয়েছে যে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করবার জন্য প্রাদেশিক সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে সুপারিশ করবেন। ছাত্র সমাজ এটাকে একটা নিছক ভাওতা বলেই ধরে নিয়েছে। খাজা নাজিমুদ্দিনও ১৯৪৮ সনে এমনি এক ভাওতা দিয়ে আন্দোলনকে ধামাচাপা দিয়েছিলেন। ছাত্রদের দাবী আজ ব্যাপক ভাবে মাইক যোগে প্রচার করা হচ্ছে।
– বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে হবে।
– আরবী হরফে বাংলা লেখা চলবে না।
– ১৪৪ ধারার উচ্ছেদ চাই।
– পুলিশী হামলা চলবে না।
– লীগ মন্ত্রিসভার পদত্যাগ চাই।
– শহীদদের ক্ষতিপূরন করতে হবে।
– গুলি চালনা সম্পর্কে তদন্তের জন্য একটি বেসরকারী তদন্ত কমিশন চাই।
– অভিযুক্ত ও অপরাধী কর্মচারীদের উপযুক্ত বিচার চাই।
– রাজবন্দীদের বিচার চাই।
সব চাইতে আশ্চর্য ঠেকছে একটা সংবাদ পড়ে। অবিভক্ত বাংলার লীগ সেক্রেটারী দৃষ্টিহীন বৃদ্ধ জনার আবুল হাসিম সাহেব কে নাকি গ্রেফতার করা হয়েছে। এই সেই আবুল হাসিম, যার বাগ্মিতায় আর আত্মত্যাগে এক দিন সারা ভারতে জয় জয়কার পড়েছিল। এই সেই আবুল হাসিম, যিনি পাকিস্তান হাসিলের জন্য যে কোন ত্যাগ স্বীকারে রাজী ছিলেন। তার সে কর্মের পুরষ্কার, ভাগ্যে ছিল তার হাজতবাস। ধন্য নুরুল আমিন! বিচিত্র তোমার মহিমা!
আজকের ধর্মঘট সবচাইতে গুরুত্ত্বপূর্ণ। সেক্রেটারিয়েট ও অন্যান্য অফিস তো বন্ধই, তদুপরি রেলওয়ে ওয়ার্কশপ ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে ধর্মঘট করেছে। সকাল থেকে রেলগড়ি ও অন্যান্য যানবাহন বন্ধ। বেলা এগারোটায় রেলওয়ে ওয়ার্কশপের কর্মচারীবৃন্দ কার্য্যে বিরত থেকে নওয়াবপুর রেলওয়ে ক্রশিং এর কাছে সমবেত হতে থাকে। আজ তারা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনার্থে এতই উন্মুখ যে যে কোন ত্যাগ স্বীকারে তারা প্রস্তুত। কিন্তু দূর্বল সরকার এ শ্রদ্ধাঞ্জলির পরিমাপ করতেও সাহসী নয়। নিরস্ত্র সন্তপ্ত কর্মচারীদের ওপর পুলিশ হঠাৎ লাঠি চালনা আরম্ভ করে। অপ্রস্তুত জনতা অতর্কিত আক্রমনে ছত্রভংগ হয়ে পড়ে। দুইজন গুরুতর আহত হয় এবং কুড়ি জনের মত অল্প আহত হয়। হাসপাতালে গিয়ে দেখলাম – গুরুতর আহত দুজনের পা কেটে ফেলা ছাড়া উপায় নেই। এ কর্মচারীবৃন্দের অপরাধ ছিল যে তারা পুলিশের কথামত কাজে যোগদান করতে রাজী হয়নি। এই তো স্বাধীন দেশের ব্যাক্তি স্বাধীণতার নমুনা। নুরুল আমিনের জমানায় সব কিছুই সম্ভব হল।
বিকেলের দিকে আজ মেডিকেল কলেজ হোষ্টেলে গিয়েছিলুম। একুশ তারিখের স্মৃতি মনে জেগে মনটাকে তিক্ত করে তুলল। দেখলাম, সে জাতীয় তীর্থক্ষেত্রে শত শত লোক সাশ্রুনয়নে আসা যাওয়া করছে। ১২ নং ও ২০ নং শেডের বারান্দা যেখানে বরকত আর সালাহউদ্দিন শহীদ হয়েছে, সে যায়গা ঘেরাও করে রাখা হয়েছে। যেখানে জব্বার শহীদ হয়েছে, সে স্থানটাও চিহ্নিত করা হয়েছে। শহীদদের শুষ্ক রক্ত এখনও তার স্বাক্ষর রেখেছে বারান্দায়, যে স্বাক্ষর জাগাবে অনুবর্তীদেরকে প্রেরনা। হোষ্টেলের ঠিক গেট এর পাশটায় কয়জন বন্ধু দেখলুম চতুষ্কোন আকৃতিতে মাটি খুড়ছে। জিজ্ঞেস করে জানলুম এখানে শহীদানদের স্মৃতিস্তম্ভ হবে। বন্ধুদের উদ্যমের প্রশংসা না করে পারলাম না। শ্রদ্ধায় মস্তক অবনত হয়ে এলো। এক জন ছাত্রবন্ধু একখানা কাগজে স্মৃতিস্তম্ভের প্ল্যান দেখালে। দেখলুম, চতুষ্কোন আকৃতিতে চার ফুট উঠে বাকি ছয় ফুট পিরামিড আকৃতিতে উঠবে। ছাত্রবন্ধুদের এ উদ্যম দেখে সত্যি কত যে আনন্দ হয়েছিল তা বোঝাতে পারব না। ((নোটঃ আমাদের জাতি স্বত্ত্বার অন্যতম স্মারক শহীদ মিনারের প্রথম নকশা!)
আজ সারাদিন মুসলিম হল আর মেডিকেল কলেজ হোষ্টেলের মাইক সমান ভাবে প্রচার করে গেছে। হিংসাত্মক কার্যাবলী দ্বারা ছাত্ররা তাদের দাবীকে নস্যাত করে দেবে না; প্রত্যেকে নিয়ম কানুন শৃংখলার ভেতর দিয়ে তাদের ন্যায্য দাবী জালেম সরকারের কাছ থেকে আদায় করে নেবে, এই হল ছাত্রদের প্রচার কার্য্যের মূলমন্ত্র। গতকালকের জানাজার পবিত্র মিছিলের ওপর পুলিশের ঘৃণ্য হামলার বিরুদ্ধে মাইকগুলো থেকে অবিরাম প্রতিবাদ উঠছে। বিকেলের দিকে মুসলিম হলের মাইক শোনবার জন্য বিরাট জনতা রাস্তা এবং হল প্রাংগনে অপেক্ষা করতে থাকে। এক কথাই বার বার প্রচার করা হছে – তবুও জনতা অনড়। অবশেষে পুলিশ এসে মৃদু লাঠি চার্জ করে অগণিত শ্রোতাদের ছত্রভংগ করে দিল। অসারের গর্জনই সার, তাই দূর্বল খুনী সরকার মানুষের ব্যাক্তি স্বাধীনতা হরন করতে অকারনে লাঠি চালায়।
(চলবে)
দারুন বললেও কম বলা হয়। আমাকে কেউ যেন ঐ খানে দাঁড়া করিয়ে দিয়ে এসেছে! চোখ বন্ধ করলেই ঐখানে চলে যাচ্ছি! (পাম্প দিচ্ছিনা! সত্যি কথা!)
এই কয়েকদিন মুক্তমনায় না এসে দেখি আরেকটু হলে আপনার লেখা গুলো মিস করে যেতাম!!
অসাধারন লাগছে। চলুক। অনেক প্রানবন্ত লেখা। তাড়াতাড়ি পরের পর্ব চাই।
ভালোই লাগছে… চলুক। 🙂