ফাগুনের আবীর মাখানো আগুন
এখানে যারা প্রাণ দিয়েছে
রমনার উর্ধ্বমুখী কৃষ্ণচূড়ার নিচে
যেখানে আগুনের ফুলকির মতো
এখানে ওখানে জ্বলছে রক্তের আলপনা,
সেখানে আমি কাঁদতে আসিনি।
মাহবুবুল আলম চৌধুরী
কোন ভাষার মর্যাদা রক্ষার করার জন্য সেই ভাষাভাষীদের প্রাণ দিতে হয়েছে এরকম ঘটনা পৃথিবীতে একেবারেই বিরল। বাংলাই খুব সম্ভবত একমাত্র ভাষা যে ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য প্রাণ দিয়েছে এই ভাষায় কথা বলা মানুষেরা। আর এই প্রাণ দেয়া শুধু্মাত্র একবার ঘটেনি। দুই দুইবার এই ভাষাভাষীরা আত্মাহুতি দিয়েছে তাদের ভাষার মর্যাদা রক্ষার তাগিদে।
বাংলাভাষীরা প্রথবার প্রাণ দিয়েছে ঢাকায়। উর্দিওয়ালাদের ভাষা উর্দুর আগ্রাসন থেকে বাংলাকে রক্ষা করাই ছিলো মূল কারণ। ছাপ্পান্ন শতাংশ মানুষের মাতৃভাষাকে উপেক্ষা করে মাত্র আট শতাংশ মানুষের ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রতিবাদে রাজপথে নেমে আসে মানুষ। এই ধরনের আন্দোলন পৃথিবীর ইতিহাসে অভূতপূর্ব এবং অতি বিস্ময়কর। অসংখ্য বিষয় নিয়ে অসংখ্য ধরনের আন্দোলন দেখেছে পৃথিবীর মানুষ। কিন্তু মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলন কখনো দেখেনি তারা। ভাষার জন্য মানুষ যে রাজপথে রক্তজবা এঁকে দিতে পারে, ফোটাতে পারে লাল টুকটুকে পলাশ, শিমুল, ফাগুনে জ্বালাতে পারে আবীর মাখানো আগুন, সেই ধারণাতো কারোই ছিল না কখনো। বায়ান্নতেই প্রথম সেই ঘটনা ঘটে। এই আন্দোলন পরে আর শুধুমাত্র ভাষার আন্দোলনে সীমাবদ্ধ থাকেনি। এর থেকে জন্ম নিয়েছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। একটি জাতির নবজন্মের সূচনা হয়েছিল এখান থেকেই। এখন আমরা সবাই জানি যে, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন এবং সেই আন্দোলনে জীবন ক্ষয়ের কারণেই এতো দ্রুত মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল আমাদের। জন্ম হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের।
দ্বিতীয়বার বাংলাভাষীরা প্রাণ দিয়েছে আসামের শিলচরে। আসামের প্রাদেশিক সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিষিদ্ধ করে। এর প্রতিবাদে বায়ান্নর অনুকরণে ১৯৬১ সালের ১৯ মে সত্যাগ্রহ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিল বাঙালিরা। একদল সত্যাগ্রহী মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার দাবিতে রেল লাইন দখল করে সেখানে বসে পড়েন। পুলিশ তাঁদের গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। কয়েক মিনিটের মধ্যে আরেকদল এসে সেখানে বসে পড়েন। এভাবে একদল গ্রেফতার হনতো আরেকদল এসে বসে পড়েন। বায়ান্নর ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে এখানেও। গুলি চালায় পুলিশ। ভাষার জন্য এগারোজন বাঙালি শহীদ হন। এর ফলে প্রাদেশিক সরকার বাংলা ভাষার মর্যাদাকে মেনে নিতে বাধ্য হয় এবং বাংলা ভাষাকে আসাম প্রদেশের দ্বিতীয় দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। যে রেল স্টেশনে এই সত্যাগ্রহ আন্দোলন হয়েছিল সেই স্টেশনের নাম এখন শিলচর ভাষা শহীদ রেল স্টেশন।
ভাষার ক্ষেত্রে সাধারণত দেখা যায় যে, যে ভাষায় বেশি লোকে কথা বলে বা যে ভাষা অধিকতর শক্তিশালী সেই ভাষাটি অধিকতর দুর্বল ভাষার উপর জেনে অথবা না জেনে আধিপত্য চালায়। কিন্তু বাংলার ক্ষেত্রে এই সূত্র প্রযোজ্য হয়নি। বরং উল্টোটাই ঘটেছে। মাতৃভাষার বিচারে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম ভাষা হবার পরেও এর উপর আধিপত্য চালাতে চেয়েছে অল্প সংখ্যক লোকে কথা বলে এমন দুর্বল ভাষাগুলো। অত্যন্ত শক্তিশালী ভাষা হওয়া এবং সাহিত্যের সুপ্রতিষ্ঠিত বুনিয়াদ থাকার পরেও সবচেয়ে বেশি অবহেলিত, সবচেয়ে বেশি নিগ্রহের স্বীকার হতে হয়েছে বাংলাকেই। এই নিগ্রহে বাইরের লোকই যে শুধু সামিল ছিল তা কিন্তু নয়। বাংলার নিজস্ব কিছু লোকেরাও ভিনদেশিদের পক্ষ নিয়ে বাংলার কম ক্ষতি সাধন করার চেষ্টা করেনি। এই অবহেলা, নিগ্রহ এবং ক্ষতি সাধনের প্রচেষ্টা অবশ্য আজকের নয়। সেই প্রাচীন যুগে বা মধ্যযুগেও বাংলাকে একই ধরনের অত্যাচার সইতে হয়েছে। মধ্যযুগের বিখ্যাত কবি, কবি আব্দুল হাকিমতো ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে বলেই ফেলেছিলেন যে,
যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।
তবে মজার বিষয় হচ্ছে এই বার বার আক্রান্ত হওয়া ভাষাই আজ পৃথিবীর অসংখ্য বিলুপ্তপ্রায় ভাষার রক্ষাকবচ হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনকে স্মরণ করে একুশে ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে তুলে নিয়েছে ইউনেস্কো। বর্তমানে সারা পৃথিবীতে ছয় থেকে সাত হাজারের মত ভাষা প্রচলিত রয়েছে। এর অর্ধেকের চেয়ে বেশি ভাষাতেই ভাষাভাষীর সংখ্যা ছয় হাজারের চেয়েও কম। এই সমস্ত ভাষাগুলো ভয়াবহ অস্তিত্বের সংকটে পড়ে গিয়েছে। প্রতিমাসে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে যাচ্ছে দু’টো করে ভাষা। এসআইএল নামের একটি খৃস্টান মিশনারী সংগঠন চারশো সতেরোটি ভাষাকে প্রায় বিলুপ্ত ভাষা হিসাবে চিহ্নিত করেছে। এই সব ভাষায় সামান্য ক’জন মাত্র বুড়ো লোক কথা বলে থাকে। এদের মৃত্যুর সাথে সাথেই পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেবে এই ভাষাগুলো। আর কোনদিনই জানা যাবে না যে এই ভাষাগুলো কীরকম ছিল। এর থেকে অপূরণীয় ক্ষতি আর কী হতে পারে।
ইউনেস্কো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনের মাধ্যমে এই সমস্ত ভাষাগুলোকে বাঁচানোর উদ্যোগ নিয়েছে। বাঁচাতে না পারলেও যাতে এগুলোকে দলিলবদ্ধ করা যায় তার উদ্যোগ নিয়েছে। এতে অন্তত একেবারে হারিয়ে যাবার হাত থেকে বাঁচানো যাবে ভাষাগুলোকে।
বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারীতে মাতৃভাষার জন্য গভীর ভালবাসায় যে সমস্ত তরুণেরা প্রাণ দিয়েছিলেন, তারা শুধু তাদের মাতৃভাষাকেই রক্ষা করেননি। আজ সারা বিশ্বের সকল মানুষের মাতৃভাষা রক্ষার সূর্যসৈনিক হয়ে দাঁড়িয়েছেন তারা। সারা বিশ্বের মানুষের কাছে এখন বীর তারা, পূজনীয় তারা। প্রতিবছরের এই দিনে স্মরণ করা হচ্ছে তাদের দেশে দেশে।
আমরা যেমন ভুলতে পারিনা রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারীকে। পৃথিবীর মানুষও তেমনি ভুলতে পারে না এই দিনকে। মায়ের ভাষায় কথা বলার অপার আনন্দ, মায়ের ভাষাকে রক্ষা করার দুর্দমনীয় দুরন্ত সঞ্জিবনী শক্তি যে লুকিয়ে আছে এই বিশেষ দিনের আড়ালে। আটান্ন বছর আগে শ্যামল কোমল এক দেশের আবেগী তরুণেরা তাদের বুকের তাজা রক্তে কোন এক লাল টুকটুকে ফাগুনে আবীর মাখানো যে আগুন জ্বেলেছিল, সেই আগুনের আলোয় এখন আলোকিত হতে চলেছে পৃথিবীর সকল মানুষের মাতৃভাষা।
|
গানটা একুশে ফেব্রুয়ারীতে শুনতে না পেলেও আজ শুনলাম । ভালো লাগা জানিয়ে গেলাম ।
আমাদেরও গৌরবদীপ্ত ইতিহাস ছিল, ছিল সংগ্রামের উজ্জ্বল ঐতিহ্য।
আমাদেরও অন্যায়ের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠার বিদ্রোহী মন ছিল, ছিল প্রতিবাদের ধারালো শ্লোগান।
আমাদেরও অধিকার আদায়ের দৃপ্তকঠিন শপথ ছিল, ছিল ত্যাগের নিঃস্বার্থ অঙ্গীকার।
ফরিদকে ধন্যবাদ আজকের এই দিনে মনে করিয়ে দেয়ার জন্য। সশ্রদ্ধচিত্তে শহীদদের আত্মদান স্মরণ করছি। শহীদস্মৃতি অমর হোক।
বিদেশের মাটিতে একুশের গান ও কবিতার জন্য ধন্যবাদ!
আসলে পৃথিবীর কয়টা ভাষাভাষীর নিজের আবাসভূমি আছে?
যেটা আমাদের আছে!
আসলে কৃতজ্ঞতায় নতজানু হতে হয় ঐসব শহীদের প্রতি যারা জীবন দিয়ে আমাদর
ভাষা রক্ষা করেছে।
যারা নিজেদের শোনিতে ভেজা লাল সবুজে মেশা পতাকা আমাদের উপহার দিয়ে গেছে!
তাদের ঋণ কোনদিন আমরা শোধ দিতে পারবনা!
জনাব ফরিদ আহমেদ,
সত্যি এ এক বিষ্ময়! কি এক অমিততেজ ছিলো বাঙ্গালী তরুণের! কি এক উজ্জিবনী মন্ত্রে দীক্ষিত ছিলো জাতি! ঊনিশশতকের তিনচতুর্থাংশ জুড়েই সেই অত্যার্শ্চর্য বাঙ্গালীর পারঙ্গমতা আমাদের নজর কাড়ে! কখনো কখনো আমরা বাঙ্গালীকে বিস্মৃতিশীল অভীক্ষায় অভিহিত করি, হয়তো তা যথার্থও। তবুও কেনো যেনো মনে হয় মাঝে মাঝে, বাঙ্গালীর এই আপাতঃ নিষ্পৃহতা তার অসীম ধৈর্য্যের পরিচায়ক। কারণ, সত্যিকার অর্থে শেষ পর্যন্ত বাঙ্গালী কখনো অন্যায়- অনাচারের কাছে মাথা নত করেনি। আমরা অবহেলিত হয়েছি, অত্যাচারিত হয়েছি কিন্তু কোন একসময় বাঙ্গালী এসবের বিরুদ্ধে ফুঁসেও উঠেছে। ১৯৫২, ‘৫৬, ‘৬১, ‘৬২, ‘৬৯, ‘৭১ এর উদাহরণ। ঐ ধরনের উদাহরণ সুদূর আতীতের বাঙ্গালীর ইতিহাসেও আছে! তবে এটি সত্যি যে জাতি হিসেবে বাঙ্গালীর গৌরবের যদি কিছু থাকে তা এই অমর আনন্য ভাষা সংগ্রাম। এই ভাষাই বাঙালীকে আজও ঐক্যের বন্ধনে বেঁধে রেখেছে। বাঙালী জাতির ঐক্যের হাতিয়ার এই বাংলা ভাষা, ভাষার সংগ্রাম তথা অমর ২১শে ফেব্রুয়ারী। শুধু তাই না, আপনার সুরে সুর মিলিয়ে বলা যেতে পারে বিশ্বের তাবৎ ভাষার রক্ষা কবচও আজ এই বাঙ্গালীর পলাশ ফোটানো অমর একুশ!