ইয়ারার তীরে মেলবোর্ন- [০১] [০২] [০৩] [০৪] [০৫] [০৬] [০৭]
০৮
বুধবার ১৫ জুলাই ১৯৯৮
ইয়ারা ইয়থ হোস্টেল
মেলবোর্নের আকাশ যে কত ঘন ঘন রঙ বদলায় তুমি ভাবতেও পারবে না। কাল রাতে সেই যে ঝম্ ঝম্ বৃষ্টি – সকালে তার চিহ্ন মাত্রও নেই। হোটেল থেকে যখন বেরোচ্ছি রোদে ঝলমল করছে চারদিক। তাই বলে যদি ভাবো ‘মর্নিং শো-জ দি ডে’ – ভুল করবে। মেলবোর্নের জন্য ওই আপ্তবাক্য খাটে না। আজ সারাদিনে আকাশের কত রূপ যে দেখলাম! এই রোদ, একটু পরে প্রচন্ড কুয়াশা, আবার ঘন্টাখানেকের মধ্যেই দেখা গেল কুয়াশার আস্তরণ সরিয়ে সূর্য তার হাসিমুখ দেখাচ্ছে। কয়েক মিনিটের বৃষ্টিও হয়ে গেল শহরের কোথাও কোথাও। শুধু আবহাওয়ার বদল নয় – আমার অবস্থা ও অবস্থানের বদলও হয়েছে আজ অনেক। বলছি ক্রমান্বয়ে।
ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে আজ মনটা অন্যরকম ভালো হয়ে গেল। বেলুন ফেস্টুন আর ইউনিভার্সিটির পতাকায় ছেয়ে গেছে ক্যাম্পাস। লাল-নীল টি-শার্ট গায়ে প্রচুর ছাত্রছাত্রী নতুনদের স্বাগত জানাচ্ছে গেটের কাছে, রাস্তার মোড়ে মোড়ে। ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার সেজেছে অপরূপ সাজে। দরজায় লাগানো লাল-নীল-হলুদ বেলুনের ঝোপ পেরিয়ে কাউন্টারের সামনে দাঁড়াতেই দেখতে পেলাম আইডাকে। মাথায় অসংখ্য বেণীর ঘন্টায় টুং টাং শব্দ করতে করতে কি যেন বলছে। কনফার্মেশান লেটারটা এগিয়ে দিতেই হাসিমুখে বললো – “ইউ হ্যাভ টু গো টু গ্রাজুয়েশান সেন্টার। অল পোস্টগ্র্যাড এনরোলমেন্ট উইল বি ইন 1888 বিল্ডিং”।
1888 বিল্ডিং এর যেদিকে স্কলারশিপ অফিস তার বিপরীত দিকে যেতে হলো আজ। গ্রাজুয়েশান সেন্টারেই পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্টদের এনরোলমেন্ট। সেকেন্ড সেমিস্টারে মনে হয় খুব বেশি স্টুডেন্ট এনরোল করে না। বললো – সকাল দশটায় ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টদের জন্য ওরিয়েন্টেশান প্রোগ্রাম আছে ওল্ড প্যাথোলজি বিল্ডিং-এ। তারপর ক্যাম্পাস ট্যুরের ব্যবস্থা আছে। এনরোলমেন্ট বিকেল তিনটায়।
ওল্ড প্যাথোলজি বিল্ডিং শুনে ভেবেছিলাম ওটা মেডিকেল ফ্যাকাল্টির দিকে হবে কোথাও। কিন্তু না প্রায় এক শ’ বছরের পুরনো এই বিল্ডিং-টি ফিজিক্স বিল্ডিং এর কাছেই। আর্কিটেক্চার বিল্ডিং এর পাশে। অনেক বছর আগে ক্যাম্পাস যখন ছোট ছিল তখন হয়তো মেডিকেল ফ্যাকাল্টি এদিকেই ছিল। ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টদের ওরিয়েন্টেশান এখানে। সাড়ে ন’টা থেকেই ভীড় জমে গেছে। পৃথিবীর নানা দেশের প্রচুর শিক্ষার্থী আসে এখানে। চায়নিজ স্টুডেন্টের সংখ্যা মনে হচ্ছে সবচেয়ে বেশি।
ওরিয়েন্টেশান হলো প্যাথোলজি লেকচার থিয়েটারে। ভেতরে ঢুকে কিছুটা হতভম্ব হয়ে গেলাম। এত বড় হল! এটা কি ক্লাসরুম – নাকি আসলেই কোন থিয়েটার যেখানে নাটক মঞ্চস্থ হয়? বিরাট গ্যালারি, সারি সারি আরামদায়ক চেয়ার। চেয়ারের সাথে লাগানো ফোল্ডিং টেবিল। সামনে বিশাল ডায়াস। সেখানে কম্পিঊটার, মাইক্রোফোন, লাইট ও সাউন্ড কন্ট্রোলিং সিস্টেম। সামনের দেয়ালজুড়ে বিশাল হোয়াইট-বোর্ড। দু’পাশে সিনেমার পর্দার মত দুটো বড় বড় সাদা পর্দা। পর্দার সামনে ছাদ থেকে নেমে এসেছে দুটো প্রজেক্টার। এ রকম ক্লাসরুম আমি আগে কখনো দেখিনি।
প্রচুর হৈ চৈ হচ্ছে। সেকেন্ড সেমিস্টারেও প্রচুর আন্ডারগ্রাজুয়েট স্টুডেন্ট। রিসার্চ স্টুডেন্টদের কোর্স-ওয়ার্ক না থাকলে বছরের যে কোন সময় থেকে শুরু করতে পারে গবেষণা। কিন্তু কোর্স-ওয়ার্কও যে বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে শুরু করা যায় জানা ছিল না।
‘সেমিস্টার’ শব্দটি সম্পর্কেও আমার একটা ভুল ধারণা ছিল। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি যখন পড়াশোনা শুরু করি তখন আমাদের সিস্টেমকে বলা হতো সেমিস্টার সিস্টেম। ফার্স্ট ইয়ারের শেষে ফার্স্ট ইয়ারের পরীক্ষা হয়ে যাচ্ছে, পাস করলে সেকেন্ড ইয়ারে ওঠা – এ রকম বছর ভিত্তিক পড়াশোনা ও পরীক্ষা এবং তিন বছর পর সব বছরের রেজাল্ট যোগ করে অনার্সের রেজাল্ট। বছর ভিত্তিক এ পদ্ধতির নাম কেন সেমিস্টার পদ্ধতি হলো আমি জানি না। তাই ভেবেছিলাম একটা সেমিস্টার মানে একটা বছর। অবশ্য বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে নানারকম অবাঞ্ছিত ছুটি, হরতাল আর পরীক্ষা পেছানোর কারণে এক শিক্ষা-বর্ষের কার্যক্রম অনেক সময় দু’বছরেও শেষ হয় না। আর অস্ট্রেলিয়ান শিক্ষার্থীরা জানেই না ‘সেশান জট’ কাকে বলে, ‘অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ ঘোষণা’ বলতে কী বোঝায়, বা কীভাবে করতে হয় ‘পরীক্ষা পেছানোর আন্দোলন’।
আমি যে সারিতে বসেছি সেখানে প্রায় সবাই চায়নিজ। নিজেদের ভাষায় কথা বলছে তারা। গ্যালারিতে প্রচুর সাদা চামড়ার ছেলে-মেয়েও দেখা যাচ্ছে। দূর থেকে দেখে আলাদা করে বলা সম্ভব নয় কে কোন্ দেশের। সামনের দিকে একজন সাদা টুপি পরা দাড়িওয়ালা ভদ্রলোককে দেখা গেলো। এধরণের টুপি বাংলাদেশের মৌলভীসাহেবদের মাথায় খুব দেখা যায়। তবে ইনি অন্য কোন দেশেরও হতে পারেন।
আমার পাশে বসা মেয়েটির সাথে চোখাচোখি হতেই বললাম,
“হাই”
“হাই”
“আর ইউ ফ্রম চায়না?”
“ইয়েস। ইউ?”
“বাংলাদেশ”
“বাংলাদেশ! ইজ ইট ইন আফ্রিকা?”
আমার গায়ের রঙ দেখে আমাকে আফ্রিকান নিগ্রো মনে হতেও পারে তার। কিন্তু আমার চেহারাতেও যে আফ্রিকান ছাপ আছে তা এতদিন কেউ বলেনি আমাকে। এই চায়নিজ মেয়েটির এডুকেটেড গেস বাংলাদেশকে একেবারে আফ্রিকায় নিয়ে গেছে। এটা মেনে নেয়া যায় না।
“ডোন্ট ইউ নো হোয়ার বাংলাদেশ ইজ?”
“সরি, মাই জিওগ্রাফি নলেজ ইজ নট গুড”
কিছুটা রেগে যাচ্ছিলাম। কিন্তু সামলে নিলাম। এখানে যারা এসেছে তাদের প্রত্যেকের দেশের নাম বললে অনেক দেশতো আমিও চিনবো না। তবে ঘরের পাশের একটা দেশের নাম জানবে না এটা কীভাবে হয়? দেশের বাইরে আমার দেশের পরিচয় তুলে ধরাটা আমার কর্তব্য। ডায়েরিতে একটা ওয়ার্ল্ড-ম্যাপ আছে। সেখানে বাংলাদেশের আয়তন এত ছোট যে দেখাতে গেলে ইন্ডিয়াই চোখে পড়ে আগে। তবুও তাকে দেখালাম।
“এই যে তোমাদের চীন, তার পাশে ইন্ডিয়া দেখতে পাচ্ছো, আর এই যে আরেকটু দক্ষিণ দিকে বাংলাদেশ। আমরা তোমাদের এত কাছে অথচ তুমি এই দেশের নামই জানো না?”
“আই নো দিস কান্ট্রি। মইন জালা। উই কল দিস কান্ট্রি মইন জালা”
“হোয়াই? ডু ইউ হ্যাভ এ নেম ফর এভরি ডিফারেন্ট কান্ট্রি?”
“ইয়েস। উই ট্রান্সলেট এভরিথিং”
“হোয়াট ইউ কল অস্ট্রেলিয়া?”
“অথেলিয়া”
ভাষার জাল একেক দেশে একেক সংস্কৃতিতে একেক রকমের। সংস্কৃতির সাথে ভাষা এমন ভাবে জড়িয়ে থাকে যে কোন একটা দেশের সংস্কৃতি না জেনে সে দেশের ভাষা পুরোটা আয়ত্ব করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। ইংল্যান্ড, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া সহ আরো অনেক দেশের ভাষা ইংরেজি। কিন্তু এই ইংরেজিতেও যে কত পার্থক্য তা এখানে আসার আগে কখনো চিন্তাই করিনি।
ঠিক দশটা বাজার সাথে সাথে ওরিয়েন্টেশান প্রোগ্রাম শুরু হলো। ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারের পরিচালক প্রফেসর বারবারা ওয়েলকাম এড্রেস দিলেন। ভীষণ মোটা এই প্রফেসর দারুণ মজার। হঠাৎ হলের সবগুলো লাইট নিভিয়ে দিয়ে বললেন যার যার সিটের নিচে হাত দিতে। দিলাম। হাতে ঠেকলো একটা বড় কাগজের ব্যাগ। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই লাইট জ্বলে উঠলো। দেখলাম প্রত্যেকে যার যার ওরিয়েন্টেশান ব্যাগ পেয়ে গেছে। ভালো লাগলো এদের প্রোগ্রাম প্ল্যানিং। ওরিয়েন্টেশান ব্যাগের মধ্যে মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্টস সার্ভিসগুলোর প্রস্পেক্টাস, ভিসি প্রফেসর গিলবার্টের শুভেচ্ছা বাণী, দরকারী সব ঠিকানা ও টেলিফোন নাম্বার, মেলবোর্ন সিটির ম্যাপ, ট্রাম-ট্রেন-বাসের রুট-ম্যাপ, আরো কত কিছু। ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টদের জন্য যা যা লাগবে তার প্রায় সব তথ্যই আছে এই ব্যাগের মধ্যে।
প্রফেসর বারবারা কম্পিঊটার প্রজেক্টারের মাধ্যমে অনেক তথ্য দেখালেন। ১৮৫৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এই ইউনিভার্সিটির ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আসে মালয়েশিয়া থেকে, তারপর আমেরিকা থেকে। আমেরিকা থেকে এত স্টুডেন্ট এখানে পড়তে আসে জেনে একটু আশ্চর্য লাগলো। ইউরোপের অনেক দেশ থেকেই শিক্ষার্থীরা আসে এখানে। ইন্দোনেশিয়া, আর ইন্ডিয়া থেকে আসা স্টুডেন্টের সংখ্যাও অনেক। লিস্টে আলাদা করে বাংলাদেশের নাম নেই। আমরা হলাম ‘আদার কান্ট্রিজ’ – ৪%। কী কী দেশ মিলে এই আদার কান্ট্রিজ জানি না। বাংলাদেশ থেকে আসা শিক্ষার্থীদের সংখ্যা এই ইউনিভার্সিটিতে এখনো খুব একটা বেশি নয়।
বক্তৃতা শেষে হাততালি দেবার সময় হঠাৎ মনে হলো কুকুরের শব্দ পেলাম। কেমন যেন একটা কুঁই কুঁই শব্দ। সামনের দিক থেকে আসছে। তাকিয়ে দেখি দু’সারি সামনে আমার দিকে তাকিয়ে আছে মুখে কালো মুখোশ লাগানো একটা কুকুর। সোনালী চুলের একটা মেয়ের পিঠে বাঁধা বিশেষ ধরণের ব্যাগের ভেতর থেকে মাথাটা বের হয়ে আছে কুকুরটির। লুসি নয়তো? ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম। লুসিই তো। মুখ বাঁধা বলে চেঁচাতে পারছে না। কিন্তু মনে হচ্ছে আমাকে ঠিকই চিনতে পেরেছে। চোখ পিট পিট করে তাকাচ্ছে। এই মেয়েটি কি কুকুর সাথে নিয়েই ক্লাস করবে প্রতিদিন?
এবার বক্তৃতা করছেন ডাক্তার জোসেফিন নুয়েন। নামের সাথে অনেক ডিগ্রি। কতবছর থেকে এদেশে আছেন জানি না। ইংরেজিতে এখনো একটু চায়নিজ টান আসে। জোসেফিনের শারীরিক উচ্চতা খুব বেশি নয়, কিন্তু পদের উচ্চতা অনেক। তিনি মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটি হেল্থ সেন্টারের পরিচালক। শিক্ষার্থীদের শারীরিক মানসিক ও সামাজিক সুস্বাস্থ্য যে কত দরকার এবং তা কীভাবে রক্ষা করা যায় সে সম্পর্কে টিপ্স দিলেন।
অস্ট্রেলিয়ায় ইউনিভার্সিটি পর্যায়ের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে মানসিক সম্পর্কের সাথে সাথে শারীরিক সম্পর্ককেও খুব সহজ ভাবে দেখা হয়। ইউনিভার্সিটির হোস্টেলগুলোতে ছেলে-মেয়ে একসাথে থাকে। জোসেফিন এ ব্যাপারে বিস্তারিত পরামর্শ দেয়ার সাথে সাথে সতর্কও করে দিলেন যে সবচেয়ে আকাঙ্খিত সম্পর্ক থেকেই সামান্য অসাবধানতায় হয়ে যেতে পারে সবচেয়ে অনাকাঙ্খিত রোগ। অস্ট্রেলিয়ান ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্টদের মধ্যে যৌনরোগ সংক্রমণের হার খুব বেশি। জোসেফিন বলছেন, “ইট ক্যান বি প্রটেক্টেড ইজিলি ইফ ইউ ইউজ সিম্পল এক্সটার্নাল প্রটেকশান – দিস”। বলেই কোটের পকেট থেকে বের করলেন কন্ডমের প্যাকেট। “ইউ ক্যান গেট দিস ভেরি ইম্পর্ট্যান্ট থিং ইন এভরি সুপারমার্কেট, এভরি ফার্মাসি, এন্ড ফ্রম ভেন্ডিং মেশিন ইন দি স্টুডেন্টস টয়লেট”।
আমার একটু অস্বস্তি লাগছিলো। আমাদের সংস্কৃতিতে মানব-মানবীর সবচেয়ে প্রয়োজনীয় সম্পর্ক সম্পর্কেই সবচেয়ে বেশী নীরবতা পালন করা হয় শিক্ষাক্রমে। এ সংক্রান্ত বেশির ভাগ তথ্যই আমাদের জানতে হয় গোপনে নিজেদের মত করে। ফলে অনেক ভুল ধারণা নিয়ে আমরা বড় হই, নিজেদের অজ্ঞানতার খেসারত দিতে হয় বিভিন্ন ভাবে।
জোসেফিন আরো একটা দরকারী কথা বললেন – বিশেষ করে মেয়েদের জন্য-
“নো ম্যাটার হাউ মাচ ইউ লাভ ইওর পার্টনার – নেভার এভার লুজ সেল্ফ কন্ট্রোল। ইট্স ইওর বডি – ইওর ডিসিশান। নেভার টেক ডিসিশান এগেন্স্ট ইওর উইল। ইট ইজ ইউ হু উইল ফেস দি কনসিকোয়েন্সেস এট্ দি এন্ড”।
প্রকৃতি ছেলেদেরকে অনেক বায়োলজিক্যাল এডভান্টেজ দিয়েছে। এডভান্টেজ মানে অপকর্ম করে পালানোর সুযোগ। আর ছেলেরা সারা পৃথিবীতেই এই সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছে। বেশির ভাগ সময়েই দেখা যায় মেয়েদেরই ভালবাসার দায় বয়ে বেড়াতে হয়। অস্ট্রেলিয়ায় কিশোরী মায়ের সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছে।
শিক্ষার্থীদের শারীরিক মানসিক সামাজিক বিকাশের জন্য অনেক এক্সট্রা-একাডেমিক প্রোগ্রাম আছে ইউনিভার্সিটিতে। সবগুলোর খবর দেয়া হলো। ঘন্টা দুয়েকের এই ওরিয়েন্টেশান প্রোগ্রামটি সত্যিই খুব দরকারি।
ওরিয়েন্টেশানের পর ক্যাম্পাস ট্যুরে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা আছে। ওটা আমাকে বাদ দিতে হচ্ছে। কারণ হোটেলে ফিরতে হবে। আলী সাহেব আসবেন আমাকে ইয়থ হোস্টেলে পৌঁছে দিতে।
তাড়াতাড়ি করে বেরোবার সময় হঠাৎ লুসির মালিকের মুখোমুখি হয়ে গেলাম। এত কাছ থেকে তাকে হোটেলেও একবার দেখেছিলাম, কিন্তু তখন লুসির ভয়ে ভালো করে তাকাতে পারিনি। এত সুন্দর এই মেয়েটি কুকুর সাথে নিয়ে বেড়ায় কেন? এখানেও নিয়ে এসেছে একেবারে পিঠে বেঁধে! আমাকে চিনতে পারলো মেয়েটি। হাসিমুখে বললো, “হাই!”
“হাই! হাউ আর ইউ?”
তার সাথে কী কথা বলবো বুঝতে পারছি না। তার সৌন্দর্যে আমার কিছুটা চিত্তচাঞ্চল্য দেখা দিতে শুরু করেছে। হয়তো সে বুঝে ফেলেছে এর মধ্যেই। মনে হচ্ছে সে ছেলেদের এরকম তাৎক্ষণিক চিত্তচাঞ্চল্য দেখতে অভ্যস্ত। আমাকে দেখে যেন সত্যিই খুশি হয়েছে এমন ভাব করে হাসিমুখে বললো,
“গুড। আই স ইউ ইন দি হোটেল। হুইচ কোর্স আর ইউ ডুয়িং?”
“পোস্টগ্র্যাড ফিজিক্স। ইউ?”
“পোস্টগ্র্যাড ল। বাই দি ওয়ে, আই এম কার্স্টিন”
তার বাড়িয়ে দেয়া হাত ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললাম, “আই এম প্রদীপ”
“ইউ আর ফ্রম ইন্ডিয়া, রাইট?”
“নো। আই এম ফ্রম বাংলাদেশ”
“ও! বাংলাদেশ। আই এম ফ্রম জার্মানি, বার্লিন। আর ইউ গোয়িং ফর ক্যাম্পাস ট্যুর?”
“নো। আই হ্যাভ টু গো টু হোটেল। আই এম চেকিং আউট টুডে। নাইস টকিং টু ইউ”।
প্রায় দৌড়ে চলে এলাম। চিত্তচাঞ্চল্যকে প্রশ্রয় দেবার সময় নেই আমার। ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের পাশ দিয়ে ছোট্ট একটা গলিপথ আছে। ওটা দিয়ে শর্টকাটে সোয়ান্সটন স্ট্রিটে এসে ট্রামে উঠে পড়লাম।
হোটেলে পৌঁছলাম পৌনে একটায়। রুমে ঢুকে সুটকেস আর ব্যাগ দুটো নিয়ে পাঁচ মিনিটের মধ্যেই নিচে নেমে এলাম। রিসেপশানে হিসেব-নিকেশ চুকিয়ে চাবি জমা দিয়ে দিলাম। টেলিফোন বিল দেখে চোখ কপালে ওঠার জোগাড়। মাত্র কয়েকটা ফোন করেছি তাতেই বিল এসেছে ঊনিশ ডলার। আলী সাহেবের মোবাইলে ফোন করেছিলাম প্রথম দিন। মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য চার্জ করেছে প্রায় দশ ডলার। মোবাইল ফোনের কলচার্জ এত বেশি! পে-ফোন থেকে একটা লোকাল কল করতে লাগে চল্লিশ সেন্ট। অথচ হোটেলে লোকাল ফোনের জন্য চার্জ করেছে এক ডলার করে। আমি ফোন-কার্ড ব্যবহার করার জন্য হোটেল থেকে মাত্র কয়েকটা কল করেছি। এখন বুঝতে পারছি আলী সাহেব কেন আমাকে হোটেলের ফোন ব্যবহার করতে মানা করেছিলেন।
একটা থেকে দেড়টার মধ্যে আসার কথা আলী সাহেবের। তাঁর ফোর্ড ফ্যালকন আমি এখন চিনি। একটা বাজার পর থেকে দাঁড়িয়ে আছি হোটেলের সামনে লিটল কলিন স্ট্রিটের ফুটপাতে। ব্যাগগুলো মনে হচ্ছে আরো ভারী হয়েছে। সুটকেসটা ফুটপাতের উপর হোটেলের দেয়াল ঘেঁষে রেখে পাশে দাঁড়িয়ে আছি মিনিট বিশেক। আলী সাহেবের আসতে দেরি হচ্ছে। চোখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকাতেই চোখে পড়লো কারস্টিন। লুসিকে কোলে নিয়ে হোটেলের দিকে আসছে। তাড়াতাড়ি চোখ ফিরিয়ে নিলাম অন্যদিকে। এমন ভাবে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম যেন তাকে আমি দেখতে পাইনি। কী কারণে তাকে এড়াতে চাইছি তা আমার নিজের কাছেও স্পষ্ট নয়।
“ঘেউ ঘেউ ঘেউ” – এই লুসিটার জন্য পারা গেল না। আমাকে সে দেখে ফেলেছে।
“হাই প্রদীপ, অলরেডি চেক্ড আউট?”
কারস্টিন আমার নাম মনে রেখেছে বলে ভালো লাগলো। নাম মনে রাখার ক্ষমতা যাদের থাকে তারা সহজেই মানুষের কাছে চলে আসতে পারে। নাম ধরে ডাকলেই কেমন যেন একটা অন্তরঙ্গতা প্রকাশ পায়।
“ইয়েস। অলরেডি ফিনিশ্ড ক্যাম্পাস ট্যুর?”
“নট রিয়েলি। আই হ্যাড টু কাম ব্যাক ফর লুসি। শি ওয়াজ নট ফিলিং কম্ফোর্টেবল। এনিওয়ে, হোয়ার ইউ গোয়িং?”
“নর্থ মেলবোর্ন। ইন এ হোস্টেল”
কারস্টিনের সাথে কথা বলতে আমার ভালো লাগছে। শুনেছিলাম জার্মানরা খুব নাক-উঁচা, বর্ণ-বিদ্বেষী। নীল চোখ আর সোনালী চুলের অহংকার তাদের রক্তে মিশে আছে। এই বর্ণ-বিদ্বেষ থেকে জাতি-বিদ্বেষ, আর সেখান থেকে এত বড় বিশ্বযুদ্ধ বাধিয়ে ফেলেছিল হিটলার। কিন্তু সব নীল-চোখ আর সোনালী চুলের জার্মান যে একরকম নয় তা কারস্টিনকে দেখে বুঝতে পারছি। কত সহজ ভাবে কথা বলছে সে আমার সাথে। টের পাচ্ছি আমার হৃৎপিন্ডে রক্তসঞ্চালন আবারো কিছুটা দ্রুত লয়ে ঘটতে শুরু করেছে।
“ঘেউ ঘেউ ঘেউ ঘেউ” হঠাৎ ভীষণ চঞ্চল হয়ে উঠলো লুসি। কারস্টিনের কোল থেকে লাফিয়ে নেমে গেল। হোটেলের কাচের দরজা খুলে গেল আর প্রায় ছ’ফুট লম্বা এক শ্বেতাঙ্গ যুবক বেরিয়ে এলো হোটেল থেকে। আমি ভালো করে তার দিকে তাকানোর আগেই কারস্টিন অদ্ভুত একটা শব্দ করে এক লাফে যুবকটির গলা ধরে প্রায় কোলে উঠে গেল। তারপর ওই অবস্থাতেই হোটেলে ঢুকে গেল। আমার দিকে একবার ফিরেও তাকালো না। আমি কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম বন্ধ হতে থাকা কাচের দরজার দিকে।
“সরি, আমার একটু দেরি হয়ে গেল” বলতে বলতে গাড়ি থেকে নেমে এলেন আলী সাহেব। আমি আরো সংকুচিত হয়ে গেলাম। আমার জন্য এত করছেন, আবার অল্প একটু দেরির জন্য দুঃখ প্রকাশ করছেন – এত ভদ্রতা এত কিছু কি আমার প্রাপ্য?
“সুটকেসটা বুটে তুলে দাও। আর হ্যান্ড-ব্যাগ দুটো গাড়ির ভেতরে রাখ। কুইক কুইক, এখানে গাড়ি থামতে দেয় না”
এক মিনিটের মধ্যেই হয়ে গেল। গাড়িতে উঠে বসলাম। গাড়ি চলছে ইউনিভার্সিটির দিকে। মনে হচ্ছে হোস্টেলটি ইউনিভার্সিটির কাছাকাছি কোথাও হবে। মেডিকেল ফ্যাকাল্টি পার হয়ে আরো সামনে যাচ্ছি।
“চ্যাপম্যান স্ট্রিট, নর্থ মেলবোর্ন। দাঁড়াও, মেলওয়ে-টা দেখে নিতে হবে” রাস্তার এক পাশে গাড়ি থামাতে থামাতে বললেন আলী সাহেব।
“মেলওয়ে-টা দাও এদিকে”
“মেলওয়ে কী?”
“ওই যে তোমার বাম পাশে মোটা বইটা। মেলবোর্নের সব স্ট্রিট-ম্যাপ আছে ওখানে”
বেশ মোটা একটা বই। পাতায় পাতায় রঙিন ম্যাপ সব। মেলবোর্নের সব অলিগলির হদিশ এখানে। এটা দেখে মেলবোর্নের যে কোন ঠিকানা খুঁজে বের করা যাবে। মিনিট খানেকের মধ্যে আলী সাহেব বুঝে ফেললেন কোন্ দিকে যেতে হবে।
হোস্টেলের দরজায় “নো পেট্স” লেখা দেখেই মনটা ফুরফুরে হয়ে গেল। হোস্টেলে টুইন শেয়ার রুমে থাকতে হবে। সেখানে রুম-মেট যদি কুকুর নিয়ে আসে থাকাটা অসহ্য হয়ে উঠবে।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই চেকিং ইন হয়ে গেল। এই হোস্টেলগুলো মূলত ব্যাক-প্যাক ট্রাভেলারদের জন্য। ইউরোপ আর অস্ট্রেলিয়ার তরুণ-তরুণীরা পিঠের উপর বিরাট ব্যাগ নিয়ে সারা দুনিয়া ঘুরে বেড়াচ্ছে আজকাল। কম খরচে ভ্রমণ আর থাকার জন্য এধরণের হোস্টেল আছে সারা পৃথিবীর বিভিন্ন শহরে। হোস্টেলে মেম্বার আর নন-মেম্বারদের আলাদা রেট। আমি যেহেতু মেম্বার নই – আমাকে প্রতি রাতে তিন ডলার করে বেশি ভাড়া দিতে হবে। সাড়ে বিশ ডলার দিয়ে রুমের চাবি আর একটা কার্ড পেলাম। কার্ডের একদিকে লেখাঃ
Yarra Youth Hostel
Chapman Gardens
76 Chapman Street
North Melbourne, Vic 3051
Australia
এর নিচে আমার নাম লেখা হলো। অন্যদিকে নয়টা বর্গক্ষেত্র। প্রথম বর্গক্ষেত্রে আজকের তারিখ দিয়ে একটা সিল দেয়া হয়েছে। পর পর নয় রাত এই হোস্টেলে থাকলে আমি মেম্বারশিপ পেয়ে যাবো। ওই মেম্বারশিপ নিয়ে আমি পৃথিবীর যে কোন দেশে গিয়ে এরকম ইয়থ হোস্টেলে থাকতে পারবো মেম্বার-রেটে। মেম্বারশিপ এক বছর মেয়াদি।
দোতলার চল্লিশ নম্বর রুমে আমার থাকার ব্যবস্থা। তিন-তলা এই হোস্টেলে কোন লিফ্ট নেই। সুটকেস নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতেই গলদ-ঘর্ম হয়ে গেলাম। আলী সাহেব জোর করে আমার ছোট ব্যাগ দুটো বয়ে নিয়ে এলেন। একাধিক কোম্পানির মালিক নিজের হাতে আমার মত নগণ্য একজন ছাত্রের ব্যাগ বয়ে নিয়ে আসছেন এই দৃশ্য বাংলাদেশে কল্পনাও করা সম্ভব নয়। আমি ভেতরে ভেতরে যেমন সংকুচিত হয়ে যাচ্ছিলাম – তেমনি শিখে নিচ্ছিলাম কীভাবে সত্যিকারের বড় মানুষ হতে হয়। ধনী হতে তো অনেকেই পারেন, কিন্তু বড় হতে পারেন ক’জন?
রুমের কোথায় কী আছে দেখার সময় নেই হাতে। তিনটার মধ্যে ইউনিভার্সিটিতে ফিরতে হবে এনরোলমেন্টের জন্য। সুটকেস আর ব্যাগদুটো রেখে দরজা বন্ধ করে চলে এলাম।
“আমি আস্তে আস্তে চালাবো। তুমি রাস্তা দেখে রাখো। ফেরার সময় এই পথ ধরে হেঁটে ফিরতে পারবে। খুব বেশি দূরে নয় ইউনিভার্সিটি থেকে”
গাড়ি চালাতে চালাতে বলছেন আলী সাহেব। “আর শোন, কাল সন্ধ্যায় তোমাকে একটা জায়গায় নিয়ে যাবো। অনেক বাংলাদেশীর সাথে আলাপ হবে। সন্ধ্যায় রেডি হয়ে থেকো। আমি হোস্টেল থেকে তুলে নেবো তোমাকে”।
এদিকের এলাকাটা খুব সুন্দর। রাস্তার দু’পাশে বেশ বড় বড় গাছ। তারপর ফুটপাত। বাড়িগুলো সব একই ধরণের। দোতলা টাউন-হাউস। হঠাৎ একটা বাড়ির সামনে গাড়ি থামালেন আলী সাহেব।
“দেখি এখানে কোথাও রুম খালি আছে কি না”
“এখানে?”
“এদেশে হয় কি জানো – ছেলে-মেয়েরা বড় হয়ে গেলে কেউ আর মা-বাবার সাথে থাকে না। তখন বুড়ো-বুড়ি একা হয়ে যায়। ছেলে-মেয়েদের রুমগুলো তখন তারা ভাড়া দিয়ে দেয়। সেরকম একটা পেলে তোমার আর কিছু লাগবে না। সস্তায় ভালো থাকার এমন ব্যবস্থা আর হয় না”
কয়েকটা বাড়ির সামনে হেঁটে একটা বাড়ির কড়া নাড়াতে শুরু করলেন আলী সাহেব। কোন সাড়া পেলেন না।
“মনে হয় কেউ নেই এখন। তুমি সন্ধ্যাবেলা এসে খবর নিয়ে যেয়ো। লোকাল শপিং সেন্টারে এরা এড দেয় মাঝে মাঝে। নজর রেখো”
তিনটা বাজার দশ মিনিট আগে আমাকে ইউনিভার্সিটির তেরো নম্বর গেটের সামনে নামিয়ে দিয়ে আলী সাহেব চলে গেলেন। ক্যাম্পাসের ভেতর দিয়ে এক প্রকার দৌড়ে এলাম ১৮৮৮ বিল্ডিং-এ। এনরোলমেন্ট ফরম নিয়ে নির্দেশনা মত গেলাম আর্টস এডুকেশান বিল্ডিং-এ। অনেক স্টুডেন্ট। সবাই পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট পর্যায়ের শিক্ষার্থী। লাইনে দাঁড়ালাম।
মিনিট দশেকের মধ্যে এনরোলমেন্ট হয়ে গেল। আমি এখন পুরো মাত্রায় মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির ছাত্র। আমার স্টুডেন্ট নাম্বার 62733 – এপ্লিকেশান নাম্বারটাই স্টুডেন্ট নাম্বার হয়ে গেছে। ভর্তির জন্য দরখাস্ত করলে যে ফাইল নাম্বার দেয়া হয় ওটাই শেষ পর্যন্ত স্টুডেন্ট নাম্বার হয়ে যায় বলে মনে হচ্ছে।
আমার ছবি যে এত বাজে হয় তা তো তুমি কখনো বলোনি আমাকে। আই-ডি’র ছবিটা দেখে বুঝতে পারছি চায়নিজ মেয়েটি কেন আমাকে আফ্রিকান মনে করেছিল। জানি তুমি এখন কী বলবে। বলবে এই তো- “যেমন দেখতে তেমন ছবিই তো উঠবে”। এখানে ভর্তির জন্য নিজের ছবি নিজেকে আনতে হয় না – কী মজা! ‘প্রথম শ্রেণীর গেজেটেড অফিসার কর্তৃক সত্যায়িত তিন কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি, চারিত্রিক সনদ-পত্র’ জাতীয় কোন ঝামেলা নেই।
কম্পিউটারের সাথে লাগানো ছোট একটা ক্যামেরায় ছবি তোলা হলো এবং সাথে সাথে তা প্রিন্ট হয়ে আই-ডি হয়ে গেল। নতুন নতুন টেকনোলজি দেখছি আর কেমন যেন হয়ে যাচ্ছি আমি। মনে হচ্ছে একেকটা নতুন চোখ গজাচ্ছে আমার। জানি কয়েক বছর পর এসব প্রযুক্তি মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে যাবে। কিন্তু প্রথমবার দেখার অনুভূতিটা যে কী সেটাই তোমাকে বোঝাতে চাচ্ছি।
ট্যাক্স ফাইল কাকে বলে জানো? এদেশে নাকি যারা উপার্জন করে তাদের সবাইকেই ট্যাক্স দিতে হয়। প্রত্যেকের নামেই একটা করে ট্যাক্স ফাইল থাকে। এই ট্যাক্স-ফাইল-নাম্বার বা টি-এফ-এন নাকি খুবই দরকারি। ট্যাক্স অফিসে দরখাস্ত করে এই নাম্বারটা নিতে হয়। ইউনিভার্সিটিগুলোর এনরোলমেন্টের সময় ট্যাক্স অফিস থেকে লোক এসে দরখাস্ত জমা নিয়ে যায়। আজ দু’জন ট্যাক্স অফিসার এসেছিলেন। একটা বুথে বসেছিলেন তাঁরা। ট্যাক্স ফাইল নাম্বারের জন্য দরখাস্ত নিয়ে এসেছি আজ। উনারা কালকেও আসবেন। কাল জমা দিয়ে দেবো। এদেশে কেউ ছ’মাসের বেশি কাজ করলে ট্যাক্স অফিসের চোখে তারা অস্ট্রেলিয়ান। অস্ট্রেলিয়ানদের যে হারে ট্যাক্স দিতে হয়, তাদেরও একই হারে ট্যাক্স দিতে হবে। এই হার কিন্তু কম না – গড়ে প্রায় ৩০%। ১০০ ডলার উপার্জন করলে পাবো মাত্র ৭০ ডলার। তবুও ভাল যে আমার স্কলারশিপটা ট্যাক্স-ফ্রি।
বিকেল চারটা বাজতে না বাজতেই আকাশের মুখ গোমড়া হয়ে গেল। টুপ-টাপ করে কিছুটা বৃষ্টিও ঝরিয়ে দিল। আর ঠান্ডা বাতাস তো আছেই। হোস্টেলে ফিরতে হবে। ওদিকে কোন শপিং সেন্টার আছে কি-না জানি না। কার্লটনের সেফ-ওয়ে থেকে দেড় লিটারের এক বোতল কোক, এক প্যাক মাফিন আর চারটা আপেল কিনলাম। এগুলো দিয়ে কমপক্ষে দু’দিন চলবে। বৃষ্টি আর কনকনে হাওয়া গায়ে মাখতে মাখতে রওনা দিলাম হোস্টেলের দিকে। ইউনিভার্সিটির ১৩নং গেটের কাছে এসে বুঝতে চেষ্টা করলাম কোন্দিক থেকে এসেছিলাম এখানে।
হোস্টেল থেকে একটা ম্যাপ নিয়ে এসেছিলাম। সেখানে হোস্টেলের অবস্থান চিহ্নিত আছে। কিন্তু ম্যাপ পড়তে জানতে হয়। ম্যাপের উত্তর-দক্ষিণের সাথে বাস্তবের উত্তর-দক্ষিণ মেলানোর দক্ষতা না থাকার কারণে বেশ বেগ পেতে হলো আমাকে হোস্টেল খুঁজে বের করতে। অনেক বার পথ ভুল করে, পথ হারিয়ে অবশেষে পথ খুঁজে পেলাম। ভুল করার উপকারিতাও আছে। ভুল থেকে শিক্ষা নিলে নাকি শিক্ষা টেকসই হয়। আমার শিক্ষা কেমন টেকসই হয়েছে তা বোঝার জন্য কাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। কাল ইউনিভার্সিটি যাবার সময় বোঝা যাবে।
হোস্টেলের নাম ইয়ারা ইয়থ হলেও এই অঞ্চলের আশে-পাশে ইয়ারা নেই। যখন তখন ইয়ারার পাড়ে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। হোটেলের ভাড়া থেকে সাড়ে নয় ডলার কম ভাড়ার এই হোস্টেল রুমের একটা বর্ণনা দিই তোমাকে। আট ফুট বাই দশ ফুট একটা রুম। দু’দিকের দেয়াল ঘেঁষে দুটো লোহার খাট, শক্ত ম্যাট্রেস আর খসখসে ছাই রঙের কম্বল। দুটো খাটের মাঝে একফুট দূরত্ব। বিছানার মাথার দিকে বড় একটা কাচের জানালা পুরো দেয়াল জুড়ে। অন্যদিকের দেয়ালের খোপে দুটো স্টিলের লকার। লকারের লক নিজেকেই লাগাতে হয়। নিজের কাছে তালা না থাকলে রিসেপশান থেকে দশ ডলার জমা দিয়ে আনা যায়। পরে তালা ফেরৎ দিলে ডলার ফেরৎ। এই লকারগুলো এত ছোট যে সুটকেস ঢোকে না।
লকারের পাশে একটা নামকাওয়াস্তে ওয়ার্ড্রোব আছে। কয়েকটা প্লাস্টিকের হ্যাংগার ঝুলছে সেখানে। এখন রাত আটটা বেজে গেছে। এত রাতে আর কেউ নিশ্চয় আসবে না এই রুমে। মনে হচ্ছে আজকের রাতের জন্য এই রুম আমার একার। টুইন শেয়ারের এই রুমের সাইজ ভিক্টোরিয়া হোটেলের রুমের চেয়ে অনেক ছোট। অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার কথা বাদই দিলাম। এর মধ্যেই যদি দু’জন থাকে – প্রত্যেকে যদি সাড়ে বিশ ডলার করে ভাড়া দেয় – এই রুমের ভাড়া হয় একচল্লিশ ডলার। হোটেলের চেয়ে সস্তা কীভাবে হলো?
এই ফ্লোরে ক’টা রুম জানি না। করিডোরের একেবারে শেষের দিকে পুরুষ আর মহিলাদের আলাদা আলাদা দুটো করে বাথরুম আর টয়লেট। নিচের তলায় বেশ বড় একটা কমিউনিটি কিচেন। একবার উঁকি মেরেছিলাম একটু আগে। রুমের মাঝখানে কয়েক সারি গ্যাসের চুলা। একসাথে ছোট বড় চারটা করে বার্নার। একটাতে রান্না করছেন একজন বয়স্ক মহিলা। একদিকের দেয়াল ঘেঁষে চারটি বড় বড় ফ্রিজ। ফ্রিজের গায়ে বড় বড় অক্ষরে যা লেখা আছে তা বাংলায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায় এরকমঃ “দয়া করে অন্যের খাবার খাবেন না। যারা খাবার রাখবেন নিজেদের নাম ও রুম নাম্বার লিখে রাখবেন। নাম ও রুম নাম্বার বিহীন খাবার ফেলে দেয়া হবে। ফ্রিজ পরিষ্কার রাখুন”।
আমি মনযোগ দিয়ে নোটিস পড়ছি দেখে মহিলাটি এগিয়ে এসে বললেন, “ভেরি ফানি, ইজন্ট ইট?” বলেই এমন জোরে হাসতে লাগলেন যে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। মহিলার সামনের পাটির বেশ কয়েকটা দাঁত নেই। হাসার সময় জিভ বেরিয়ে আসে। কেমন যেন একটু ভয় পেয়ে গেলাম। দ্রুত চলে এলাম কিচেন থেকে। মহিলার বিকট হাসির শব্দ অনেক দূর থেকে শোনা যাচ্ছিলো।
লাউঞ্জ রুম যেটাকে বলা হচ্ছে সেখানে দুই সেট সোফা আছে ঘরের মাঝখানে। আর ছড়ানো ছিটানো অনেকগুলো ফোল্ডিং চেয়ার। এক কোণায় ছাদের কাছাকাছি দেয়ালে লাগানো একটি বিশ ইঞ্চি টিভি। টিভিতে বিকট শব্দে বিজ্ঞাপন প্রচারিত হচ্ছে। রুমে একজন মানুষও নেই। এসময় মনে হয় কেউ থাকে না। এই রুমে একটা ভেন্ডিং মেশিন আছে। চিপ্স, চকলেট, কোক ইত্যাদি সাজানো আছে ভেতরে।
লাউঞ্জ রুমের বাইরে রিসেপশান। এখন বন্ধ হয়ে গেছে। সন্ধ্যা ছ’টার পর আর কেউ থাকে না রিসেপশানে। হোটেলের মেইন গেট বন্ধ হয়ে যায় রাত দশটায়। দশটার পর কেউ ঢুকতে চাইলে কোড নাম্বার ব্যবহার করতে হবে। প্রতিদিন কোড নাম্বার বদলে যায়। রিসেপশান থেকে প্রতিদিনের কোড সংগ্রহ করতে হয়। আজকের কোড কী তা আমি জানি না। কাল সকালে বেরোবার আগে কোড নাম্বার জেনে বের হতে হবে।
দুটো পাবলিক ফোন আছে সিঁড়ির কাছে। ৭০% ফ্রি টক-টাইম কার্ডটি ব্যবহার করতে পারিনি এখনো। আরেকবার চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে। রুমে এসে কয়েন আর কার্ডটা নিয়ে নিচে নামলাম আবার। লোকাল নাম্বারে ডায়াল করে পিন-নাম্বার ঢুকিয়ে দিদিভাইর নাম্বার ডায়াল করা পর্যন্ত ঠিক আছে। “ইউ হ্যাভ সিক্সটি মিনিটস ফর দিস কল”। কী হলো! কালকেও পচাত্তর মিনিট ছিল। একটুও কথা বলতে পারিনি – অথচ এক দিনের মধ্যেই পনের মিনিট কমে গেল! আজকেও রিং হচ্ছে – রিং হচ্ছে এবং একটু পরেই রিং বদলে গিয়ে টুং টাং বাজনা। কার্ডের গায়ে লেখা আছে দুইবার হ্যাস্ (#) টিপে আরেকটা নাম্বারে ডায়াল করা যায়। লোকাল নাম্বারে আর ডায়াল করার দরকার নেই। দুই বার হ্যাস্ (#) টিপলাম। আরো কিছু টুং টাং বাজনা শোনানো হলো এবং একটু পরেই লাইনটা কেটে গেল। আর কয়েন নেই আমার কাছে। রুমে ফিরে এলাম।
রুমে কোন টেবিল নেই। অবশ্য টেবিল বসানোর জায়গাও নেই। বিছানায় বসে এতক্ষণ লিখলাম তোমাকে। ঠান্ডা লাগছে। রুমে একটা হিটার আছে এবং ওটা ফুল পাওয়ারে অন করে দিয়েছি প্রায় দু’ঘন্টা আগে। কিন্তু হিটের কোন নামগন্ধ নেই। যে দুটো কম্বল দেয়া হয়েছে – সেগুলো ছাই রঙের; ময়লা কি পরিষ্কার বোঝার কোন উপায় নেই। আর এমন খসখসে – গায়ে কাঁটার মত বিঁধছে।
এর চেয়েও বেশি বিঁধছে অন্য কিছু। মাথার ভেতর ঘুরছে জীবনানন্দঃ
“অনেক কমলারঙের রোদ ছিল,
অনেক কাকাতুয়া পায়রা ছিল,
মেহগনির ছায়াঘন পল্লব ছিল অনেক;
অনেক কমলারঙের রোদ ছিল,
অনেক কমলারঙের রোদ;
আর তুমি ছিলে;
তোমার মুখের রূপ কত শত শতাব্দী আমি দেখিনা”
ক্রমশঃ______________
Leave A Comment