মুসলিম ইতিহাস প্রথম ইমাম তাবারীর (৮৩৯-৯২৩ খ্রীঃ) দ্বারা লিখিত হয় হিজরী তৃতীয়ের শেষ দিকে ও চতুর্থ শতক শুরুর দিকে। ইমাম তাবারী ৩১০ হিজরীতে মৃত্যূ বরন করেন। তার ইতিহাসের নথিপত্র বলতে কিছুই ছিল না। তার পুরো ইতিহাস সংরক্ষিত হয়েছে বিভিন্ন ব্যক্তির শোনা কথার উপর ভিত্তি করে। আর এই ব্যক্তিগণও কেউ কোন ঘটনার সাক্ষী ছিলেননা। পুরোটাই শোনা কথা হিসেবে এসেছ তার পূর্ববর্তী এবং তারও পূর্ববর্তী এমন করে ছয় বা সাত পুরুষ আগের কারো কাছ থেকে। এমনকি তাবারী তার বইয়ের শুরুতে বলেছেন যে, যে সব অসংগত ঘটনা তিনি বর্ণনা করেছেন তার জন্য তিনি দায়ী নন বরং যারা তাকে বলেছেন তারাই দায়ী। তিনি আরও লিখেছিলেন তার পারসিক পুরোহিতমন্ডলীগণ (Magian) তাকে যে ভাবে উপদেশ দিতেন এবং তার রাজকীয় নিয়োগ-কর্তাদের আদেশ অনুযায়ী তিনি তার বই লিখেছেন। এগুলো ছাড়াও, তিনি আরো উল্লেখ করেছেন তার এসব ঘটনা বর্ণনার উৎস হারমুযান, জাফীনা এবং সা’বা বিন শামি’উন (এরা সবাই খলীফা বা ইমাম হত্যার সাথে জড়িত ছিলো) বংশধরদের কাছ থেকে এসেছে। ইমাম তাবারী একজন কাহিনীকার হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। তার ১৩ খন্ডের ইতিহাস এবং ৩০ খন্ডের কোরানের ব্যাখ্যা তাকে ইমামদের মধে অন্যতম হিসেবে পরিচিতি দিয়েছে। তার এই ইতিহাস ও কোরানের ব্যাখ্যা আব্বাসীয় রাজাদের কাজ-কর্মের সাথে সামঞ্জস্য করে লিখিত। তাই সহজেই তার লেখা রাজকীয় সমর্থন পায়। তার ইতিহাস-রচনা এবং কোরানের ব্যাখ্যা রাজকীয় ভাবধারাকে আইনসিদ্ধ করে ভোগ-বিলাস, ঐশ্বর্য, দাস-দাসী, হারেমের প্রথাকে উৎসাহিত করে। তাবারী তাদেরকে ধর্মের বৈধতা দান করে নিজে অর্থ-বিত্ত ও ধর্মের ধ্বজাধারী হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। পরবর্তীতে মুহম্মদ বিন ইয়াকুব বিন ইসহাক আল-কালীনীও একই পথের পথিক হন। তিনিও হিজরী চার শতকের শেষের দিকে এসে ইতিহাস লেখেন কোন নথিপত্র ছাড়াই শুধু শোনা কথার উপর ভিত্তি করে।

উল্লেখযোগ্য যে ইসলামের ইতিহাসের পরিচিত ইতিহাসবিসগণের প্রায় সবাই তাবারী-কালীনী পরবর্তী যুগের। তাদের আগে কি কেউ ছিল না!! মুসলিম ইতিহাসের যে সময়টাকে স্বর্ণ-যুগ বলা হয় সে সময়ের প্রমাণ-পত্র সব কোথায়? ১৬৫ আল-হিজরীতে আব্বাসীয় বংশের খলীফা হারুন-আর-রশীদ যখন ইমাম আহমাদ বিন হানবালকে তার তথ্যের সত্যতা প্রমানের নথি-পত্র দেখাতে বলেন তার কিছুই তিনি দখাতে পারেননি। এমনকি মামুন আর-রশীদের সাথে ‘কোরান আল্লাহর বাণী না অন্য কিছু’ এই নিয়ে বিতর্কে অংশ গহণ করে বেত্রঘাত পর্যন্ত সহ্য করতে হয়েছিল। ঐ সময় অন্য কোন ইমাম তার পাশে রাজ-তন্ত্রের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বলেনি যে-এই আচরন অইসলামিক। ফলে, সময়ের সাথে সাথে শাসকদের স্বেচ্ছাচারিতা শক্তি অর্জন করতে থাকে।

ইমাম আবু হানিফার শিষ্য/ছাত্র ইমাম আবু ইউসুফ যেমন খলীফা মো’তামিদের (২৭০ হিজরী) রাজকীয় বিচার বিভাগের একজন বিচারক ছিলেন, ইমাম তাবারীও তেমনি একজন সেসময়ের বিচারক ছিলেন। ইমাম তাবারী, খলীফা আল-মুক্তাদার বিল্লাহর ইচ্ছার অন্যতম দোসর ছিলেন। বিভিন্ন সূত্রের ভিত্তিতে জানা যায় যে ইমাম তাবারী তার পারসীয়ান পরিচয় গোপন করার জন্য নিজ নাম ইবন জরীর বিন রুস্তম ইবন তাবারী (Ibn Jareer bin Rustam Ibn Tabar) থেকে ইবন জরীর বিন ইয়াজিদ তাবারী (Imam Ibn Jareer bin Yazeed Tabari) নামে পরিচয় দিতেন। তার সম্বন্ধে অনেক বিতর্কিত খবর আছে, অর্থাৎ ইসলামের কোন দল কে (শিয়া/সুন্নী, খারীজি/অথবা জরোয়াস্ট্রিয়ান)তিনি অনুসরন করতেন। প্রচলিত আছে যে ইমাম তাবারী বিন ইয়াজিদ এবং ইমাম তাবারী বিন রুস্তম দু’জন ভিন্ন ব্যক্তি, যদিও তারা দু’জনেই জন্মেছেন একই দিনে, দু’জনেই ইতিহাসবিদ, একই শহরে বাস করতেন, একই রকম দেখতে, একই রকম পোশাক পরিধান করতেন এবং এমনকি একই দিন মৃত্যূ বরন করেন। এই ধরনের সমাপতন সত্যি বিস্ময়কর!!

কারবালা যুদ্ধের যে বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায় তার সম্পূর্ণটাই তাবারী কর্তৃক রচিত এবং তা উল্লেখিত কারবালা যুদ্ধের ২৩৯ বছর পর লিখিত; এবং এখানেও সেই একই ভাবে শুরু করেছেন,”আবু মুকনিফ বলেছিল এটা, আবু মুকনিফ বলেছিল ওটা—“। স্কলার শাহ আব্দুল আজিজ, আল্লামা তামান্না ইমাদি, এবং মওলানা হাবিবুর রহমান খানদালবী এক গবেষণার পর মতামত দেন যে ‘আবু মুকনিফ’ একটা কাল্পনিক চরিত্র। অন্যান্য স্কলারগণ এ প্রসঙ্গে বলেন যে আবু মুকনিফ বলে যদি কেউ রক্ত-মাংসের থেকেও থাকে, তিনি মৃত্যূ বরন করেছিলেন তাবারী জন্মেরও ৫০ বছর পূর্বে। তাদের মতে তাবারী নিজেই কাহিণী লিখেছিলেন আবু মুকনিফের নামে। এমনকি তাবারী কখনো উল্লেখ করেনি যে তার সাথে আবু মুকনিফের দেখা হয়েছিল কিনা। আরও একটি উল্লেখ্য বিষয় যে, যেহেতু ঘটনা ঘটার প্রায় ২৩৯ বছর পর তাবারী বিষয়টি নিয়ে লিখেছেন; এর মধ্যবর্তী সময়ে আর কেউ কি এ বিষয়ে জানতেন না? এ রকম ঘটনা ঘটার পর প্রায় কয়েকশ’ লেখা খুঁজে পাবার কথা; কিন্তু শুধু তাবারীর মাধ্যমেই আমরা এটা জানতে পারলাম!! কিছু স্কলার তাদের এ বিষয়ে গবেষণার পর মনে করেন যে, আবু মুকনিফ ছাড়াও লুত বিন ইয়াহিয়া, মুহম্মদ বিন সায়েব কলবী চরিত্রগুলো কাল্পনিক। ইতিহাসবিদগণ প্রয়োজন অনুযায়ী চরিত্রগুলো সৃস্টি করেছেন। এখানে আরো উল্লেখযোগ্য প্রশ্ন যে, ইয়াজিদ যদি সত্যি এতই ঘৃনিত ব্যক্তি হতেন, তা হলে হযরত হাসান-হুসেনের বংশধর কেন ইয়াজিদের আত্মীয় স্বজনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন বা পরবর্তীতে উল্লখে যোগ্য ব্যক্তিত্ব এবং খলীফাগণ তাদের নাম ইয়াজিদ রেখেছিলেন?

অনেক ইউরোপীয়ান গবেষকগণ বলেছেন যে প্রাচ্যের ইতিহাসের বর্ণনায় অনেক অতিরঞ্জিত বিষয় থাকে। যেমন, মোল্লা দরবান্দী তার ‘আসরার আল-সাহাদাহ’ বইতে লিখেছেন যে কারবালার যুদ্ধে উমর ইবন সা’দের বাহিনীতে প্রায় ৬০০,০০০ অশ্বারোহী, ২০ মিলিয়ন পদাতিক বাহিনী একত্রিত হয়েছিল। সেই সময় পুরো আরব এবং ইরাকে কি সত্যি এত লোক বাস করত? এ ছাড়াও কুফা থেকে ১ মিলিয়ন ৬০০,০০০ অর্থাৎ কুফার সকল জনগন যোগ দিয়েছিল। এখন প্রশ্ন, কত বড় শহর ছিল কুফা? কুফা খুব একটা পুরনো শহর না; উমর বিন খাত্তাবের সময় কুফা মিলিটারী ঘাঁটি(outpost) হিসেবে গড়ে উঠে। এছাড়া, এটা নিশ্চিত করে বলা যায় না এই রকম নতুন একটা নগরীতে কত লোক বাস করত। কুফা বাহিনীত এত লোক জড়ো হওয়া এবং ইমাম হুসেনের ৩০০,০০০ হাজার লোক হত্যা করা মোটেও যুক্তিযুক্ত মনে হয় না। এই ধরনের হিসাব পুরো ঘটনার উপরেই একটা সন্দেহের বীজ বপন করে। ইবনে জযির মতে শত্রুপক্ষে মোট সৈন্য সংখ্যা ৬ হাজার, সৈয়দ বিন তুসির মতে ২০ হাজার, আবি ফারাস বলেন ৫০ হাজার, আর আবি নাহাফ আজওয়ির মতে ৮০ হাজার। অন্যদিকে, ইমাম হুসেনের বাহিনীতে আবি ফারাসির মতে ১ হাজার, শেইখ মুফীদের মতে ৭২ জন (৩২ জন অশ্বারোহী এবং ৪০ জন পদাতিক সৈন্য), ইমাম বাকীর বলেন ১৪৫ জন।

কারবালার ঘটনার এমন অসম্ভব ও অবাস্তবপূর্ণ বর্ণনা যে, পুরো ঘটনাটাই বিভিন্ন প্রশ্ন-উত্তরের দাবী রাখে। সম্পূর্ণ ঘটনাটি এখানে আলোচনা সম্ভব নয়, তাই সামান্য কিছু অংশ উল্লেখ করা হলো। উদাহরণ সরুপ, — –ইবন জিয়াদ ইমাম হুসেনকে বলেন যে সে নরম বালিশে মাথা রাখতে পারবে না বা ভাল খাদ্য গ্রহণ করতে পারবেনা যতক্ষন না সে ইমামকে হত্যা করতে পারে। এর উত্তরে ইমাম বলেন যে কুফা নগর বাসী তার কাছে চিঠি লিখেছিল তাই সে এসেছে। এখন সে যদি এটা পছন্দ না করে তবে তাকে চলে যেতে দেয়া হোক। এমন কি ইমাম হুসেন, উমর বিন সা’দকে অনুরোধ করে ছিলেন যে তাকে চলে যেতে দেয়া হোক যেহেতু পৃথিবীটা অনেক বিস্তৃত। কিন্তু মুজতাহিদ লেখকের মতে ইমাম হুসেন সেখানে গিয়েছিলেন জিহাদের উদ্দেশ্যে; তাহলে কেন তিনি চলে যেতে দেবার জন্য অনুরোধ করবেন? কথিত আছে পারসীয়ানদের তখন ঘৃণা বা হিংসা ছিল হযরত সা’দ বিন আবি ওয়াকাসের উপর; কারণ তিনি ৫০ বছর পূর্বে অর্ধেক পারস্য জয় করেছিলেন। তাই উমর বিন সা’দের নাম এখানে লাগানো হয়েছে। কিন্তু হিসাব মতে উমর বিন সা’দ তখন সিরিয়ায় তার বাহিনীকে নির্দেশনা দিচ্ছিল।(Ref. Al-Milil Wanhil by Imam Sheristani)

আশুরার দিনে (১০ই মুহররম)ইমাম হুসেন ইয়াজিদকে বলেছিলেন, “Yazeed the bastard, son of a bastard has forced me to choose between death and disgrace.” কিন্তু ঘটনা বর্ণনার অন্য জায়াগায় বলা আছে ইমাম নিজের ইচ্ছাতেই কুফায় এসেছিলেন, এমনকি বিভিন্ন ব্যক্তি প্রধানের কুফাতে না যাবার উপদেশ সত্ত্বেও। তার ১৫ ভাইয়ের মাত্র ৪ জন সঙ্গী হয়েছিলেন, আর বাকী সবাই তাকে থামানোর চেষ্টা করেন। তাহলে আর গালি-গালাজ কেন? আর একজন নেতৃত্ব স্হানীয় ব্যক্তির ভাষা কি এমন হতে পারে?

ইমাম জয়নুল আবেদিন বলেন যে যখন ইমাম হুসেন তার মৃত্যূ সম্বন্ধে শ্লোক আওড়াচ্ছিলেন, তা শুনে জয়নব তার নিজ মুখ-মন্ডলে আঘাত করছিলেন এবং প্রায় কাপড় ছিঁড়ে ফেলছিলেন; এক সময় অজ্ঞান হয়ে যান। ইমাম হুসেন তার বোনকে বলেন যে তাকে (জয়নব) ওয়াদা করতে হবে যে তার মৃত্যূর পর সে নিজেকে আঘাতে জর্জরিত করতে পারবে না বা কাপড় ছিঁড়ে শোক প্রকাশ করতে পারবেনা। কিন্তু কেউ কি ইমামের এই উপদেশ বা শেষ ইচ্ছার মর্যাদা দিয়েছে? নাকি ইচ্ছে মতো যে যেমন পেরেছে চরিত্রগুলোর মুখে কথা দিয়ে ঘটনা এগিয়ে নিয়ে গেছে! ইমাম তাবারী তার এই বই ‘Sa’aadatuddarain fi Qatlil Husain’ বইতে শুধু ঘটনার বর্ণনাই নয়, কি ভাবে ইমাম হুসেনের স্মৃতি উৎসব পালন করতে হবে তারও নির্দেশনা বর্ণনা করেছেন। এখন কথা হচ্ছে, এই নিয়ম তিনি কোথা থেকে পেলেন?

শুধু এখানেই থেমে নেই, আরো বর্ণনা আছে যে একটা পাখি ইমাম হুসেনের মাথার উপর পাখা ছড়িয়ে বলে যে আল্লাহ ইচ্ছে করলে তাকে বিজয় দিতে পারে; এরপর ৪ হাজার ফেরেশ্তা তাকে যুদ্ধে সাহায্য করতে চায় কিন্তু তিনি কোন সাহায্যই চান না। এমনকি জ্বীনরা এসেও তাকে সাহায্যর কথা বলেন , কিন্তু কারও সাহায্য তিনি গ্রহণ করেন না। কোন সাহায্যই যদি কাম্য নয় তবে জিহাদে বা কুফা নগরীর লোকেদের কি ভাবে সাহায্য করবেন; যীশুর মতো নিজের জীবন উৎসর্গ করে কিভাবে জনগনের সেবা করা হলো? যখন শত্রুপক্ষ হাজার হাজার তীর ছোঁড়া শুরু করলো, ইমাম হুসেন ও তার দল পালটা আঘাত শুরু করল। যুদ্ধ প্রায় এক ঘন্টা চলে। এত হাজার হাজার তীরের বিরুদ্ধে কি ৭২ জনের বা ১৪৫ জনের একঘন্টাও টিকে থাকা সম্বম্ভ? শুধু ঘটনার পূংঙ্খানু্পূংঙ্খ বর্ণনাই নয়, সেই সাথে ইতিহাসবিদগণ যেভাবে শত্রু-মিত্র পক্ষের প্রতক্ষ কথোপোকথন বর্ণনা করেছেন, মনে হয় তারা সেই ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন অথবা অডিও-ভিডিওতে ধারন করা হয়েছে।

ইমাম তার দুধের শিশু আলি আসগরকে তাবুর বাইরে পানি খাওয়ানোর জন্য নিয়ে এসে একটু পানি দেবার অনুরোধ করেন, পরিবর্তে শত্রুপক্ষের লোক তীর ছুঁড়ে মারে যার আঘাতে আলি আসগর মারা যায়। কিন্তু তার এক ফোঁটা রক্ত ইমাম হুসেন মাটি পড়তে না দিয়ে নিজের হাতের তালুতে ধারন করেন এবং আকাশের দিকে ছুঁড়ে মারেন এবং এক ফোঁটা রক্তও মাটিতে ফিরে আসে না। একই ভাবে ইমাম হুসেন যখন হাজার হাজার তীর (১,৯৫০ টা তীর- কিন্তু কেউ বলেনি কে গুনল বা কিভাবে তখন হিসাব করা সম্ভব!) দ্বারা আক্রান্ত হন, তার নিজের রক্তও এভাবে আকাশে ছুঁড়ে মারেন এবং এক ফোঁটাও মাটিতে ফিরে আসে না। পরবর্তী তিন দিন এই রক্তই রক্ত-বৃস্টি হয়ে ঝরে পড়ে। এই ইতিহাসবইগুলোতে বলা আছে যে তিন দিন যাবৎ এরকম রক্ত-বৃস্টি দেখে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় লোকজন ভাবতে শুরু করল যে কেয়ামত চলে এসেছে। কিন্তু এমন ঐতিহাসিক ঘটনার বর্ণনা রোমান, মিশরীয়, গ্রীক, ভারত বা অন্যান্য দেশের ইতিহাসে লেখা নেই বা কেউ জানল না যতদিন না তাবারী তার কারবালার কাহিণী লিখল।

এবার সময়ের হিসাবটা করা যাক।
৬৮০ খ্রীঃ উল্লেখিত কারবালার ঘটনা সংঘটিত(??)
৭০০ খ্রীঃ ইমাম হুসেনের পুত্র ইমাম যয়নুল আবেদিন দু’টো বই লেখেন (মুনাজাত-ই-যয়নুল আবেদিন ও সহীফা সাজ্জাদিয়া) যাতে কারবালার ঘটনার কোন উল্লেখ নেই; বরং ইয়াজিদের প্রশংসা করা হয়েছে। ইয়াজিদ ছিলেন দ্বিতীয় বনি উমায়াদ খলীফা, যিনি সুরা কাউন্সিলের মাধ্যমে নির্বাচিত হন এবং সিরিয়া, ইসরাঈল, ইরাক, মক্কা, মদীনা, মিশর, ইয়েমেন, ইরান এবং অন্যান্য কাছের অংশে যেখানে উট দ্বারা যাওয়া-আসা সম্বম্ভ সেখানে তাকে খলীফা হিসেবে মেনে নেয়।
৭৫৮ খ্রীঃ ইমাম মালিকের বই ‘মুওয়াত্তা’ লেখেন, তাতে কারবালার কোন উল্লেখ নেই
৮৬০ খ্রীঃ হাদিস বইগুলো লেখা শুরু হয়, সেখানেও কারবালার ঘটনা নেই
৯০০ খ্রীঃ ইমাম তাবারী কারবালার যুদ্ধের বর্ণনা করেন, তবে তার লেখার পক্ষে কোন প্রমাণ বা নথি-পত্র নেই
৯১০ খ্রীঃ এরপর থেকে আজ পর্যন্ত নিত্য-নতুন ঘটনা সংযোজিত হয়ে ঘটিনাটি সমাজে আশুরা হিসেব প্রতিষ্ঠা পেয়ে পালন হয়ে আসছে।
‘Rawdat al-shuhada’ নামে মোল্লা হুসাইন কাশিফি একটি বই লেখেন। বইটি পারস্য ভাষায় লিখিত। মোল্লা হুসাইন কাশিফি একজন জ্ঞানী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন। কিন্তু তার সম্বন্ধেও অনেক বিতর্কিত তথ্য আছে। তাকে হাজী নুরী বহুরূপী গিরগিটির(chameleon) সাথে তুলনা করেছেন ; অর্থাৎ শিয়াদের সাথে একজন শিয়া হিসেবে মিশেছেন আবার সুন্নীদের কাছে নিজেকে হানাফী হিসাবে পরিচয় দিতেন। তিনি Sabzawar অঞ্চলের লোক ছিলেন, যেখানকার লোকজন প্রায় সবাই শিয়া ছিলো। এই নিজ অঞ্চলেই তিনি কারবালার ঘটনা বর্ণনা করেন। তিনি প্রায় ৯১০ হিজরীর দিকে মৃত্যূ বরন করেন। তার এই বই পড়ে হাজী নুরী বলেন যে, এই বইয়ে ইমাম হুসেনের সঙ্গীদের নামগুলো বানানো; এমনকি শত্রু পক্ষের নামগুলোও বানানো। বেশীরভাগ লোকজনই ছিল অশিক্ষিত এবং আরবী পড়তে জানত না। যেহেতু, এই বইটা পারস্য ভাষায় লেখা প্রথম বই এবং ইমাম হুসেন স্মরণে তাই তারা এই বই থেকে ঘটনা একত্রিত হওয়া জনগণকে পড়ে শোনাত। এই ভাবে একত্রিত হয়ে ইমাম হুসেনের জন্য শোক করাকে বলে rawdeh-khwani; কিন্তু radeh-khwani ইমাম সাদিক বা ইমাম হাসান আসকারীর সময়ে ছিলনা, বা সাঈদ মুরতাদা (হিজরী ৪৩৬) বা খাজা নাসির আল-দিন আল তুসির (হিজরী ৬৭২) সময়ে পরিলক্ষিত হয়নি। আর radeh-khwani মানে হচ্ছে Rawdat al-shuhada বই থেকে পড়ে শোনানো। হাজী নুরী এই বইকে –“a pack of lies” বলে উল্লেখ করেছেন। যখন থেকে সাধারন জনগণ এই বইটা অনুসরন করা শুরু করল, তখন থেকে আর কেউ ইমাম হুসেনের জীবনী নিয়ে অনুধ্যান করার চেষ্টা করলোনা। এরপর মাঠে এলেন মোল্লা দরবান্দী; যিনি Rawdat al-shuhadaর বিষয়বস্তু নিয়ে লিখে ফেললেন একটি বই, নাম ‘আসরার আল-সাহাদাহ’। এই বইটিই তখন থেকে ইসলামের ভাগ্যে অন্যতম শোকগাঁথা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে।

কারবালার ঘটনার বর্ণনা এবং সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে আসলে ইমাম হুসেনকেই অসন্মান করা হয়েছে; এবং এর সাথে সাথে মানুষের সাধারন বুদ্ধি, বিবেচনা, প্রকৃতির নিয়ম কানুন, সর্বপরি মানুষের বুদ্ধিমত্তাকেই হেয় করা হয়েছে। আশুরার দিনে একজন আরেকজনের দাঁড়িতে ধূলা ছুঁড়ে দেয়া মুহম্মদ (সাঃ) সময়কার নিয়ম। (Tirmizi Shareef, vol ii Pg 218, Delhi Edition) কিন্তু লেখক ভুলে গেছেন যে মুহম্মদ (সাঃ) মৃত্যূবরন করেছিলেন কারবালার ঘটনার ৫০ বছর পূর্বে। তাহলে এটা নবীর সময়কার রীতি হলো কি করে? ইসলামের ইতিহাসবিদগণ ইচ্ছেমতো বিষয় নিয়ে লিখেছেন; শুধুমাত্র তারাই নয় হাদিস লেখকরাও সময় ও ঘটনার বিন্যাসের তোয়াক্কাও করেনি। যার ফলে হাদিস ও ইতিহাস মিলেমিশে এমন অসঙ্গতিপূর্ণ ও বৈপরিত্য অবস্হার সৃস্টি করেছে যে এর থেকে বের হওয়া বেশ কস্টসাধ্য ব্যাপার।
এখন কথা হচ্ছে, কেন একদল লোক আশুরা পালনের মাধ্যমে ইমাম হুসেনকে স্মরনীয় রাখতে চায়? ইমাম হুসেনের আগে হযরত ওমর, উসমান বা আলীর মৃত্যূ নিয়ে তো কোন মাতামাতি হয়নি!! ইমাম হুসেনের মাজার জিয়ারত, তাকে নিয়ে শোক পালন করার জন্য শিয়াদের উৎসাহিত বা জোর দেয়া হয় কেন ??

তথ্য সূত্রঃ
Ashura-History and Popular Legend, Second Sermon Martyr Murtada Mutahhari; Tanslated from the Persian by ‘Ali Quli Qara’I , Vol XIII No.3 (Fall 1996)

Karbala—Fact or Fiction? by Shabbir Ahmed, M.D.