বিষাদেরই জল আঁখি কোণে
ফরিদ আহমেদ
সেলিনা হোসেনের উপন্যাস হাঙ্গর নদী গ্রেনেডের মূল চরিত্রের নাম বুড়ি। বিধবা এই মহিলার অতি আদরের সৎ দুই ছেলে যুদ্ধে গিয়েছে। তার নিজের পেটের সন্তান মানসিক প্রতিবন্ধী কিশোর। যুদ্ধে যাওয়া দুই ছেলের বন্ধুরা একদিন এসে আশ্রয় নেয় বুড়ির বাড়ীতে। কীভাবে যেন তাদের উপস্থিতি টের পেয়ে যায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী। ঘিরে ফেলে বাড়ী তারা। মুক্তিযোদ্ধা ছেলেদের বাঁচাতে তার অবোধ সন্তানের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে সেনাবাহিনীর সদস্যদের মনযোগ ঘুরিয়ে দেন তিনি। সৈন্যদের হাতে মারা যায় তার পরম আদরের সন্তান, কিন্তু বেঁচে যায় মুক্তিযোদ্ধা ছেলেগুলো।
মুহাম্মদ জাফর ইকবালের একটা ছোট গল্প আছে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। যুদ্ধের পরে এক মা তার মেয়েকে নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে খুঁজে পেতে তার ছেলের সাথে যুদ্ধে ছিল এমন একজনকে নিয়ে যায় তাদের বাড়ীতে। পাকিস্তান আর্মি যখন ধরে নিয়ে গিয়েছিল তখন কী রকম বীরত্বের সাথে তাদের মোকাবেলা করেছিল তার ছেলে, সেটাই জানা ছিল তার উদ্দেশ্য। মায়ের উদ্দেশ্য টের পেয়ে ওই ছেলেও পাকিস্তানীদের অত্যাচারে বিধ্বস্ত হয়ে যাবার কথা না বলে বানিয়ে বানিয়ে তার ছেলের বীরত্বের গল্প বলতে থাকে। আর সজল চোখে মায়ের মুখ গৌরবে উদ্ভাসিত হয়ে উঠে ছেলের বীরত্বগাঁথায়।
এ তো গেলো গল্প বা উপন্যাসের মায়েদের কথা। বাস্তবের মায়েরা কী করেছিলেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়। মায়েদের আবেগের কথা, অনুভূতির কথা, তাদের যন্ত্রণার কথা, তাদের আত্মত্যাগের কথা, তাদের সাহসের কথা, তাদের বীরত্বগাঁথার কথা কী সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে আমাদের ইতিহাসে? মনে হয় না। আমাদের ইতিহাসে আমরা মুক্তিযুদ্ধের অসংখ্য দিকের প্রতি খেয়াল রেখেছি, শুধু সময় পাইনি এই সব সন্তানহারা মায়েদের বা বাবাদের অনুভূতির কথা জানা, বুকফাটা আর্তনাদের কথা শোনার।
কোন এক অনুষ্ঠানে একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার মাকে আনা হয়েছিল। সেই মা মঞ্চে উঠে বললেন, ‘এদেশে ৩০ লক্ষ মানুষ শহীদ হয়েছিল এ কথাই বার বার বলা হয় কিন্তু কেউ বলে না সেই ৩০ লক্ষ মানুষের মা ছিল। ৩০ লক্ষ মাও যে শহীদ হয়েছিল। সে কথা কেউ বলে না।‘
আসলেওতো তাই। ত্রিশ লাখ মানুষের মৃত্যুর সাথে সাথে যে ত্রিশ লক্ষ মায়েরও মৃত্যু হয়েছে সেই হিসাবতো আমরা রাখিনি কখনো। সন্তানের মৃত্যু যেদিন হয় একজন মা-তো সেদিনই মরে যান। শুধু মা-ই যে মারা যায় তা নয়, বাবাদের অবস্থাও হয় ঠিক একই রকম।
ভদ্রলোকের বাড়ী ছিল নারায়নগঞ্জে। ছোটখাটো ব্যবসা করতেন তিনি সেখানে। একটাই মাত্র ছেলে তার। জগতে ওই ছেলে ছাড়া তাঁর আর কেউ ছিল না ভদ্রলোকের। যুদ্ধের সময় ভদ্রলোক নারায়ণগঞ্জ থেকে পালিয়ে গেছেন ত্রিপুরার মেলাঘরে, আশ্রয় নিয়েছেন শরণার্থী ক্যাম্পে। তাঁর তরুণ ছেলেটি যোগ দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধে। মেজর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে ২ নম্বর সেক্টরে একজন গণযোদ্ধা সে। খালেদ মোশাররফ মুক্তিযোদ্ধাদের একটা দলকে পাঠান নারায়ণগঞ্জের টানবাজার থানা আক্রমণ করতে। সেই দলে এই তরুণটিও ছিল। যেহেতু তার বাড়ি নারায়ণগঞ্জে, ফলে সে সেখানকার রাস্তাঘাট ভালোভাবেই চিনত। অপারেশন সফল হয়। বিজয়ীর বেশেই ফিরে আসছিল এই গেরিলারা। কিন্তু ফিরে আসার সময় এক রাজাকারের হঠাৎ ছুড়ে মারা গুলিতে মারা যায় ছেলেটি।
খবর আসে মেজর খালেদ মোশাররফের কাছে। তিনি ব্যথিত ও চিন্তিত হন। ক্যাপ্টেন এম এ মতিনকে ডেকে বলেন, ‘এই ছেলের বাবা তো পাশেই শরণার্থী শিবিরে থাকেন। তাঁকে ডেকে এনে ছেলের মৃত্যুসংবাদ জানান। আর কিছু টাকা-পয়সা দেন, সান্ত্বনার বাণী শোনান।’
ক্যাপ্টেন মতিন মেজরের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করলেন। মেলাঘর প্রশিক্ষণ শিবিরে ডেকে আনলেন সেই বাবাকে। তাঁকে বললেন
, ‘সবাইকে মরতে হবে। আগে আর পরে। দেশের জন্য প্রাণ দেওয়া গৌরবের ব্যাপার। আপনার ছেলে দেশের জন্য শহীদ হয়েছে।’ ক্যাপ্টেন মতিন লক্ষ করলেন, এই বাবাটি যেন কেমন অন্যমনস্ক। তাঁর কানে যেন কিছুই ঢুকছে না। মতিন বললেন,
‘দাদা, কী চিন্তা করছেন?’
বাবা বললেন, ‘ভাবতেছি।’
‘কী ভাবতেছেন?’
‘আমি ভাবতেছি ভগবান কেন আমাকে একটা মাত্র ছেলে দিল। আজকে আমার আর একটা ছেলে থাকলে তো আমি তাকে মুক্তিযুদ্ধে পাঠাতাম।’
বাংলা পপ গানের জীবিত কিংবদন্তী আজম খান। বীর মুক্তিযোদ্ধা তিনি। সেই আজম খানকে তার বাবা-মা কীভাবে যুদ্ধে যাবার অনুমতি দিলেন তা জানা যায় তার নিজের ভাষ্যে। “একাত্তরে ২৫ মার্চের পর সারা শহরে কারফিউ। আর্মিদের জ্বালায় থাকতে পারতাম না। পালিয়ে থাকতাম। বন্ধুরা মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম, এভাবে নয়। মরলে যুদ্ধ করেই মরব। সবাই সিদ্ধান্ত নিলাম, ভারতে গিয়ে ট্রেনিং করব। যুদ্ধ করব। যে যার মতো চলে গেল। আমি যেদিন গেলাম, সেদিন আমার সঙ্গে ছিল দুই বন্ধু শাফি আর কচি। বেলা সাড়ে ১১টা। মাকে গিয়ে বললাম, ‘মা, যুদ্ধে যেতে চাই।’ মা বললেন, ‘ঠিক আছে, তোর বাবাকে বল।’ বাবা প্রয়াত আফতাব উদ্দীন খান ছিলেন কলকাতার প্রশাসনিক কর্মকর্তা। কাঁপতে কাঁপতে গেলাম বাবার সামনে। মাথা নিচু করে বললাম, আমি যুদ্ধে যাচ্ছি। চিন্তা করলাম, এই বুঝি লাথি বা থাপ্পড় দেবেন। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে বাবা বললেন, ‘ঠিক আছে, যুদ্ধে যাইবা ভালো কথা। দেশ স্বাধীন না কইরা ঘরে ফিরতে পারবা না।’
আজম খানের মত জুয়েলও ছিলেন স্বনামখ্যাত ব্যক্তি। ছিলেন দুর্দান্ত একজন ক্রিকেটার। দেশের টানে যুদ্ধে গিয়ে অকালে শহীদ হন তিনি। তার মৃত্যু খবর যখন তার মা কাছে এসে পৌছায়, তখন তিনি বলেন, ‘ক্রিকেটকে যে ভালোবাসতো, সে হাতে স্টেনগান নিল। আমি মা হয়ে মানা করিনি। নিজের চোখে যখন দেখলাম অসংখ্য মানুষ মিলিটারীর হাতে প্রাণ দিচ্ছে তখন বাছাকে আমি মানা করি কিভাবে? আমি জানতাম স্বাধীনতার জন্য যারা জীবন প্রাণকে উৎসর্গ করে তাদের পরিণতি কি হয়। তাই ছেলের মৃত্যুতে আমি অবাক হইনি।‘
আনিসুল হক তার সত্যি ঘটনা অবলম্বনে লিখিত ‘মা’ উপন্যাসে একজন মুক্তিযোদ্ধা আজাদের মায়ের কথা বলেছেন। আজাদ ছিল তার বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। ঢাকার ইস্কাটনে আজাদদের ছিল প্রাসাদোপম বাড়ি। আজাদের বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করলেন। আজাদের মা তাঁর একমাত্র সন্তানকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন বাড়ি থেকে। অনেক কষ্টে ছেলেকে লেখাপড়া শেখাতে লাগলেন। একাত্তর সালে আজাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে মাস্টার্স পাস করল। দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে। আজাদের বন্ধুরা−রুমি, হাবিবুল আলম, কাজী কামাল প্রমুখ মেলাঘরে গিয়ে ট্রেনিং নিয়ে এসেছে। তারা ঢাকা শহরে থেকে গেরিলা অপারেশন পরিচালনা করছে। আজাদদের বাড়িতেও তারা আশ্রয় নিতে চায়, অস্ত্র রাখতে চায়। আজাদের মা বললেন, ‘নিশ্চয়ই। আমি তো শুধু আমার জন্য তোমাকে মানুষ করিনি আজাদ, নিশ্চয়ই তুমি দেশের কাজে লাগবে।’ আজাদদের বাড়িটিও হয়ে উঠে মুক্তিযোদ্ধাদের একটা গোপন ঘাঁটি। বন্ধুদের সঙ্গে একটা অপারেশনে আজাদ অংশও নেয়। ১৯৭১ সালের ৩০ আগস্ট দিনে আর রাতে ঢাকা শহরের অনেক মুক্তিযোদ্ধা-বাড়িতে পাকিস্তানি সেনারা হামলা চালায়। আজাদদের মগবাজারের বাড়িতে ছিলেন কাজী কামালসহ আরো অনেকেই। তিনি পাকিস্তানি অফিসারের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে গুলি করে পালিয়ে যেতে সমর্থ হলেও আজাদসহ কয়েকজন ধরা পড়ল। আজাদকে তার বাসা থেকে তার মায়ের সামনে মারতে মারতে থানায় নেয়া হয়। টর্চার সেলে প্রচন্ড মারধরের পরে তাকে সিলিং ফ্যানের সাথে উলটো করে সারা দিন ঝুলিয়ে রাখা হয়। সারা শরীরে বেল্ট দিয়ে পিটানো হয়। তার সারা গা রক্তাক্ত হয়ে যায় মুখ থেকে রক্ত পরছে কিন্তু তারা কিছুই ফাঁস করেনি।
আজাদের মাকে বলা হলো, ছেলেকে ছেড়ে দেওয়া হবে, যদি সে সবকিছু স্বীকার করে। যদি সে মুক্তিযোদ্ধা বন্ধুদের নামধাম ও অস্ত্রের ঠিকানা বলে দেয়। আজাদের মা দেখা করলেন আজাদের সঙ্গে। কিন্তু দেখা করে বললেন সম্পুর্ণ উল্টো কথা। বললেন, “বাবা রে, যখন মারবে, তুমি শক্ত হয়ে থেকো। সহ্য করো। কারো নাম যেন বলে দিও না।“
আজাদ সেই রাতে মাকে বলে, ‘মা, কয়েক দিন ভাত খাই না, কাল যখন আসবে আমার জন্য ভাত নিয়ে আসবে।’ পরের দিন মা ছেলের জন্য ভাত নিয়ে গেলেন। গিয়ে দেখেন, ছেলে নেই। এই ছেলে আর কোনো দিনও ফিরে আসেনি। আর এই মা যত দিন বেঁচে ছিলেন, কোনো দিন ভাত খাননি। সুদীর্ঘ ১৪ বছর খালি রুটি খেয়েছেন দুইবেলা কখনো একবেলা শুধু পানিতে চুবিয়ে। আর কোনো দিন তিনি বিছানায় শোননি। শুতেন মাটিতে একটা পাতলা কাপড় বিছিয়ে। কারণ তিনি জানেন না, তাঁর ছেলে আর কোনো দিন ভাত খেতে পেয়েছিল কি না, কারণ তিনি জানেন না তাঁর ছেলে আর কোনো দিন বিছানায় শুতে পেরেছিল কি না। ১৯৮৫ সালে এই মা মারা যান। মৃত্যুর আগে তিনি বলে যান, তাঁর কবরের গায়ে যেন একটা কথাই লেখা থাকে−শহীদ আজাদের মা। জুরাইন কবরস্থানে এই মায়ের কবরে আজ সেই কথাটাই লেখা আছে।
মুক্তিযুদ্ধে মায়েদের অনুভূতি কী রকম ছিল তার সবচেয়ে সেরা বর্ণনা পাওয়া যায় জাহানারা ইমামের লেখায়। তিনিই বোধহয় একমাত্র মা যিনি সমস্ত ঘটনাগুলোকে লিখিত আকারে আমাদের সামনে তুলে দিয়ে গেছেন। তার অবিস্মরণীয় গ্রন্থ ‘একাত্তরের দিনগুলি’-তে প্রতিটা মুহুর্তের প্রতিটা অনুভূতির বর্ণনা করে গেছেন তিনি।
তার বিশ বছরের ছেলে রুমি ছিল সব দিকে দিয়ে চৌকস এক ছেলে। ছিল অসাধারণ এক বিতার্কিক। আমেরিকায় ইঞ্জিয়ারিং পড়তে যাওয়ার সব কিছু ঠিকঠাক তার। সেপ্টেম্বর থেকেই ক্লাশ শুরু হবে। সেই ছেলেই আমেরিকায় যাবার স্বপ্নকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে যুদ্ধে যাবে বলে মাকে রাজী করানোর জন্য মায়ের সাথে ক্রমাগত বিতর্ক করে যেতে থাকে। বলে দেখো মা রোমান গ্লাডিয়েটরদের চেয়েও খারাপ অবস্থা আমাদের। সিংহে সাথে যুদ্ধে গ্লাডিয়েটরেরো কিছু আশা থাকে। ঝুটোপুটি করার সুযোগ থাকে। কিন্তু আমাদেরতো সেই সুযোগ নেই। হাত পা বেধে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে আর কট কট করে কিছু গুলি ছুটে যাচ্ছে। মুহুর্তের মধ্যে লোকগুলো মারা যাচ্ছে। তুমি যদি এই অবস্থায় আমাকে বাইরে পাঠাতে চাও আমি হয়তো যাবো। কিন্তু বিবেকের কাছে চিরকালের মত অপরাধী হয়ে থাকবো আমি। হয়তো বড় ডিগ্রি নিয়ে এসে বড় ইঞ্জিনিয়ার হবো। কিন্তু বিবেকের ভ্রুকুটির সামনে কোনদিন মাথা উচু করে দাঁড়াতে পারবো না। তুমি কি তাই চাও আম্মা।
কোনদিন কোন বিতর্কে হারেনি রুমি। মায়ের কাছেই বা হারবে কেন। বিতর্কে পরাজিত মা অবশেষে দু চোখ বন্ধ করে বলেন, ‘না তাই চাইনে। ঠিক আছে তোর কথাই মেনে নিলাম। দিলাম তোকে দেশের জন্য কোরবানী করে। যা, তুই যুদ্ধেই যা।’
এই এক কথার জন্য সারাজীবন আফসোস করেছেন জাহানারা ইমাম। দেশের জন্য কোরবানী কথাটা না বললে হয়তো তার ছেলেটা বেঁচে থাকতো।
এর পর জাহানারা ইমাম যা করেছিলেন তা বিরল। নিজেই গাড়ী চালিয়ে রুমিকে নামিয়ে দিয়ে এসেছিলেন ভারতে যাবার পথে। এরকম নিজ হাতে রণসাজে সাজিয়ে ছেলেকে যুদ্ধের ময়দানে পাঠাতে ক’জন মা পারেন।
জাহানারা ইমাম যতদিন বেঁচে ছিলেন রুমির স্মৃতিকে সঙ্গী করেই ছিলেন। রুমির মত অগুনতি মানুষকে বিনা কারণে যারা পাখির মত গুলি করে মেরেছিল তাদের কোন বিচার হলো না এই বাংলাদেশে, এটা তিনি মেনে নিতে পারেননি কিছুতেই। তাই, শরীরের মৃত্যুর বীজ বয়ে নিয়েও তিনি দিনের পর দিন ছুটে বেড়িয়েছেন সারা দেশে, ঘাতকদের বিচারের জন্য। সংগঠিত করেছেন মানুষকে, সচেতন করেছেন মানুষকে। গড়ে তুলেছিলেন দুর্দমনীয় এক আন্দোলন। সন্তানহারা মায়ের কী অসীম সংকল্প, কী ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা। তার দিন হাতে গোনা। তারপরেও থামেননি তিনি। কোথা থেকে এই শক্তি পায় মায়েরা?
ব্যালাড অব এ সোলজার চলচ্চিত্রে এক মাকে দেখানো হয়। যে মা প্রতিদিন গ্রামের শেষ সীমানায় এসে দিগন্তের দিকে হারিয়ে যাওয়া আকাবাঁকা পথের উপর দাঁড়িয়ে থাকেন তার যুদ্ধে যাওয়া তরুন ছেলের প্রতীক্ষায়। এই পথ দিয়েই একদিন তার ছেলে চলে গিয়েছিল যুদ্ধক্ষেত্রে। আবার এই পথে ধরেই সেই ছেলে একদিন ফিরে এসেছিল মায়ের ঘরের চালা ঠিক করার জন্য। এই পথেই সামান্য ক্ষণের জন্য মা ছেলের দেখা হয়েছিল সেদিন। এই পথেই আবার একদিন ছেলে তার ফিরে আসবে সেই আশাতেই প্রতিদিন তিনি এসে দাঁড়িয়ে থাকেন এখানে। কোন যুক্তি, কোন বাস্তবতা কাজে আসে না মায়ের আবেগের কাছে। দুচোখে সুগভীর যন্ত্রণা আর সীমাহীন শুন্যতা নিয়ে মা প্রতিদিন প্রতীক্ষায় থাকেন তার আদরের সন্তানের।
একাত্তরের পরে আমাদের মায়েরাও হয়তো ওরকমই পথ চেয়ে বসে থাকতো। ভাবতো কোন একদিন তার দুরন্ত ছেলেটা এসে দূর থেকে মা বলে ডাক দেবে। দৌঁড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে মায়ের বুকে। আর মা তার সমস্ত মমতাটুকু দিয়ে বুকে টেনে নেবে ছেলেকে। গভীর ভালবাসায় চুমু খাবে তার কপালে, গালে, মাথায়। অভাগিনী মায়েদের সেই আশা আর পূর্ণ হয়নি কখনো। অসীম অহংকারে একদিন যারা সূর্যকে বন্দী করতে গিয়েছিল সূর্যোদয়ের দেশে, তারাই একদিন হারিয়ে গিয়েছিল ফেরা যায় না এমন কোন ঘোর অন্ধকারের বনে। তাদের মায়েদেরকে চির দুঃখিনী করে দিয়ে। কত কত সন্তানহারা মায়ের আর্তনাদ, হাহাকার, যন্ত্রণা, বুকভাঙ্গা কষ্ট আর অসীম শুন্যতা মিশে আছে আমাদের স্বাধীনতার সাথে তার হিসাব কী আমরা কখনো করেছি?
জনম দুঃখিনী সেই সব মায়েদের জন্য কিছুইতো করতে পারিনি আমরা। বিষাদের জলটুকুই না হয় থাকুক আমাদের চোখের কোণায়।
তথ্যসূত্রঃ
১। একাত্তরের দিনগুলি – জাহানারা ইমাম
২। মা – আনিসুল হক
৩। http://taiyabs.wordpress.com/2008/12/16/anisul-haque-17/
৪। http://prothom-alo.com/detail/news/22725
আমার মনে পড়ে “একাত্তরের দিনগুলি” পড়ে কেমন শিউরে উঠতাম, বন্ধুদের সাথে আলোচনা করতাম এটা নিয়ে যে ঠিক আমাদের বয়েসী বা আমাদের চেয়ে ছোট ওই মানুষগুলো কি অবলীলায় যুদ্ধে যাবার কথা ভাবছে, আমি কি পারতাম? আর যে বাবা-মায়েরা এভাবে সহযোগিতা করেছেন তেমন শক্তি তো আমাদের মাঝে নাই… আমি যদি বাঙালি হই তাহলে এদেরকে বাঙালি বলতে সঙ্কোচ হয়…
@লীনা রহমান,
আমি সবসময়ই একটা কথা বলে থাকি। একাত্তর একটা দেশের ইতিহাসে একবারই মাত্র আসে। ওই রকম একটা একবার আসা স্বর্ণসময়েই কেবল বাচ্চা বাচ্চা ছেলেরা নিজেদের ভবিষ্যতের কথা না ভেবে ঝাপিয়ে পড়তে পারে দাবানলে। মায়েরাও তাঁদের চোখে অশ্রুর বদলে নিয়ে আসেন অনল। সন্তানদের আহম্মকি আত্মহত্যায় বাধা না দিয়ে, তার পরিবর্তে বেশ যুদ্ধসাঁজে সাঁজিয়েগুঁজিয়ে ছেলেগুলোকে পাঠিয়ে দেন রণাঙ্গনে।
ফরিদ আহমেদ,
আপনি যেটাকে আবেগ বলেছেন সেটাতো আবেগ নয়,এযে আমার হ্্দয়ের রক্তক্ষরন,এ রক্তক্ষরন বাংগালীজাতি(গোলাম আজম গং-রা ও পাকিস্হানের পেতাত্তারা বাদে) আজ ৩৮ বছর নিরবে-সরবে একা একা বয়ে বেড়াচ্ছে।আর আমি নরম মনের মানুষ কি-না জানি না তবে আপনার কথা ১০০% ঠিক যে আমি শুধু এ যুগেই অচল নই,এমন কি নিজেই নিজের জীবনের কাছে সম্পূর্ন অচল বলে প্রমানিত।তবে আপনি ও আপনারা আশেপাশে আছেন বলে এখনও মাঝে মাঝে নিজেকে সচল বলে মনে হয়।
শেষতঃ বলব ভৌগলিক ও জলবায়ুগত কারনে আমরা বাংগালী জাতিটা কেমন জানি একটু বেশী জীবনের সর্বক্ষেত্রে বড় আবেগী।
ভালো থাকবেন।
পড়ে সত্যিই বিষাদের জল জমে গেল আঁখিকোণে…
@নিবেদিতা,
অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে নিবেদিতা।
ফরিদ ভাই, আপনার লেখাগুলো পড়তে ভয় লাগে আজকাল। মনে হয়, আসলেই কি এখন পড়বো, নাকি পরে পড়বো, মনটা কি এতটা খারাপ করতে চাই এখনই? খুব বেশী লেখকের মনে হয় এরকম প্রভাব থাকে না পাঠকের উপর, খুব বড় দরের লেখক হতে হয় এর জন্যে। বকলমের মতই বলতে হয় … অন্ধ হলেই তো আর প্রলয় বন্ধ হয় না। তবে ধন্যবাদ আপনাকে লেখাগুলোর জন্য। চোখ বন্ধ করেই তো থাকি, এই লেখাগুলো মাঝে মাঝে জোড় করে চোখ খোলায়।
@বন্যা আহমেদ,
কী ব্যাপার? আমাকে এরকম করে পচানোর মানেটা কী? কী ক্ষতি করেছি আমি তোমার। :-X
দাঁড়াও পচাতে আমিও পারি। 😀
আজ থেকে চার বছর আগে বন্যা আহমেদ নামের একজন যদি আমাকে ফোন করে লেখার তাগাদা না দিত, তবে হয়তো কখনোই নিয়মিত লেখা হতো না আমার।
মজার বিষয় হচ্ছে এখন গনেশ গেছে উলটে। আজকাল আমাকেই মিথ্যা প্রোপাগান্ডা চালাতে হয় বন্যার কাছে থেকে লেখা বের করার জন্য। :laugh:
মুক্তমনায় আমার যত লেখালেখি এর সূচনাতেই রয়েছে অভি আর বন্যার হাত। ওরা যদি আগ্রহী না হত, উৎসাহ না দিত, তাগাদা না দিত, তবে পাঠক হয়েই বাকী জীবনটা কাটাতে হত আমার। :yes:
তবে এটাও ঠিক, ওই জীবনটাও খুব একটা খারাপ ছিল না আমার।
ফরিদ ভাই,
এ লেখাটি না পড়েই মন্তব্য করছি।
নীড়পাতায় যে একটুখানি দেখা যায়, (বিস্তারিত তে যাওয়ার আগে) তাতে বুঝতে পারছি মর্মস্পশী ধরনের লেখা। তাও আবার মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে।
অন্যান্য বাঙালির মত আমিও একটু ছিচ কাদুনে। কাজেই আগেই বুঝতে পারছি এ লেখার এফেক্ট কি হবে।
তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, বিজয়ের আনন্দ নিয়েই থাকব দু এক দিন; এ লেখাটা আমি পড়ব না। যদিও জানি, অন্ধ হলেই প্রলয় বন্ধ হয় না।
@বকলম,
বিজয়ের আনন্দের দুই একদিন শেষ। এবার পড়ে ফেলতে পারেন। 🙂
ফরিদ ভাই,
চমৎকার, মর্মস্পর্শী লেখা।
@প্রদীপ দেব,
ধন্যবাদ আপনাকে।
ফরিদ ভাই,
আরেকটা ব্যানার তৈরির ব্যর্থ চেষ্টা করা হল- এখানে।
আগের দুইটা এখানে আর এখানে
বুড়া বয়সে এই ছবি লইয়া গুতাগুতি মানায় কন তো? আপনে এডোবি ফটোশপ কেমন পারেন, কন
@অভিজিৎ,
ব্যর্থ চেষ্টাতেই যা বের হচ্ছে তাতেই চলবে। শেষটাতো দুর্দান্ত হয়েছে। :yes:
আমি বুড়োকাল পার হয়ে আবার শৈশবে ফিরে গেছি। এক সময় পারতাম কিছুটা। এখন নতুন করে আবার শিখতে হবে। 🙁
@অভিজিৎ,
ব্যানারগুলো অপূর্ব হয়েছে। তবে প্রথমটাতে পূর্ব আর সূর্য বানান – ঊ-কার হবে।
@প্রদীপ দেব,
ঊ কার ই দেয়া হয়েছে, কিন্তু ফটোশপে ঠিকমত নেয় নি, কিংবা দেখাচ্ছে না। পূর্ব, সূর্য … দু’ ক্ষেত্রেই 🙁
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ফরিদ ভাইয়ের ইদানিংকালের লেখাগুলোর সত্যই কোন তুলনা হয় না – না তথ্যে, না গুনে মানে।
@অভিজিৎ,
😀
সাধারণত লেখা পড়ে বা ছবি দেখে আমার চোখে জল আসে না, এই লেখাটা পড়তে পড়তে আমার চোখে … কি হলো? কম্পিউটারের মনিটরটা ঠিকই আছে, চশমাটাও পাল্টিয়েছি দিন কয়েক আগে, তবুও!
ইরতিশাদ ভাই,
সময় স্বল্পতার কারণে লেখাটা খুব তাড়াহুড়োর মধ্যে লিখতে হয়েছিল আমাকে। ফলে, আমি নিজেই পুরোপুরি সন্তুষ্ট ছিলাম না এটাকে নিয়ে।
আপনার মন্তব্যের পর সেই অসন্তুষ্টিটা কেটে গেলো।
আমি বাকরুদ্ধ। ধন্যবাদ অসাধারন লেখাটির জন্য
@রামগড়ুড়ের ছানা,
পড়ার জন্য আপনাকেও ধন্যবাদ রামগড়ুড়ের ছানা।
শহীদ আজাদের মা শাফিয়া খাতুন বা জাহানারা ইমামের মত মা, আরো অনেক বাবা মার কথা যখন আমি ভাবি তখন মনে একটা কুটিল প্রশ্ন উদয় হয়। আজকে যদি দেশে ৭১ জাতীয় কোন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তাহলে কয়জন বাবা মা নিজ সন্তানকে এভাবে দেশের জন্য, ন্যায়ের জন্য কোরবান করে দিতে পারবেন?
আমার নিজের মনের উত্তর মোটেও আশাপ্রদ কিছু নয়।
কোরবানী ঈদের সময় বেশ বিতর্ক হচ্ছিল পশু কোরবানী নিয়ে। তখন বলতে যেয়েও বলিনি, কোরবানীর এমন জলন্ত উদাহরন কি ধর্মীয় রীতি শেখাতে পেরেছে? এর চেয়ে বড় কোরবানী আর কি হতে পারে?
@আদিল মাহমুদ,
আমার মনেও একটা কুটিল প্রশ্ন উদয় হয়। আজ যদি মুক্তিযুদ্ধ হত, কতজন ছেলে জুয়েলের মত জাতীয় ক্রিকেট দলে খেলার সম্ভাবনাকে পায়ে দলে যুদ্ধে যেত, কতজন ছেলে রুমির মত আমেরিকায় পড়তে যাওয়া বাদ দিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা মায়ের সাথ বিতর্ক করতো যুদ্ধে যাবার অনুমতির জন্য।
একাত্তর আসলে একবারই আসে একটা জাতির জীবনে।
@ফরিদ আহমেদ,
খুবই যুক্তিসংগত প্রশ্ন।
আর কোন জাতিকে মনে হয় না কোনদিন এই প্রশ্নের সম্ভাবনা নিয়ে ভাবতে হয়। আমাদের হয়।
@ফরিদ আহমেদ,
মুক্তিযুদ্ধে মায়েদের অনুভূতি কী রকম ছিল তার সবচেয়ে সেরা বর্ণনা পাওয়া যায় জাহানারা ইমামের লেখায়। তিনিই বোধহয় একমাত্র মা যিনি সমস্ত ঘটনাগুলোকে লিখিত আকারে আমাদের সামনে তুলে দিয়ে গেছেন। তার অবিস্মরণীয় গ্রন্থ ‘একাত্তরের দিনগুলি’-তে প্রতিটা মুহুর্তের প্রতিটা অনুভূতির বর্ণনা করে গেছেন তিনি। :rose2:
আমরা বাংগালী জাতি সব সময় বিজয় অর্জন করেও শেষতঃ বিজয় ধরে রাখতে পারি নি, পারি না,শুধু শত্রুরা এসে আমাদের বিজয় ছিনিয়ে নেয়,আর তা হয় আমাদের নেতৃত্তের দূর্বলতার সুযোগে অথবা সময় ও সুযোগটা শেষমেষ শত্রুদের দখলে চলে যায়।ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ব্যানারে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্তে যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবী আদায়ের সংগ্রাম একেবারে হাতের মুটোয় তখনই আরেক ঘাতক ক্যান্সার নামক দৈত্যটি এসে আমাদেরকে আবারো এক অ-কূল সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে গেল এবং তার জন্য আরো কতকাল আমাদেরকে সাগতে ভাসতে হয় কে জানে ? ভাগ্যবান গোলাম আজম গং-রা ও পাকিস্হানের পেতাত্তারা যারা শকুনের ছোবল দিয়ে আমার মা-জননী হতভাগা জাতিটির সকল আপামর মানুষের মাংস খো্বলে খো্বলে খাচ্ছে।অথচ রুমির মা যদি আর কয়টা বছর বেঁছে থাকতেন তাহলে বাংগালীর ইতিহাসের মোড়টা হয়ত অন্য দিকে ঘুরে যেতো। হায়,এমন ই দূর্ভাগা বংগ জননীর ছেঁড়া কপাল আমাদের।
আর কত?? জাগো বায়ে জাগো,আমরা যদি না জাগি ভাই কেমনে সকাল হবে ???
ইরতিশাদ ভাইয়ের মতো আপনার লেখা পড়তে পড়তে শেষমেষ আর চোখের জল আটকে রাখতে পারিনি, জল টপ্ টপ করে গাল বেয়ে বুকের উপর পড়তেছিল।
ফরিদ আহমেদ এর সাথে সহমত পোষন করছি,শেষের ব্যানারটি আজকে সকলের প্রত্যাশা ও একমাত্র সময়ের দাবী।
মামুন ভাই,
আপনার আবেগ দেখে কি বলবো বুঝতে পারছি না। শুধু বলি অনেক নরম মনের মানুষ আপনি। আপনার মত মানুষ এই যুগে অচল।
@আদিল মাহমুদ,
একটা কথা মনে রাখতে হবে। একাত্তর টুপ করে আকাশ থেকে পরে নি। ৪৭, ৪৮,৫২,৫৬,৬২,৬৯,৭০ এই বিশাল সময় পার করে তবেই একাত্তর এসেছে। এই সময়গুলো পুরোটাই একাত্তরের প্রেক্ষাপট তৈরি করে দিয়েছে,তাই তাদের মায়েরাও সিদ্ধান্ত নিতে দুবার ভাবেননি।
একটা সুগঠিত প্রেক্ষাপট অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সবই আপনার চোখের সামনে সিনেমার দৃশ্যের মত ভাসিয়ে তুলবে। মায়েরা তখন জানতেন যে দেশ শত্রু মুক্ত করতে তাদের সন্তানদের প্রয়োজন।তাই তারা তাদের সন্তানদের “দেশের নামে কুরবানী” করে দিতে পেরেছিলেন। একটা ভালো প্রেক্ষাপট হোক, আমাদের মায়েরা আবার তাদের সন্তানদের হাসিমুখে বিদায় দেবেন।
তারা যে মা!! মায়েদের এত স্বার্থপর ভাববেন না কখনই! :rose2:
ফরিদ,
লেখাটি পড়ে আবেগ প্রশমন করতে কষ্ট হচ্ছে। যে মা বাবাদের কথা বললে, তাদের অনেকেই আজ আর বেঁচে নেই। আর দুয়েক বছর পর আমাদের এ পূর্ব প্রজন্মকে তাদের শহীদ মুক্তিযযোদ্ধা সন্তানদের স্মৃতিচারণ করার জন্যেও পাব না।এমন কোন উদ্যোগ কি নেয়া যায় না যাতে তাদের মুখে তাদের শহীদ মুক্তিযযোদ্ধা সন্তানদের কথা দলিল করে রাখা যায়।
মুক্ত-মনা কি এ বিষয়ে ভাবতে পারে না?
গীতা দাস একটি ভাল প্রস্তাব দিয়েছেন। :yes:
দিদি,
এই লেখা লেখার সময় আমার নিজেরো আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে কষ্ট হয়েছে। যতবারই ভেবেছি যে, যখন বাচ্চা বাচ্চা ছেলেগুলো বলে অথবা না বলে যুদ্ধক্ষত্রে চলে যেতো তখন কেমন লাগতো মায়েদের, ততবারই গা শিউরে উঠেছে আমার। যুদ্ধের মাসগুলোতে মায়েরা জানতোই না তাদের সন্তানেরা কোথায় আছে, কীভাবে আছে। বেঁচে আছে না মরে গেছে। সেই বিভীষিকাময় সময় মায়েরা পার করেছে কীভাবে। তারপর যুদ্ধের পর কেউ ফিরে পেয়েছে তার সন্তানকে, কেউ পায়নি। কেউ জেনেছে তার সন্তান মারা গেছে, আবার কেউ কেউ আছেন কিছুই জানতে পারেননি। ছেলে বেঁচে আছে না মারা গেছে কিছুই না। এই সমস্ত মায়েদের মানসিক মৃত্যু কিন্তু তখনি হয়ে গেছে। তারপর তারা যতদিন বেঁচে ছিলেন বা আছেন সেটাকে আর বেঁচে থাকা বলা যায় না।
এরকম কত অজস্র জীবন্মৃত মা যে আমাদের চারপাশে ছিল বা আছে তার খেয়াল কী কোনদিন করেছি আমরা?