[ আমি নিশ্চিত যে এই লেখার বেশীরভাগ অংশই অনেকেই হয়ত আরো বিস্তারিত ও নিখুতভাবে জানেন। তাও লেখার লোভ সামলাতে পারলাম না দুটি কারনে। একজনের জরুরী অনুরোধ ছিল। অনেকটা অনুরোধে ঢেকি গেলার মত শুরু করলাম, খালি মনে হচ্ছিল সবার জানা ঘটনা লিখে কি লাভ? মানুষ না বিরক্ত হয়ে উলটো গাল দেয়। কিন্তু একটু পরেই আবিষ্কার করলাম যে কিছু ঘটনা কোনদিনই পুরনো হবে না, কিছু বিবরণী কোনদিনই মনে হয় বিরক্তিকর মনে হবে না। আশংকামুক্ত হলাম, ঢেকি গেলার বেদনাও কোথায় যেন পালিয়ে গেল। এ বিষয়ে লিখে কটূ কথাও হাসিমুখে সহ্য করা যায়।]

আমরা বাঙ্গালী মাত্রেই সবাই জানি বর্বর পাকিস্তানী বাহিনীর এ দেশীয় দোষররা কিছু মানুষ নামের অযোগ্য পশুরা কি সীমাহীন নিষ্ঠুরতা আর নিখুত পরিকল্পনার মাঝে সঙ্ঘটিত করেছিল মানব ইতিহাসের জঘন্যতম বুদ্বিজীবী হত্যা। আমরা অনেকেই আরো জানি ভারতীয় বিমান বাহিনীর মিগ-২১ জঙ্গী বিমানগুলো ১৪ই ডিসেম্বর বোমা হামলা করে ঢাকার গভর্ণর হাউজ় গুড়িয়ে দেয়। ভারতীয় বোমারু বিমানের এই বেসামরিক গভর্ণর হাউজ়ের হামলার আসল উদ্দেশ্য কি ছিল তা একটু বলা দরকার। বুদ্ধিজীবি হত্যার ভয়াবহ বিবরণ শুনলে যে কারোই গা শিউরে উঠবে। খুব সম্ভবত আমাদের আরো অনেক বুদ্ধিজীবি দক্ষ গোয়েন্দা সূত্রের সময়মত খবরে বেচে যান। সদ্য স্বাধীন দেশও সম্ভবত রক্ষা পায় পুরোপুরি মেধাশূন্য একটি জাতি নিয়ে যাত্রা শুরু করা থেকে।

ভারতীয় সরকারী সূত্রে বলা হয়ে থাকে যে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের থেকে খবর পায় যে ১৫ই ডিসেম্বর সকালে গভর্ণর হাউজে (এখনকার বংগভবন) পাকিস্তান সরকারের একটি গুরুত্ত্বপূর্ণ বৈঠক হবে, তাই তারা বিমান হামলা চালাবার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধান তাজউদ্দীন আহমদের কন্যা সিমিন হোসেন রিমি তার বইতে বলেছেন যে ঢাকা থেকে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের কাছে একটি গোপন খবর আসে। সে খবর অনুযায়ী পাক সামরিক জান্তা ততকালীন গভর্ণর হাউজে দেশের প্রখ্যাত সব বুদ্বিজীবিকে আলোচলনার নামে দাওয়াত দিয়ে এনে পাইকারী গণহত্যার একটা ভয়ংকর পরিকল্পনা এটেছে। তখন বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে ভারতকে অনুরোধ করা হয় গভর্ণর হাউজে বোমা বর্ষনের [১]। যুদ্ধের পরে ভারতীয় সেনা অফিসারদেরও কেউ কেউ ব্যক্তিগত স্মৃতি রোমন্থনে এর সমর্থনে বক্তব্য দিয়েছেন। তাদের মতে ভারত ডিসেম্বরের প্রথমেই ঢাকায় বুদ্বিজীবি হত্যা সম্পর্কে অবগত হয়ে যায়। কিন্তু তারা তখনো ঢাকার কাছে আসেনি, তাই অনেকটা অসহায়ের মত শুনে যাওয়া ছাড়া আর তেমন কিছুই তাদের করার ছিল না। আসামের গৌহাটি থেকে ভারতীয় বিমান বাহিনীর ২৮ স্কোয়াড্রনের ৪টি মিগ-২১ এই হামলায় অংশ নেয়। ঢাকা শহরের ট্যুরিষ্ট ম্যাপ সম্বল করে তারা নিপুন দক্ষতায় সম্পূর্ণ গুড়িয়ে দেয় গভর্ণর হাউজ। অনেকটা অলৌকিকভাবেই এই হামলায় কোন প্রানহানী হয়নি। শুধু একটি কাচের একুয়ইরিয়ামের কয়েকটি মাছ মারা যায়। পূর্ব পাকিস্তানে ইয়াহিয়ার ৭৪ বছরের বেসামরিক গভর্ণর মালেক এই হামলা চলাকালীন সময়েই বাইরে লনের ট্রেঞ্চে আশ্রয় নিয়ে এক বিদেশী সাংবাদিকের থেকে কলম ধার করে কম্পিত হস্তে তার পদত্যাগপত্র লিখে দ্রুত সাংগোপাঙ্গো সমেত হোটেল ইন্টারকনের রেডক্রশের আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা এলাকায় আশ্রয় নেয়। নিয়াজী বেজায় ঘাবড়ে যায়, তার ওপর এই বোমা বর্ষনের সাইকোলজিক্যাল এফেক্ট হয় চরম। আত্মসমর্পনের সিদ্ধান্ত নিতে এই ঘটনার বড় ভূমিকা ছিল।

এদিকে রণক্ষেত্রের যুদ্ধের পাশাপাশি পর্দার আড়ালে চলছিল আরেক যুদ্ধ, সেটা কূটনৈতিক পর্যায়। পাকিস্তানের মিত্র যুক্তরাষ্ট্র ও চীন অবিরাম চেষ্টা করে যাচ্ছে যুদ্ধবিরতীর। যেটা সফল হবার সোজা মানে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের পরিসমাপ্তি। কূটনৈতিক চেষ্টার আড়ালে চীন সরাসরি ভারতকে আক্রমনেরও হুমকি দিয়েছে। তারা ৬২ সালের মত আবারো লাদাক সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ শুরু করেছে ভারতের উপর চাপ সৃষ্টি করতে। তবে সেসময় সোভিয়েত রাশিয়া পাল্টা হুমকি দেওয়ায় চীনারা আর সে পথে যায়নি। রাশিয়া আগেই হুশিয়ারী দিয়ে রেখেছিল যে পূর্ব পাকিস্তানে যে কারো সামরিক হস্তক্ষেপ সে নিজ দেশে হামলা হিসেবেই বিবেচণা করবে। এসময় কাঠমুন্ডুতে সোভিয়েত এবং ভারতীয় মিলিটারী এটাশে মার্কিন মিলিটারী এটাশে কর্ণেল মেলভিন হোষ্টকে চীনের হুমকি ও সপ্তম নৌবহর সম্পর্কে জানতে চান [২]। পরে রুশ প্রতিনিধি চীনা মিলিটারী এটাশেকে পরিষ্কার জানিয়ে দেন যে চীনের যেকোন হস্তক্ষেপ রাশিয়া কঠোরভাবে মোকাবেলা করবে। দিল্লীতে রুশ রাষ্ট্রদূত নিকোলাই পেগভ ইন্দিরার সাথে দেখা করেও একই আশ্বাস দেন। তিনি জানিয়ে দেন যে চীন যদি লাদাখ সীমান্তে হামলা করে তবে তারাও চীনের সিংকিয়াং প্রদেশে চীনের এচিলী হাইটে পালটা হামলা চালাবে। এদিকে জাতিসংঘে সোভিয়েত স্থায়ী প্রতিনিধি জেকব মালিক ৩ বার যুদ্ধবিরতীর চীনা-মার্কিন প্রস্তাবে ভেটো দেন। শেষ ভেটো তিনি দেন ১৩ই ডিসেম্বর। এর ফলে ভূট্টো রেগে মেগে তার দলবল সমেত জাতিসংঘ ত্যাগ করে বেরিয়ে যায় (ভিডীও)। তবে আর কতদিন এদের ঠেকিয়ে রাখা যাবে তা নিয়ে আশংকা বাড়তেই থাকে। বাংলাদেশ-ভারত মিত্র বাহিনীর হাতে মোটেও বেশী সময় নেই। যুদ্ধবিরতীর কোন আন্তর্জাতিক প্রস্তাব পাশ হবার আগেই পতন ঘটাতে হবে ঢাকার। পাকিস্তানীরাও এটা জানে, তাই তাদের লক্ষ্য যেকোন উপায়ে ঢাকার দখল ধরে রাখতে হবে যতক্ষন পারা যায়। যুদ্ধের প্রথম দুদিনেই পরিষ্কার হয়ে যায় যে পাক বাহিনীর পরাজয় আসন্ন। তখন ঢাকার প্রতিরোধ জোরদার করে যুদ্ব দীর্ঘায়িত করার জন্য তাদের পরাজিত সব বাহিনীকে ঢাকা চলে আসার নির্দেশ দেওয়া হয়।

নিয়াজী ডিসেম্বর এর ১২ তারিখে অবস্থা বেগতিক দেখে তার মেঃ জেনারেল রাও ফরমান আলী ও মেঃ জেনারেল রহিমের সাথে পরামর্শ করল। দুই ঘাগু সমরবিদই রায় দিল যে পিন্ডির কাছে আত্মসর্মপনের অনুমতি চাওয়া হোক বলে। সে মত রাও ফরমান প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাছে অনুমতি চেয়ে জরুরী তার পাঠায়। ১৩ তারিখে তার কোনই জবাব এলো না। পরে জানা যায় যে ইয়াহিয়া ডিসেম্বর এর ৩ তারিখ থেকেই যুদ্ধের ব্যাপারে সব উতসাহ হারিয়ে এমনকি অফিসে আসাও বন্ধ করে দিয়েছিল। ১৪ তারিখ সকালে ঘটল গভর্ণর হাউজে বিমান হামলা, সাথে সাথে খবর এলো ময়মনসিংহ-টাঙ্গাঈল এলাকায় নিয়োজিত জেনারেলের জামশেদের ৩৬ ডিভিশনের ব্রিগেডীয়ার কাদেরের দূর্ধষ ৯৩ ব্রিগেড কাদেরীয় বাহিনীর কাছে সম্পুর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে। ব্রিগেডিয়ায় কাদের আরো ১৮ জন অফিসার সহ পায়ে হেটে ঢাকা আসার পথে কালিয়াকৈরে কাদেরীয়া বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বন্দী হয়। তবে আরো জানা যায় যে ইয়াহিয়া এসময় পর্যন্ত মার্কিন ৭ম নৌবহর ও চীনা সৈন্যের আশায় ছিল। বিশেষ করে চীন ১২ তারিখেও তাকে আশ্বাস দেয় যে ৩ দিনের মধ্যেই তারা সৈন্য পাঠানো শুরু করবে [২]। বলাই বাহুল্য রূশ হুমকির মুখে সে আশ্বাস কাজে পরিনত হয়নি। নিয়াজী পিন্ডি থেকে কোন সাড়া না পেয়ে নিরুপায় হয়ে ১৫ই ডিসেম্বর মধ্যরাতে আবারো পিন্ডিতে পাক সেনাপ্রধান জেনারেল হামিদের কাছে ধর্ণা দেয়। অবশেষে এতে কাজ হয়, ১৫ই ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ইয়াহিয়া নিয়াজীর বিবেচণা সাপেক্ষে আত্মসমর্পনের অনুমতি দেয়।

এমনি অবস্থায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর ১০১ মাউন্টেন ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল গন্ধর্ব নাগরা তার বাহিনী, বাঘা কাদের সিদ্দিকী ও তার বাহিনী নিয়ে এগিয়ে চলেছেন ঢাকার দিকে উত্তর দিক থেকে। তার সাথে আরো যোগ দিয়েছেন ভারতীয় ১৩ গার্ডস এর সন্ত সিং এবং শিখ লাইট ইনফ্যান্ট্রির ব্রিগেডীয়ার হরদেব সিং ক্লার। মিত্র বাহিনীর এই অগ্রযাত্রা ছিল ঢাকাস্থ পাক বাহিনীর জন্য অনেকটা অপ্রত্যাশিত। কারন পাকিস্তানীরা নাগরা বাহিনীর মূল রূট জয়দেবপুর-টংগী-নয়ারহাট-ঢাকা হিসেব করে সে পথে জয়দেবপুর-টঙ্গী এলাকায় তুরাগ নদীর অপর পাড়ে ২১ বালুচের দূর্ভেদ্য ডিফেন্স বসিয়ে রেখেছে। নাগরা বাহিনীর কাছে সে ডিফেন্স তূলনীয় না হলেও তারা অন্তত মিত্র বাহিনীকে অনেকটা দেরী করিয়ে দিতে পারবে। নাগরা কোনমতেই এই ঝুকি নিতে চাইলেন না। কাদের সিদ্দিকীর পরামর্শে তাই তিনি ভিন্ন পথে কালিয়াকৈর হয়ে নয়ারহাট ঢাকা পথ ধরে এসেছেন, এই পথটি তখনো নুতন হওয়ায় ম্যাপে ছিল না। যদিও এই পথেও ঢাকা প্রতিরক্ষার দায়িত্বে নিয়োযিত পাক ব্রিগেডিয়ার বশীর খুলনা থেকে ৬ই ডিসেম্বর পালিয়ে আসা কর্ণেল ফজলে হামিদকে তার দলবলসহ অবস্থানের নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু বশীর জানত না যে কর্ণেল হামিদের ক্ষতবিক্ষত দলবল আরো যুদ্ধ করার বদলে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে আশ্রয় নেওয়াকেই শ্রেয় মনে করেছে। ফলে মিত্র বাহিনীকে সাভার ডেইরী ফার্ম এলাকার সামান্য পাক প্রতিরোধ ছাড়া তেমন যুদ্ধ করতে হয়নি। এরা মূলত কাদেরিয়া বাহিনির হাতেই ধ্বংস হয়। ফলে ব্রিগেডিয়ার বশীর দ্রুত মেজর সালামতের নেতৃত্বে কিছু সৈন্য মীরপুর ব্রীজ পাহারায় পাঠিয়ে দেয়। এই দল মিত্র বাহিনী পৌছার মাত্র অল্প কিছু আগে এখানে পৌছাতে সক্ষম হয়। এরা কামানে সজ্জিত ছিল।

মিত্র বাহিনী ১৬ই ডিসেম্বর ভোর দুটায় ঢাকার উপকন্ঠে মীরপুর ব্রীজের অপর পাড়ে পৌছে যান। তখনো পাক বাহিনী আত্মসমর্পনের সিদ্ধান্ত নেয়নি। ভারতীয় সেনাবাহিনীর দুটো জীপ এসময় ব্রীজ পার হওয়ার চেষ্টা করলে পাকিস্তানী সেনাদের গোলায় দুটি জীপই ধ্বংস হয়, এতে একজন অফিসারসহ ৪ জন ভারতীয় সেনা নিহত হয়। এ ঘটনা নাগরাকে কিছুটা হলেও চিন্তায় ফেলে। তার আরো চিন্তা হয় যে মীরপুর ব্রীজ পাকিরা উড়িয়ে দিলে তিনি আরো বিপদে পড়বেন, কারন তার দলের ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের সদস্যরা এসে পৌছাতে আরো দেরী হবে। তবে তার সাথে আসা ২ কমান্ডো বাহিনীর সদস্যরা সফলতার সাথে ব্রীজ ওড়ানো ঠেকিয়ে যাচ্ছে। ভারতীয় সেনাপ্রধান মানেক শ ৩ দিন ধরেই পাক বাহিনীকে আত্মসমর্পনের প্রস্তাব দিয়ে আসছেন; নিয়াজী সরাসরি রাজী না হলেও সময় চাওয়ায় ভারত ১৫ই ডিসেম্বর বিকাল ৫ টা থেকে ১৬ই ডিসেম্বর ভোর ৯ টা পর্যন্ত সিজ ফায়ার ঘোষনা করে। তবে নাগরা চিন্তা পড়লেন যে আর কয়েক ঘন্টার মধ্যেই এই সিজ ফায়ার শেষ হলেই পাক বাহিনী ব্যাপক যুদ্ধে লিপ্ত হবে। এমনি অবস্থায় ভোর ৫ টায় পাওয়া যায় একটি বিরাট সুসংবাদ। ভারতীয়রা রেডিওতে পাক বাহিনীর ওয়ার্লেস ম্যাসেজ ইন্টারসেপ্ট করে, তাতে নিয়াজীর তরফ থেকে তার ষ্টাফ অফিসার ব্রিগেডিয়ার বকর দেশের সব যায়গার পাক বাহিনীর অধিনায়কদের স্থানীয় ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমপর্নের নির্দেশ দিচ্ছিল। যদিও আত্মসম্মানে লাগায় কায়দা করে সারেন্ডার শব্দটা এড়িয়ে মেসেজ দেওয়া হচ্ছিল। এসময় নাগরা কাদের সিদ্দিকী ব্রিগেডিয়ার ক্লার, এবং সন্ত সিং এর সংগে আলোচনায় ঠিক করলেন যে এইই সুযোগ, নিয়াজীকে আত্মসমর্পনের প্রস্তাব দিতে হবে। ঘটনাক্রমে নাগরা ও নিয়াজী অবিভক্ত ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে একই সাথে কমিশন পান, সে সূত্রে তাদের পূর্ব পরিচয় ছিল। নাগরা মিলিটারী এটাশে হিসেবে পাকিস্তানে দায়িত্ব পালন করার সময়েও তাদের আবারো যোগাযোগ ঘটে।

সেই পরিচয়ের সূত্রে নাগরা নিয়াজীকে ছোট্ট একটি চিঠিতে সম্মানজনক ও নিরাপদ আত্মসমর্পনের আহবান জানান যার কথা মনে হয় সবাই জানেন। তবুও কিছুটা তুলে দিচ্ছি; “MY dear Abdullah. I am here. The game is up. I suggest you give yourself up to me. I will look after you”. [৩] এই চিঠি নিয়ে নাগরার এডিসি ক্যাপ্টেন মেহতা একটি জীপে সাদা পতাকা উড়িয়ে ঢাকায় নিয়াজীকে পৌছাতে রওনা হলেন। বিনা বাধায় তারা ব্রীজ পার হলেন। এটাই ঢাকায় প্রথম ভারতীয় বাহিনীর পদার্পন। পাক সেনা সদস্যদের বিস্ময়ের সাগরে ভাসিয়ে এই জীপ সোজা নিয়াজীর সেনা সদরে পৌছে। ব্রিগেডিয়ার বকর এই চিঠি গ্রহন করে নিয়াজীর কাছে পৌছে দেন। এরপর বসে এই চিঠির কি প্রত্যুত্তর দেওয়া যায় সে প্রশ্নে নিয়াজী, রাও ফরমান আলী, জেনারেল জামশেদ, ও এডমিরাল শরীফের বৈঠক। ঢাকা শহর রক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত জেনারেল জামশেদ সাফ জানিয়ে দিলেন যে নাগরার মিত্র বাহিনীকে ঠেকানোর মত কোন শক্তি তার নেই। এর উত্তরে নিয়াজী নির্বাক; তবে ফরমান আলী ও শরীফ একই সাথে বলে উঠল, “তাহলে নাগরা যা বলছে তাই করা হোক”। ফ্যাল ফ্যাল করে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে নিয়াজী তার সেনা জীবনে সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হল। তার হাতে ঢাকায় তখনো যত সৈন্য ছিল তা দিয়ে সে আরো কয়েকদিন যুদ্ধ চালিয়ে যেতেই পারত। কিন্তু পাক বাহিনীর নৈতিক পরাজয় আরো আগেই ঘটে গেছে। নিয়াজী পরে ফোর্ট উইলিয়ামে যুদ্ধবন্দী অবস্থায় আনার পর একটি সাক্ষাতকারে এর ব্যাখ্যা দিয়েছিল। তার মতে সে যুদ্ধ আরো কিছুদিন হয়ত চালাতে পারত, কিন্তু তাতে ফলের কোন উনিশ বিশ হত না, বরং তাকে ৯০,০০০ যুদ্ধবন্দী নিয়ে পাকিস্তান যাবার পরিবর্তে ৯০,০০০ বিধবা ও ৫ লাখ এতিমের মুখোমুখি হতে হত। তাই সে আত্মসমর্পনের পথই বেছে নেয়। সন্দেহ নেই তার গোটা সামরিক জীবনে এটাই সবচেয়ে ভাল সিদ্ধান্ত।

নিয়াজীর সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে জেনারেল জামশেদ যিনি ছিলেন ঢাকা শহর প্রতিরক্ষার দায়িত্বে, তাকেই পাঠানো হল নাগরার এডিসি ক্যাপ্টেন মেহতার সাথে মিত্র বাহিনীর মেহমানদের আপ্যায়ন করে নিয়ে আসার জন্য। মীরপুর ব্রীজের কাছে পৌছে জামশেদ রইলেন পাকিস্তানী তীরে আর তার একজন বার্তাবহ মেজর সাদা পতাকা উড়িয়ে জীপে করে নদীর অপর পাড়ে ভারতীয় শিবিরে গেল। সেখানে নাগরাকে স্যালূট করে সে নিয়াজীর বার্তা পৌছে দিল। নিয়াজীর তাতক্ষনিক প্রতিক্রিয়া ছিল আর কোন গোলাগুলি হবে না। আরো জানালো যে নদীর অপর পাড়ে জেনারেল জামশেদ অভ্যর্থনা করে নেবার জন্য অপেক্ষা করছে। এ সুখবর ততক্ষনাত পৌছে গেল কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম হয়ে দিল্লীতে। সেখানে আত্মসমর্পনের দলিল মুসাবিদা শুরু হয়ে গেল। এরপর জামশেদের ষ্টাফ কারে নাগরা, কাদের সিদ্দিকী, ব্রিগেডিয়ার ক্লার, ও সন্ত সিং চললেন নিয়াজী দর্শনে। নিয়াজীর অফিসে ব্রিগেডিয়ার বকর তাদের সাদর অভ্যর্থনা জানালো। একটু পরেই এল নিয়াজী। নাগরাই প্রথম কথা বললেন; “হ্যালো আব্দুল্লাহ, কেমন আছো? টাইগার নিয়াজী বলে খ্যাতিমান নিয়াজী আর নিজেকে সামলাতে পারল না, নাগরাকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। পাঞ্জাবীতে বলল; ” পিন্ডিমে বেহতে হুয়ে লোগো নে মারওয়া দিয়া” [৩]। আশ্চর্যজনকভাবে ৭১ এর পাক সেনানায়কদের মনে হয় সবারই এ রোগটা ছিল। কেউই দায়িত্ব স্বীকার করতে রাজী নয়, সব দোষ অন্যের। নিয়াজী ও রাও ফরমান পরে নিজেদের বইতে একে অপরকে চরমভাবে দোষারপ করেছে। এরপর নাগরা নিয়াজীর সাথে পাক বাহিনীর আতংক সেই কিংবদন্তীর কাদের সিদ্দিকীর পরিচয় করিয়ে দিলেন।

নাগরা নিয়াজীকে ধাতস্থ হবার জন্য কিছু সময় দিলেন। চা নাশতার সাথে কিছু হালকা কথাবার্তা হল। নিয়াজী ধাতস্থ হয়ে তার স্বভাবমত কিছু ডার্টি জোকস শুরু করল। এর মাঝেই খবর এলো যে ফোর্ট উইলিয়াম থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলের ষ্টাফ প্রধান মেজের জেনারেল জেকব দুপুর ১ টায় হেলিকপ্টারে আসছেন ঐতিহাসিক আত্মসমর্পনের দলিল নিয়ে। তাই নাগরা ও তার সংগীরা পাক ব্রিগেডিয়ার বকরসহ চলে গেলেন তেজগাও এয়ারপোর্টে তাকে অভ্যার্থনা জানাতে। নাগরা ব্রিগেডিয়ার ক্লারকে পাঠালেন হোটেল ইন্টারকনের নিরপেক্ষ জোনের নিরাপত্তা জোরদার করতে, কারন তখনো শহর জুড়ে ব্যাপক গোলাগুলির আওয়াজ আসছে। জ্যাকবের সাথে আরো এলেন গোয়েন্দা বিভাগের কর্ণেল খেরা। সবাই আবারো নিয়াজীর অফিস কক্ষে মিলিত হলেন সেই ঐতিহাসিক আত্মসপমর্পনের দলিল পর্যালোচনার জন্য। নিয়াজী একনজর দেখেই সেটা রাও ফরমানের হাতে তুলে দিল। রাও ফরমান পড়ে প্রথমেই ভারত-বাংলাদেশের মিলিত বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পনে আপত্তি জানালো। কারন এটা মেনে নেওয়ার মানে বাংলাদেশকে মেনে নেওয়া। কিন্তু জেকব অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে জানিয়ে দিলেন যে এই দলিল দিল্লী থেকে এসেছে, এর কোন পরিবর্তন বা সংশোধন ওনাদের কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। ব্যক্তিগত আরো কিছু সূত্রে জানা যায় যে পাকিস্তানীরা রেসকোর্সের মত খোলা ময়দানেও আত্মসমর্পনে আপত্তি তুলেছিল। কিন্তু ভারতীয়রা ইচ্ছাকৃতভাবেই তাদের প্রকাশ্যে খোলা ময়দানে আত্মসমর্পনে বাধ্য করায়।

বেলা ৩ টার দিকে হেলিকপ্টারে এসে পৌছুলেন সস্ত্রীক জেনারেল জগজিত সিং আরোরা। নিয়াজী রীতি অনুযায়ী তাকে তেজগাও বিমান বন্দরে অভ্যর্থনা জানাল। বেলা ৪ টার একটু পরেই নিয়াজীকে নিয়ে আরোরা এসে পৌছালেন রেসকোর্সের ময়দানে। ময়দানের সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্বে আছে নাগরার ১০১ ডিভিশনের সৈনিকেরা। পাকিস্তানী অফিসার ও সেনারা যথেষ্ট নিরাপত্তার আশংকা করছে তাদের গত ৯ মাসের কৃতকর্মের জন্য। আরো এসে পৌছালেন বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে মুক্তিযুদ্ধের উপাধিনায়ক গ্রুপ ক্যাপ্টেন একে খোন্দকার, আরেক কিংবদন্তীর নায়ক বিখ্যার ক্র্যাক প্ল্যাটুনের সংগঠক মেজর হায়দার, কাদের সিদ্দিকী তো আছেনই। আরো আছে লাখ দশেক দর্শক, যারা পাকিস্তানীদের তাদের হাতে তুলে দেবার দাবী জানাচ্ছে। বিকেল ঠিক ৪ টা ৩১ মিনিটে নিয়াজী আত্মসমর্পনের দলিলে সই করে। এক দানবীয় শক্তির করুন পতনের সাথে সাথে জন্ম নিল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। বিশ্ব মানচিত্রে ঘটল এক বিরাট পরিবর্তন। সই করার পর আনুষ্ঠানিকতা পালনের জন্য নিয়াজী তার ৭.৬২ মিমি সার্ভিস রিভলবার আনুগত্যের নিদর্শন হিসেবে আরোরার হাতে তুলে দিল। এই রিভলবার ভারতের কোন এক সামরিক যাদুঘরে আছে। এরপর পরাজিত সেনাপতি তার কাধ থেকে জেনারেলের ব্যাজ খুলে বিজয়ী সেনাপতি অরোরার হাতে তুলে দিল, কপালে কপাল ঘষল। বাংগালী জাতির সবচেয়ে গৌরবময় এই মুহুর্তের খবর দ্রুত পৌছে গেল দেশের সীমানা পার হয়ে বহিঃবিশ্বে। ঢাকা তখন উতসবের শহর, প্রতিটা বাড়িতে উড়ছে লাল সবুজের অতি প্রিয় পাতাকা। লন্ডনেও বেরিয়ে গেছে আনন্দ মিছিল। এমন মুহুর্ত খুব কম জাতির ভাগ্যেই জোটে।

এরপর ১৮ ই ডিসেম্বর নিয়াজীসহ সিনিয়র পাক অফিসারদের নিয়ে যাওয়া হয় যুদ্ধবন্দী হিসেবে ফোর্ট উইলিয়ামে।

সূত্রঃ

আমি বিজয় দেখছি -এম এর আখতার মুকুল

[১] আমার ছেলেবেলা ১৯৭১ এবং বাবা তাজউদ্দিন আহমেদ – সিমিন হোসেন রিমি (পৃষ্টা ১১৬)

[২] Pakistan Cut to Size – D.R.Mankekar

[] http://www.tribuneindia.com/1998/98dec26/saturday/head7.htm

কিছু ছবি