সূর্য ওঠার প্রহরে আক্রান্ত হলাম আমরা।

 

গভীর ঘুমে তলিয়ে ছিলাম তিনজনই, বিলাইছড়ির কাছাকাছি একটা নিরিবিলি গ্রামে। গত কয়েকদিনে খুব সামান্যই ঘুমোতে পেরেছি আমরা। একটু সুযোগ পেয়েই মড়ার মত ঘুমিয়েছিলাম সবাই। যে বুড়োর বাড়ীতে আশ্রয় নিয়েছিলাম সে আশ্বস্ত করেছিল এই বলে যে এখানে কোন বিপদ নেই। তাছাড়া সে আমাদের জন্য সারারাত পাহারা দেবেও বলেছিল। কোন বিপদ আসার আগেই আমাদেরকে সতর্ক করবে বলেছিল। ফলে নিশ্চিন্ত মনেই ঘুমোতে গিয়েছিলাম আমরা।

 

দড়াম করে দরজা ভেঙ্গে সেনাবাহিনীর লোকেরা ঘরে ঢুকতেই নিমেষেই জেগে গেলাম সবাই। দীর্ঘদিন ধরে বিপদকে সঙ্গী করে চলতে অভ্যস্ত আমরা। স্নায়ুগুলো বিপদের জন্য প্রস্তুত হয়েই থাকে সারাক্ষণ। কে যেন শক্তিশালী সার্চ লাইটের আলো ফেললো আমাদের উপর। তীব্র আলোয় চোখ ধাধিয়ে গেল আমার। কিশোর আর জুনুকে দেখলাম পাহাড়ি চিতার ক্ষিপ্রতায় ঝাঁপিয়ে পড়লো পাশে রাখা অস্ত্রের দিকে। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে অনেক। অস্ত্র হাতে তুলতে না তুলতে একরাশ গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেলো দুজনেই। অস্ত্র হাতে নিতে গেলে কিশোর আর জুনুকে টপকে যেতে হবে আমাকে। আমি অসহায়ের মত দুহাত উপরে তুলে দাঁড়িয়ে গেলাম। তীব্র আলোয় সবকিছুই আবছা দেখছি। চারিদিকে কিছু ছায়ামুর্তির অস্পষ্ট নড়াচড়া । যে কোনো মুহুর্তেই একঝাক গুলি এসে কিশোর আর জুনুর মত আমাকে ঝাঁঝরা করে দেবে হয়তো এক্ষুনি। মৃত্যুর কত কাছে এসে দাঁড়িয়েছি আমি। আচ্ছা, মৃত্যুর সময় কেমন লাগে মানুষের? কিশোর আর জুনু কি কিছু ভাবার সময় পেয়েছিল? চারপাশ থেকে কর্কশ আওয়াজ ভেসে আসছে। চারিদিকে ধাতব ঝংকার। এর মধ্যেই কেউ একজন আদেশের স্বরে চেঁচিয়ে উঠলো, খবরদার, কেউ গুলি করবে না। ও নিরস্ত্র

 

গলার স্বরটা আবছাভাবে পরিচিত মনে হলো আমার। আগে কোথাও শুনেছি। কোথায় শুনেছি, সেটা নিয়ে ভাবার সময় পেলাম না। ঘাড়ের উপর রাইফেলের বাট দিয়ে কেউ একজন সজোরে বাড়ি দিল। হাটুর উপরে ভা্রি বুটের লাথি খেয়ে মেঝেতে পড়ে গেলাম আমি। আবারো ধমকে উঠলো সেই একই কণ্ঠস্বর। কোন মারপিটও নয়

 

টেনে হিঁচড়ে আমাকে উঠোনে নিয়ে এলো সৈনিকেরা। সাতজনের একটা দল। ইস্পাত কঠিন চেহারা সকলেরই। সকালের নরম আলোতে কেন যেন আরো কঠিন দেখাচ্ছে সবাইকে। তরুণ একটা ছেলে দলনেতা। কাঁধে ক্যাপ্টেনের ব্যাজ। ওকে দেখেই বিস্ময়ে চমকে উঠি আমি। আরে, এতো সুমন। কবে ক্যাপ্টেন হয়ে গেছে। আমার বিস্ময় অবশ্য চোখের পলকে সামলে নেই আমি। সুমনের চেহারায় আমাকে চেনার কোন লক্ষণই দেখি না। সুমন কি আমাকে চিনেছে? নিশ্চয়ই চিনেছে। তা না হলে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতো না আমাকে। আমার মতই হয়তো না চেনার ভান করছে। যুদ্ধ যে সব কিছুকেই পালটে দেয় তার নিজস্ব নিয়মে।

 

উপজাতীয় কোটায় আমি তখন ভর্তি হয়েছি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পশুপালন অনুষদে। থাকতাম আশরাফুল হক হলে। কৃষি অর্থনীতির ছাত্র ছিল সুমন। আমি আর সুমন আরো চারজন ছাত্রের সাথে গাদাগাদি করে এক রুমে থাকতাম। দুর্দান্ত ফুটবলার ছিল সুমন। আমিও খুব একটা খারাপ খেলতাম না। সুমনের কারণেই আন্তঃ হল ফুটবল প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়ে গিয়েছিলাম আমরা সেবার। ফার্স্ট ইয়ারের শেষের দিকে আইএসএসবিতে টিকে গিয়ে বিএমএর লং কোর্স করতে ভাটিয়ারির মিলিটারী একাডেমিতে চলে গেল সুমন। তারপর থেকেই আর কোন যোগাযোগ নেই ওর সাথে আমার। থাকার কথাও নয়। আমার পৃথিবী যে উলটে যেতে শুরু করেছে তখন।

 

সেকেণ্ড ইয়ারে পড়ার সময়ই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় দুঃসংবাদটা এলো। আবদুর রশীদ নামের এক বাঙালি নেতাকে অজ্ঞাত পরিচয় কেউ গুলি করে মেরে ফেলেছিল। তারই জের ধরে সেনাবাহিনী আর গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সহায়তায় অস্ত্র সস্ত্র নিয়ে বাঙালি সেটলাররা নৃশংসভাবে রাতের আঁধারে হামলা চালিয়েছিল আমাদের গ্রামে। সমস্ত গ্রামটাকেই জ্বালিয়ে দিয়েছিল তারা সুতীব্র ঘৃণায়। আমার কিশোরী ছোট বোনটাকে ছিনিয়ে নিয়ে বিধবা মাকে ঘরের মধ্যে আটকে রেখে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল তারা। ছোট বোনটার মানুষ নামক শকুনে খাওয়া রক্তাক্ত শরীর পড়ে ছিল পাশের বাঁশ ঝাড়ের নিচে। খবর পেয়ে সাথে সাথেই লংগদুতে ছুটে গিয়েছিলাম আমি।

 

আগুনে পোড়া ঝলসানো মা আর ক্ষত বিক্ষত বোনটার সকার করে পোড়াবাড়ির দিকে শুন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম আমি বহুক্ষণ। আপনার বলতে এই বিশাল পৃথিবীতে এখন আর কেউ রইলো না আমার।

 

ঘরের মধ্যে আটকে রেখে যখন আগুন দিয়েছিল মায়ের আমার কেমন লেগেছিল? খুব কী কষ্ট পেয়েছিল মা আমার? ব্যথায় কী চিকার করেছিল গলা ফাটিয়ে? আমাকে কী ডেকেছিল বাঁচানোর জন্য? কী ভেবেছিল তখন আমার গর্ভধারিনী? জীবন্ত রোষ্ট হতে হতে নিশ্চয়ই তার কিশোরী মেয়ের কল্যানের কথাই ভেবেছিলেন তিনি। মায়ের যে আমাদের দুজনকে ছাড়া আর কোন চিন্তা ছিল না কখনো। আমরা দু ভাইবোনই ছিলাম তার গোটা পৃথিবী। মায়ের কারণেই পাহাড়ের অস্থিরতা থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখে ছিলাম আমি সযত্নে। পড়ালেখা শেষ করে কীভাবে মায়ের মুখে হাসি ফোঁটাবো সেই চিন্তাতেই বিভোর ছিলাম আমি।

 

যে কাজটা এর আগে অনেক বলেও আমাকে দিয়ে করাতে পারেনি কেউ, সেই কাজটাই নির্দ্বিধায় করে ফেলি আমি। মা-বোনকে সকারের পরের দিনই শান্তি বাহিনীতে যোগ দেই আমি।

 

কিশোর আর জুনুর লাশকে বাশের সাথে ঝুলিয়ে দুই মাথা দুজন করে সৈনিক কাঁধে ঝুলিয়ে নেয়। আমার হাত পিছন দিকে নিয়ে হাতকড়া পরিয়ে দেয়। গ্রাম থেকে মাইল খানেক দূরে জঙ্গলের হেঁটে যাই সবাই। আমাদের আক্রমণ করার আগে এখানেই আর্মির লোকজন তাদের ট্রাকটাকে লুকিয়ে রেখেছিল। ট্রাকের শব্দ পেয়ে আমরা যেন সতর্ক হতে না পারি সে কারণে। ট্রাকে করে পাহাড়ের উঁচু নীচু আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে ঘন্টা খানেকের মধ্যেই মেরাংছড়ি আর্মি ক্যাম্পে পৌঁছে যাই আমরা। একটা স্কুলকে আর্মি ক্যাম্পে পরিণত করা হয়েছে। এর মধ্যে একবারো সুমন আমার সঙ্গে কথা বলার কোন চেষ্টা করে নাই। এমনকি একবার ফিরেও তাকায়নি আমার দিকে। ভাবলেশহীন মুখ করে রেখেছে। ক্যাম্পে নিয়ে একটা রুমে আটকে রাখা হলো আমাকে।

 

ঘন্টা দুয়েক পরে হেলিকপ্টারের শব্দ শুনতে পেলাম। স্কুলের মাঠেই নামছে মনে হলো। বিকট শব্দ হচ্ছে। একটু পরেই থেমে গেল সে শব্দ। কিছুক্ষণের মধ্যেই দরজা খুলে দুইজন সৈনিক আসে আমার কক্ষে। ধাক্কাতে ধাক্কাতে বাইরে নিয়ে যায় আমাকে। স্কুলের মাঠে জলপাই রঙ এর বিশাল হেলিকপ্টারটা অলস ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। একটা গাছের নীচে দাঁড়িয়ে সুমন আর মুষ্টিযোদ্ধাদের মত সুঠামদেহী এক মেজর কথা বলছে। মেজরের হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। উত্তেজিত ভাবভঙ্গি দুজনেরই। কিছু একটা নিয়ে দুজনেই তর্ক করছিল মনে হয়। আমাকে দেখেই থেমে গেল দুজনেই। এই মেজর সাহেবই তাহলে হেলিকপ্টারে করে এসেছেন। মেজরের বুকের ডানদিকে নেম ট্যাগ ঝুলানো। তানভীর নাম ভদ্রলোকের।

 

গাছের সাথে বাঁধো ব্যাটাকে। আমাকে টেনে আনতে দেখেই জলদ গম্ভীর স্বরে হুকুম দেয় মেজর তানভীর।

 

শক্ত করে গাছের সাথে বেঁধে ফেলা হয় আমাকে।

 

একে কি ইন্টারোগেশন করেছো? সুমনকে জিজ্ঞেস করে মেজর।

 

না করিনি এখনো।

 

কেন করোনি? ধমকে উঠেন মেজর।

 

আমার সৈন্যরা ক্লান্ত ছিল। গতরাতে অনেক ধকল গেছে ওদের উপর দিয়ে। তাছাড়া আমিও ক্লান্ত ছিলাম

 

কটমট করে সুমনের দিকে তাকালো মেজর তানভীর। দায়িত্বে এতখানি অবহেলা মেনে নিতে পারছে না।

 

ঠিক আছে। আমার সৈন্যরা ক্লান্ত না। আমিও ক্লান্ত নই। আমরাই জেরা করছি

 

নাম কি? আমার দিকে ফিরে আমাকে জিজ্ঞেস করলো মেজর।

 

কুসুম, কুসুম চাকমা

 

বাড়ী কোথায়?

 

লংগদু

 

ট্রেনিং নিয়েছো কোথায়? ইণ্ডিয়ায়?

 

কথা বলি না আমি।

 

চুপ করে আছিস কেন শুওরের বাচ্চা। কি বলছি শুনিস নাই। তুই তোকারিতে নেমে এসেছে মেজর সাহেব এখন।

 

দেশেই ট্রেনিং নিয়েছি। ইণ্ডিয়াতে যাইনি

 

ঘুষিটা এতো দ্রুত গতিতে এলো যে মুখটা সরাবার সময় পেলাম না আমি। নাকের হাড় ভাঙ্গার শব্দ হলো। গলগল করে রক্ত আমার মুখ বেয়ে বুকে এসে পড়লো।

 

মিথ্যাবাদী লোকজন আমি দুই চোখে দেখতে পারি না। এটা হলো মিথ্যা বলার শাস্তি

 

তোদের নেতা সন্তু লারমা এখন কোথায়?

 

জানি না। মৃদু স্বরে বলি আমি।

 

বলিস কি? জানিস না? নেতার কথায় সাধারণ মানুষজনকে মারিস আর নেতার খবরই রাখিস না

 

সন্তু লারমার খবর সত্যিই জানি না আমি। এমনকি কোনদিন চোখেও দেখিনি তাকে। শান্তি বাহিনীতে আমরা ছোট ছোট ইউনিট হিসাবে কাজ করি। কোন একটা ইউনিট ধরা পড়লেও পুরো অর্গানাইজেশনের কোন ক্ষতি হয় না। কিছু না জানার কারণে হাজার অত্যাচারেও অন্যদের বিষয়ে কোন তথ্য দিতে পারে না তারা। আর্মির লোকেরাও তা জানে। তারপরও খামোখাই অত্যাচার চালায় বন্দীদের উপর।

 

সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না। কীভাবে কথা বলাতে হয় জানি আমি।

 

মেজর কাছে দাঁড়ানো একজন সৈন্যকে ঈশারা দিলেন। দেড় হাত লম্বা কাঠের একটা ব্যাটন এনে দিল সে মেজরের হাতে। ব্যাটনটা দিয়ে আমার দুই হাটুতে নির্দয়ভাবে পেটাতে শুরু করলেন তিনি। তীব্র বেদনায় অমানুষিক চিকার বেরিয়ে এলো আমার মুখ দিয়ে। পশুর মত আমাকে পেটাতে পেটাতে এক সময় হয়রান হয়ে গেলেন তিনি। ব্যাটনটা তুলে দিলেন সৈন্যটার হাতে। পূর্ণ শক্তিতে সৈন্যটাও আমার হাটুতে পেটাতে শুরু করলো। তীব্র যন্ত্রণায় কখন যে জ্ঞান হারিয়েছি নিজেই জানি না। যখন জ্ঞান ফিরলো দেখলাম আমার সারা শরীর ভেজা। গায়ে পানি ঢেলে জ্ঞান ফিরিয়েছে আমার। দু হাটু ফুলে ঢোল হয়ে গেছে। কোন চেতনাই নেই আর সেখানে। সারা জীবনের জন্য পঙ্গু করে দিয়েছে আমাকে এরা। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি সুমন দাঁড়িয়ে আছে এখনো সেই একি জায়গায়। চেহারা আগের মতই ভাবলেশহীন। কয়েকমন ওজন মনে হচ্ছে মাথটাকে আমার। ধরে রাখতে কষ্ট হচ্ছে। নিজের অজান্তেই বুকের কাছে চলে এলো সেটা।

 

চুলের মুঠি ধরে আমার মাথাটা উঁচু করে ধরলেন মেজর। সন্তু লারমা কোথায়? আবারো জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

 

জানি না, আমি জানি না। জড়ানো গলায় উত্তর দেই আমি।

 

আমার গালে জ্বলন্ত সিগারেট চেপে ধরেন তিনি। কেন যেন কোন ব্যথাই লাগছে না এখন আর আমার। শুধু ঘুম পাচ্ছে। গভীর ঘুম। ঘুমের অতলে তলিয়ে যেতে যেতে চামড়া পোড়ার গন্ধ পাই আমি। মায়ের চামড়া পোড়া গন্ধ আসছে কোথা থেকে?

 

পেটের উপর হাটুর গুঁতো খেয়ে চেতনা ফেরে আমার। চোখ মেলে তাকাই। রক্ত চক্ষু নিয়ে পৈশাচিক উন্মত্ততায় গালিগালাজ করে চলেছে মেজর তানভীর তখনো।

 

শালা, নাক বোঁচা বেজন্মা কোথাকার। ভেবেছিস ইণ্ডিয়ার সাহায্য নিয়ে স্বাধীন হয়ে যাবি তোরা। স্বাধীন হওয়া ছুটাচ্ছি তোদের। স্বাধীনতা তোদের পাছার মধ্য দিয়ে ঢুকিয়ে দেবো

 

স্বাধীনতা না, আমরা স্বায়ত্বশাসন চাইছি। দুর্বল স্বরে মেজরের ভুল শোধরানোর চেষ্টা করি আমি।

 

ঠাস করে গালে প্রচণ্ড থাবড়া কষায় মেজর তানভীর। গালের ভিতরটা কেটে যায় আমার। বান্দীর বাচ্চা,  জ্ঞান দিতে আসিস। আমার কাছে দুটোই এক জিনিষ

 

আমার মাকে নিয়ে প্রচণ্ড কুসিত একটা গালি দেয় সে। আর সহ্য হয় না আমার। তীব্র ঘৃণায় মুখের মধ্যে জমে থাকা থুথু আর রক্ত ছুড়ে দেই ওর গালে।

 

গালে থুথু পড়তেই কয়েক সেকেণ্ডের জন্য হতভম্ভ হয়ে যায় মেজর তানভীর। তারপরই প্রচণ্ড রাগে আগুনের মত জ্বলে উঠে তার চোখ দুটো। চোখ মুখ বিকৃত হয়ে গেছে ক্রোধে। দুই পা পিছিয়ে কোমর থেকে পিস্তল বের করে সে। আমার বুকের দিকে তাক করে আঙুলের চাপ বাড়াতে থাকে।  পরিষ্কার খুনের নেশা দেখতে পাই আমি তার চোখে।

 

ঠিক তখনই পিস্তলের সেফটি ক্লাচ অফ করার মৃদু একটা শব্দ ভেসে আসে। মেজরের দিকে অস্ত্র বাগিয়ে ধরেছে সুমন।

 

ওকে গুলি করলে আপনাকেও মরতে হবে স্যার। হিমশীতল কন্ঠে সুমন বলে।

 

অবাক বিস্ময়ে সুমনের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে মেজর।

 

ও নিরস্ত্র, যুদ্ধবন্দী। ওকে হত্যা করার অধিকার আপনার নেই। সুমনের গলার স্বর এখনো শান্ত।

 

নিরস্ত্র? যুদ্ধবন্দী? এই বদমায়েশগুলো একেকটা সন্ত্রাসী। যুদ্ধবন্দীতো দূরের কথা বন্দীর মর্যাদাও এরা পাবে না। কুকুরের মত গুলি করে মারতে হবে এগুলোকে। পুরো এলাকাটাতে অশান্তি বানিয়ে রেখেছে এরা

 

আপনি ওদেরকে যা খুশি ভাবতে পারেন। আমার কাছে ও বন্দী এবং নিরস্ত্র। ওকে গুলি করেছেনতো আপনাকেও মরতে হবে

 

তুমি বোধ হয় ভুলে যাচ্ছ যে, আমি তোমার উপরের পোস্টে আছি। রাগী গলায় চেঁচিয়ে উঠেন মেজর তানভীর।

 

ভুলি নাই, স্যার। কিন্তু এটা আমার ক্যাম্প, আপনার নয়। আমিই এখানকার ইনচার্জ। এখানে আমার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত

 

সুমনের গলার স্বরে এমন একটা কিছু ছিল যে মেজর অস্ত্র নামিয়ে নেয়। হিংস্র চোখে তাকিয়ে থাকে সুমনের দিকে।

 

এর ফল তোমাকে পেতে হবে ক্যাপ্টেন। ফিরে গিয়েই অফিসিয়ালি অভিযোগ করবো আমি। তোমার যাতে কোর্ট মার্শাল হয় তার সব ব্যবস্থাই করবো আমি। সাপের মত হিসহিস করে বলে সে।

 

বেজন্মাটাকে আমার সাথে চিটাগং নিয়ে যাচ্ছি আমি। অর্ডার সাথেই আছে আমার। কাজেই বোকার মত বাধা দিতে যেওনা। ওখানে নিয়ে গেলে ওরাই ওকে পরপারে পাঠিয়ে দেবে। আমাকে কিছু করতে হবে না। ঠা ঠা করে বিকৃত হাসি দেয় মেজর।

 

বাঁধন খুলে দেয়া হয় আমার। হুমড়ি খেয়ে মাটিতে পড়ে যাই আমি। পায়ে ভর করে দাঁড়ানোর অবস্থা নষ্ট করে দিয়েছে ওরা আমার। দুজন সৈনিক দুপাশ থেকে আমাকে ধরে ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে হেলিকপ্টারে তোলে। হেলিকপ্টারে উঠার আগে আমি শেষবারের মত সুমনের দিকে তাকাই। কঠিন মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে সে। চোয়ালে হাড়্গুলো উঁচু হয়ে আছে। কোথায় যেন সূক্ষ্ণ একটু পরিবর্তন হয়েছে সুমনের। চোখ দুটো কি একটু কুঁচকে আছে ওর? সুমনের জন্য বুকের মধ্যে গভীর ভালবাসা অনুভব করি আমি।

 

ভাল থাকিস দোস্ত, খুব ভাল থাকিস। মনে মনে বলি।

 

আমাদের নিয়ে বিশাল ফড়িঙটা উড়াল দেয় আকাশে। বাতাস কেটে চট্টগ্রামের দিকে ছুটে চলেছে দ্রুতগতিতে। হাত বাধা অবস্থায় কপ্টারের মেঝেতে ফেলে রাখা হয়েছে আমাকে। আমার ডানদিকে বসে আছে মেজর তানভীর। পিছনের দিকে সৈন্যরা।

 

কিছুক্ষণ পরেই ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনের দুই সৈনিকের দিকে তাকালেন মেজর।

 

কী করতে হবে জানোতো তোমরা। দেরি করার আর দরকার নেই।

 

হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে তারা। নিঃশব্দ হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে মুখ। সিট থেকে উঠে আমার পাশে এসে দাঁড়ায় তারা। হ্যাচকা টানে আমাকে নিয়ে আসে হেলিকপ্টারের দরজার কাছে। ঠেলা দিয়ে উন্মুক্ত করে দেয় দরজা। আমার পিছনে নিঃশব্দে এসে দাঁড়িয়েছে মেজর তানভীর। কী ঘটতে যাচ্ছে বুঝতে কোন অসুবিধা হয় না আমার। তবে, কোন বিকার ঘটে না আমার। কোন ভীতিও স্পর্শ করে না আমাকে। ভয় ভীতির অনেক উর্ধ্বে চলে গিয়েছি আমি এখন।

 

খোলা দরজা দিয়ে বাইরে তাকাই আমি। অনেক নীচে পাহাড়ের বুক চিরে সাপের মত আঁকাবাকা হয়ে শুয়ে আছে চেংগি নদী। তার পাশেই পাহাড়ী উপতক্যায় নানান জাতের গাছ-গাছালিগুলো গভীর মমতায় কাধে কাধ মিশিয়ে বন্ধুর মত দাঁড়িয়ে আছে। কারো সাথে কারো কোন ঝগড়াঝাটি নেই, নেই কোন বিবাদ, নেই কোন বিসম্বাদ। শুধু মানুষগুলোই আলাদা। কেন যেন মিলে মিশে একসাথে থাকতে পারে না কিছুতেই।

 

পিঠে প্রচণ্ড একটা লাথি খেয়ে আমি ছিটকে পড়লাম অসীম শূন্যতায়। পাখির পালকের মত হালকা হয়ে গেছে শরীরটা আমার। নীচে চোখ গেলো। নীল পাহাড়ের চূড়ায় চূড়ায় সূর্যের আলো পড়ে লাল আভা তৈরি হয়েছে। তার পাশেই স্নেহময়ী সবুজ বনভূমি।  পরম আদরে আমাকে তার কোলে তুলে নেবার জন্যই মনে হয় দ্রুতগতি আমার দিকে এগিয়ে আসছে সেই সবুজ জমিন। ভারী চোখ মেলে আকাশের দিকে তাকালাম আমি। নীল আকাশে পাল তোলা সাদা সাদা মেঘের ভেলা ভেসে চলেছে এলোমেলো। কী আশ্চর্য! ওই ভেলাতেই দেখি আমার মমতাময়ী মা সজল চোখে দাঁড়িয়ে আছে। গভীর ভালবাসায় দুহাত বাড়িয়ে রেখেছে আমার দিকে।

 

ছটফট করে উঠি আমি। মায়ের বুকের নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠে আমার। আকুল স্বরে বিড়বিড় করে উঠি আমি, মা, মাগো, একটুখানি অপেক্ষা করো। আমি আসছি