[গত শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে ঢাকায় ‘মুসলিম সাহিত্য-সমাজ’ ও তার মুখপত্র ‘শিখা’কে কেন্দ্র করে বাঙালি মুসলিম সমাজে যে মুক্তবুদ্ধি ও স্বাধীন চিন্তাচর্চার উন্মেষ ঘটে, তা আমাদের (বাঙালির) সামজিক-সাংস্কৃতিক লৌকিক ঐতিহ্যে ‘বুদ্ধিরমুক্তি আন্দোলন’ নামে খ্যাত। এই আন্দোলনের ‘কর্মযোগী’ প্রাণপুরুষ হিসেবে অভিহিত মনীষী আবুল হুসেন (১৮৯৭-১৯৩৮), তাঁর তীব্র ক্ষুরধার যুক্তিবাদী মননশীল প্রভূত রচনা ঔপেনিবেশিক বাঙলার প্রথাবদ্ধ-সংস্কারাচ্ছন্ন-স্থবির মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে নূতন প্রাণের সঞ্চার করে; জাগিয়ে তুলে জিজ্ঞাসা, সৌন্দর্য পিপাসা আর সৃষ্টিশীলতা। তিনি বলতেন (বিশ্বাসও করতেন)―“জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব।” ‘জ্ঞান-বুদ্ধি-যুক্তির আলোকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ’―আবুল হুসেনের রচনায় উদ্বুদ্ধ বাঙালি মুসলিমদের সামনে নবদিগন্তের উন্মেষ ঘটায়। এজন্য সভ্যতার অমোঘ নিয়মে ক্ষমতাশীল অতীন্দ্রিয়তার কারিগরদের কাছে চক্ষুশূল হয়ে দাঁড়ান তিনি; ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া হিসেবে তাঁর বিরুদ্ধে শুরু হয় নানা ষড়যন্ত্র-কুৎসা-বাদ-বিবাদ থেকে নির্যাতন-নিপীড়ন। এমন কী তাঁর বলিষ্ঠ যুক্তিবাদী বক্তব্যের সামনে টিকে থাকতে না পেরে ‘কাফের’ আখ্যা দিয়ে জীবননাশ করার চেষ্টা করে, তার লেখনীকে চিরদিনের মত স্তব্ধ করিয়ে দেবার চেষ্টা করা হয়।

আজকের একবিংশ শতকে এসেও আমরা দেখি সমাজের একই রূপ। বহিরঙ্গে প্রযুক্তির ছোঁয়া লাগলেও অন্তরঙ্গে এখনো শুচিবাই, সংস্কারাচ্ছন্ন, অতীন্দ্রিয়তার প্রতি দাসত্ব। তাই আমরা মনে করি আবুল হুসেনের রচনার আবেদন এখনো ফুরিয়ে যায়নি। বরং যুক্তিবোধের উন্মেষ, বিশুদ্ধ জ্ঞানের চর্চা আর মৌলিকচিন্তার ভাণ্ডার ঋদ্ধকরণের জন্য আবুল হুসেনের পুনঃপাঠ অত্যাবশ্যকীয়। মনীষী আবুল হুসেনের আলোচ্য প্রবন্ধটি ‘নির্বাচিত প্রবন্ধ : আবুল হুসেন‘ (মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ ১৯৯৭, পৃষ্ঠা ১৬২-১৬৪) গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত।]

ব্রিটিশ-ভারতে মুসলমান-আইন

আবুল হুসেন

মানুষ আপনার শক্তি বিকাশ ও শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আইন গঠন করে। তাই আইন ও মানুষে অবিচ্ছেদ্য সম্বন্ধ। একে অপরকে এড়িয়ে যেতে পারে না, বরং একে অপরের হাত ধরাধরি করে চলে। তাই বলে যে আইন ও মানুষ সনাতন অপরিবর্তনীয় হয়ে থাকে তা নয়। মানুষ তার আপনার প্রয়োজনে আইন গড়ে, ভাঙ্গে, পরিবর্তন করে ও ছেড়ে দেয়- সঙ্গে-সঙ্গে আইন মানুষকে ক্রমেই বিকাশের পথে এগিয়ে নিয়ে চলে। মানুষের এগিয়ে চলা যেমন স্বাভাবিক, আইনের পরিবর্তন করবার শক্তিও তার তেমনি অনিবার্য। কিন্তু যে-মানুষ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে চায় ও আইনকেও ধ’রে রাখতে চেষ্টা করে, সে মানুষ তার জীবনস্রোত হারাতে বাধ্য।

যুগে-যুগে মানুষ তার পারিপার্শ্বিক অবস্থার তাড়নায় আপনার সত্তার প্রয়োজনে আইন গড়েছে। সেই অবস্থা বিশেষেই আইনের জন্ম দিয়েছে। কাজেই অবস্থার পরিবর্তন হলে আইনের পরিবর্তনও অবশ্যম্ভাবী।

হযরত মুহম্মদের (সঃ) যুগে আরব দেশের প্রয়োজন অনুসারে যে আইন রচিত হয়েছিল সে আইন জগতের সর্বত্র সর্ব অবস্থাতেই প্রযোজ্য বলে অনেকে বিশ্বাস করেন। কিন্তু সে বিশ্বাস মানুষের সমাজ ও রাষ্ট্রের ইতিহাস সমর্থন করতে পারে না। সেই ভ্রান্ত বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে এদেশের মুসলমানদের জন্য ব্রিটিশ প্রভু যে মুসলমান আইনের প্রচলন করেছেন তার জন্মভূমি ছিল আরব-মরু, বোখারা, খোরাসান ও সমরকন্দ-যার পারিপার্শ্বিক অবস্থার সাথে আধুনিক ভারতীয় মুসলমানের পরিপার্শ্বের আদৌ মিল নাই। এই জীবন্ত পরিপার্শ্বকে তুচ্ছ করে জোরজবরদস্তী খোরাসান-বোখারার আইন হুবহু প্রবর্তন করবার চেষ্টা করা হয়েছে।

ফলে, ভারতীয় মুসলমান-মানুষ ও মুসলমান-আইনের মধ্যে যে বিরোধ দিনদিন প্রবল হয়ে উঠেছে এবং তাতে ভারতীয় মুসলমান সমাজের যে অবস্থা হয়েছে তা চক্ষুষ্মান্‌ ব্যক্তি মাত্রই ইচ্ছা করলে দেখতে পারেন। আজ আমি ব্রিটিশ-ভারতের মুসলমান-মানুষ ও মুসলমান-আইনের পরস্পরের সম্বন্ধ কি ও তার ফলাফল কি হয়েছে ও হচ্ছে সে সম্পর্কে সামান্য কিছু ইঙ্গিত করেই ক্ষান্ত হব। এ সম্বন্ধে যোগ্যতর ব্যক্তি ও বিস্তৃতভাবে আলোচনা করলে ভারতীয় মুসলমান-সমাজের বহু ব্যাধি দূরীকরণের পথ উন্মুক্ত হবে বলে আমার বিশ্বাস।

গোড়াতেই স্মরণ রাখা কর্তব্য যে, ব্রিটিশরাজ ভারতীয় মুসলমানের মাত্র ওয়ারিসী স্বত্ব, দান, বিবাহ, তালাক, ওয়াক্‌ফ ও হক্‌শোফা সম্পর্কিত আইনের প্রচলনে সম্মতি দিয়েছেন, কিন্তু অপরাপর আইনের প্রচলন বন্ধ করেছেন। তারপর ঐ সমস্ত প্রচলিত আইন পরিচালনার জন্য মুসলমান-আইন-সঙ্গত যে বিধি-বিধান প্রচলিত ছিল, যেমন ইজমা, কিয়াস, ইজতিহাদ, তা-ও বন্ধ করেছেন। তাতেও পক্ষান্তরে ব্রিটিশ-অনুমোদিত মুসলমান-আইনের ব্যবস্থার (practice) অনেকখানি ক্ষুণ্ন হয়েছে। তাতে মুসলমান সমাজে মুসলমান-আইনের প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা ও ভয় অনেকখানি কমে গেছে এবং সেজন্যই মুসলমান সমাজের শ্রী ফুটতে পারছে না। আর একদিকে থেকে ভারতীয় মুসলমানের জীবন বিকশিত হতে পারছে না। আরবি না জানার দরুণ অনেক ক্ষেত্রেই মুসলমান আইনের প্রকৃত মর্ম বিচারকগণ উপলব্ধি করতে না পেরে ভুল অর্থে আইনের প্রয়োগ করায় মুসলমান-সমাজের বর্তমান অবস্থার সাথে মুসলমান-আইনের সামঞ্জস্য হারিয়ে গেছে ও প্রতিনিয়ত যাচ্ছে কথাটি বেশি বিস্তৃত করে বলবার ইচ্ছা প্রবল হলেও এ প্রবন্ধে বলতে পারলাম না বলে দুঃখিত। এ কটি কথা কেবল বন্ধুদের পুনঃপুনঃ তাগিদের জন্য লিখতে বাধ্য হয়েছি।

দুই-একটা দৃষ্টান্ত দিই। হক্‌শোফার (Right of pre-emption) আইন বলেছে, যদি কোন তৃতীয় ব্যক্তি আপনার কোন শরিকের অংশ ক্রয় করে তবে আপনি সেই অংশ ঐ তৃতীয় ব্যক্তির নিকট হতে কিনে নিতে বা ফিরিয়ে নিতে পারেন। উদ্দেশ্য- আপনার কোন শত্রু বা অপ্রীতিকর পড়শী এসে আপনার সংসারকে বিপর্যস্ত না করে। এলাহাবাদ হাইকোর্টের নজির অনুসারে যদি কোন হিন্দু আপনার শরিকের অংশ খরিদ করে তবে আপনি তাঁর থেকে সেই অংশ ফিরিয়ে নিয়ে আপনার সংসার শান্তিময় রাখতে পারবেন; কিন্তু বাঙলা দেশে হক্‌শোফার আইন হিন্দু খরিদ্দারকে আপনার শরিকের অংশ খরিদ করতে অনুমতি দিয়েছে। মুসলমান আইনের উদ্দেশ্য এখানে অনেকখানি ব্যর্থ হয়ে গেছে। ফলে বাঙলাদেশের সমস্ত মুসলমানের সম্পত্তি হিন্দুর হাতে চলে গেছে ও যাচ্ছে, কিন্তু মুসলমান ইচ্ছা থাকলেও ফেরাতে পারে নাই ও পারছে না। তাই দেখতে পাবেন, অনেক শহরে আজ যেখানে হিন্দুর বড়-বড় ইমারত উঠেছে সেখানে অতি নিকট-অতীতে মুসলমানের বসতি ছিল। মুসলমান সম্পত্তি বিক্রয় করেছে বা করছে কেন তার কারণ ঢের আছে, কিন্তু হক্‌শোফার আইন এমনি করে ক্ষুণ্ন হয়ে যাওয়ায় মুসলমান একেবারে শহর থেকে বিতাড়িত হচ্ছে।

তারপর ধরুন ওয়াক্‌ফ আইন। মুসলমান তার বংশধরদের জন্য সম্পত্তি ওয়াক্‌ফ করতে পারে। মুসলমান বাদশাহ্‌দের আমলে এই অনুসারে বহু মুসলমান বড়বড় সম্পত্তি আপন বংশধরদের জন্য ওয়াক্‌ফ করে গিয়েছিলেন। কিন্তু ব্রিটিশ আমলের বিচারকগণ ঐ প্রকার ওয়াক্‌ফকে বাতিল করে দিলেন। ফলে শত শত সম্পত্তি হস্তান্তরযোগ্য হয়ে গেল। বংশধরগণ নিজ নিজ স্বার্থ-সিদ্ধির জন্য ঝগড়া-বিবাদে প্রবৃত্ত হল-মহাজন জমিদার নিলাম করে ওয়াক্‌ফ সম্পত্তি গ্রাস করতে লাগল। ক্রমশঃ এক নজিরের বলে শতশত মুসলমান পরিবার অনিবার্য দারিদ্র্যের পথে দ্রুত অগ্রসর হতে লাগল। তার গতি এখনও প্রতিহত হয় নাই।

তারপর ওয়ারিশী স্বত্বের আইন। এই আইন প্রচলিত থাকায় ভারতীয় মুসলমান, বিশেষতঃ বাঙলার মুসলমান বাটোয়ারা (partition) মোকাদ্দমা করতে-করতে সর্বস্বান্ত হচ্ছে। একদিন আমার জৈনক senior হিন্দু উকিল-বন্ধু মুক্তচিত্তে বলেছিলেন, “Thanks to the great prophet of the desert. Because but for his law of inheritance 60% litigation of our courts would have been diminished and half of our judges would have been discharged.” এতেই আপনারা বুঝতে পারবেন, আইনের ব্যবহার বাঙলার মুসলমানকে দিনদিন অশান্তি ও দারিদ্র্যের চরম সীমায় নিয়ে যাচ্ছে।

অবশেষে বিবাহ ও তালাকের আইনের প্রতি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। বিবাহের ভিত্তি হচ্ছে স্বামী-স্ত্রীর সম্মত্তি ও উভয়ের স্বাধীন ব্যক্তিত্ব। এই সম্মতি ও ব্যক্তিত্বের সামঞ্জস্য যখন হারিয়ে যায় তখনই তালাকের আইন ব্যবহূত হওয়া উচিত। এই ব্যবহার করার অধিকার মুসলমান স্বামী-স্ত্রী উভয়েরই সমান। কিন্তু ব্রিটিশ-ভারতে মুসলমান-স্ত্রী এই সমান অধিকার হতে বঞ্চিত হয়েছে। ফলে, স্ত্রীর উপর অত্যাচার ও নির্যাতনের অবধি নাই। স্ত্রী আজ মূক্‌, নিরুপায়। সমাজের অর্ধাঙ্গ যদি এমনি করে আইনের অধিকার হতে বঞ্চিত থাকে এবং তার জন্য অপর অর্ধের স্পর্ধা যদি বৃদ্ধি পায় তবে সমাজের স্বাভাবিক স্ফুর্তি প্রতিহত হতে বাধ্য। আজ মুসলমান সমাজের অভ্যন্তরীণ অবস্থা লক্ষ্য করলে এই তালাকের অধিকার পুরুষের একচেটে হয়ে পড়ায় কতখানি ক্ষতি হয়েছে ও হচ্ছে তা স্পষ্ট বোঝা যায়।

উপসংহারে এই কথা বলতে চাই যে, বর্তমান ব্রিটিশ-ভারতের প্রচলিত মুসলমান-আইন সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা দরকার। নতুবা মুসলমান সমাজের স্বাভাবিক বিকাশ সম্ভবপর হতে পারে না।-সে আইন আধুনিক ভারতের অবস্থার সাথে মুসলমান বাদশাহ্‌দের আমলে মুসলমান-আইনের অবস্থা কি ছিল। আমি যতদূর জানতে পেরেছি, তাতে মনে হয়, এ দেশের অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মুসলমান বাদশাহ্‌গণ আইন রচনা করেছিলেন। গজনীর বাদশাহ্‌ মাহমুদের ’ফতোয়া-ই-মহম্মদী’ ও ফিরোজশাহ তোগলকের ’ফতোয়া-ই ফিরোজশাহী’ হতে আরম্ভ করে টিপু সুলতানের ’ফতোয়া-ই-আহমদী’ ও যাখিরা-ই-ওয়ারেন হেস্টিংস্‌’ পর্যন্ত যে-সমস্ত আইনের পুস্তক রচিত হয়েছে তাতে ইঙ্গিত পাওয়া যায়, এদেশের মুসলমানদের জীবনের প্রয়োজনে ঐ সমস্ত আইন রচিত হয়েছিল। আরব, পারস্য, সিরিয়া প্রভৃতি দেশের মধ্যযুগীয় ফিকাহ্‌বা ব্যবহার-শাস্ত্রের বিধি-বিধান তাঁরা অন্ধভাবে প্রবর্তন করেন নাই। বর্তমানে এ দেশের রচিত ও প্রবর্তিত ব্যবহার- শাস্ত্রের মধ্যে একমাত্র ’ফতোয়া-ই-আলমগিরি’ ব্যবহূত হয়ে থাকে। কিন্তু ’ফতোয়া-ই-আলমগিরি’ হতে মুসলমান বাদশাহ্‌দের আইন রচনার অধিকার ও তার স্বাধীন ব্যবহার সম্বন্ধে কিছুই পাওয়া যায় না। ’ফতোয়া-ই-আলমগিরি’ Reaction-এ রচিত ও প্রবর্তিত হয়েছিল। সে সময় বাদশাহ্‌আলমগীর ভারতকে না দেখে দেখেছিলেন মক্কার মরুভূমির পবিত্রতা। সেই মনোভাব ’ফতোয়া-ই-আলমগিরি’কে অনেকখানি technical ও artificial করেছে। সেই মনোভাব ব্রিটিশ-ভারতে আজও আমাদের রাজা ও প্রজা উভয়কেই মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছে।

শিখা
১৩৩৭ বাংলা (১৯৩০ ইং)।