১.
একটা কুকুর কতোদিন বাঁচে? আর কুকুরের মতো যে মানুষদের জীবন- তারা বাঁচে কতোদিন?
কুকুরের মতো বাঁচা বলতে ঠিক কী বুঝায়, সেটা জানি না। উদয়াস্ত খাঁটুনির পর শরীরটাকে কোনোমতে ঝুলিয়ে রাখা কোনো কোনো মানুষের চাহনি দেখি আজকাল, কিংবা দেখি কথা বলার ধরন- মাঝে মাঝে মনে হয় এই মানুষগুলো বেঁচে আছে অনাবশ্যক বেঁচে থাকার চাহিদায়। বেঁচে থাকাটা মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে না- মানুষগুলো তাই বেঁচে আছে হয়তো।
০৬.০৯.০৯
২.
গাড়ি চালাতে চালাতে ড্রাইভার জানাচ্ছিলো- এই জীবনে সে মানুষ মারে নাই। আমি বলি, প্রাণী মেরেছেন কি?
তিনি আমাকে করুণার দৃষ্টিতে দেখেন, বলেন- মানুষ আর প্রাণী কি এক হলো? আমি নতুন প্রশ্ন নিয়ে সামনের দিকে বৃষ্টিস্নাত ঘোলা কাচে তাকাই। সাইডমিররে দেখি সামনের সিটে বসে থাকা প্রাণীটাকে- দেখি, কোনো মানুষ দেখা যায় কিনা!
বৃষ্টি থেমে গেলে কুমিল্লা রোডে গাড়ির গতি বাড়ে, ওভারটেকের প্রতিযোগিতায় পরাজয় মানে ধ্বংস। সুতরাং সেখানে চলে মানইজ্জতের খেলা- ট্রাকের বনাম মারুতির, মার্সিডিজের বনাম ভ্যানের। অসংখ্য মরা কুকুর জমে থাকে রাস্তার ওপর, ওভারটেকের খেলায় তারা নীরব দর্শক। কারো মুখ দিয়ে রক্ত বেরুয়, কারো বা চামড়া পিষে যায় পিচে। রাতবিরেতে কোনো স্পাউস কুকুর এসে কিছুক্ষণের জন্য কি বসে থাকে না? নাকি গাড়ির হেডলাইটের আলো কুকুরের সহানুভূতি উড়িয়ে নিয়ে যায় একশ কিলোমিটার স্পিডে?
০৬.০৯.০৯
৩.
তেমনি মুহূর্তে কুকুরটি তাকায় করুণ চোখে। বামে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত গাড়ি, ডানের গাড়িতে আমার মতো আরেকটি প্রাণী বসা- দুহাতকে যারা প্রয়োজনে দু-পা বানাতে পারে? কালো কুকুরটি তীক্ষ্ম কণ্ঠে কাকে ডাকে? কারো কাছে কি বিচার দিয়ে যায়? গাড়ির সাথে ধাক্কা লাগার আগমুহূর্তে কি দেখে যায় আমার অপরাধী চেহারাটা?
সংঘর্ষের শব্দ শুনি। সিঁটিয়ে যাই, আশি কিলোমিটার গতির সঙ্গে শরীর ঠাণ্ডা হয়ে কিংবা কলজে-জমে-যাওয়া কুকুরের শরীরের ঘর্ষণ আর তার ধাক্কা আমার গাড়ি থামায়, হালকা দুলুনিতে টের পাইয়ে দেয় ঘর্ষণের তীব্রতা- আমার চোখের সামনে দিয়ে দেখি পাখির মতো উড়ে গিয়ে কুকুর থামে গাছের ডালে, সেখান থেকে জমিনের উপর।
ড্রাইভার গাড়ি থামায় না, কুকুরের শরীর থেকে এক লহমায় বের হওয়া রক্ত জমতে থাকে আমার চোখের ভিতর, ড্রাইভার এবার ভয় পায়- রক্তের ভয়- গাড়ি থামায়- আমি থামি, কুকুরটির দিকে ফিরে তাকাই মাত্র একবার- তখনও হয়তো বেঁচে আছে। আছে কি? দুনিয়ার বিষ ঠিক সেই মুহূর্তে বেরুতে থাকে আমার মুখ দিয়ে- একেবারে হড়হড় করে- ঠিক সেই মুহূর্তে শুনি নাড়িভুড়ি বেরিয়ে কুকুরটি শেষ হয়েছে। আস্তে আস্তে পাকস্থলী খালি করে চোখ-মুখ ধুয়ে আমি দেখতে যাই কুকুরটিকে।
০৭.০৯.০৯
৪.
রাঙ্গামাটির রাস্তা দিয়েও আমরা যাই আগের গতিতে। আমিই বলি ড্রাইভারকে, পাহাড়ের বাঁকে কিংবা ঢালু রাস্তায় কিংবা খাদের কিনার দিয়ে দ্রুতির খেলা মানুষই খেলে। যাওয়ার পথে কোনো সমস্যা হয় না, আসার পথে আচমকিতেই চাকা হড়কে যায়, চোখের সামনে হঠাৎ দেখি অতল গহ্বর- দুলে উঠে গাড়ি, কোনোমতে পাশের সিট আঁকড়ে ধরতে যাই, উল্টে পড়ি গাড়ির ভিতর। ঠিক সেই মুহূর্তে কিছু ভাবছিলাম কি?
কীভাবে উঠে দাঁড়ালাম টের পাই নি। শরীরে অসম্ভব ঘূর্ণন। আস্তে আস্তে গাড়ির ভিতর থেকে বেরিয়ে বাম পাশের দশাসই ঘটোৎকচকে দেখলাম, বাম পাশে উঁকি দিয়ে দেখি শুয়ে থাকা অতল গহ্বরকে। কতো ফুট? কতো মিটার? উত্তরের দরকার নেই। চিরকালের মতো একটা মানুষকে পিষে ফেলার জন্য একটা এমন গর্তই কি যথেষ্ট নয়? মানুষের সমাজে যেগুলো অদৃশ্য, এখানে সেগুলো সদম্ভে দণ্ডায়মান- পার্থক্য এটুকুই।
আস্তে ধীরে গর্তের কিনারে বসলাম। এখন চাইলেই কিংবা কেউ একটু আলতো করে ধাক্কা দিলেই চলে যেতে পারি গর্তের উদরে। না, কোনো ভয় পাচ্ছি না, যদিও উপর থেকে দেখে মাথা ঘুরছে। ওদিকে নতমস্তকে ড্রাইভার দাঁড়ানো। আমি হাসি- বলি, আপনি একটু পানি-টানি খান।
পেছন ফিরে দেখি ঘটোৎকচকে। তীব্র কামনায় আহ্বান করি, আমাকে পিষে দিয়ে যাও। তীব্র ঘৃণায় তাকাই খাদের দিকে, একটা মানুষকে টেনে নেবার মুরোদ নেই তোর। ছিঃ
মিনিট পনের পর ঘুরে দাঁড়াই, উঠে দাঁড়াই। পাশে শুয়ে থাকা মাটির টুকরাটাকে সদম্ভে লাথি দিই- গর্তকে লাথি দেওয়া সম্ভব নয় বলে? মাটির টুকরা উড়ে গিয়ে ছিদ্র করে দেয় খাদের তলপেটকে।
০৯.০৯.০৯
৫.
আজ সকালে গায়ে চাদর জড়িয়ে বেরুই, চা খেতে- মানুষের অবাকচক্ষুতে কিছুটা বিব্রত। কুকুরের মৃত্যুর সময় চলে আসা শরীরের কাঁপুনি মাঝে মাঝে আদর করে দিয়ে যায়। ভেতরের রক্ত শীতল হয়ে যাচ্ছে কিনা ভাবতে ভাবতে রিকশা দিয়ে পায়ে হাঁটা পথ পেরুই- কারোর সামনের মুখ দেখি না, দুলিয়ে দুলিয়ে হাঁটতে থাকা গার্মেন্টস-নারীর দিকে লোলুপ চোখে তাকিয়ে তলপেটের ক্ষুধা মেটাই। ওদিকে বৃষ্টির পানির ছিটার স্পর্শ বাঁচাতে পাজামা তুলে হাঁটার সময় রিকশাওয়ালা ঝাড়ি দেয়- কাকে জানি না, বলে- কুত্তার মতোন কাম করে। পানি লাগলে জাত যায়!
ভাবি- কুকুর কারা? ভাবি- কুকুরের মতো জীবন কাদের? ভাবি- চাদর-মোড়ানো ভদ্রলোকের কয়টি কুকুর থাকে? ভাবি- কয়টি কুকুর প্রভু নিজেদের আলাদা করতে পারে কুকুর-জীবন থেকে। ভাবি- মরণের আগে মানুষ-কুকুর দুটোই যৌথভাবে প্রাণী হয়ে যায় কিনা!
১২.০৯.০৯
ধন্যবাদ পরশ আপনার মন্তব্যের জন্য।
@অ্যাডমিন, এখানে আরেকটি মন্তব্য ছিলো। সেটি কি মুছে গেছে। মন্তব্যটি আগেই দেখেছি কিন্তু উত্তর দেওয়ার সুযোগ পাই নি। মন্তব্যটি কি ফেরানো যায়? ধন্যবাদ।
@গৌতম রায়,
সম্ভবতঃ মন্তব্যকারী নিজেই মন্তব্যটি প্রত্যাহার করেছেন (সাইটে নতুন কিছু ফীচার যোগ করা হয়েছে, এর মধ্যে একটি হল মন্তব্যকারী তার মন্তব্য রদ বদল বা মুছে ফেলতে পারেন)। আমরা দুঃখিত – কোন মুছে যাওয়া মন্তব্য ফেরানো আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
ভবিষ্যতে এ ধরণের অবাঞ্ছিত পরিস্থিতি এড়াতে ব্লগে কারো মন্তব্য দেখামাত্র উত্তর দিয়ে দেবেন :)। উত্তর দেয়া মন্তব্য প্রত্যাহার করা যাবে না 🙂
গৌতম রায়,
আপনার ব্যাপারটা আরেকবার চিন্তা করে অতিথিদের মন্তব্য প্রত্যাহার করার সংযোজনটি বাদ দেয়া হল। শুধু লগইন করা সদস্যরা এখন থেকে তাদের মন্তব্য পরিবর্তন বা মুছতে পারবেন।
@মুক্তমনা এডমিন, ধন্যবাদ। তবে আমার মনে হয়, কেউ মন্তব্য করার পর যাতে সহজে পরিবর্তন বা মুছতে না পারেন, এ ব্যবস্থাটা সবার জন্যই থাকা দরকার। না হলে এগুলো পরে সমস্যা হয়।
কথাটা অবশ্য অন্য ব্লগের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। এখানে তেমন কিছু্ই হবে, এটুকু বিশ্বাস রাখছি। আবারও ধন্যবাদ।
@মুক্তমনা এডমিন,
মন্তব্য আমিই করেছিলাম,এবং তা বাদ ও দেইনি, কারন কিভাবে বাদ দিতে হয় তা আমি জানিই না! :-)। কিন্তু কি হল বুঝলাম না। কে জানে, মনে হয় ভুল করে উলটাপালটা কিছু ক্লিক করে ফেলেছিলাম।
যাকগে, গত তিন চার দিন আমি মুক্তমনায় ঢুকিনি, তাই কি লিখেছিলাম তা এখন আর মনে পরছে না।
nice…
nicely expressed.
~Porosh