বাসুনকে, মা
পর্ব ৫০
বাসুন,
কোন কোন একাকী মুহুর্তে ভীষন অবাক লাগে এই যাপিত জীবনটাকে দেখে। আমি অবাক বিস্ময়ে আমার জানালার কাঁচে বৃষ্টির ফোঁটা পড়া দেখি, ঝুমঝুম বৃষ্টিতে ঢেকে আছে শহর। আমার একাকী ঘর, তুই স্কুলে, আমার চারপাশটা কি অসম্ভব একাকীত্বে ভরে থাকে, আমি সবকিছু প্রাণভরে দেখতে থাকি। কখনো ভুলে যাই আমি, কোথা থেকে শুরু করেছিলাম তোকে নিয়ে এই জীবন? কি শক্তি কাজ করেছিলে সেদিন আমার ভিতর? আমি দুহাত ঢেকে একা একা চিৎকার দিয়ে কাঁদি, বার বার নিজেকে বলি আমি, ভালোবাসি এই জীবনকে, ভীষণ ভলোবাসি । আমি কেন কাঁদছি? কেন কাদঁছি আমি? না বাসুন, আমি থামতে পারি না, আমার সব অর্জন, সব চেষ্টাকে ছাপিয়ে দুচোখ ভরে পানি আসে, আমি উঠে গিয়ে চলতে থাকা সিডি বন্ধ করি ‘বধুয়া আমার চেখে জল এনেছে হায় বিনা কারনে, নীল আকাশ থেকে একি বাজ হেনেছে হায় বিনা কারনে’। বাবু, নীরব দুপুরে এমন গান শোনা যায় না রে, ভিতর থেকে সব দুমড়ে মুচড়ে যায়। এমন দুপুর আমাকে পুরোপুরি উন্মামাতাল করে, তোর স্কুল থেকে ফেরার সময় হবে ভেবে আমি তাড়াহুড়া করে স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করি। তবুও লুকাতে পারিনা নিজেকে, তুই বাড়ি ঢুকেই আমার গলা পেচিঁয়ে জানতে চাস কি হয়েছে মা তোমার? আমি কি করে বোঝাবো সোনা যে, আমার কিচ্ছু হয়নি, কিছুই না, এই জীবন আমার অর্জিত জীবন। আমি একটা একটা করে সিঁড়ি পার হয়েছি তোকে নিয়ে, সেই ২০০১ সাল থেকে সিড়ি ভাংগা শুরু করেছি আমি, বিশাল খাঁড়া খাঁড়া সিড়ি ছিলো সেদিন আমার সামনে, পা পিছলে পড়বার ঝুঁকি ছিলো, আমার সামনে নিকষ কালো অন্ধকারও ছিলো সেদিন। আমার চারপাশে মানুষও ছিলো, তারা আমাকে বার বার বলেছে, লুনা তুমি পারবে, কিন্তু তারপর তারা ফিরে চলে গেছে নিজেদের জীবনে এবং সেটাই স্বাভাবিক। আমি তোকে নিয়ে একা একা পার হচিছ, তুই হামাগুড়ি দিতি, আমি স্বপ্ন দেখতাম কবে তুই একা একটু দাঁড়াতে পারবি, তারপর তুই দাঁড়িয়ে হাটতে শিখলি, কিন্তু আমার হাত ছড়লি না বাবু, এবার আমি তোকে ঘন্টা দুই এর জন্য রেখে বের হতে পারতাম। তোর নানী আপুর বাড়িতে বসে শুধুই ভাবতাম কবে তোকে নিয়ে ছোট একটা আশ্রয় পাবো। কোন কোন গভীর রাতে ঢাকা শহরের নিয়ন আলোর ঘোলাটে রাস্তায় উজ্জল জীবনের আলো দেখতে চাইতাম, একা দাড়িয়ে প্রার্থনা করতাম ‘খোদা তুমি শুধু আমাকে একটা নিরিবিলি জীবন দাও, আমি আমার ছেলেটাকে নিয়ে একাকী বাঁচতে চাই, জানিস বাবু, শুধুমাত্র এই একটি চাওয়া আমাকে টেনে এনেছে আট বছর। যতবার আমি খাড়া সিড়ি দেখেছি, তোকে নিয়ে একটি করে সিড়ি গুনে গুনে পা ফেলেছি ততবার মনে হয়েছে না, একদিন এই সিড়ি শেষ হবেই, আমার পাশ থেকে সবাই চলে গেছে একদিন, বাবা/মা/বোনেরা দূরে থেকে শুধু বলেছে, সাহস রাখ, কিন্তু একটা একটা করে দিন পার করেছি আমি বাসুন, সোনা আমার। তোর সেই শিশুমুখ আজ নয়বছরের প্রতিচ্ছবি, আজ টরোন্টো শহরে আমার সাততালা এপার্টমেন্টের এলিভেটর দিয়ে আমি নীচে নামার আগেই তুই সিড়ি দিয়ে নেমে যেতে পারিস সোনা। এখন তোর হাত শক্ত, একহাতে বাস্কেটবল অন্যহাত দিয়ে আমাকে ধরে তুই দিব্যি পেরিয়ে আসিস বড় রাস্তা সোনা। আমি গতবছর এপ্রিল এ অন্ধকার বেসমেন্ট দিয়ে বৃষ্টির শব্দ শুনতাম, আজ আমি উঁচু বিল্ডিং এর চূড়া থেকে আকাশ দেখতে পারি, একদিন আমি এই শহরে যে কোন অংকের (ছোট একটা জব) একটা সেটেল জব এর স্বপ্ন দেখতাম, আমি নাওয়া/ খাওয়া ভুলে সেই নিরাপত্তার জন্য অপেক্ষা করেছি,বাবু, আজ আমার সামনে বুক ভরে নিঃশ্বাস নেবার মতে খোলা মাঠ, আমার নিরাপদ অনাবিল বয়ে যাওয়া এই সময়ে আরো বার বার ভালোবাসতে ইচ্ছে করে জীবনকে। অনেক সিড়ি ভাংগার পরও আমি ক্লান্ত হইনি একটুও সোনা, বরং মনে হয় দুঃখের সময়টা চলে গেলে কেনো? আমি এখন বিশ্বাস করি ‘প্রতিবন্ধকতাই মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় রাজতীলক’। তোকে নিয়ে আমার এক পর্বের যুদ্ধ শেষ সোনা । এবার তোর জীবনকে ভরে তুলবো আনন্দে, যেখানে তোকে শুধু জয়ের গল্প শোনাবো না সোনা, তোকে বলে যাবো হতাশার চুড়ায় বসে কি করে বিজয়ের হাসি হাসতে হয়, তোকে জানিয়ে যাবো, সব অর্জনই বলে বেড়াবার নয়, কিছু আনন্দ দুঃখ দিয়ে পেতে জানতে হয়। বাসুন রে, গতবছর জুলাই মাসে তোকে এই লেখা শুরু করেছিলাম, বাসুন পর্ব শুরু করার সময় বলেছিলাম, তুই জন্মের পর একতাল নরম মাংসের দলা ছিলি। আজ তুই বড়, বল শুন্য আকাশে ছুড়ে মারিস, আমি তাকিয়ে দেখি বল নেমে আসে তোর দুহাতের মাঝখানে, একদিন এমনি করে জীবনের চ্যালেন্জও নিতে শিখবে তুই ও তোরা, প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম এমনি করেই হাতের নিশান বদল হবে।
বাসুন পর্ব আর নয়, যারা বিভিন্ন সময়ে আমাকে এই লেখার জন্য উৎসাহিত করেছেন, সঠিক সমালোচনা করে আমাকে শক্তিশালী করেছেন, যারা সাহস যুগিয়েছেন,সেইসব পাঠক/ পাঠিকা, সবাইকেই আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।
লুনা শীরিন
২০ শে এপ্রিল , ২০০৯।
আপনার এই ধারাবাহিক লেখা আমার পড়া হয়নি, কিন্তু “বাসুন কে মা” বইটি পড়েছি। এই অন্তর ছুঁয়ে যাওয়া লেখা নিয়ে মন্তব্য করা খুব কঠিন। আমি সেদিকে যাবো না। শুধুই আপনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে অনুরোধ করবো, সাদাকালো প্রকাশনীর থেকে প্রকাশিত হওয়ায় বইটি সব বুক স্টোরে পাওয়া যায় না। এই ব্যাপারে আপনার বা সাদাকালো প্রকাশনীর কিছু করনীয় থাকলে তা করা উচিৎ। আমি এমন অনেককেই পেয়েছি যারা “বাসুন কে মা” বুক স্টলে গিয়ে পাননি। আর সাদা কালো স্টোর তো বাংলাদেশের সব জায়গায় নেই, তাই মফস্বলের পাঠকরা বঞ্চিত হচ্ছেন এই বই পড়া থেকে। কেননা, মফস্বলের কোন জেলা শহরের পাঠক এই বইয়ের সন্ধান পেলেও তাঁকে কাউকে দিয়ে ঢাকা থেকে বই নিয়ে আসতে হয়। এই কাজটা একটু কঠিন অনেকের জন্য। আবারও ধন্যবাদ। নতুন লেখার অপেক্ষায় থাকলাম।
এই সিরিজটির নিবিড় পাঠ যেকোনো মানুষের মাতৃপ্রেম গভীর করবে। চমৎকার একটা টেক্সট।
এর গ্রন্থরূপ দেখতে চাই।
লুনা,
সুন্দর এই সিরিজটা শেষ করার জন্য আপনাকে অভিনন্দন। আশা করতে দোষ নেই – বড় হয়ে একদিন নিশ্চয় আপনার বাসুন আপনার লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়বে, আজকের এই সময়কে দেখবে ভবিষ্যতের গন্তব্যে দাঁড়িয়ে। জানবে কী ভাবে লড়াই করেছিলো তার মা ছোট্ট এই বাসুনকে সাথে নিয়ে এই বন্ধুর পৃথিবীতে …।
লুনা ভাল থাকুন, অনেক ভাল। আমি আপনার এই লিখাগুলোকে আজীবন মনে রাখবো।
@নাসরিন,
Apnar motto eakjon pathok holeo je kono lekhok er lekhar sharthokota chole ashe. Nasrin, ami sudu khusi holam eatuku vebe je eakjon maush holeo onttoto amar lekha diea amake mone rakhbe. Apnar jonno onek onek suvokamona.
luna