উপজেলা নির্বাচনঃ একটি আসনের চিত্র

পরশপাথর

 

উপজেলা নির্বাচনের ঠিক দুই দিন আগে, আমার নিজ এলাকার দুজন উপজেলা চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীর প্রতিনিধি এসে আমার কাছে জানতে চাইল, কবে আমি ভোট দিতে দেশের বাড়ি ব। তাহলে সেহিসেবে তারা গাড়ির ব্যবস্থা করবে। ভবিষ্যতে তাদের কিছু কটূবাক্য হজম করতে হবে, সেটা জেনেও আমি সফলভাবে দুই দলের কাছেই বুঝাতে পেরেছিলাম , বাংলা ছবির নায়করা এখনো মরে য়নি। আজকাল বাংলা ছবি ছাড়া নিরপেক্ষ লোক কোথাও খুব একটা দেখা য় না। আমি বাংলা ছবির নায়কের মত তাদেরকে বলেছিলাম, ভোট দিতে আমি অবশ্যই ব, তবে সেটা কারো দেয়া গাড়ীতে নয়। বাংলা ছবির নায়কের মতই আমার নিজের গাড়ী নেই বলে ভাব দেখিয়ে আর বলতে পারিনি, আমি আমার নিজের গাড়ীতে । আসলে নিরপেক্ষ লোকদের অবস্থা দাঁড়ায় বয়ফ্রেন্ডবিহীন তরুনীদের মত। আশপাশের সব ছেলেগুলো ভাবতে থাকে, আরে! এই মেয়েটাতো ফাঁকাই আছে। তারপর গ-বিয়োগ করতে থাকে, এর সাথে সম্পর্কে জড়ালে কি কি সুবিধা আর অসুবিধা থাকছে। অথচ মেয়েটারও হিসেব-নিকেশ এর একটা ব্যাপার আছে, সে কথা তারা ভুলেই বসে থাকে।

 

থাসময়েই আমি নির্বাচনে ভোট দিতে হাজির হয়েছিলাম। অতএব, এখন আমার প্রার্থীদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়াটা দায়িত্বের মধ্যে পড়ে য়। প্রথমজন আওয়ামীলীগ সমর্থিত। বাংলাদেশ সরকারে কমার্শিয়াল ইম্পরটেন্ট পারসন। ব্যবসা-বাণিজ্য করেন। জাতীয়-বিজাতীয় বহু পুরস্কারে ভূষিত। বাংলাদেশ থেকে উনি বাইরের দেশে পান, মুড়ি আর কচুর লতি পাঠান। কচুর লতি পাঠিয়ে বিরাট ব্যবসায়ী হওয়া য় এটা আমি বিশ্বাস করেছি উনাকে দেখে। রমনা চাইনিজ-এ একবার নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানোর সময় আমাকে তিনি বলেছিলেন, দল থেকে উনাকে পদপ্রার্থী হতে বলছেন। কিন্তু উনার সেটা হবার কোন ইচ্ছে নেই। উনি বরং ব্যবসায় আরো বেশি করে মনোনিবেশ করবেন। এতে করে এলাকার আরো বেশি লোকের কর্মসংস্থান হবে। আমি সাধু সাধু বলে বেরিয়ে এসে উনার দলীয় লোকজনকে জিজ্ঞেস করলাম, উনারতো প্রার্থী হবার কোন ইচ্ছেই নেই। তাহলে আপনাদের প্রার্থী কে হবে? উনার দলীয় লোকজন আমাকে বলল, পাওয়ার, সেক্স আর মানি- এই তিনটা ব্যাপারে নিজের বাপকেও বিশ্বাস করবেন না। আমি সেদিন সে-কথা অবিশ্বাস করে শুধু শুধু অবিশ্বাসীর খাতায় নাম লিখিয়েছিলাম। সে-ই হোক। এই প্রার্থীর ব্যবহার ভালো। মিষ্টি করে কথা বলেন। নিজের মান-সন্মানের প্রতি গভীর মনোনিবেশ।

 

দ্বিতীয় প্রার্থী বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত জামাতের প্রার্থী। ঢাকার বেশ কয়েকটা নাম করা শপিং মল, গুলোর বিজ্ঞাপণের অত্যাচারে টিভি সেটের ভলিউম কমিয়ে দিতে হয়, সে-রকম কয়েকটার মালিক। ইসলামি জীবন-মরণ বীমা টাইপ কতগুলো ইন্সুরেন্স কোম্পানীর চেয়ারম্যান। রিয়েল এস্টেটের ব্যবসাও করেন। আচার-ব্যবহারে আপত্তিকর রকমের কর্কশ। একবার উনার অফিসে বসা অবস্থায় দেখেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র এসেছে। ভর্তি সংক্রান্ত ব্যাপারে কিছু আর্থিক সহায়তার জন্য। উনি জেলা, থানা, ইউনিয়ন, স্কুল-কলেজ  সব জায়গায় টেলিফোন করে দলীয় লোকদের কাছে  জানতে চাইলেন, এই ছেলে আসলেই ছাত্র শিবির করে কিনা বা করতো কিনা? তার পর সবকিছু নিশ্চিত হয়ে তিনি পরিমাণ অর্থ সাহা্য  দিলেন তা-দেখে আমার বাংলা সিনেমার নায়ক টাইপ সত্তাটা জেগে উঠেছিলো। অবশ্য জেগে উঠার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আবার চুপসেও গিয়েছিলো। তারপর উনি দলীয় সবাইকে ফোন করে জানালেন, দলের একজন ছেলের জন্য তার এই অবদানের কথা। তিনি- কতটুকু দলপ্রেমিক সেটা সবাইকে বুঝিয়ে ছাড়লেন। লিখে রাখো এক ফোঁটা দিলাম শিশির-টাইপের লোক। সে-ই হোক। ইনি আবার জন দরদী। মাঝেমধ্যেই এলাকাতে গিয়ে কাপড়,চাল,ডাল ইত্যাদি বিতরণ করে আসেন। গরীব দুঃস্থ মানুষদের দেখলে সম্ভবত উনার কান্না কান্না ভাব আসে। প্রতিপক্ষ অবশ্য বলে, উনি কাতের দান খয়রাত করার জন্যই এলাকায় আসেন। এখানকার মানুষ সহায়তা পছন্দ করলে খয়রাতি দান পছন্দ করে না। সংক্ষেপে এই হল প্রার্থীগণ।

 

এবার নির্বাচন প্রসঙ্গে চলে াই। আগেই বলে রাখি, আওয়ামী সমর্থিত প্রার্থী সর্বমোট খরচ করেছেন প্রায় ২ কোটি টাকা। আর বিএনপি-জামাত প্রার্থী আগে পরে মিলিয়ে এর থেকে বেশি না হলেও কমও না। এর মধ্যে ভোটের দিন জন প্রতি খরচ করেছেন প্রায় পঁচিশ লক্ষ টাকা করে। এখানে নির্বাচনের সবচেয়ে উপভোগ্য বিষয় নির্বাচনী প্রচারণা। প্রতিপক্ষের টাকা খরচের দিকে নির্দেশ করে একেক প্রার্থীর সমর্থকরা একেক রকমের প্রচারণা চালাচ্ছে। মাইকে জোরে জোরে গলা ফাটিয়ে বলছে, টাকা পয়সা আল্লাহর দান/ ত পারেন তত খান / খাইতে খাইতে শুয়ে ন / জেগে উঠে আবার খান/ জায়গামত ভুলে । মানুষজন হেসে লুটোপুটি খায়।

 

ভোটের দিনের কথা বলি এবার। সবকিছু ঠিকঠাক মত থাকলে জামায়াত সমর্থিত প্রার্থী হেসে-খেলে জিতে যাবে, এটা সবাই আগে থেকেই জানে। বিএনপির প্রচুর ভোট থাকলেও পার্থক্যটা আসলে গড়ে দেবে নারী ভোটাররা। এই ভোটগুলো আসে বেহেস্তে বার জন্য। ধর্মভিত্তিক রাজনীতিবিদদের অর্জন। লীগের পরিকল্পনা হচ্ছে নারী ভোটাররা তে ভোট দিতে আসতে না পারে যে-করেই হোক সেই ব্যবস্থা করা। প্রতিবাদ, প্রতিরোধ করবার মত লোকজন নেই বললেই চলে। উল্লেখ্য, জাতীয় নির্বাচনে পরাজয়ের পর এখানকার বিএনপি-জামায়াতের অনেক নেতা কর্মী পলাতক। বিগতবছরগুলোতে তারা পশুর মত -পরিমাণ অপকর্ম করেছে, পালিয়ে গিয়ে মূলত তারা প্রমাণ করেছে, তারা আসলে পশু নয়, মানুষ; পাপের ফল ভোগ করার ভয় তাদেরও আছে।

 

পরিকল্পনা বাস্তবায়নের নিমিত্তে লীগের পক্ষ থেকে প্রথমে কিছু অদ্ভূত, অরুচিকর প্রস্তাব আসলো। যেমন, সকালে রটিয়ে দেয়া হবে, ভোট কেন্দ্রে লীগ কর্মীরা দুজন নারী ভোটারের বোরখা খুলে ফেলেছে; কেউ কেউ বলবে, কাপড়ও খুলে ফেলেছে। তার পর কাপড় হারানোর ভয়ে অন্য মহিলারা আর আসবেনা। এদের চিন্তা ভাবনা দেখে হাসা উচি না কান্নাকাটি করা উচি বুঝতে পারছিলাম না। এখানে লক্ষ্যণীয় যে, আমি কেবল একটি আসনের একটি বা দুইটি কেন্দ্রের কথা বলছি। এটি কোনভাবেই পুরো দেশের উপজেলা নির্বাচনের চিত্র নয়। সার্বিকভাবে আমার বর্ণিত আসনে টা বাস্তবায়ন করা হল, সেটা হচ্ছে -সকালে মহিলারা খন রিক্সায় করে ভোট কেন্দ্রে আসতে শুরু করলো, তখন তাদের রিক্সা আটকে দেয়া হল। দেখা হল, তারা কোন দলীয় ভোটার। উল্লেখ্য, এই সমস্ত জায়গায় মোটামুটি আগে থেকে বলে দেয়া য় কোন দলের সমর্থক কারা। এই কর্মটি সুসম্পন্ন করা হচ্ছে ভোট কেন্দ্র থেকে অনেক দূরে, খানে আইন-শৃংখলা বাহিনীর নাম-গন্ধও নেই, থাকবার কথাও নয়। দি দেখা য় রিক্সার মহিলারা বিএনপি জামাত জোটের ভোটার,  সাথে সাথে ১। রিক্সাওয়ালার দুই গালে দুই চড়। ২। রিক্সার টায়ার থেকে বাতাস বের করে অকেজো করে দেয়া। ৩। মহিলাদেরকে বলা, এবার হাঁটতে হাঁটতে বাড়ী চলে ন। মোট এই তিনটা ধাপ।

 

এই পরিস্থিতিতে, সকাল ১১ টার সময় জামায়াত প্রার্থী সংবাদ সন্মেলন করে নির্বাচন বয়কট করার ঘোষণা দেন এবং তার এজেন্টদেরকে ভোট কেন্দ্র থেকে বের হয়ে তে বলেন। কথামত এজেন্টরা কেন্দ্র থেকে বের হয়ে গেল। অতঃপর লীগের লোকজন বলতে লাগল, এরা খালি খালি কেন্দ্র ছেড়ে চলে চ্ছে কেন? কই এদেরকেতো কেউ মারতে আসেনি? অন্যদিকে, কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার ভোট স্থগিত করার কোন প্রশ্নই আসেনা। কারণ আপাত দৃষ্টিতে কেন্দ্রে কোন ধরণের ঝামেলাই হয়নি। এদিকে লীগের লোকজন ঘোষণা করল, প্রতিপক্ষ খারাপ হতে পারে, কিন্তু তাই বলে তারাও সেরকম হয়ে গেলে সুস্থ আর অসুস্থ ধারার রাজনীতির মধ্যে পার্থক্য থাকবে কি করে। অতএব, তারা সব নির্বাচন আচরণ বিধি মেনে চলব। প্রতিপক্ষ কেন্দ্র ছেড়ে চলে বার পর তারা সব আচরণ বিধি মানতে শুরু করল। সবাই কেন্দ্র থেকে চারশ গজ দূরে সরে গেল। কিছুক্ষণ পরে, তাদের একজন এসে বললো, দেখলেন কি রকম শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে? আমি বললাম, প্রতিপক্ষতো নেই, অশান্তি করবে কারা? উনি বলেন, নিজেদের মধ্যেওতো দল, উপদল আছে, সেই কথাই বলছিলাম। আমি শুধু মুচকি হাসলাম।

 

ফলাফলে আসি। জাতীয় নির্বাচনের তুলনায় এবার উপজেলা নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল একদমই কম। অতএব ভোট কাস্ট হবার তা আসলে সকাল ১১ টার মাঝেই হয়ে গেছে। প্রতিপক্ষের এজেন্টবিহীন অবস্থায় শেষ বিকেলে লীগ কর্মীরা একেকজন সাত-আটটি করে ভোটও দিয়েছে, তবে সব জায়গায় নয়, কয়েকটা জায়গায় মাত্র। ফলাফলে দেখা গেল লীগসমর্থিত-প্রার্থী খুব বেশি পার্থক্য নিয়ে জিততে পারেন নি। বরং বিএনপি-জামাত কর্মীরাই বলছিল, নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করা উচি হয়নি। কারণ সরাকারি দল একটু আধটু জোর প্রভাবতো খাটাবেই। কিন্তু দের ভোট দেবার ইচ্ছে আছে, দলের জন্য দের টান আছে তারা ভাবেই হোক কেন্দ্রে আসতো। তাছাড়া, কিছু নীরব ভোটারতো র‌য়েছেই।

 

ই হোক, শেষ দৃশ্যে লীগ সমর্থিত প্রার্থীর গলায় ফুলের পর ফুল। প্রতিক্রিয়ায় উনি প্রায় আকাশ থেকে পড়ে সবার কাছে জানালেন, প্রতিপক্ষ কেন যে নির্বাচন বয়কট করল, সেটা উনার মাথায়ই আসছেনা। উনি কেন, এটা নাকি কোন সুস্থ মানুষের মাথায়ই আসা সম্ভব নয়।  আমি আবারো মুচকি হাসলাম। কেন জানি মনের মাঝে বেজে উঠল, এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে রা, আমরা তোমাদের ভুলবনা। জীবনে চলার পথে যখন নিজেকে খুব অসহায় মনে হয়, যখন মনে হয় সব বুঝি শেষ হয়ে গেল, তখন আমার ভেতরে এই গানটা বেজে উঠে। তখন মনে হয়, না! আমরা খুব দুর্বল না। একদিন এই আমরাইতো পেরেছিলাম।

 

January 25, 2009

[email protected]