বাসুনকে, মা
পর্ব ৪৫
বাসুন,
বাসাতে সবচেয়ে যে বড় মগটা খুঁজে পেলাম সেটাতেই কফি নিয়ে বসলাম এইমাত্র। আজ প্রায় তিন সপ্তাহ হতে চলল তোকে এই জার্নাল লেখার সময় করে উঠতে পারিনি, সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।
টরন্টোতে এখন বরফের ধুম চলছে, তোকে নিয়ে বের হয়েছিলাম বাজার করবো বলে। এতদিন পরে বাড়ি ফিরে অনেক কিছুই নেই বলে মনে হচ্ছে, কিন্তু কই বাজারে যেতে পারলাম বল? ঠান্ডায় আমি মাঝ রাস্তা থেকে ফিরে এলাম, কিন্তু কি অবাক? তুই বাড়িতে ফিরেই আবার প্যান্ট আর বুট পড়ে রওনা হলি বন্ধুদের সাথে খেলতে, কেমন করে এই ঠান্ডাকে এডাপ্ট করলি সোনা? কফিতে চুমুক দিচ্ছি আর আমার সাততালার এপার্টমেন্টের জানালা দিয়ে বাইরের মেঘ মেঘ মন খারাপ করা আকাশকে দেখতে পারছি, কি বিরামহীন বরফ পড়ছে অথচ মাত্র তিনদিন আগেই তিনঘন্টার প্লেন ড্রাইভের দূরত্বে আমরা ঘুরে এলাম সোনাঝরা বাংলাদেশের আবহাওয়ার মতো দেশ ফ্লোরিডা থেকে। একই পৃথিবীর কি বিচিত্র রূপ, তাই না বাসুন?
আজকে থেকে ১৬ বছর আগে যে বড়বোনকে বিয়ে দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম আমেরিকা নামক স্বপ্নের দেশে সেই বোনকে একনজর দেখবো বলে টরোন্টো শহরেও আমি পার করেছি পাক্কা ৪ বছর। এই তো জীবন বাবু, আজকের বিশ্বের যেসব মহানায়করা গ্লোবাল ভিলেজ করে করে গলায় রক্ত তোলে তারা কি কোনদিন এই পৃথিবীতে আমার মতো হাজার হাজার মানুষের জীবনে বয়ে বেড়ানো দুঃখের হাহাকার শুনতে পায়? কাগজ নেই বলে কানাডা আমেরিকার বা অন্য সব দেশে যে মানুষগুলো একবার ঢুকে আর বের হতে পারেনি বা কোনদিন তাদের লাশও দেশের মানুষ দেখতে পারবে কিনা তাও যারা জানে না এমন সব মানুষের জন্য গ্লোবাল ভিলেজ কথাটা কতটুকু সত্য বা কার্যকরী? বাবু, তোর বড়খালা মানে আমার বড়পা তেমনি এক মানুষ, ১৬ বছর পরে যে আমেরিকাতে লিগ্যাল কাগজের সন্ধ্যান পেয়েছে, আমি ফ্লোরিডাতে সেই বোনকেই দেখতে গিয়েছিলাম। প্রতিকুল পরিবেশ মানুষকে শক্তিশালী করে তোলে, মানুষ হয়ে উঠে ইস্পাত কঠিন, আমি অনেকবার এরকম কাহিনী শুনেছি, কাছ থেকে এরকম মানুষ দেখেছি, তাদের জীবনের সাফল্য গড়েই উঠেছে প্রবল বাধা থেকে, অপ্রতিরোধ্য বাধা পেরিয়ে তাই সাধারন মানুষ হয়েছে অসীম প্রতিভাবান। আমার বড়পা তেমনি এক মানুষ। আমি আর বড়পা পিঠাপিঠি বলে ছোটবেলায় একসাথে স্কুলে যেতাম, আমি স্কুলে যাবার পথে ব্ন্ধুদের সাথে দুষ্টুমি করতাম, রাস্তায় হয়তো কথা বলতাম জোরে জোরে তাই বড়পা বাড়িতে ফিরে মাকে বলতো আমি লুনার সাথে স্কুলে যাবো না। কারন বড়পা সারাদিনে একটা কথাও জোর গলায় বলতো না। আমার পরিস্কার মনে আছে ধানমন্ডি স্কুলে আমি যখন এইটে পড়ি বড়পা টেন এ পড়ে, একদিন স্কুলের জাদরেল টিচার নুরমহল আপা এসে আমাকে বললেন, তোমার লজ্জা লাগে না তোমর আপন বোন সারাদিন ডেস্ক থেকে নড়ে না আর তুমি স্কুলে এসেই গাছে গাছে ঘুরে বেড়াও। এই ছিলো আমার বড়পা, বড়পার একমাত্র অস্ত্র ছিলো ওর চোখের পানি, ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত বড়পা শুধু কাঁদতে পারতো। যেহেতু বাবা/ মা দুই পরিবারের ভিতর বড়পাই ছিলো সবচেয়ে বড় মেয়ে তাই বড়পাকে ভীষন আদর করতো সবাই, যদি কোন মামা খালা বড়পাকে কোন বকা দিতো সাথে সাথেই সবাই আমাকে বলতো, এই লুনা যা যা একটা কলস নিয়ে রুমার চোখের কাছে ধর ও তো এখন কাদঁবে, এই কথা বলাও সারা বড়পার চোখ দিয়ে টস টস করে পানি পড়াও সারা। আমার আজকের সেই বোন ১৬ বছর পর আমাকে দেখে একটু বিচলিত হলো না বরং আমিই বড়পাকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে উঠলাম। জীবনের কাছে এটাই পরম পাওয়া , একদিন যে বোনকে জীবনমুখী করতে চেয়েছিলাম সবাই মিলে, একদিন যার চোখের পানি দেখে আমাদের ধারনা হয়েছিলো বড়পাকে দিয়ে কিছুই হবে না আজকে সত্যিকার অর্থে গত ১৬ বছরে বড়পাই আমাদেরকে টেনে টেনে বড় করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পড়তাম বড়পা আমাকে প্রতিদিন ২০ টাকা করে দিতো, মায়ের কাছে বড়পা ডলার পাঠাতো মা টাকা দিতেন আমার হাতে। সেই টাকা দিয়েই আমার সব খরচ চালাতাম আমি। আমি সহ বাকী তিনবোনের বিয়ে হবে, টাকার যোগান দিত বড়পা, সরকারী অফিসার বাবা কত টাকাই বা বেতন পেতেন? আমি কানাডায় এপ্লাই করবো, টাকা কোথা থেকে আসবে? হাত বাড়িয়ে দিলো বড়পা। ছোটবোনের বিয়ে? গয়না এলো আমেরিকা থেকে। আর জ্ঞাতিগুষ্ঠি সব বড়পার নামে ধন্য ধন্য করতে লাগলো, অথচ আমরা কেউ টের পেলাম না বড়পা কি যুদ্ধ করে টাকাটার যোগান দিচ্ছে। স্বামী / সংসার সামলে দুটো ডলার একসাথে করতে বড়পা কি করেছে, বছরের পর বছর আমি নিজে যদি বিদেশে না থাকতাম, যদি বিদেশে নিজের চেষ্টায় নিজেকে দাঁড়া না করাতাম তাহলে কোনদিনই উপলব্ধি করতে পারতাম না। আজ সেই বোনকেই দেখে এলাম, দোর্দন্ড প্রতাপে একটা বড় টয়োটা সিয়েনা ভ্যান চালাচ্ছে, একটা দোকান প্রায় একহাতেই দাড় করিয়ে ফেলেছে, একই মুখে কথা বলছে ইংরেজী / উর্দু/ হিন্দি/বাংলায়, বড়পা যেন একটা জীবন্ত মেশিন। একজন কাষ্টমারের দাঁড়ানোর ভংগি দেখেই বলে ফেলছে কাষ্টমার কি চায়? আমি খুব কাছ থেকে বড়পাকে দেখে ভাবলাম এই কি আমার বড়বোন যাকে ডিগ্রী পর্যন্ত মা না ডাকলে খেতে আসতো না, একা একা ঘরে বসে কাঁদতো? কোন পরিবেশ বড়পাকে এমন করে তুলল যে পৃথিবীর যে কোন চ্যালেন্জ বড়পা হাসিমুখে নিতে শিখলো? ইউএস ২৭ রোড ধরে বড়পা যখন আমাকে আর তোকে এয়ারপোর্টে দিতে এলো বাবু, মনে আছে তোর? এই তো মাত্র ৮ দিন আগে, এখনো সপ্তাহ ঘোরেনি। বড়পা রাস্তাতে বার বার বলছিলো কি রে লুনা চুপ করে আছিস কেন? এইতো এখন তো তোর সাথে প্রায়ই দেখা হবে, ৯০ মাইল ম্পিডে গাড়ির স্টিয়ারিং ধরা বড়পার, একটু বেখেয়াল হলেই দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, আমি বার বার বলছি বড়পা সাবধান, কিন্তু বড়পা কি শোনে? জীবন এখন ওর কাছে পান্তাভাত, গতিই নাকি বড়পার প্রিয়। আমি বিস্মিত চোখে চেয়েছিলাম রাস্তার দিকে। কতদূর যেতে চায় বড়পা, আমাকে যে ছোটবেলায় সবাই গুন্ডা ডাকতো, আর বড়পার ডাকনাম ছিলো ভেদলি (রংপুরের ওদিকে বোকাদেরকে ভেদলি বলে) আজতো দেখতে পারছি আমিই ভেদলির মতো পড়ে আছি ১০০ বছর পিছনে। একজন পাঠক আমার লেখা পড়ে বলেছেন, আমি এতো দুঃখের কথা লিখি কেন? আমি তো দুঃখ লিখি না, আমি লিখি জীবনের গল্প। বিকাশমান সময় ও মানুষ আর মানুষের জয়যাত্রার গল্প। সেখানে কষ্ট আছে বলেই তো জয় আছে, বড়পা তোমার না পারার বেদনাই তোমাকে সাফল্যর জয়মাল্য পড়িয়েছে, এমন বড়বোন যেন যুগে যুগে জন্ম নেয় । অনেক ভালোবাসা বড়পা, আবার দেখা হবে । বাবু, তোর বড়আম্মুর গল্প বড় হলে আমার লেখায় পড়ে নিস সোনা।
তোর মা,
১০ ই জানুয়ারী ২০০৮ .
গীতা দি, নাসরিন,
আপনাদের মন্তব্য (নেগেটিভ প্লাস পজিটিভ) দুইই আমার লেখার জন্য বড় পাওয়া। এই ফাঁকে মুক্তমনাকে শুভেচ্ছা জানাই, যারা প্রতিদিনের কাজের পাশাপাশি এই কাজগুলো চালিয়ে যাচ্ছেন। নাসরিন, আপনি কি জানেন আমার জন্ম রংপুরে? কুড়িগ্রামের বহু মানুষ আমাকে ভীষণ আপন জানে? যাদের সাথে এখনো আমার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে? সত্যি নাসরীন, পৃথিবীটা কত ছোট।
গীতা দি, তোমার লেখাও কিন্তু ভাল। নাসরীন ভাল থাকবেন, আমাকে মেইলও করতে পারেন ইচ্ছে করলে।
শুভেচ্ছা,
লুনা
জীবনকে সাজাতে কি নিজের ইচ্ছাই যথেষ্ট না। হ্যাঁ নাসরীন, জীবন সাজাতে নিজের ইচ্ছাই যথেষ্ট বলেই তো ল্লুনা তা পারছে। সংগ্রাম করছে, তবে সে সংগ্রামে নিজেই নেতা — নিজেই যোদ্ধা। শুধু তার জীবন যুদ্ধের ইতিহাস আমরা পড়ছি। আর লুনা কিন্তু তার আনন্দের কথাও লিখছে। তার কানাডার পাসপোর্ট পাবার কথা অমাদের জানিয়েছে।
লুনা নিজের কথা অকপটে বলে ফেলতে পারে বলেই সে হাসি খুশি থাকতে পারে। ( তার ভাষ্য মতে সে হাসি খুশি থাকে) আমার এক বন্ধু হীরা খানম লুনার লেখা খুব পছন্দ করে। আমাকে বলেও। পছন্দের কারণ তার সংগ্রামী জীবনের সত্য কথন। লুনার বড় আপার ভূমিকা ,চারিত্র্যিক বৈশিষ্টের সাথে আমাদের অনেকের মিল খুঁজে পাই। তবে বড় আপা আমেরিকায় গিয়ে আমরা দেশে থেকে। অর্থাৎ বড় আপা , লুনা আমাদের চারপাশের, আমাদের পরিবারেরইচরিত্র।
লুনা,
পাঠকের আনন্দের জন্যে তুমি তোমার লেখার সবলীল গতি থেকে সরে যেও না।
আমি বাংলাদেশে থাকি। রংপুর কুড়িগ্রাম আমার শ্বশুর বাড়ি। আপনার লিখা খুব ভাল লাগে।
নাসরিন,
আপনার কমেন্ট পড়লাম, আমি কিন্তু খুব বেশি হাসি খুশি মেয়ে, জোরে হাসি বলে আমার কিছুটা অপবাদও আছে (হাহাহা)। কিন্তু জানেন জীবনের যে কোন পাওয়াকে আমি একটু পিছন থেকে দেখি আর সেটা আমার লেখাতেও প্রতিবার এসে যায়, এটা আমার দুর্বলতা হয়তো, সহজ করে হাসতে বা পেতে জানি না আমি। লেখা পড়ার জন্য থ্যাংকস।
কোথা থেকে লেখেন আপনি? আমার ধারে কাছে কোথাও?
শুভেচ্ছা,
লুনা
কেমন আছেন? আমি আপনার লেখা খুঁজি প্রতিদিন। এত ভাল লিখেন। এত চাপা বেদনা কেন আপনার? জীবনকে সাজাতে কি নিজের ইচ্ছাই যথেষ্ট না। একটা খুব আনন্দের লিখা লিখুন…. একবার খুব জোরে হাসুন