অবাধ-সুষ্ঠ নির্বাচনের অন্তরালে: ও যোগ্য প্রার্থী নির্বাচন এখনো দূরস্থ !

এডভোকেট মো: জানে আলম

 

গত ২৯ সে ডিসেম্বর, ২০০৮ অনুষ্ঠিত হয়ে গেল বহু প্রতীক্ষিত ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনবিগত ১১ই জানুয়ারী, ২০০৭ এর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলশ্রতিতে নতুন তত্ত্বাবধায় সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর হতে এ নির্বাচন নিয়ে সংশয় সন্দেহের অন্ত ছিল নাকিন্তু সকল সংশয় ও সন্দেহের অবসান ঘটিয়ে পরিশেষে এমন একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে বর্তমান নির্বাচন কমিশন সক্ষম হয়েছেন, যা সুষ্ঠ ও অবাধ নির্বাচন হিসাবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও পেয়েছেএ নির্বাচনের সর্বাপেক্ষা বড় বৈশিষ্ট হল ভোটারদের অংশগ্রহণের মাত্রাএত বেশী সংখ্যক ভোটারের ভোট প্রদানের ইতিহাস এদেশে বিরলপ্রচণ্ড উসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে ভোটারেরা ভোট কেন্দ্রে উপস্থিত হয়েছেনপ্রায় সকলের হাতে ছিল জাতীয় পরিচয় পত্রতবে নির্বাচন কমিশন জাতীয় পরিচয় পত্রের নাম্বারের সাথে ভোটার নাম্বারের কেন মিল রাখলেন নাÑতা বোধগম্য হচ্ছেনাতাহলে একদিকে যেমন ভোটারদের ভোট প্রদান আরো সহজ হত, অন্যদিকে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করে প্রার্থীদের আলাদা ভোটার কার্ড ছাপাতে হতনাফলে কোন ভোটার কোন বিশেষ দল বা প্রার্থীর ভোটার কার্ড নিয়ে ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার বিড়ম্বনা থেকে রেহাই পেতেনসব মিলিয়ে বাহ্যিকভাবে এ নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠ বলা ছাড়া কোন গত্যন্তর নেইবাহ্যিকভাবে শব্দটা কেন ব্যবহার করলাম? অবাধ, সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন বলতে যদি আমরা কেবল ভোটারদের ভোট প্রদান, ভোট গণনা ও সঠিক ফলাফল ঘোষণাকে বুঝি, তাহলে  বিগত ২৯ সে ডিসেম্বরের নির্বাচন অতীতের সকল নির্বাচনের চেয়ে অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়েছেকিন্তু মর্মগতভাবে নির্বাচনকে যদি আমরা জনমতের সঠিক প্রতিফলন মনে করি তাহলে আমাদের দেখতে হবে ভোটাররা সত্যিকার অর্থে স্বাধীনভাবে তার বিবেক-বুদ্ধি দিয়ে ভোট প্রদান করতে পেরেছেন কিনা,  নাকি নানা বাহ্যিক কারণে  প্রভাবিত হয়ে সে কোন না কোন দল বা প্রার্থীকে ভোট প্রদান করতে বাধ্য হয়েছেন ? জনমতের প্রতিফলন যদি নির্বাচনের মূল বিষয় হয়, সেখানে এ প্রশ্নটি অত্যন্ত মৌলিক

 

একটি অবাধ ও সুষ্ঠ নির্বাচনের ১ম শর্ত হচ্ছে নির্বাচনের মাঠে সকল প্রার্থীর সমান সুযোগ। (বহু কথিত লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড)বিগত নির্বাচনে কি সে সমান মাঠ ছিল?

 

প্রথমত: নির্বাচনী প্রচারণার ধরণ কেমন ছিল ?

 

প্রচার-প্রচারণার ক্ষেত্রে স্বাভাবিক ভাবেই প্রতিষ্ঠিত বড় দলগুলোর সুবিধা ও সুযোগ বেশি ছিল তাদের পূর্ব থেকেই থাকা তৃণমূল সাংগঠনিক কাঠামোর কারণে এটা তাদের দলীয় সক্ষমতা, কারো কিছু বলার নেইঅতঃপর আসে মিডিয়ার প্রশ্নবর্তমানে ইলেকট্রনিক্স ও প্রিন্ট মিডিয়া নির্বাচণী প্রচারে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেকিন্তু আমি হলফ করে বলতে পারি, বিগত নির্বাচনে আমাদের উভয় মিডিয়ার প্রচার-প্রচারণায় মনে হয়েছে, বাংলাদেশে মাত্র দুটি জোট নির্বাচন করছেএর বাইরে কারো অস্থিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নিইলেকট্রনিক্স মিডিয়ায় সকাল-সন্ধ্যা কেবল দুই নেত্রী, দুই মার্কা আর দুই জোটের প্রচারণা চালু ছিলআমি চট্টগ্রাম-১০ নির্বাচনী এলাকা থেকে জাতীয় যুক্তফ্রন্ট ও গণফোরাম মনোনীত প্রার্থী হিসাবে নির্বাচনে অংশ নিইপ্রার্থীদের গণসংযোগের সংবাদ যখন স্থানীয় পত্র পত্রিকায় দেদারছে প্রকাশিত হতে থাকে, তখন নির্বাচনী প্রচারণার স্বার্থে প্রতিদিন আমার গণসংযোগ কর্মসূচীর সংবাদ ও ফটো স্থানীয় ৩ টি পত্রিকায় পাঠাতে াকিকিন্তু হা! হতোস্মি ! বড় দল বা জোটের প্রচারে সয়লাব পত্রিকাগুলোতে আমাদের মত প্রার্থীদের সংবাদের কোন ঠাঁই হয়নি বললেই চলে পরিচিত কোন সাংবাদিক বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলে সে একই জবাব- ভাই বুঝেন তো? কী যে বুঝি, কী যে বুঝব সেটা কখনো বুঝিনিআসুন ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ার কথাপ্রতিদিন বিভিন্ন চ্যানেলে নির্বাচনী হালচাল বা নির্বাচন আপডেট নামে সারাদেশের নির্বাচনী প্রচারণার সংবাদ ভিডিও ফুটেজ সহ প্রচার করা হলেও সেখানেও স্থান পেয়েছে কেবল ঐ দুই জোট, দুই মার্কা ও দুনেত্রী এবং তাদের প্রার্থীদের প্রচার

 

প্রার্থীদের যোগ্যতা-অযোগ্যতা, সততা ইত্যাকার বিষয় বিন্দুমাত্র স্থান পায়নি প্রিন্ট কিংবা ইলেকট্রনিক্স মিডিয়াতেঅথচ দুই বড় জোটের প্রার্থীদের মধ্যে অনেকেই আছেন ্ঋণ খেলাপি, বিল খেলাপি, দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত, এমনকি খুনের মামলার আসামীওদুই জোট তাদের এসব নেতা কিংবা তাদের আত্মীয়দের মনোনয়ন প্রদানে কোন কার্পন্য করে নিমিডিয়াগুলো এ ব্যাপারে নির্বাচনের সময়ে টু শব্দটিও করেন নিসবচেয়ে মজার ব্যাপার হল, জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত বিভিন্ন দল প্রধানের ভাষণের ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার ভাষণ সব চ্যানেলে বিটিভির সাথে যুগপ প্রচার করা  হয়েছেঅথচ বাকী দল নেতারা কে কখন ভাষণ দিলেন জাতি তা জানেও নাকারণ বেচারা বিটিভি ছাড়া কোন চ্যানেল সে ভাষণ প্রচার করে নিএমনকি ভাষণের কোন কথা তাদের নিয়মিত সংবাদেও ঠাঁই পায় নিএকটি বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা বলি২৭ ডিসেম্বর সকাল ৯-৩০ ঘটিকা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আমার নির্বাচনী প্রচারে অংশ গ্রহণ করার জন্য ড. কামাল হোসেন চট্টগ্রাম আসেনতিনি দক্ষিণ পতেঙ্গা আলীর-দোকান হতে শুরু করে উত্তর মধ্যম হালিশহর এর মরহুম এম, , আজিজ এর কবরস্থান পর্যন্ত যাবেন এবং পথে পথে বিভিন্ন পথ সভায় বক্তৃতা শেষে মরহুম এম,এ আজিজের কবর জিয়ারত করবেনপরিশেষে সন্ধ্যায় ইপিজেড চত্বরে এক শ্রমিক জনসভায় ভাষণ দিবেনতার অনুষ্ঠান ধারণ করার জন্য অনেক অনুরোধ-উপরোধ করে দুটি ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ার সাংবাদিকদের রাজি করালামতাদের জন্য বিশেষ  গাড়ীর ব্যবস্থা করা হলকিন্তু ১০-৩০ টা অনুষ্ঠান শুরুস্থলে এসে তারা ড. কামাল হোসেনের একটি পোজ নেওয়ার জন্য অস্থির হয়ে পড়লেন এবং তা করতে আমরা বাধ্য হলামঅত:পর তারা বিদায় হলেন অনুষ্ঠানের শুরুতেইঅথচ বৃহ জোট বা দলগুলোর এ জাতীয় কর্মসূচী প্রতিদিন তারা লাইভ প্রচার করেনবিস্ময়ের ব্যাপার হল, এত চেষ্টা তদবির করে ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ার সাংবাদিক বন্ধুদের আনলেও তাদের সে ধারণকৃত অনুষ্ঠান কয়েক সেকেন্ডের জন্যও দেখানো হলনাঅথচ বড় দলের প্রার্থীরা কোন বিবাহ, আকিকা, না অনুষ্ঠান, যেখানেই গিয়েছেন ক্যামেরা তাদের অনুসরণ করেছেকারণ বলা যাবে না, অনুমান করতে পারেনএ হলো বিগত নির্বাচনে আমাদের মিডিয়াগুলোর নিরপেক্ষ প্রচারের স্বরূপ

 

এর পর এবং সর্বগ্রাসী যে বিষয়টি, তাহল টাকার খেলাআমাদের নির্বাচনী ব্যয় যেখানে সর্বোচ্চ ১৫ লাখ টাকা, সেখানে বড় বড় জোটের প্রার্থীরা কেবল পোস্টার-লিফলেট ছাপিয়েছে সে পরিমাণ টাকারনির্বাচনী আচরণ বিধিতে আছে এক ওয়ার্ডে একটি নির্বাচনী অফিস, অথচ প্রত্যেক পাড়ায় মহল্লায় নির্বাচনী অফিসÑভোট ক্রয় কেন্দ্রÑকরেছে তারাছোট দল কিংবা গরীব প্রার্থীরা উল্টো আচরণ বিধির দোহাই পেড়ে তাদের কর্মীদের একটির বেশি নির্বাচনী অফিস করতে দেয়নিশুধ ুকি তাই, এবার নগদ টাকা দিয়ে ভোট ক্রয়ের যে মহোসব চলেছে নীরবে-নিভৃতে তা দূর থেকে কিংবা উপর থেকে যারা নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছেন, তাদের বোঝার কোন উপায় নেইকী ভাবে ভোট কিনেছে তারা ? স্বেচ্ছাসেবক, এক ঘরের সব ভোটারই স্বেচ্ছাসেবক এবং স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে তাদের সম্মাানি মাথাপিছু ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্তগ্রামে, তৃণমূলের ভোটারদের সাথে কথা বললে সহজে এসব তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যাবে  বড় দুই জোটের  প্রার্থীদের কর্মীদের কাছেই শুণেছি, কেবল নির্বাচনের দিন একটি সেন্টারে নাকি সেন্টার খরচ হিসাবে ৩০,০০০ থেকে ৫০,০০০ টাকা পর্যন্ত প্রদান করেছেনহিসাব করুন, ১৪০ টি কেন্দ্রে ৫০,০০০ টাকা হিসাবে মোট টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় ৭০,০০০০.০০(সত্তর লক্ষ) টাকাএ শুধু নির্বাচনের দিনের খরচটাকার এ খেলায় স ও যোগ্য প্রার্থীর ঠিকে থাকার কোন উপায় আছে কি ? না ঠিকে থাকতে পারে নি তারাতাই দেখা গেছে নির্বাচন হয়েছে কেবল দুই জোটের মধ্যে, আরো নির্দিষ্ট করে বললে দুই মার্কার মধ্যেএখানে প্রার্থীর কোন পরিচয়, যোগ্যতা, তার রাজনৈতিক ভূমিকা অবান্তর হয়ে ওঠেনির্বাচনের পূর্বে অনেক কাল টাকার মালিক, ঋণ খেলাপি, বিল খেলাপি সবাই হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়ে কিংবা স্থগিতাদেশ নিয়ে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেনশত শত কোটি টাকা লুঠপাটকারীদের কাছে দুএক কোটি টাকা হাতের ময়লাঅথচ কোন স ও যোগ্য ব্যক্তির পক্ষে এ টাকা খরচ করা কখনো সম্ভব হবে নাতাই নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠ হওয়ার যত ঢেকুর তোলা হউক না কেন, তা কেবল তার বাহ্যিক স্বরূপ এবং এ জাতীয় নির্বাচনে  ও যোগ্য প্রার্থীর নির্বাচন বহু দূরস্ত !