নির্বাচন ২০০৮: দিন বদলের পালা?

 

ইরতিশাদ আহমদ

 

You may fool all the people some of the time, you can even fool some of the people all of the time, but you cannot fool all of the people all the time.    Abraham Lincoln

 

আওয়ামী লীগ আবারো এক ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করলো।  নিজেদের কাছে আশাতীত আর অন্যদের  কাছে অপ্রত্যাশিত।  তুলনীয় চুয়ান্ন আর সত্তরের নির্বাচনী ফলাফলের সাথে।  এরশাদের জাতীয় পার্টি ছাড়া নৌকার জোয়ারে ভেসে গেছে বি এন পি সহ অন্য সব দলগুলির নির্বাচনী আকাঙ্খা।  জাতীয় পার্টির সাফল্যও এসেছে আওয়ামী লীগের ঘাড়ে চাপতে পারার ফলেই।

 

ছিয়ানব্বই-এর নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ জয় অর্জন করেছিল, তবে ব্যাপকতায় এবারের নির্বাচনের ফলাফলের কাছে সেই জয় তেমন দর্শনীয় ছিল না।  সেবারে আওয়ামী লীগকে জাতীয় পার্টি এবং জাসদের সাথে কোয়ালিশন করে তথাকথিত ঐক্যমতের সরকার গঠন করতে হয়েছিল।  আরও একবার আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জয়লাভ করেছিল, তিয়াত্তরে।  তবে সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সামনে তেমন কোন প্রতিপক্ষ ছিল না বলে ফলাফলও অভাবনীয় ছিল না।  

 

চুয়ান্নর নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের জয় আওয়ামী লীগকে ক্ষমতার স্বাদ দিলেও তা ছিল ক্ষণস্থায়ী।  আর সত্তরের নির্বাচনে জয়লাভের পরিণতি তো সবারই জানা।  শুধু নির্বাচনে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ সেবারে ক্ষমতায় যেতে পারে নি।  একটা রক্তাক্ত যুদ্ধে সারা জাতিকে নিয়ে জিততে হয়েছিল। 

 

আর এবারই প্রথম স্বাধীন দেশের মাটিতে আওয়ামী লীগ পেল অভাবনীয় জয়।  আওয়ামী লীগের নেতারাও ভাবতে পারেন নি বিজয়ের পরিধি হবে এতটা ব্যাপক।  এজন্যই চুয়ান্ন আর সত্তরের সাথে আওয়ামী লীগের এই নির্বাচনী সাফল্যকে তুলনা করা যায়।

 

জনগণই ইতিহাস সৃষ্টি করে।  সীমিত ব্যালটভিত্তিক গণতন্ত্রও – অর্থ, প্রতিপত্তি, ক্ষমতা আর পেশীশক্তির দাপট সত্বেও – জনগণের হাতে হয়ে উঠতে পারে মোক্ষম অস্ত্র।  চুয়ান্ন আর সত্তরে আমরা তাই হতে দেখেছি।  এই অস্ত্রের কার্যক্ষমতা সীমিত যেহেতু গণমানুষের সার্বিক মুক্তির নিশ্চয়তা বিধানে ব্যালটভিত্তিক গণতান্ত্রিক ব্যাবস্থার কার্যকারিতাও সীমিত।  তবুও ইতিহাসে দেখা যায় জনগণ সুযোগ পেলেই এই অস্ত্র প্রয়োগ করে বিচক্ষনতার সাথে।  কাংখিত ফলাফল আসে না প্রায় কখনোই; ঐ যে বললাম এই অস্ত্রের সীমিত কার্যক্ষমতার জন্য।  কিন্তু ভুল হয় না জনগণের এই অস্ত্রের অব্যার্থ প্রয়োগে।  

 

নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের বিজয়ের কারণগুলি বিশ্লেষন করলে সহজেই বোঝা যাবে জনগণ নির্বাচনে যে রায় দিয়েছে তা মোটেও অস্বাভাবিক নয়। 

 

প্রথমেই বলে নেয়া দরকার, নানা কারণে পরিস্থিতি মহাজোটের অনুকুলে ছিল।  কিন্তু তবুও আওয়ামী লীগ একশত পঞ্চাশটার মতো আসন পাবে এটাই ছিল অনেক অভিজ্ঞ রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত।  বেশ কয়েকটা প্রাক-নির্বাচনী জরিপেও এই ধরনের ফলাফল অনুমিত হয়েছিল।  তাহলে দেখা যাক, সব অনুমানকে ছাপিয়ে মহাজোটের মহাবিজয়ের আর চারদলীয় জোটের ভরাডূবির কারণগুলি কি?

 

এক: বিএনপির ২০০১-২০০৬ শাসনামলের সীমাহীন দুঃশাসন ও দূর্নীতি, উদ্ধত বেপরোয়া ক্ষমতাগর্বী আচরণ।  খালেদা জিয়ার স্বজনপ্রীতি ও ক্ষমতার আত্মীকরণ, দুই সন্তান, ভাই, বোন আর হাওয়া ভবনের মাধ্যমে।  বিএনপি সরকারের জঙ্গীদের মদদদাতা হিসেবে পরিচিতি পাওয়া।  দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে বিএনপি সরকারের ব্যর্থতা।  

 

দুই: আর তার সাথে জামাতে ইসলামীর জোটবদ্ধতা।  ২০০১-এর নির্বাচনে জামাতের ভোট হয়তো বিএনপিকে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে সাহায্য করেছিল।  কিন্তু এবারে, ২০০৮-এ জামাত বিএনপির জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায়  (নীচের পাঁচ নম্বর পয়েন্টটাও দেখুন।)

 

তিন: আওয়ামী লীগের তৃণমূল স্তরে সংগঠনের বিস্তৃতি ও কর্মতপরতা, নিবেদিতপ্রাণ কর্মী-সমর্থকদের অবিচল আনুগত্য, আর শেখ হাসিনার কতিপয় সঠিক ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত (যেমন, দলের প্রভাবশালী সংস্কারবাদীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যাবস্থা না নিয়ে দলীয় ঐক্য বজায় রাখা, এবং কিছু কিছু চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও দূর্নীতিবাজদের মনোনয়ন না দেয়া)।  আওয়ামী লীগের উপর নির্যাতন (একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলা এবং পরবর্তীতে তত্বাবধায়ক সরকারের হাতে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী নেতাদের কারাগারে প্রেরণ) মানুষের মনে আওয়ামী লীগের প্রতি সহানুভূতির জন্ম দেয়।  (এই সহানুভূতির ভাগ বিএনপি অতটা পায় নি, কারণ অনেক ক্ষেত্রেই মানুষ মনে করেছে তারা উপযুক্ত শাস্তিই পাচ্ছে, এটা তাদের প্রাপ্য ছিল। )

 

চার: সেনানিয়ন্ত্রিত তত্বাবধায়ক সরকারের অরাজনৈতিক, বিশৃংখল, প্রতিহিংসাপরায়ণ, এবং সমন্বয়হীন প্রশাসন।  এই সরকারেরও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সীমাহীন ব্যার্থতা।  গনমানুষের অনির্বাচিত সরকারের প্রতি অনীহা।

 

পাঁচ: যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে সেক্টর কমান্ডারদের প্রচারণা এবং এই বিষয়ে সাধারণ মানুষের সচেতনতা।

 

ছয়: তরুন, নতুন ভোটারদের সমর্থন।  এই তরুন ভোটারদের মনে বিএনপির দুঃশাসনের স্মৃতি ছিল উজ্জ্বল, পূর্ববর্তী আওয়ামী শাসনামলের (১৯৯৬-২০০১) তুলনায়।  তরুন ভোটারেরা বিএনপি-জামাতের পশ্চাদমুখী ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতিকেও আমার মনে হয় প্রত্যাখ্যান করেছে। 

 

সাত: মহাজোটে বামপন্থীদের অংশগ্রহন।  ওয়ার্কার্স পার্টি আর জাসদের অল্প হলেও কিছু ভোট আছে, সেগুলি এবারে নিজ নিজ দলের প্রার্থী ছাড়াও আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা পেয়েছে।  (জাতীয় পার্টির মহাজোটে অংশ নেয়ার ফলে আওয়ামী লীগের চেয়ে আমার মনে হয় জাতীয় পার্টিই বেশি লাভবান হয়েছে।  এমনও হতে পারে যে, লাভতো নয়ই, আওয়ামী লীগের বরং ক্ষতিই হয়েছে।)

 

একটা কথা মনে রাখা দরকার, আসনসংখ্যা কম পেলেও এই নির্বাচনে বিএনপি-জামাতের কবর রচিত হয় নি।  বিএনপি মোট ভোটের ৩৩ শতাংশ বা প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ভোট পেয়েছে।  যা আগের বারের চাইতে কম হলেও দলের জনপ্রিয়তা শূণ্যের কোঠায় নেমে গেছে বলা যাবে না।  অন্যদিকে জামাতের আসন মাত্র দুটিতে নেমে আসলেও শতকরা হিসেবে প্রায় একই রয়ে গেছে। সেক্যুলার রাজনীতির সমর্থকদের জন্য  আশঙ্কাজনক হলেও সত্যি জামাতের ভোটের সংখ্যা বেড়েছে কারণ মোট ভোটারের সংখ্যা এবারে আগের বারের চাইতে বেশি।     

 

উপরে যে সাতটি কারণ আমি উল্লেখ করেছি, তাছাড়াও আরো কারণ থাকতে পারে (প্রকাশ্য অথবা অপ্রকাশ্য) এবং কারণগুলির গুরুত্ব একেকজনের কাছে একেকরকম মনে হতে পারে দৃষ্টিভঙ্গীর পার্থক্যের দরুণ।  তবে ২০০৮-এর নির্বাচনে অন্তত দুটো বিষয়ে জনগণ অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে রায় দিয়েছে বলে আমার ধারনা।  

 

প্রথমত, বাংলাদেশের মানুষ সেক্যুলার শাসনব্যাবস্থা চায়।  বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ ধর্মপ্রাণ, কোন বিচারেই তাদেরকে ধর্মবিরোধী বলা যায় না।  কিন্তু সাধারণ মানুষ ধর্মের কারণে বিদ্বেষ, হানাহানি পছন্দ করে না।  অন্যান্য সভ্য দেশের মানুষের মতোই বাংলাদেশের জনগণ রাষ্ট্র আর ধর্মের মধ্যে সুস্পষ্ট সীমারেখা দেখতে চায়।  

 

দুঃখের সাথে বলতে হয়, পঁচাত্তর-পরবর্তী আওয়ামী লীগ ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে আন্তরিক নয়।  নির্বাচনী রাজনীতির কৌশল হিসেবে আওয়ামী লীগ সেক্যুলারিজমের নীতিকে বর্জন করতে দ্বিধা করে নি।  এই প্রসঙ্গে ২০০৬-এ একটা অখ্যাত ইসলামী গ্রুপের সাথে সম্পাদিত, এবং পরে প্রতিবাদের মুখে বাতিলকৃত, আওয়ামী লীগের বিতর্কিত চুক্তির কথা আমি পাঠকদের মনে করিয়ে দিতে চাই।  জামাতকে সাথে নিয়েও আওয়ামী লীগ আন্দোলন করেছে।  আমার মনে হয় এই ধরনের পদক্ষেপগুলি শুধু নীতিগতভাবে ভুল নয়, কৌশল হিসেবেও ভ্রান্ত।  

 

কিন্তু আওয়ামী লীগের শ্রেণীচরিত্রই আওয়ামী লীগকে এই ধরনের ভুলের চোরাবালিতে বারবার নিয়ে যাবে।  তাই আমরা অতীতে দেখেছি, সংবিধানের চার মূলনীতির দুইটি, সমাজতন্ত্র আর ধর্মনিরপেক্ষতা আওয়ামী লীগের ইশতেহার থেকে বাতিল হয়ে গেছে, যদিও আওয়ামী লীগের দলীয় পতাকায় চারটি তারা এখনো এই চার মূলনীতির প্রতীক হিসাবে শোভা পায়।  সেই একই শ্রেণীচরিত্রের কারণে জামাতে ইসলামীসহ ধর্মভিত্তিক দলগুলির সাথে আওয়ামী লীগকে দেখা যায় আঁতাত করতে, নুর হোসেন আর ডাক্তার মিলনের হত্যাকারী এরশাদের মতো ঘৃণ্য স্বৈরাচারীর সাথে গাঁটছড়া বাঁধতে।   

 

প্রশ্ন তোলা যেতে পারে, তাহলে জামাতকে সাথে নিয়ে গেলোবারে (২০০১) বিএনপি জিতলো কি করে?  জামাতই বা অতগুলো আসন পেলো কি করে?  আমার উত্তর হলো, জামাতের জন্য নয়, জামাত সত্বেও মানুষ সেবার বিএনপিকে ভোট দিয়েছিল।  জামাতকে সেবারে মানুষ অতটা বিপজ্জনক মনে করে নি, necessary evil ভেবে বিপদের সম্ভাবনাকে উপেক্ষা করেছে।  আর জামাত সেই সুযোগে বিএনপির ঘাড় থেকে মাথায় চড়ে বসেছিল।  ক্ষমতার অংশীদার হওয়ার পরে জামাতের ভয়াবহ রূপ মানুষ দেখতে পেয়েছে, আর তাই মানুষ জামাত সম্পর্কে নতুনকরে ভাবতে বাধ্য হয়েছে।  মানুষ ধর্মব্যাবসায়ী স্বাধীনতাবিরোধীদের ক্ষমতায় দেখতে চায় না।

 

দ্বিতীয়ত, মানুষ অনির্বাচিত সরকার চায় না।  সেনাসমর্থিত হোক বা সেনানিয়ন্ত্রিত হোক, যে সরকারের জনগণের কাছে জবাবদিহিতা নেই মানুষ প্রয়োজনের অতিরিক্ত একদিনও সেই ধরনের সরকারকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না।  (প্রয়োজনের অতিরিক্ত বললাম এইজন্য যে, দুই নির্বাচিত সরকারের মেয়াদের মাঝখানে তিন মাসের জন্য তত্বাবধায়ক সরকারের একটা উদ্ভট বিধান বাংলাদেশের শাসনতন্ত্রে আছে।) 

 

অরাজনৈতিক শক্তির সংবিধান-বহির্ভূত উপায়ে (অস্ত্রের জোরে) ক্ষমতা দখলের উচ্চাভিলাষকে দেশের মানুষ ভালো চোখে দেখে নি।  মহাজোট তাদের কাছে এই অবস্থার বিপরীতে একটা শক্তিশালী বিকল্প হিসাবে আবির্ভুত হয়েছে। বিএনপি বা চারদলীয় জোট তত্বাবধায়ক সরকারের কড়া সমালোচনা করলেও জনগণ তাদেরকেই এই অবস্থা সৃষ্টির জন্য দায়ী ভেবেছে।

 

সামরিক সরকার চায় নি বলেই অতীতেও মানুষ জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বৃদ্ধ অথর্ব বিচারপতি সাত্তারকে বিপুল ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করেছিল।  শেষরক্ষা যদিও হয় নি।  সামরিক শাসনের জগদ্দল পাথরের নীচে মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা চাপা পড়ে গিয়েছিল।  একানব্বইর নির্বাচনেও বিএনপি জিতেছিল কারণ মানুষ আওয়ামী লীগের সাথে পতিত স্বৈরাচারী সেনাশাসকের অতীতের মাখামাখিকে সন্দেহের চোখে দেখেছিল।  

 

আবারো প্রশ্ন উঠতে পারে তাহলে এবার কেন সেই একই স্বৈরাচার ও তার দলকে মানুষ মেনে নিল।  আমার মনে হয় মেনে নিয়েছে nuisance হিসেবে।  মানুষ যে কারণে জামাতকে উপেক্ষা করেছিল, আওয়ামী লীগের সন্ত্রাস-দুর্নীতির হাত থেকে মুক্তির আশায় বিএনপিকে ভোট দিয়েছিল, ঠিক সেই একই কারণে এবারে তারা এরশাদকেও মেনে নিয়েছে।  আমার ধারনা এই জন্য আওয়ামী লীগকে কোন না কোন ভাবে খেসারত দিতে হবে। 

 

উপরের আলোচনার আলোকে এবারের নির্বাচনী ফলাফল ও তার সম্ভাব্য পরিণতি নিয়েও কিছু প্রশ্ন তোলা যায়।  প্রথমেই দেখা যাক, এই সংসদ কি গুণগত বিচারে আগের কোন সংসদের চেয়ে আলাদা?  দৈনিক প্রথম আলো-র ২রা জানুয়ারী সংখ্যায় প্রকাশিত সুজনের (সুশাসনের জন্য নাগরিক) এক সমীক্ষা থেকে জানা যায়,

 

·        দূর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ১৭ জনকে আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দেয়, সবাই নির্বাচিত হন।  বিএনপি মনোনয়ন দেয় এমন ২৯ জনকে , নির্বাচিত হন ছয়জন।

·        এবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মাত্র ১০ জন পেশাদার রাজনীতিবি, ৪৪ জন আইনজীবী ও ১৯ জন কৄষিজীবী নির্বাচিত হয়েছে অপরিদেক ১৬৯ জন ব্যাবসায়ী নির্বাচিত হয়েছন  এবারের  সংসদে ১২৮ জন কোটিপতি নির্বাচিত হয়েছেন।  এঁদের মধ্যে আওয়ামী লীগের ৯২ জন, বিনপির ১৯ জন, জাতীয় পার্টির ১৪ জন, জামায়াত, বিজেপি ও সতন্ত্র প্রার্থীদের একজন করে কোটিপতি।

·        সাংসদদেঘোষণা অনুযায়ী ১০ কোটি টাকার বেশি ম্পদ আছে ২১ জনের।  সুজনের সভাপতিধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ বলেন, এভাবেলতে থাকেল ভবিষ্যতে জাতীয় সংসদ কোটিপতিদের ক্লাবে পরিণত হতে পারে, যা হবে প্রতিনিধিত্বশীল গণতান্ত্রিক ধারণার পরিপন্থী।

 

শোষক শ্রেণী টাকার জোরে কিভাবে ক্ষমতার কেন্দ্রগুলিকে কব্জা করে নেয় তা বোঝাবার জন্য বাংলাদেশের রাজনীতি একটা আদর্শ কেস স্টাডি হতে পারে।  ওপরের পরিসংখ্যান দেখলে কারোরই বুঝতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়, শ্রেনী স্বার্থের প্রশ্নে আওয়ামী লীগ আর বিএনপি একই মায়ের পেটের ভাই না হলেও একে অপরের মাসতুতো-পিসতুতো ভাইতো বটেই।   

 

তাই প্রশ্ন থেকেই যায়, আওয়ামী লীগ কি গণমানুষের আস্থার মূল্য দিতে পারবে?  পারবে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধগতির লাগাম টেনে ধরতে?  পারবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আওতায় আনতে?  সফল হবে কি সন্ত্রাসের হাত থেকে সাধারণ মানুষকে মুক্ত করতে?  দূর্নীতির করালগ্রাস থেকে দেশবাসী কি নিস্তার পাবে?

 

শুধু সময়ই বলতে পারে।  তবে অতীতের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে আশাবাদী হওয়াটা মুস্কিল।

 

কি করে ভুলি, আওয়ামী লীগ সুযোগ থাকা সত্বেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে নি। 

 

কি করে ভুলি, আওয়ামী লীগ তিয়াত্তরের নির্বাচনে বিরোধীদলশুন্য জাতীয় সংসদে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে গনতন্ত্রের কবর দিয়েছিল; ক্ষমতার দম্ভে অন্ধ হয়ে নিজেদের দলটকেও বিলুপ্ত করে দিয়ে বাকশাল নামে একটা জগদ্দল পাথর মানুষের উপর চাপিয়ে দিয়েছিল।

 

কি করে ভুলি, আওয়ামী লীগ তথাকথিত শত্রুসম্পত্তি আইন বাতিল করে নি, আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই এই আইনের সুযোগ নিয়ে হিন্দুদের সম্পত্তির মালিক হয়েছিল অন্যায়ভাবে।

 

কি করে ভুলি, এই সেদিনও শেখ হাসিনা ফেণীর সন্ত্রাসী জয়নাল হাজারীকে সমর্থন দিতে গিয়ে বলেছিলেন,  ভিপি জয়নাল (ফেণীর বিএনপি দলীয় আরেক সন্ত্রাসী) আছে বলেই জয়নাল হাজারীও আছে। 

 

কি করে ভুলি, শেখ হাসিনা আর তার বোন শেখ রেহানা গণভবন নিজেদের নামে লিখিয়ে নিতে চেয়েছিলেন।

 

আওয়ামী লীগে কি দূর্নীতিবাজরা এখনো নাই?  আছে।  তাদের কেউই কি সংসদ সদস্য হন নি?  হয়েছেন। (ওপরে উল্লেখিত সুজন-এর সমীক্ষা দেখুন)  তাদের কেউই কি মন্ত্রী হবেন না?  হবেন।  তাহলে?

 

মুক্তবাজার অর্থনীতির নামে সাম্রাজ্যবাদ তোষনে আওয়ামী লীগ আর বিএনপি দুই দলের কেউ কারো চেয়ে কম যায় না।  দেশের সম্ভাবনাময় পাটশিল্প ধ্বংসের কৃতিত্ব দাবী করতে পারে দুটি দলই।  গ্যাস ও কয়লা সম্পদ সাম্রাজ্যবাদী বিদেশী বেনিয়াদের হাতে তুলে দিতে দুই দলই সমান পারদর্শী।  তাহলে?

 

তাহলে যারা বলেন আওয়ামী লীগ আর বিএনপি আসলে একই মূদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ তারা কি খুব একটা ভুল বলেন?  

 

ভুল না বললেও মন্তব্যটা ঢালাও।  পার্থক্যতো আছেই।  তবে তা নির্ভর করছে দলদুটিকে আমরা কোন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছি তার ওপর। 

 

প্রয়াত আহমদ ছফা আক্ষেপ করে বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ হারলে আমরা সবাই হারি, আর জিতলে শুধু আওয়ামী লীগই জিতে  কথাটা সত্যি, আওয়ামী লীগ জিতলেই আহমদ ছফার মতো প্রগতিশীল  বুদ্ধিজীবিদের জয় হয় না, সাধারণ মানুষের তো নয়ই।  আর হারলে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষতো হারেই, তারাতো হারতেই অভ্যস্ত।  আরো হারে তারা যারা স্বাধীনতার চেতনায় বিশ্বাসী, সেক্যুলার সমাজ যাদের স্বপ্ন।

 

মায়ামি, ফ্লোরিডা

জানুয়ারী ৩, ২০০৯

______________________________________________________________

তিয়াত্তরের নির্বাচন সম্পর্কে যে কথাটি না বললেই নয়; সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং-এর মাধ্যমে বেশ কয়েকটি আসনে ফলাফল নিজেদের পক্ষে নির্ধারণ করে নেয়।  আক্ষেপের সাথে বলতে হয়, তিয়াত্তরের নির্বাচন সেই সময়ের আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের অগনতান্ত্রিক আচরণের কলঙ্কজনক নিদর্শন হিসেবে ইতিহাসে বেঁচে থাকবে।

 

জামাতে ইসলামী বিএনপির সাথে গাঁটছড়া বেঁধে ২০০১-এ বেশ কয়েকটা আসনে জয়লাভ করতে সক্ষম হয়।  যদিও জামাতের ভোটপ্রাপ্তির হার প্রায় সবসময়ই একইরকম থেকেছে, শতকরা হিসেবে প্রদত্ত ভোটের প্রায় সাড়ে চার  ভাগের কাছাকাছি।