নির্বাচনের ফল-ক্ষুধাপিড়ীতদের আহাজারি
আতিক রাঢ়ী
আরেকটা সংসদ নির্বাচন শেষ হলো। ফলাফলে দেখাগেল গত সংসদ নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি। মানে বলতে চাচ্ছি, নিরঙ্কুশ ভাবে নির্বাচিত করার প্রবনতা এবারেও লক্ষ্যনীয়। জনগন প্রতীকেই বেছে নিচ্ছে, ব্যাক্তিকে নয়। ২০০১ এর নির্বাচনের ফলাফলে দেখা গিয়াছিল সন্ত্রাসপিড়ীত জনগনের আহাজারি। এবারে দেখা গেল ক্ষুধাপিড়ীতদের আহাজরি।
সবাই একযোগে ছুটছে, কড়া নাড়ছে দুটি নির্ধারিত দরজায়। কখন উত্তের, কখন দক্ষিনে। বলা বাহুল্য যে তাদের অবশেষ প্রাপ্তি, অসীম হতাশা। দুটি দলের ইশ্তেহার প্রায় অভিন্ন। এরা উভয়ে দূর্নিতীতে বিপুল পারদর্শিতা দেখিয়েছে। নৃশংসতায় কেউ কম যান না। পতিত সৈ্রাচার এরশাদকে নিয়ে টানা-হেচড়া করতে কেউই লজ্জিত নন। ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের সুযোগ কোন দলই হাত ছারা করতে চান না।
তবুও এরাই আমাদের রাজনৈতিক দল। এদের হাতেই আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বোভৌমত্য পাহারার দায়িত্ত্ব দিয়া আমরা ঘুমাতে যেতে পারি। অনেক জ্ঞানী, প্রাজ্ঞ ও সৎ ব্যাক্তি রাজনৈতিক দল খুলেছেন, মুক্তির গান শুনাচ্ছেন কিন্তু জনগনের ভরসার প্রতীক হতে পারছেন না। তারা হতাশ, গাল পাড়ছেন জনগনের অজ্ঞতাকে। তারা বুঝতে পারছেন না কেন তাদের মত এমন যোগ্য লোকদের যথাযথ মূল্যায়ন কোরছেনা এরা। কিন্তু তারা বোঝেননা যে দলদুটির প্রতিষ্ঠাতাদেরকে প্রমানদিতে হয়েছিল তাদের দায় বদ্ধতার। জনগনের মুক্তির জন্য শেখ মুজিবর রহমান প্রায় বারটি বছর জেলে কাটিয়েছিলেন আর জিয়াউর রহমানকে বউ-বাচ্চা ফেলে তাদেরকে এক প্রকার উৎস্বর্গ করেদিয়ে ঝাপিয়ে পরতে হয়েছিলো মুক্তিযুদ্ধে। মানুষ বা নেতা হিসাবে তাদেরও সীমাবদ্ধতা ছিলো কিন্তু দেশ প্রেমের পরীক্ষয় তারা উত্তীর্ন হয়েছিলেন সন্দেহাতীতভাবে। তারা আজকে মিথ হয়ে গেছেন। যারা নতুন পথের কথা বলেন তাদেরকে লোড়তে হবে এই মিথের সাথে। প্রমান দিতে হবে তাদের শপথের পক্ষে।জনগন কেন তাদের শাসনের ভার একদল অর্বাচিনের হাতে তুলে দেবে? তারাযে দেশকে নেতৃ্ত্ব দেবার যোগ্য সেই প্রমান তাদেরকেই দিতে হবে। কেবল মাত্র শপথ বাক্য উচ্চারনি সে জন্য যথেষ্ঠ নয়।
গনতন্ত্রের জন্য এদেশের মানুষের সংগ্রামের ইতিহাস অনেক পুরনো। এই ইতিহাসে যেমন সাফল্যের কথা আছে, তেমনি আছে ব্যার্থতার গ্লানী। অভাব রয়েছে গনতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে। সময় ছাড়া সে অভাব দূর করার আর কোন সমাধান নেই। অনভিজ্ঞতা জনিত
কিছু সমস্য যা দুরকরা না গেলে সহসা ভালো কিছু আশাকরাও যাবেনা। সেরকম কিছু সমস্যা এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
যেমন সংবিধানের ৭০নং অনুচ্ছেদ । যেখানে ফ্লোর ক্রসিং নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই বিধানটা সংসদকে সকল কর্ম কান্ডের কেন্দ্রবিন্দু করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অন্তরায় হিসাবে কাজ করছে। সংসদ সদস্যগনের জন্য সংসদে যাবার মত বিরক্তিকর ব্যাপার আর দ্বিতীয়টি নেই। একজন তরুন সাংসদ যখন দেখেন তিনি মুলত সংসদে গিয়ে কোরাম পুরন ছাড়া আর কিছুই করছেননা তখন তাকে হতাশায় পেয়ে বসা স্বাভাবিক। প্রতিটি মানুষই চায় তার প্রতিভার স্বিকৃ্তি। কিন্তু ভিন্নমত পোষনের সুযোগ না থাকায় কেবল মাত্র হ্যা বা না বলার জন্য সংসদে উপস্হিত হবার আগ্রহ ধরে রাখা সত্যিই কঠিন। ফলে বারে বারে গরম হয়ে উঠে রাজপথ। রাজপথ গরম হওয়া মানে হরতাল, মানে ভাংচুর।দলদুটির প্রধান নেতৃ্ত্বের ভয় মূলত সাংসদ দের নৈ্তিক্তা নিয়ে। যদি সংসদগন রাতারাতি নীজেদেরকে বিক্রীকরে বসেন ? ভয়টা একেবারে আমূলক নয়। কিন্তু দল দুটির কর্নধারদের নমিনেসন বিক্রী বন্ধ করতে হবে আগে। আদর্শের প্রশ্নে আপোষ করা তাদেরকেই বন্ধ করতে হবে প্রথমে। নেতৃ্ত্ব যদি সঠিক পথে না থাকেন তবে সংসদগন তো বিপথে যেবেনই। আর বিক্রী যাওয়া সাংসদদের মূল্যায়নের ভার জনগনের হাতেই ছেড়ে দেওয়া ভালো। কারন জনগন যে ভুল করেনা যেটাতো আজকে প্রমানিত সত্য।
আরেকটা বড় সমস্যা তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এটা আমাদের গনতন্ত্রের এমন একটা ছিদ্র যা দিয়ে অনায়াসে ঢুকে যেতে পারে অজগর।এখন সময় এসেছে ছিদ্রটির পুরোপুরি অপসারনের। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষাতো হলো। বিষয়টাতো এখন পরিস্কার যে হয় বিচার বিভাগ ও নির্বাচন কমিশনের অর্থবহ ও কার্যকর স্বাধীনতা নিশ্চিৎ করতে হবে, অন্যথায় আস্থা রাখতে হবে সেই তত্ত্ববধায়ক সরকারেই। পথ আছে এই দুটি। আমাদের প্রত্যাশা সরকার ইতিবাচক পথটিই বেছে নিক। আমরা আত্ম-মর্যাদা নিয়ে বিশ্ব দরবারে মাথা উচুকরে দাড়াই।
সাংসদদের মূল দায়িত্ব যেহেতু আইন প্রনয়ন করা সেহেতু সংবিধান সম্পর্কে তাদের জ্ঞান থাকা আপরিহার্য।আমরা কি এমন একটা পরীক্ষার ব্যাবস্থা করতে পারিনা – যেখানে যারা সংসদ সদস্য হতে চান তাদেরকে সংবিধান বিষয়ক একটা পরীক্ষায় আংশ গ্রহন করতে হবে এবং সন্তোসজনক ফলাফল করলেই কেবল সংসদ সদস্য হওয়ার জন্য আবেদন করতে পারবেন ? সংবিধানকে কেন বিরল বস্তু করে রাখা হয়েছে আমি বুঝিনা। সংবিধানের সহজ লভ্যতায় কি ক্ষতি ? কার ক্ষতি ?
আমি লেখার শুরুতে বলেছি, এই ফলাফল হচ্ছে ক্ষুধাপিড়ীত মানুষের আহাজারি। যাদের স্মৃতীশক্তি ভাল তাদেরকে ৪ দলীয় জোট সরকারের মাঝা মাঝি সময়ের দিন গুলিতে ফিরে যেতে বলছি। সিন্ডিকেট ও দ্রব্যমূল্য নিয়ে প্রেস ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার লাগাতার প্রচারের মাঝে বেগম খালেদা জিয়া কামরাঙ্গীর চরে এক জনসভায় ঘোষনা দিলেন যে – এগুলি সব অপপ্রচার। কোন জিনিষের দাম বাড়েনি। জনগনের সরিষা ফুল দেখা সেই শুরু যা আজও চলছে কিছুটা সহনীয় মাত্রায়। ক্ষমতায় থাকলেই প্রধান নেতা চাটুকার পরিবেষ্টিত হয়ে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পরেন। তাদের পরান রঙ্গীন চসমায় প্রধান নেতা দেখেন বাংলাদেশ। প্রকৃ্ত দেশের আকাশে মেঘ না খা খা রোদ্দুর তা তারা একবারের জন্যও বুঝতে পারেন না।
এই মাত্র পত্রিকাতে পরাজিত পক্ষের প্রতিক্রিয়া দেখলাম। যথারিতী আরেকবার হতাশ করলেন বেগম খালেদা জিয়া। পরাজয়কে মানে নিতে পারলেন না। তিনি বুঝতেও পারলেন না যে নতুন ভোটার দের মা হতে গেলে তাকেও নতুন কিছু করে দেখাতে হবে। সেই বহু ব্যবহারে মলিন অস্ত্রগুলি এখন ফেলে দেবার সময় হয়েছে।
আওয়ামিলীগ কখনই দ্রব্যমুল্য ইস্যুকে নির্বাচনের ইস্যুর থেকে বেশী গুরুত্ত্বদিয়ে জনগনের সামনে আনেনি। ক্ষুধার্ত মানুষকে আশানিয়েই বাঁচতে হয়। সেই আশা আওয়ামিলীগই জনগনকে দেখিয়েছে। নির্বাচনের ফলাফলের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় মনে হচ্ছে আওয়ামিলীগ কেমন যেন ভরকে গেছে। আমাদের আশা হতবিহবলতা কাটিয়ে তারা তাদের উপর আর্পিত দায়িত্ত্ব পালনের জন্য প্রস্তুত হোক।
ভোটারদের সচেতন অংশের সমর্থন আওয়ামিলীগের পক্ষেই গেছে। ২১শে অগাস্টের গ্রেনেড হামলা থেকে এটা নিশ্চিৎ হওয়া গেছে যে আওয়ামিলীগের সাথে জংগীদের আতাতের আর কোন সুযোগ অবশিষ্ট নেই। অন্যদিকে বি, এন, পি আর জামায়াত আজ একাকার। জংগি প্রশ্নে তাদের আবস্থান দ্বিধান্বীত। সুতারং সিদ্ধান্তনিতে এই অংশের মোটেও বেগ পেতে হয়নি।
৯৬এর নির্বাচনের পরে যে বাক্যটি সবচেয়ে বেশীবার শুনতে হয়েছিলো সেটা হলো “ ২১ বছর খাইনি, সুতারং খাব “ আমার এলাকা ঢাকা জেলার মোহাম্মদপুরে অল্পকিছু খেলার মাঠ ছাড়া সবই এই খাদ্য তালিকায় গেছে। তাদের নিরবিচ্ছিন্ন খাওয়া – দাওয়ার ফলে তাদের শাসনের শেষ বছরে এসে বাংলাদেশকে তারা দুর্নিতীতে প্রথম স্হানে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন। সবচেয়ে হতাশাজনক ব্যাপার ছিলো এই ভোঁজ উৎসবে প্রধান নেতৃত্ত্বের প্রশ্রয়। এই ভোজ উৎসবের আকার- আকৃ্তি পরবর্তি সরকারের জন্য লজ্জা, সরমের আর কোন বালাই রাখলনা। তারা টানা পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন বানিয়ে দিল দেশকে। তলে তলে দেশে যে একটা মাঝারি শিল্পের বিকাশ ঘটছিলো, বিদ্যুতের প্রোয়জন বারছিলো প্রতিদিন, সেদিকে খেয়াল করার কেউ ছিলোনা।
আসলে ২০০১ এর নির্বাচন ৪ দলীয় জোটকে বরনের নর্বাচন ছিলোনা, এটা ছিলো আওয়ামিলীগকে বর্জনের নির্বাচন। এবারের নির্বাচন ও আওয়ামিলীগকে বরনের নির্বাচন নয়, এটাও ৪ দলীও জোট তথা বি, এন, পি কে বর্জনের নির্বাচন।
সুতরাং আমি জনগনের পক্ষ থেকে মহাজোট তথা আওয়ামিলীগকে স্বরন করিয়ে দিতে চাই – পাকিস্থান পিপলস পার্টি ২০টি আসন পেয়েছিলো । তারা কিন্তু এখন আবার ক্ষমতায়। সুতরাং আহলাদে আত্মহারা হবেন না। জনগনের অর্পিত দায়িত্বের প্রতি সম্ভ্রম প্রদর্শন করুন। আর অতীত মুখী না থেকে নতুন শতাব্দির চ্যালেজ্ঞ গ্রহন করুন। জনগনকে পাশেই পাবেন।
আতিক রাঢ়ী, আপনাকে ধন্যবাদ আপনার বিশ্লেষণমুলক লেখার জন্যে। একটা বিষয়ে একটু খটকা লাগছে। শেখ মুজিব এবং জিয়াউর রহমান দুজনকেই আপনি মিথ বানিয়ে দিয়েছেন ভাল কথা কিন্তু এটাতো আমরা সবাই জানি দেশের জন্যে শেখ মুজিব কি করেছেন আর জিয়াউর রহমান কি করেছেন। আজকে আমাদের দেশে এইযে ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতি এবং রাজনীতির দুরবৃত্তায়ন এর জনক কে? যদিও একথা সত্য শেখ মুজিবও সমালোচনার বাইরে নন। নিঃসন্দেহে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে সম্মান জিয়াউর রহমানের প্রাপ্য তাই বলে কি তাঁদের উচ্চতা এক?
খুব সুন্দর একটা লেখা। ধন্যবাদ আতিক রাঢ়ী। আপনার উপলব্ধিটা আমাদের নির্বাচিত নেতারা যত দ্রুত বুঝতে পারবে ততই দেশের জন্য মঙ্গল হবে।
আপনার গদ্যরীতি খুব সাবলীল। ভাল লাগে পড়তে। শুধু কিছু দৃষ্টিকটু বানান ভুল চোখকে পীড়া দিয়েছে এই যা। আশা করি এ বিষয়ে আপনি মনযোগী হবেন। নিয়মিত লিখতে থাকুন মুক্তমনায়। খুশী হবো আমরা।