তখন ও এখন
গীতা দাস
(২৪)
ডিসেম্বর মাস। বিজয়ের মাস। আনন্দের মাস। বেদনার মাস। একাত্তুরে হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের মনে করার মাস। মুক্তিযুদ্ধের দুঃসহ স্মৃতি মনে করে ভেতরে ভেতরে জ্বলে পোড়ার মাস। কারো ত্যাগকে অবমূল্যায়ন করা দেখলে অন্য সময়ের চেয়ে এ মাসে একটু যেন বেশীই চোখে ঝাঁঝে — বুকে বাজে —কানে লাগে — হৃদয়ে দাগে। মুক্তিযুদ্ধের গাঁথা — সংগ্রামের ব্যথা — ত্যাগের কথা এ মাসেই নাড়া দেয় — জ্বালা দেয় —- পীড়া দেয় বেশী। আজ এমনি এক ব্যথার পুঁথির পাতা খুলব।
একাত্তুরে হারিয়ে যাওয়া আমার এক স্বজন প্রমিলা দাস আমার ক্লাসে পরত, তবে বয়সে আমার চেয়ে বেশ বড় ছিল। আমি যখন খালি গায়ে নদীতে দাপাদাপি করতে পারি তখন প্রমিলাকে রীতিমত ওড়না পরে স্কুলে যেতে হত। এখন সর্বজনীন শিক্ষার প্রভাবে একই ক্লাসে বয়সের এত হেরফের চোখে খুবই কম পড়ে।
প্রমিলা আমার জেঠিমার দূর সম্পর্কের আত্মীয়। যাওয়া আসার জন্যে কাছের মনে হত। এক ক্লাসে পড়লেও মাসি বলে ডাকতাম এবং বয়সে বড় বলে আমাকে আদর করত। বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় আমাকে অনুপপ্রেরণা দিয়েছিল যেন আমি দৌড়ে অংশগ্রহণ করি, যদিও বাইরের খেলাধুলায় আমি কখনোই ভাল ছিলাম না। দৌড়ঝাঁপ, লাফালাফি এক আর প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ আরেক। তবুও প্রমিলা মাসির আদরের বহিঃপ্রকাশ ছিল আমাকে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করানোর জন্যে উদ্ধুদ্ধকরণে।
নরসিংদীর বৌয়াকূড় গ্রামের জগৎ দাসের মেয়ে প্রমিলা। স্বচ্ছল পরিবার। তবূও মেয়েকে দেরীতেই স্কুলে দিয়েছিল। তবে ঐ পরিবারের বড় দুইছেলে ও মেয়েরা স্কুলে যায়নি বললেই চলে। ছোট মেয়েটিও নয়। সবার ছোটটির বড় প্রমিলা ও তার বড় ভাইটিই শুধু পড়াশুনা করত। বাকী ভাইয়েরা বাবার প্রতিষ্ঠিত ব্যবসা দেখত ও বোনদের যথারীতি পাত্রস্থ করাই ছিল ঐ পরিবারের ঐতিহ্য। প্রমিলার মা ছিল না বলে আমার জেঠিমাও অকে বেশ আদর করত। প্রায়ই আমাদের বাড়িতে তার আসা যাওয়া ছিল।
আমার গ্রাম হাজীপুর আর তার গ্রাম বৌয়াকূড়। মাঝে নদী। পারাপারের জন্যে তখন নৌকা সহজলভ্য ছিল। খরচবিহীন যাতায়াত ব্যবস্থা। এখন গ্রামের অস্তিত্ত্ব নেই। হাজীপুর আর বৌয়াকূড় দুই মহল্লা। মাঝে ব্রিজ। রিকসায় যাতায়াত। সময় কম লাগে। তবে যাওয়া আসাও খুব কম।
সংগ্রামের সময় দেখতাম – মা বাবা এ দেশে, অথচ মেয়েদের ভারতে পাঠিয়ে দিচ্ছে ভাই, কাকা, দাদু বা নিকট আত্মীয়ের সাথে। কারণ বুঝতে পারতাম না। পরে বুঝেছিলাম পাক হানাদার, রাজাকার ও আল বদরদের হিংস্রতা থেকে রক্ষা পেতেই এ ব্যবস্থা করা হয়েছিল। প্রমিলাকেও ভারতে পাঠিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা ছিল। তবে দেরি হয়ে গিয়েছিল। বড্ড বেশি দেরি।
আমরা তৎকালীন কুমিল্লা জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিলাম। এখনকার ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায়। আশেপাশের গ্রাম জুড়েই নরসিংদীর লোকজন। হঠাৎ কানাঘোষা শুনলাম প্রমিলা মাসি কলেরায় মারা গেছে। কিন্তু ফিসিফাসে তা তাৎপর্যপুর্ণ মনে হয়েছিল। এ বিষয়ে প্রশ্ন করে সদুত্তর পাইনি বড়দের কাছ থেকে। কেউ কলেরায় মারা গেলে তা কেন ছোটরা শোনতে পারবে না — তা তখন বোধগম্য না হলেও পরে হয়েছিল।
হায় রে দেশ। হায়রে সমাজ! আর হায়রে নারীর ভাগ্য। নারীর ত্যাগ — নারীর যুদ্ধ অস্বীকৃতই থাকল। যেখানে যোদ্ধা হিসেবে সম্মান পাবার কথা সেখানে অসুস্থতার অজুহাতে মৃত্যুর খবর রটাতে হল। সম্মানিত হবার বদলে লুকানো হল তার মৃত্যুর আসল কারণ। বানানো হল কাল্পনিক অসুখ।
এখন মুক্তিযুদ্ধ হলে কী হত! নারী তার ত্যাগের কথা সগর্বে বলতে পারত। অযাচিত – অপ্রত্যাশিত সন্তানকে ধবংস করতে গিয়ে নিজের জীবন প্রমিলা মাসির মত বিসর্জন দিত না। কুমারী মায়েরা দেশের মুক্তির জন্যে জোরপূর্বক যুদ্ধ শিশুকে গর্ভে ধারণ করলেও গর্বিত হত। যুদ্ধ শিশুর মা তো অহংকারী পরিচয়।
বর্তমান নারী আন্দোলন তাদের সাথে থাকত। তখনও ছিল, তবে নারী সংগঠন সংখ্যায় এত বেশী, দেশজুড়ে ব্যাপৃত এবং শক্তিশালী ছিল না।
এখন প্রজন্মান্তরে চিন্তা চেতনার —- প্রগতিশীলতার ধারাও বেগবান হচ্ছে। মূল্যবোধের ক্ষেত্র হচ্ছে প্রসারিত। স্রোতের বিরুদ্ধ দিকে নারী দাঁড়িয়ে থাকার মত সাহসী হচ্ছে। নারীর নিজস্ব মতামতে — বিশ্বাসে —- অবস্থানে অবিচল থাকার মত মেধাও নারী অর্জন করছে। এখন অনেক কুমারী মায়ের সাহস দেখি। তখন দেখিনি।
তখন — একাত্তুরে প্রমিলা মাসি হাজীপুর আর বৌয়াকূড় গ্রামের দূরত্বে থাকলেও দেখা হয়নি। ভয়ে জড় পদার্থের মত ছিলাম। তাই মৃত্যুর আগে প্রমিলা মাসি কী ভেবেছিল —- কীভাবে ভেবেছিল — কী করেছিল আমার জানা হয়নি।
‘সখিনা বিবির কপাল ভাঙ্গল
সিঁথির সিঁদুর মুছে গেল হরিদাসীর’—
সখিনা বিবি আর হরিদাসীর কথা জানি। তবুও অজানা রয়ে গেল কত প্রমিলাদের কথা।
গীতা দাস
১ পৌষ, ১৪১৫/ ১৫ ডিসেম্বর, ২০০৮
[…] প্রকাশিত ‘তখন ও এখন’ ধারাবাহিকের ২৪তম পর্বে পাকিস্তান আর্মি কর্তৃক নির্যাতিতা […]
গীতা দি,
নীরব রাত, ছেলে ঘুমিয়ে পড়েছে, আমি মুক্তমনার পাতাতে লেখা পড়ছি। তোমার এই লেখাটা পড়তে গিয়ে মনে হলো উপরের লাইনটা কাটপেস্ট করা উচিত, স্ক্রল করে নিচে এসেছি। ওমা! দেখি ফরিদ এই লাইনেই কমেন্ট করেছে। হ্যা, গীতা দি, এখন যুদ্ধ হলে হয়তো আরো আরো খারাপ হতো। আমিও ফরিদের সাথে একমত। ছত্রিশ বছরে দেশ অনেক বেশি মুখ থুবড়ে পড়েছে। এখন যুদ্ধ হলে প্রমীলাদের কথা তুমি লিখতে পারবে কিনা আমি নিশ্চিত না।
লুনা
না– ফরিদ, আমাদের সমাজ এত প্রগতিশীল হয়নি, আপনি যথার্থই বলেছেন, তবে যুদ্ধ শিশুর মায়েদের পাশে দাঁড়ানোর মত নারী মুক্তি আন্দোলনের কর্মী সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশের সর্বত্র। এখনও কুমারী মা হচ্ছে অপ্রত্যাশিত ব্যাক্তির দ্বারা। আবার “সামাজিকভাবেও ধর্ষণের শিকার” হচ্ছে। ( আপনার সৃষ্ট শব্দটি ব্যবহার করলাম) কিন্তু জোরালোভাবে এর প্রতিবাদ হচ্ছে। প্রতিরোধের প্রচেষ্টা রয়েছে অব্যাহত।
আমি একটু বেশী আশবাদী নারী মুক্তি আন্দোলনের একজন কর্মী হিসেবে।
অভিজিৎকেও ধন্যবাদ তার প্রাসঙ্গিক একটি লেখা পড়ার সুযোগ করে দেয়ার জন্যে।
বি দ্রঃ ১৯৯৫ সালের ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে নারীপক্ষ আয়োজিত ‘আলোর স্মরণে কাটুক আঁধার’ নামক অনুষ্ঠানে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে প্রমিলা মাসির কাহিনীটি নিয়ে আমি স্মৃতিচারণ করেছিলাম।
এর আগেরবার যখন বিজয় দিবস উপলক্ষে মুক্তমনার পক্ষ থেকে বিশেষ পাতা তৈরি করা হয়েছিলো, তখন এ লেখাটা রেখেছিলাম-
The women in our liberation war : Tales of Endurance and Courage
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের করুণতম অধ্যায়ের নাম হচ্ছে বীরাঙ্গনা নারী। যুদ্ধে সকল পক্ষেরই শত্রুর পাশাপাশি কোথাও না কোথাও মিত্রও থাকে। কিন্তু এইসব অসহায় নারীদের মিত্রপক্ষ বলে কিছু ছিল না। সকলেই ছিল তাদের শত্রুপক্ষ, তা সে শত্রুই হোক কিম্বা মিত্র নামধারীরাই হোক। যুদ্ধের সময় নয়মাস তাদেরকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী, আল বদর, আল শামস, রাজাকার আর বিহারীদের কাছে শারীরিকভাবে ধর্ষিত হতে হয়েছে। আর যুদ্ধের সময় বা পরে যারা তাদের মিত্র হওয়ার কথা ছিল, পরম স্নেহে বা ভালবাসায় বুকে টেনে নেবার কথা ছিল, সেই বাপ-চাচা, ভাই বেরাদারেরাই তাদেরকে ধর্ষণ করেছে মানসিকভাবে, আরো করুণভাবে, আরো কদর্যরূপে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বীরাঙ্গনাদেরকে তাচ্ছিল্য করে এর কাছাকাছি উচ্চারণের চরম অবমাননাকর একটা নামেও ডেকেছে অনেকে। আমি একে বলি সামাজিক ধর্ষণ। সামাজিক এই ধর্ষণ শারীরিক ধর্ষণের চেয়ে কম কিছু ছিল না বীরাঙ্গনাদের জন্য।
আমাদেরই কারণে যে পঙ্কিলে তাদেরকে পতিত হতে হয়েছিল অনিচ্ছুকভাবে, মমতা মাখানো হাত দিয়ে তাদের গা থেকে সেই পঙ্কিল সাফসুতরো করার বদলে নিদারুণ স্বার্থপরতা এবং হিংস্রতার সাথে আমরা তাদেরকে ঠেলে দিয়েছিলাম আরো গভীর পঙ্কিলের মাঝে। পাছে না আবার গায়ে কাদা লেগে অশুদ্ধ হয় আমাদের এই বিশুদ্ধ সমাজ। অনিচ্ছাকৃত যে গর্ভাবস্থা তারা পেয়েছিলেন শত্রুর কাছ থেকে, সমাজের রক্তচক্ষু এবং ঘৃণার কারণে তা লুকানোটাই ছিল সেই সময় সবচেয়ে বেশি জরুরী কাজ। সমাজকে বিশুদ্ধ রাখতে তাদের কেউ কেউ গর্ভনাশ করেছেন নীরবে, কেউ কেউ আবার নিজের জীবননাশ করেছেন সংগোপনে। আর যারা তা পারেননি, তারা লোক চক্ষুর অন্তরালে সন্তান জন্ম দিয়ে চলে গেছেন অজানার পথে। জন্ম মুহুর্তেই চিরতরে ছিন্ন হয়ে গেছে মা আর তার সন্তানের নাড়ীর টান। দেবশিশুর মত সেই সব যুদ্ধ শিশুরাও এখন কে কোথায় তার কিছুই জানি না আমরা। এর দায়ভার কার? আমাদের এই সমাজের নয় কি?
আমাদের উপর অত্যাচার নির্যাতনের জন্য, গণহত্যা চালানোর জন্য আমরা পাকিস্তানের ক্ষমা প্রার্থনা দাবী করি। আমরা নিজেরাই কি আমাদের সেইসব বীরাঙ্গনা এবং তাদের সদ্যজাত সন্তানদের উপর যে চরম অবিচার করেছি, যে নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করেছি তার জন্য ক্ষমা চেয়েছি কখনো? চাইনি। চাইনি বলেই যে চাওয়া যাবে না এমন কোন কথা নেই। এখন সময় এসেছে সেই সব বীর নারীদের এবং তাদের প্রসূত যুদ্ধ শিশুদের কাছে জাতিগতভাবেই আমাদের করজোরে ক্ষমা প্রার্থনা করা। এই বিজয় দিবসে সেই অঙ্গীকারটুকুই বা আমরা করি না কেন?
আপনার সাথে একমত হতে পারলাম না বলে দুঃখিত গীতাদি। আমাদের সমাজ কি এতই প্রগতিশীল হয়ে গিয়েছে এই সাইত্রিশ বছরে? তাতো মনে হয় না। আমারতো বরং মনে হয় ভুতের মত পিছনে কদম ফেলে ফেলে পিছিয়ে গিয়েছে আরো অনেকদূর।
সুন্দর এই লেখাটির জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।